আট
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. (১১৮-১৮১হি.)
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. (১১৮-১৮১হি.)
আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক আলমারওয়াজি। শাইখুল ইসলাম। আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদিস। যামানার অতুলনীয় ইমাম। যুহদ ও তাকওয়ার রাহবার।
তিনি খোরাসানের অধিবাসী। বংশগতভাবে তুর্কি। তার পিতা মুবারক বনু হানযালার এক ব্যবসায়ীর গোলাম ছিলেন। এজন্য ইবনুল মুবারককে আলহানযালি বলা হয়। এক ক্রিতদাসের ঔরসে আল্লাহ তাআলা এ মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন।
তলবে ইলমের উদ্দেশ্যে তিনি দূর-দূরান্তের দেশে সফর করেছেন। হারামাইন শরীফাইন, খোরাসান, শাম, ইরাক, মিশর- কোন দেশই বাকি রাখেননি। বিশেষভাবে আবু হানিফা রহ. এর কাছে ফিকহ ও সুফিয়ান সাওরি রহ. এর কাছে হাদিস পড়েছেন। চার হাজার উস্তাদ থেকে তিনি ইলম শিখেছেন। তার হাদিস গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।
তিনি সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন। চার লাখ দিরহাম ছিল তার ব্যবসার মূলধন। যখন সফরে বের হতেন, তখন ব্যবসাও করতেন। মুহাদ্দিসিন, তুলাবা ও ফকির-মিসকিনদের মাঝে অকাতরে দান করতেন। এ উদ্দেশ্যেই মূলত তিনি ব্যবসা করতেন।
তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন। ইসমাঈল ইবনু আইয়াশ রহ. বলেন,
لا أعلم أن الله خلق خصلة من خصال الخير، إلا وقد جعلها في عبد الله بن المبارك. اهـ
“আল্লাহ তাআলা যত ভাল গুণ সৃষ্টি করেছেন, তার সবগুলোই আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারককে দান করেছেন।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৬৮আব্বাস ইবনু মুসআব রহ. বলেন,
جمع عبد الله الحديث، والفقه، والعربية، وأيام الناس، والشجاعة، والسخاء، والتجارة، والمحبة عند الفرق. اهـ
“ফিকহ, আরবি ভাষার ব্যূৎপত্তি, ইতিহাস, বীরত্ব, দানশীলতা, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল কিছুর সমাহার আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. এর মাঝে ঘটেছে এবং সকল মতাদর্শের লোকের কাছেই তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৬৭ইবনুল মুবারক রহ. এর কৃতদাস হাসান ইবনু ঈসা রহ. বলেন,
اجتمع جماعة مثل الفضل بن موسى، ومخلد بن الحسين، فقالوا: تعالوا نعد خصال ابن المبارك من أبواب الخير، فقالوا: العلم، والفقه، والأدب، والنحو، واللغة، والزهد، والفصاحة، والشعر، وقيام الليل، والعبادة، والحج، والغزو، والشجاعة، والفروسية، والقوة، وترك الكلام فيما لا يعنيه، والإنصاف، وقلة الخلاف على أصحابه. اهـ
“ফজল ইবনু মূসা ও মাখলাদ ইবনুল হুসাইনের মতো বিশিষ্ট এক দল আলেম সমবেত হলেন। তারা বললেন, চল! ইবনুল মুবারক রহ. এর মাঝে যেসব ভাল গুণ ছিল, আমরা সেগুলো হিসেব করি। তারা হিসেব করলেন, ইবনুল মুবারক রহ. নিম্নোক্ত সকল গুণের সমাহার ছিলেন: ইলম, ফিকহ, আদব, নাহু, লুগাত, যুহদ, ফাসাহাত, কাব্য, কিয়ামুল লাইল, ইবাদাত, হজ্ব, জিহাদ, বীরত্ব, ফিরাসাত-সুদূর প্রসারি অন্তর্দৃষ্টি, প্রভূত শারীকি শক্তি, অপ্রয়োজনীয় কোন কথা না বলা এবং যথাসম্ভব সাথী-সঙ্গীদের সাথে মতভেদ না করা।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৭৬যাহাবি রহ. বলেন,
