দুই
ইবরাহীম ইবনু আদহাম আলবালখি রহ. (১৬২হি.)
ইবরাহীম ইবনু আদহাম আলবালখি রহ. (১৬২হি.)
সাইয়্যিদুয যুহহাদ ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ. মূলত খুরাসানের বালখের অধীবাসী ছিলেন। পরে শামে চলে যান এবং সেখানেই রোমানদের বিরুদ্ধে রিবাতরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
আবু ইসহাক আসসাবিয়ী, মানসূর ইবনুল মু’তামির, মালিক ইবনু দিনার, সুলাইমান আলআ’মাশ প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।
সুফিয়ান সাওরি, বাক্বিয়্যাতুবনুল ওয়ালিদ, শাক্কিক্ব আলবালখি প্রমুখ বড় বড় ইমাম তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।
সুফি দুনিয়ায় ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ.কে নিয়ে অনেক মাতামাতি হয়ে থাকে। তার নামে বানোয়াট অনেক কিছুই প্রচলিত আছে। তবে আমরা যদি তার বাস্তব ইতিহাস দেখতাম, তাহলে বুঝতে পারতাম, সুফিবাদিরা ইবরাহীম ইবনু আদহামের আদর্শ থেকে কত হাজারো কোটি মাইল দূরেই না অবস্থান করছে। বরং বলতে গেলে ভ্রান্ত সুফিবাদিরা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ইবরাহীম ইবনু আদহামের মতো যাহেদ ইমামদেরকে ব্যবহার করছে, আর বাস্তব জীবনে তারা এসকল ইমামদের অনুসরণ থেকে সম্পূর্ণই বিমুখ।
ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ. বালখের এক উচ্চবংশীয় ও ধনাঢ্য রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঐশ্বর্য্যের কোন অভাব তার ছিল না। কিন্তু হালাল রিযিকের অন্বেষণে তিনি শুধু নিজ পরিবারই ত্যাগ করেননি, নিজ জন্মভূমিও ত্যাগ করেছেন।
প্রথমে তিনি ইরাক চলে যান। কিন্তু ইরাক তার কাছে ভাল ঠেকলো না। অনেকে পরামর্শ দিল, শামে চলে যান। সেখানে হালাল রিযিকের সন্ধান পাবেন। তিনি শাম চলে গেলেন। দিনমজুরি করে চলতে লাগলেন। একমাত্র নিজের হাতের হালাল কামাই ছাড়া অন্য কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে, তাতে হারাম নেই। এজন্য তিনি পিতার ঐশ্বর্য্য ছেড়ে এসেছেন। আর রাজা বাদশাদের হাদিয়া তোহফা গ্রহণের তো কোনো প্রশ্নই নেই। কখনো ক্ষেতে কাজ করতেন, কখনো বাগান দেখাশুনার মজুরি নিতেন, কখনও বা অন্য কোন হালাল মজুরি। যখন প্রয়োজন হতো মজুরি করতেন। পারিশ্রমিক যা পেতেন ক্ষুধা নিবারণের প্রয়োজনটুকু রেখে বাকিটুকু সাদাকা করে দিতেন। এরপরও আপসোস করতেন আর কাঁদতেন এই ভয়ে যে, আখেরাতের নিয়ামত দুনিয়াতেই ভোগ করে ফেলছেন কি’না।
এই মহামানবের রাত যেমন কাটতো ইবাদতে, দিন কাটতো রিবাতের ময়দানে। এমনকি তার শিষ্যত্ব যারা গ্রহণ করতো, তারাও মুজাহিদ হয়ে যেতো। এমনকি জিহাদ না করার কারণে তিনি জগদ্বিখ্যাত ইমাম, আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদিস: সুফিয়ান সাওরি রহ.কে-ও তিরস্কার করতেন। যাহাবি রহ. (৭২৮হি.) খুরাইবি রহ. থেকে বর্ণনা করেন,
جلست إلى إبراهيم بن أدهم، فكأنه عاب على سفيان ترك الغزو، وقال: هذا الأوزاعي يغزو، وهو أسن منه. اهـ
“একবার ইবরাহীম ইবনু আদহামের কাছে বসলাম। মনে হল তিনি জিহাদ তরক করার কারণে সুফিয়ান (সাওরি)কে তিরস্কার করেছেন এবং বলেছেন, এই যে আওযায়ী! তিনি জিহাদ করছেন অথচ তিনি সুফিয়ানের চেয়েও বয়স্ক।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/২৬৯এই মর্দে মুজাহিদ মৃত্যুকালে জিহাদপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, আজকালকার জিহাদবিদ্বেষী সুফিমহল যদি একটু বিবেচনা করে দেখতো! ইবনে কাসীর রহ. (৭৭৪হি.) বলেন,
وذكروا إنه توفي في جزيرة من جزائر بحر الروم وهو مرابط، وأنه ذهب إلى الخلاء ليلة مات نحوا من عشرين مرة، وفي كل مرة يجدد الوضوء بعد هذا، وكان به البطن، فلما كانت غشية الموت قال: أوتروا لي قوسي، فأوتروه فقبض عليه فمات وهو قابض عليه يريد الرمي به إلى العدو رحمه الله وأكرم مثواه. اهـ
“ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন, তিনি রোম সাগরের এক দ্বীপে রিবাতরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তারা লিখেছেন, যে রাত্রে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে রাত্রে বিশ বারের মতো ইস্তিনজাখানায় গিয়েছেন। প্রত্যেকবারই ইস্তিনজার পর (নামাযের জন্য) অজু করেছেন। তার পেট খারাপ ছিল। যখন (দেখলেন) মৃত্যুর আখিরি মূর্ছা শুরু হচ্ছে (সাথীদের) বললেন, ‘আমার ধনুকে রশি লাগিয়ে দাও’। সাথীরা ধুনুকে রশি লাগিয়ে দিল। তিনি ধনুক হাতে নিলেন। (আকাঙ্খা: দুনিয়া থেকে এভাবে বিদায় হন যেন,) দুশমনদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে যাচ্ছেন। এভাবে ধনুক হাতে অবস্থায়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আল্লাহ তাআলা তার উপর রহম করুন। সম্মানজনক ঠিকানা দান করুন।”- আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ১০/১৫৪ইবনে আসাকির রহ. (৫৭১হি.) উক্ত ঘটনা বর্ণনা করে বলেন,
قال: فدفناه في بعض الجزائر في بلاد الروم. اهـ
“বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আমরা তাকে রোম সাম্রাজ্যের একটি দ্বীপে দাফন করলাম।”- তারিখে দিমাশক ৬/৩৪৯বর্তমান সুফি দুনিয়াকে ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ. এর সীরাতের সাথে তুলনা করলে কত বৈপরীত্বই না দেখতে পাবো:
- তিনি হালাল রিযিকের তালাশে নিজের পিতার রাজত্ব পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন, ক্ষেত খামারে দিনমজুরি করেছেন; পক্ষান্তরে আমাদের সুফি মহল সরকার, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ, যাদের অধিকাংশের অধিকাংশ মাল সুনিশ্চিত হারাম, তাদের পকেটের দিকে তাকিয়ে থাকেন। হালাল হারামের কোন তোয়াক্কা না করে, যা আসে সবই গ্রহণ করে নেন।
- তিনি দুনিয়া খুব সামান্যই গ্রহণ করেছেন। ক্ষুধানিবারণের প্রয়োজনটুকুই শুধু গ্রহণ করেছেন; পক্ষান্তরে আমাদের সুফি মহলের ধন-ঐশ্বর্য্যের কোন শেষ নেই। একেক জন কলাগাছের মতো এমনই ফুলে উঠেছেন, যেন হস্তিপেট না হলে সুফিই হওয়া যায় না। বরং অবস্থা এমন ধারণ করেছে যে, ধন ভাণ্ডার আর আরাম আয়েশের লোভে এখন যে কেউ নিজেকে সুফি দাবি করে বসছে।
- আল্লাহ তাআলার দ্বীন বুলন্দ করার লক্ষ্যে খুরাসান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সুদূর রোম সাম্রাজ্যের এক নির্জন সমূদ্র-দ্বীপে তিনি রিবাতে চলে গেছেন; পক্ষান্তরে আমাদের সুফি মহল আজ একেতো অপব্যাখ্যা করে শরীয়তের জিহাদের প্রকৃত রূপ বিকৃত করেছেন, দ্বিতীয়ত আল্লাহ তাআলার এই বিধানটিকে দুনিয়া থেকে বিলীন করে দেয়ার হীন উদ্দেশ্যে নিজেদের সর্বসামর্থ্য দিয়ে জিহাদের বিরোধীতা আর মুজাহিদদের সমালোচনা ও গালিগালাজ করে যাচ্ছেন এবং তাদের নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট অপবাদ আরোপ করে যাচ্ছেন। এরপরও তাদের লজ্জা হয় না যে, নিজেদেরকে ইবরাহীম ইবনু আদহামের অনুসারি দাবি করে?!
শেষে ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ. এর একটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি,
كل سلطان لا يكون عادلا فهو واللص بمنزلة واحدة، وكل عالم لا يكون ورعا فهو والذئب بمنزلة واحدة، وكل من خدم سوى الله فهو والكلب بمنزلة واحدة. اهـ
- “প্রত্যেক সুলতান যে আদেল-ন্যায়পরায়ণ না হবে, সে আর চোর একই কথা। - প্রত্যেক আলেম যে পরহেযগার না হবে, সে আর হিংস্র বাঘ একই কথা।
- প্রত্যেক এমন ব্যক্তি যে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো সেবক হবে, সে আর কুকুর একই কথা।”- আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ১০/১৫১
***
Comment