হাসান বসরী রহ. ও ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ. এর মুজাহিদ শাগরেদ
আলহামদুলিল্লাহ! এতক্ষণ আমরা তাসাওউফ জগতের প্রথম সারির দু’জন শায়েখ নিয়ে আলোচনা করলাম। আমরা দেখলাম, তারা মুজাহিদ ছিলেন। এখন আমরা ইনশাআল্লাহ তাদের প্রত্যেকের দু’জন করে শাগরেদ নিয়ে আলোচনা করবো যারা মুজাহিদ ছিলেন। যাতে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, তাসাওউফ দুনিয়ায় যাদের দোহাই দিয়ে চলা হয়, তাদের বড় বড় মাশায়েখগণ নিজেরাই যে শুধু মুজাহিদ ছিলেন তাই নয়, তাদের সোহবতে যারা আসতো তারাও জিহাদি হয়ে যেত। যাতে এও স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, বর্তমান তাসাওউফের দাবিদার বহু শায়েখ, যাদের সংস্পর্শে আসলে পুরুষসূলভ গুণটিই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয় এবং জিহাদের প্রতি অনিহা সৃষ্টি হয়: তারা আর যা কিছুই হোক, অন্তত আইম্মায়ে আহলে সুন্নাহর ত্বরীকার উপর নেই।
হাসান বসরী রহ. এর দু’জন মুজাহিদ শাগরেদ: হাফেয আব্দুল্লাহ ইবনু আউন আলবাসরী রহ. (১৫১হি.) ও আর-রবি ইবনু সাবিহ আলবাসরী রহ. (১৬০হি.)।
ইবরাহীম ইবনু আদহাম রহ. এর দু’জন মুজাহিদ শাগরেদ: শাকিক আলবালখি রহ. (১৯৪হি.) ও আলী ইবনু বাক্কার আলবাসরী রহ. (২০৭হি.)।
***
তিন
হাফেয আব্দুল্লাহ ইবনু আউন আলবাসরী রহ. (১৫১হি.)
হাফেয আব্দুল্লাহ ইবনু আউন আলবাসরী রহ. (১৫১হি.)
তিনি হাসান বসরী রহ. এর প্রথম সারির শাগরেদ। বসরার ইমাম। হাফিজুল হাদিস। নজীর বিহীন তাকওয়া-পরহেযগারির অধিকারী। বুখারি-মুসলিমসহ সুনানে আরবাআর সকলেই নিজ নিজ সনদে তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। যাহাবি রহ. ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্থে বলেন (১/১১৭-১১৮):
ابن عون الإمام شيخ أهل البصرة ... الحافظ
حدث عن: سعيد بن جبير وأبي وائل وإبراهيم النخعي وعطاء ومجاهد والشعبي والحسن والقاسم بن محمد وخلق.
وعنه: حماد بن زيد وإسماعيل بن علية وإسحاق الأزرق ويزيد بن هارون وأبو عاصم الأنصاري ومسلم بن إبراهيم وخلق كثير.
قال عبد الرحمن بن مهدي: ما كان بالعراق أعلم بالسنة من بن عون. وقال قرة: كنا نعجب من ورع بن سيرين فأنساناه ابن عون. وقال شعبة: ما رأيت مثل أيوب وابن عون ويونس. وقال هشام بن حسان: لم تر عيناي مثل ابن عون. وقال ابن المبارك: ما رأيت أحدا أفضل من ابن عون. وقال شعبة: شك ابن عون أحب إلي من يقين غيره ... وقال ابن معين: ثقة في كل شيء. وقال بكار السيريني: كان ابن عون يصوم يوما ويفطر يوما وصحبته دهرا، وكان ... يختم كل أسبوع. اهـ
“ইমাম ইবনু আউন রহ. বসরার শায়েখ। ... হাফিজুল হাদিস।
সাঈদ ইবনু যুবায়ের, আবু ওয়ায়িল, ইব্রাহিম নাখায়ি, আতা, মুজাহিদ, শা’বি, হাসান (বসরী) ও কাসিম ইবনু মুহাম্মাদসহ অসংখ্য মুহাদ্দিস থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।
তার থেকে হাম্মাদ ইবনু যায়েদ, ইসামাঈল ইবনু উলাইয়া, ইসহাক আলআযরাক, ইয়াযিদ ইবনু হারুন, আবু আসিম আলআনসারি ও মুসলিম ইবনু ইব্রাহিমসহ অসংখ্য মুহাদ্দিস হাদিস রিওয়ায়াত করেছেন।
আব্দুর রহমান ইবনু মাহদি রহ. বলেন, ‘ইরাকে ইবনে আউনের চেয়ে সুন্নাহয় বড় আলেম আর কেউ নেই’।
কুররা রহ. বলেন, ‘আমরা ইবনে সিরিনের তাকওয়া-পরহেযগারিতে আশ্চর্যান্বিত হতাম। কিন্তু পরে ইবনে আউন (আপন পরহেযগারির সামনে) ইবনে সিরিনের পরহেযগারির কথা (আমাদেরকে) ভুলিয়েই দিলেন’। ...
