সাত
কাজি আসাদ ইবনুল ফুরাত (২১৩হি.)
তিনি ইমাম মালেক, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ রাহিমাহুমুল্লাহ- সকলের শাগরেদ। ইমাম মালেক থেকে মুআত্তা রিওআয়াত করেছেন। আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ রাহিমাহুমাল্লাহর কাছে ফিকহ শিখেছেন। ‘আলআসাদিয়া’ কিতাবের জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। আবু ইউসুফ রহ. উস্তাদ হয়েও তার থেকে মুআত্তা মালেক রিওয়াত করেছেন। কাজি আসাদ ইবনুল ফুরাত (২১৩হি.)
তিনি বংশীয়ভাবে খুরাসানের নিশাপুরের মানুষ। তবে তার পিতার সাথে আফ্রিকার মাগরিবে কায়রাওয়ান শহরে চলে যান। তার পিতা সেনাবাহিনির উচ্চ পদস্থ সৈনিক ছিলেন। ইলম তলবের জন্য তিনি আবার মাশরিকে আসেন। মদীনায় ইমাম মালেক রহ. এর কাছে হাদিস পড়েন। ইরাকে গিয়ে আবু ইউসুফ রহ. ও মুহাম্মাদ রহ. এর কাছে ফিকহ শিখেন। ইরাকে থাকাবস্থায়ই ইমাম মালেক রহ. এর ইন্তেকাল হয়ে যায়।
ইরাকে আবু হানিফা রহ. এর মাযহাব শিখে তিনি মিশরে চলে যান। সেখানে ইমাম মালেক রহ. এর বড় বড় দু’জন শাগরেদ বিদ্যমান ছিলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু ওয়াহব ও আব্দুর রহমান ইবনুল কাসিম। প্রথমে তিনি ইবনু ওয়াহব রহ. এর কাছে গিয়ে আবু হানিফা রহ. এর মাসআলাসমূহ পেশ করেন। আবেদন করেন, এর বিপরীতে প্রতিটি মাসআলায় ইমাম মালেকের কি অভিমত তা তুলে ধরতে। কিন্তু ইবনু ওয়াহব রহ. হিম্মত করেননি। তিনি ইবনুল কাসিম রহ. এর কাছে চলে যান। ইবনুল কাসিম রহ. প্রতিটি মাসআলায় ইমাম মালেক রহ. এর অভিমত তুলে ধরেন। যেখানে ইমাম মালেকের স্পষ্ট কোন বক্তব্য নেই, সেখানে তার অন্যান্য বক্তব্যের আলোকে সমাধান কি হতে পারে তা বলে দেন। আসাদ রহ. এসব মাসআলা সংকলন করে মাগরিবে চলে যান। তার সংকলিত এ কিতাবগুলো ‘আলআসাদিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ।
কাজি ইয়াজ রহ. (৫৪৪ হি.) বলেন,
قال سلمان بن عمران: ... بسبب أسد ظهر العلم بإفريقية. قال غيره. كان أسد أعلم العراقيين بالقيروان كافة. ومذهبه السنة لا يعرف غيرها. اهـ
“সুলাইমান ইবনু ইমরান রহ. বলেন, আসাদ রহ. এর মাধ্যমেই আফ্রিকায় ইলমের প্রচার-প্রসার হয়েছে। অন্য একজন বলেন, ইরাক থেকে ইলম অর্জনকারীদের মধ্যে কায়রাওয়ান শহরে আসাদ রহ.- ই ছিলেন সবচেয়ে বড় আলেম। তার মাযহাব সম্পূর্ণ সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত। এতদ্ব্যতীত (বিদআতি) কিছেই তিনি জানেন না।”- তারতিবুল মাদারিক ৩/৩০২আরো বলেন,
قال عمران بن أبي محرز: جاءنا موت أسد فاستعظمه أبي، وقال: اليوم مات العلم. اهـ
“ইমরান ইবনু আবু মুহরিয রহ. বলেন, আমাদের কাছে আসাদ রহ. এর মৃত্যুর খবর আসলো। আমার পিতার কাছে তার মৃত্যু অতিশয় দুঃখের বিষয় মনে হল। বললেন, আজ ইলমের মৃত্যু ঘটে গেছে।”- তারতিবুল মাদারিক ৩/৩০২বীরত্ব
যাহাবি রহ. বলেন,
وكان مع توسعه في العلم فارسا، بطلا، شجاعا، مقداما. اهـ
“প্রভূত ইলমের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার। বাহাদুর। সাহসী বীর। ময়দানের অগ্রসৈনিক।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৮/৩৫১জিহাদ ও শাহাদাত
মাগরিরেবর গভর্নর যিয়াদাতুল্লাহ আলআগলাবি প্রথমে ২০৩/২০৪ হিজরিতে তাকে কায়রাওয়ানের কাজি নিয়োগ দেন। তিনি কাজি হিসেবেই বহাল ছিলেন। ২১২ হিজরিতে তিনি তাকে দশ হাজার সৈন্যের আমীর বানিয়ে সিকিল্লিয়া দ্বীপ বিজয়ের জন্য পাঠান। তখন তিনি একাধারে বাহিনির আমীর ও কাজি ছিলেন। সিকিল্লিয়ার সম্রাট দেড় লাখ সৈন্য নিয়ে তার মোকাবেলায় আসে। তিনি তাদের পরাজিত করেন। পরে গিয়ে সারাকুসা অবরোধ করেন। এ অবরোধকালে তিনি মারা যান। আঘাতে আঘাতে গোটা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। এ জখমেই তিনি শহীদ হন। রাহিমাহুল্লাহ। কাজি ইয়াজ রহ. (৫৪৪ হি.) বলেন,