أكثر من الترحال والتطواف، وإلى أن مات في طلب العلم، وفي الغزو، وفي التجارة والإنفاق على الإخوان في الله، وتجهيزهم معه إلى الحج. اهـ
“মৃত্যু পর্যন্তই দূর-দূরান্তে সফর করেছেন। তলবে ইলম, জিহাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আল্লাহর ওয়াস্তে দ্বীনি ভাইদের পেছনে খরচ করা এবং তাদের জন্য হজ্বের সামগ্রী প্রস্তুত ও ব্যবস্থা করে দেয়ার মাঝে জীবন অতিবাহিত করেছেন।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৬৫সর্ব মহলে তিনি এমনই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন যে, আসওয়াদ ইবনু সালিম রহ. এতটুকু পর্যন্ত বলেছেন,
إذا رأيت رجلا يغمز ابن المبارك، فاتهمه على الإسلام. اهـ
“কোন ব্যক্তিকে যদি দেখো যে, সে ইবনুল মুবারকের সমালোচনা করে, তাহলে তার মুসলমান দাবির ব্যাপারে তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৭৪জিহাদ ও বীরত্ব
জিহাদের ময়দানে ইবনুল মুবারক রহ. এমনই প্রসিদ্ধ তারকাতুল্য যে, নতুন করে বলার কিছু নেই। ইলম ও জিহাদ উভয় ময়দানেই তিনি ছিলেন ঘোড়সওয়ার। এখানে তার বীরত্বের দু’টি ঘটনা তুলে ধরছি:
এক.
আবু হাতিম রাজি রহ. এর সূত্রে আবদা ইবনু সুলাইমান আলমারওয়াজি রহ. থেকে যাহাবি রহ. (৭৪৮ হি.) বর্ণনা করেন (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৭৪),
كنا سرية مع ابن المبارك في بلاد الروم، فصادفنا العدو، فلما التقى الصفان، خرج رجل من العدو، فدعا إلى البراز، فخرج إليه رجل، فقتله، ثم آخر، فقتله ثم آخر فقتله ثم دعا إلى البزاز، فخرج إليه رجل، فطارده ساعة، فطعنه، فقتله، فازدحم إليه الناس، فنظرت، فإذا هو عبد الله بن المبارك، وإذا هو يكتم وجهه بكمه، فأخذت بطرف كمه، فمددته، فإذا هو هو، فقال: وأنت يا أبا عمرو ممن يشنع علينا!!. اهـ
“আমরা রোম সাম্রাজ্যে ইবনুল মুবারক রহ. এর সাথে এক যুদ্ধে গেলাম। শত্রু বাহিনি আমাদের মুখোমুখী হল। উভয় বাহিনি যখন সারিবদ্ধ দাঁড়ালো, তখন শত্রুদের এক যোদ্ধা এসে মুবারাযা (তথা মল্লযুদ্ধ)- এর জন্য আহ্বান করতে লাগল। তখন (মুসলিম বাহিনি থেকে) এক ব্যক্তি তার ডাকে সারা দিয়ে মোকাবেলার জন্য বের হল এবং শত্রুসৈন্যটিকে হত্যা করলো। শত্রু বাহিনির আরেক যোদ্ধা আসল। তিনি তাকেও হত্যা করলেন। (তৃতীয়) আরেক যোদ্ধা আসলো। তিনি তাকেও হত্যা করলেন। এরপর মুবারাযার জন্য শত্রু বাহিনিকে আহ্বান করতে লাগলেন। তাদের থেকে এক যোদ্ধা অগ্রসর হল। তার সাথে কিছুক্ষণ মোকাবেলার পর তিনি তাকেও আঘাতে হত্যা করলেন। লোকজন মুসলিম সৈন্যটিকে দেখার জন্য ভীড় করলো। আমিও তাকে দেখার জন্য তাকালাম। দেখি তিনি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক! তিনি জামার আস্তিনের দ্বারা নিজের চেহারা লুকানোর চেষ্টা করছেন। আমি তার আস্তিনের এক পার্শ্ব ধরে টান দিলাম। (এতে চেহারা খোলে গেল এবং) দেখলাম যে, আসলেই তিনি ইবনুল মুবারক ...।” দুই.
মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না রহ. এর সূত্রে যাহাবি রহ. আব্দুল্লাহ ইবনু সিনান রহ. থেকে বর্ণনা করেন (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৮৩-৩৮৪),
كنت مع ابن المبارك، ومعتمر بن سليمان بطرسوس، فصاح الناس: النفير. فخرج ابن المبارك، والناس، فلما اصطف الجمعان، خرج رومي، فطلب البراز، فخرج إليه رجل، فشد العلج عليه، فقتله، حتى قتل ستة من المسلمين، وجعل يتبختر بين الصفين يطلب المبارزة، ولا يخرج إليه أحد، فالتفت إلي ابن المبارك فقال: يا فلان! إن قتلت، فافعل كذا وكذا. ثم حرك دابته، وبرز للعلج، فعالج معه ساعة، فقتل العلج، وطلب المبارزة، فبرز له علج آخر، فقتله، حتى قتل ستة علوج، وطلب البراز، فكأنهم كاعوا عنه، فضرب دابته، وطرد بين الصفين، ثم غاب، فلم نشعر بشيء، وإذا أنا به في الموضع الذي كان، فقال لي: يا عبد الله! لئن حدثت بهذا أحدا، وأنا حي، فذكر كلمة. اهـ
“আমরা ইবনুল মুবারক রহ. ও মু’তামির ইবনু সুলাইমান রহ. এর সাথে তরাসুসে ছিলাম। এমন সময় লোকজন চিৎকার করে উঠল, এখনই জিহাদে বেরিয়ে পড়তে হবে। ইবনুল মুবারক রহ. সহ সকলেই বেরিয়ে পড়লো। উভয় বাহিনি যখন সারিবদ্ধ দাঁড়ালো, এক রোমান সৈন্য এসে মুবারাযার জন্য আহ্বান করতে লাগল। মুসলিম বাহিনির এক ব্যক্তি তার ডাকে সাড়া দিয়ে অগ্রসর হল। সৈন্যটি তার উপর হামলা করে তাকে শহীদ করে দিল। এভাবে একে একে সে মুসলিম বাহিনির ছয়জন মুজাহিদকে হত্যা করল। এরপর উভয় বাহিনির মাঝখানে গর্বভরে হেঁলে-দুলে ফিরতে লাগল আর মুবারাযার আহ্বান করতে লাগল। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিচ্ছিল না। এমন সময় ইবনুল মুবারক রহ. আমার দিকে তাকালেন। বললেন, হে অমুক! যদি আমি নিহত হই, তাহলে তুমি এই এই কাজগুলো সম্পাদন করবে। তারপর তিনি তার সওয়ারি হাঁকালেন এবং রোমান সৈন্যটির মোকাবেলায় গেলেন। কিছুক্ষণ মোকাবেলার পর তিনি সৈন্যটিকে হত্যা করলেন এবং মুবারাযার জন্য আহ্বান করতে লাগলেন। এক সৈন্য তার ডাকে সাড়া দিয়ে অগ্রসর হল। তিনি তাকেও হত্যা করলেন। এভাবে একে একে তিনি ছয়জন সৈন্যকে হত্যা করলেন এবং মুবারাযার জন্য আহ্বান করতে লাগলেন। কিন্তু মনে হল, শত্রু বাহিনির লোকেরা তার মোকাবেলায় আসতে সাহস পাচ্ছে না। এরপর তিনি উভয় বাহিনির মাঝখানে তার সওয়ারি হাঁকালেন এবং অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ দেখি, তিনি আমার পাশে সে স্থানেই উপস্থিত, যেখানে আগে ছিলেন। আমাকে বললেন, ‘হে আব্দুল্লাহ! আমি জীবিত থাকতে যদি তুমি এ ঘটনা কাউকে বলেছো তাহলে কিন্তু ....’ ... এখানে তিনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন (যা আমি বলতে চাচ্ছি না)।” একটি স্বপ্ন