হিশাম ইবনু হাসসান রহ. বলেন, ‘আমার দু’ চক্ষু ইবনে আউনের মতো ব্যক্তি দ্বিতীয়টি দেখেনি’।
ইবনুল মুবারক রহ. বলেন, ‘ইবনে আউনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তি আমি দেখিনি’।
শু’বা রহ. বলেন, ‘ইবনে আউনের সংশয়জনক রিওয়ায়াতও আমাদের কাছে অন্যদের ইয়াকিনের তুলনায় অধিক প্রিয়’।
ইবনে মায়ীন রহ. বলেন, ‘তিনি সকল বিষয়েই নির্ভরযোগ্য’।
বাক্কার আসসিরিনি রহ. বলেন, ‘ইবনে আউন একদিন পর পর রোযা রাখতেন। আমি দীর্ঘ যামানা তার সোহবতে ছিলাম। ... তিনি প্রতি সপ্তাহে কুরআনে কারীম এক খতম করতেন’।”
এরপর ইমাম যাহাবি রহ. বলেন (১/১১৮):
لابن عون جلالة عجيبة ووقع في النفوس؛ لأنه كان إماما في العلم رأسا في التأله والعبادة حافظا لأنفاسه. كبير الشأن. مات في رجب سنة إحدى وخمسين ومائة رحمه الله تعالى. اهـ
“ইবনে আউন রহ. এর আশ্চর্য রকমের জালালত ও জনপ্রিয়তা ছিল। কেননা, তিনি ছিলেন ইলমের জগতে ইমাম। ইবাদাত ও আল্লাহমুখীতায় সকলের অগ্রগামী। আপন শ্বাস-প্রশ্বাসেরও হিফাজতকারী ছিলেন। বড় শানদার ব্যক্তি ছিলেন। রজব, ১৫১হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। রাহিমাহুল্লাহু তাআলা।”অন্যত্র বলেন,
كان ابن عون عديم النظير في وقته، زهدا، وصلاحا. اهـ
“যুহদ ও বুযুর্গীতে আপন যামানায় ইবনে আউনের সমকক্ষ কেউ ছিল না।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৭৫***
জিহাদের ময়দানে
ইলম ও আমলের ময়দানের এ শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিটি জিহাদের ময়দানেও ছিলেন বাহাদুর। তার দীর্ঘ দিনের শাগরেদ বাক্কার রহ. বলেন,
وكان يغزو ويركب الخيل. بارز مرة علجا فقتله. اهـ
“তিনি জিহাদ করতেন এবং ঘোড়ায় সওয়ার হতেন। একবার এক মল্লযুদ্ধে এক (রুমান) বাহাদুরকে হত্যা করেছেন।”- তাযকিরাতুল হুফফাজ ১/১১৮বাক্কার রহ. আরো বলেন,
وكان - فيما حدثني بعض أصحابنا - لابن عون ناقة يغزو عليها، ويحج. اهـ
“ইবনে আউনের একটি উষ্ট্রী ছিল, যার উপর সওয়ার হয়ে তিনি জিহাদ ও হজ করতেন।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৭০আরো বলেন,
وكان يغزو على ناقته إلى الشام، فإذا صار إلى الشام، ركب الخيل، وقد بارز روميا، فقتل الرومي. اهـ
“জিহাদে যাওয়ার সময় প্রথমে উষ্ট্রীটিতে চড়ে শাম যেতেন। শামে গিয়ে ঘোড়ায় চড়তেন। একবার এক রুমান সৈন্যের সাথে মল্লযুদ্ধে নেমেছিলেন। তিনি রুমান সৈন্যটিকে হত্যা করেছিলেন।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৭০মল্লযুদ্ধের ঘটনাটি অন্য রেওয়াতে আরো চমৎকারভাবে এসেছে। ইমাম যাহাবি রহ. বর্ণনা করেন (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৬৮):
محمد بن عبد الله الأنصاري: حدثني مفضل بن لاحق، قال: كنا بأرض الروم، فخرج رومي يدعو إلى المبارزة، فخرج إليه رجل فقتله، ثم دخل في الناس، فجعلت ألوذ به لأعرفه، وعليه المغفر. فوضع المغفر يمسح وجهه، فإذا ابن عون!. اهـ
“মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আলআনসারি বলেন, আমাদের কাছে মুফাজজাল ইবনু লাহিক্ব বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা একবার রোম সাম্রাজ্যে (জিহাদে) ছিলাম। তখন এক রুমান সৈন্য বেরিয়ে এল। সে মল্লযুদ্ধের জন্য ডাকাডাকি করতে লাগলো। তার ডাকে সাড়া দিয়ে (আমাদের) এক ব্যক্তি বের হলেন। তিনি সৈন্যটিকে হত্যা করে এসে লোকদের মাঝে ঢুকে পড়লেন। আমি তাকে চেনার জন্য তার পিছু নিলাম। তার মাথায় তখন শিরস্ত্রাণ পরা ছিল। তিনি মুখ মুছতে মুছতে শিরস্ত্রাণটি খুললেন। আশ্চর্য! তাকিয়ে দেখি তিনি ইবনে আউন।” এই ছিল সালাফদের অবস্থা। তারা ইলম ও আমলের ময়দানে যেমন ছিলেন অতুলনীয়, জিহাদের ময়দানেও ছিলেন বীর সেনানি।
***
Comment