قام قاضياً إلى أن خرج إلى صقلية، سنة اثنتي عشرة والياً على جيشها. وكان على علمه وفقهه أحد الشجعان. فخرج أسد في عشرة آلاف رجل منهم تسعمائة فارس ... فقال أسد إذ ذاك لزيادة الله: من بعد القضاء، والنظر في الحلال والحرام تعزلني وتوليني الإمارة؟ فقال: لا، ولكني وليتك الإمرة، وهي أشرف، وأبقيت لك اسم القضاء. فأنت أمير، قاض، فخرج إلى صقلية وظفر بكثير منها وتوفي وهو محاصر سرقوسة منها. اهـ
“২১২ হিজরিতে সেনাবাহিনির আমীর হিসেবে সিকিল্লিয়া রওয়ানা হওয়া পর্যন্তই তিনি কাজি ছিলেন। প্রভূত ইলম ও ফিকহের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিশিষ্ট বীর। আসাদ রহ. দশ হাজার সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হন, যাদের মধ্যে নয়শো ছিল ঘোড়সওয়ার। ... তখন তিনি যিয়াদাতুল্লাহর কাছে আরজ করেন, এত দিন আমি কাজি ছিলাম। হালাল হারামের ফতোয়া দিতাম। (এখন) আমাকে (এ সম্মানিত পদ থেকে) বরখাস্ত করে আমীর বানাবেন? তিনি উত্তর দেন, না! বরং আমি আপনাকে আমীর বানাচ্ছি- আর এটি অধিক সম্মানজনক- পাশাপাশি কাজি হিসেবেও বহাল রাখছি। আপনি আমীরও, কাজিও। এরপর তিনি সিকিল্লিয়া রওয়ানা হন। সেখানকার অনেক এলাকা বিজয় করেন। সারাকুসা (সিকিল্লিয়ার একটা এলাকা) অবরোধ করা অবস্থায় সেখানেই ইন্তেকাল করেন।”- তারতিবুল মাদারিক ৩/৩০৪-৩০৫
আরো বলেন,
وحكى سليمان بن سالم أن أسداً لقي ملك صقلية في مائة ألف وخمسين ألفاً. قال الرواي فرأيت أسداً لقي ملك صقلية في مائة ألف وخمسين ألفاً. قال الرواي فرأيت أسداً وفي يده اللواء وهو يزمزم وأقبل على قراءة يس، ثم حرض الناس، وحمل وحملوا معه، فهزم الله جموع النصارى، ورأيت أسداً وقد سالت الدماء على قناة اللواء. حتى صار تحت إبطه، ولقد رد يده في بعض تلك الأيام فلم يستطع مما اجتمع من الدم تحت إبطه. اهـ
“সুলাইমান ইবনু সালিম রহ. বর্ণনা করেন, আসাদ রহ. সিকিল্লিয়া সম্রাটের মুখোমুখি হন। তখন সম্রাটের সৈন্য সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। বর্ণনাকারী বলেন, দেখলাম- দেড় লাখ সৈন্য-সমেত আগত সিকিল্লিয়া সম্রাটের সাথে আসাদ রহ. মোকাবেলায় অবতীর্ণ হলেন। বর্ণনাকারী বলেন, দেখলাম আসাদ রহ. এর হাতে ঝাণ্ডা। গুণগুণ আওয়াজে সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করতে করতে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। এরপর তিনি সৈন্যদের (জিহাদে) উৎসাহিত করলেন এবং শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সৈন্যরাও ঝাঁপিয়ে পড়লো। আল্লাহ তাআলা নাসারা বাহিনিকে পরাজিত করলেন। আসাদ রহ.কে দেখলাম, ঝাণ্ডার হাতল বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। এমনকি তার বগলের নিচে পর্যন্ত গড়িয়েছে। ঐ সময় এক দিন তিনি হাত নাড়াতে চাইলেন, কিন্তু বগলের নিচে এত রক্ত জমেছিল যে, হাত নাড়াতে পারছিলেন না।”- তারতিবুল মাদারিক ৩/৩০৬শেষে বলেন,
وكانت وفاة أسد في حصار سرقوسة، من غزوة صقلية، وهو أمير الجيش وقاضيه. سنة ثلاث عشر ومائتين. وقيل أربع عشرة، وقيل سبع عشرة. وقبره ومسجده بصقلية. اهـ
“২১৩/২১৪/২১৭ হিজরিতে তার ওফাত। সিকিল্লিয়া যুদ্ধে সারাকুসা অবরোধকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তখন তিনি বাহিনির আমীর ও কাজি ছিলেন। সিকিল্লিয়াতে তার কবর ও মসজিদ বিদ্যমান।”- তারতিবুল মাদারিক ৩/৩০৯***
Comment