যাহাবি রহ. বর্ণনা করেন,
قال محمد بن الفضيل بن عياض: رأيت ابن المبارك في النوم، فقلت: أي العمل أفضل؟ قال: الأمر الذي كنت فيه. قلت: الرباط والجهاد؟ قال: نعم. قلت: فما صنع بك ربك؟ قال: غفر لي مغفرة ما بعدها مغفرة. اهـ
“ফুজাইল ইবনু ইয়াজের পুত্র মুহাম্মাদ রহ. বলেন, আমি ইবনুল মুবারক রহ.কে স্বপ্নে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি উত্তর দিলেন, আমি যে কাজটি করতাম সেটি। আমি প্রশ্ন করলাম, রিবাত ও জিহাদ (-এর কথা বলছেন)? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার রব আপনার সাথে কীরূপ আচরণ করেছেন? তিনি উত্তর দিলেন, আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। এমন মাফ করেছেন, যার পর আর কোন মাফ হতে পারে না।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৯০ কবিতা
‘ইয়া আবিদাল হারামাইন’ নামে ফুজাইল ইবনু ইয়াজের কাছে পাঠানো ইবনুল মুবারকের একটি কবিতার কথা সকলেই জানি। জিহাদ নিয়ে তার আরো একটি হৃদয়গ্রাহী কবিতা আছে। যাহাবি রহ. সেটি উল্লেখ করেছেন (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৩৮৯),
كيف القرار وكيف يهدأ مسلم ... والمسلمات مع العدو المعتدي
الضاربات خدودهن برنة ... الداعيات نبيهن محمد
القائلات إذا خشين فضيحة ... جهد المقالة ليتنا لم نولد
ما تستطيع وما لها من حيلة ... إلا التستر من أخيها باليد
“# কিভাবে স্থির থাকা যায়? কিভাবে কোনো মুসলিম প্রশান্তিতে থাকতে পারে? যেখানে মুসলিম নারীরা সীমালঙ্গনকারী শত্রুদের হাতে বন্দী?!
# তারা তাদের নবী মুহাম্মাদকে ডেকে ডেকে মুখ চাপড়িয়ে রোনাজারি করে কাঁদছে।
# যখন তারা সম্ভ্রমহানির ভয়ে শঙ্কিত, তখন শত আফসোস করে বলছে, হায়! যদি আমাদের জন্মই না হত!
# নেই তার কোন শক্তি, নেই কোন উপায়। হাত ঠেকিয়ে ভাই থেকে মুখ লুকানো ছাড়া কিছুই তার করার নেই।”
বি.দ্র.
এতক্ষণ যে আটজনের আলোচনা গেল, তাদের মধ্যে
# ইবরাহীম ইবনু আদহাম আলবালখি রহ. (১৬২হি.) এবং ইবনুল মুবারক রহ. (১৮১ হি.) আবু হানিফা রহ. এর শাগরেদ।
# শাকিক আলবালখি রহ. (১৯৪হি.) আবু হানিফা, যুফার ও আবু ইউসুফ রাহিমাহুমুল্লাহ সকলের শাগরেদ।
# কাজি আসাদ ইবনুল ফুরাত (২১৩হি.) আবু ইউসুফ রহ. ও মুহাম্মাদ রহ. এর শাগরেদ।
Comment