একুশ.
বাকি ইবনু মাখলাদ (২৭৬হি.)
শাইখুল ইসলাম। হাফিজুল হাদিস। আবু আব্দুর রহমান বাকি ইবনু মাখলাদ আলআন্দালুসি আলকুরতুবি। তিনি আমাদের হারানো গৌরব স্পেনের ইমাম। বাকি ইবনু মাখলাদ (২৭৬হি.)
দুইশো হিজরির দিকে জন্ম। প্রথমে আন্দালুসে ইলম অর্জন শুরু করেন। তারপর জন্য বাহিরে পাড়ি জমান। হারামাইন শরিফাইন, ইরাক, শাম ও মিশরসহ দূর-দূরান্ত সফর করেন। অসংখ্য মুহাদ্দিস থেকে হাদিস সংগ্রহ করেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহ. এর কাছেও এসেছিলেন। তবে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে আহমাদ রহ. ততদিনে হাদিস বর্ণনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাই আহমাদ রহ. এর কাছ থেকে তিনি হাদিস সংগ্রহ করতে পারেননি। তবে অনেক মাসায়েল ও ফাওয়ায়েদ অর্জন করেন।
আন্দালুসে তিনিই সর্বপ্রথম মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা নিয়ে যান। এছাড়াও আরো বেশ কিছু মূল্যবান ইলমী গ্রন্থ তিনি আন্দালুসে নিয়ে যান। তার মাধ্যমে আন্দালুসে হাদিসের ব্যাপক চর্চা শুরু হয়।
যাহাবি রহ. (৭৪৮হি.) বলেন,
وعني بهذا الشأن عناية لا مزيد عليها، وأدخل جزيرة الأندلس علما جما، وبه وبمحمد بن وضاح صارت تلك الناحية دار حديث. اهـ
“হাদিস অধ্যয়নে তিনি এমনই মনোনিবেশ করেন যে, এর চেয়ে বেশি আর সম্ভব নয়। আন্দালুস দ্বীপে তিনি প্রভূত ইলমের সমাগম ঘটান। তার এবং মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াদদাহ এর মাধ্যমেই মূলত উক্ত অঞ্চল হাদিসের ভূমিতে পরিণত হয়।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৩৭৮তিনি আফ্রিকায় মালিকি মাযহাবের ইমাম সুহনূন রহ. এর কাছে ফিকহ শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। হাদিস ও ফিকহে ইজতিহাদের দরজায় উন্নীত হন। তাই নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের পাবন্দী করতেন না। সরাসরি কুরআন সু্ন্নাহ থেকে ফতোয়া দিতেন।
যাহাবি রহ. বলেন,
وكان إماما مجتهدا صالحا، ربانيا صادقا مخلصا، رأسا في العلم والعمل، عديم المثل، منقطع القرين، يفتي بالأثر، ولا يقلد أحدا. اهـ
“তিনি একজন নেকার মুজতাহিদ ইমাম ছিলেন। সাদিক ও মুখলিস আলেমে রব্বানী ছিলেন। ইলম ও আমল উভয় ময়দানের শাহসওয়ার ছিলেন। এমন অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যার কোন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। হাদিস অনুযায়ী ফতোয়া দিতেন। কারো তাকলিদ করতেন না।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৩৭৯তিনি যখন কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী ফতোয়া দিতে শুরু করেন, তখন আন্দালুসের প্রচলিত আলেমরা তার বিরোধীতায় উঠে-পড়ে লাগে। তাকে বিদআতি এমনকি যিন্দিক আখ্যা দেয়। সুলতানের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করে। প্রচলিত আলেমদের একমাত্র সম্বল ছিল মালিকি মাযহাব আর ফিকহের কিছু কিতাবাদি। কুরআন-হাদিসের সাথে তাদের তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। তিনি যখন কুরআন হাদিস মতে ফতোয়া দিতে শুরু করেন, সেগুলো অনেক সময় তাদের মাযহাব এবং প্রচলিত মাসআলার বিরুদ্ধে চলে যেতো। ফলে তারা তাকে গোমরাহ ও বিদআতি মনে করতে থাকে। আন্দালুসের তখনকার সুলতান ছিলেন উমাইয়া শাসক মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান। তিনি নিজে বিদ্যান ব্যক্তি ছিলেন। ইলমের প্রতি তার মোহব্বাতও ছিল যথেষ্ট। তিনি যাছাই করে দেখলেন যে, প্রচলিত আলেমদের দাবি সত্য নয়। তিনি তাদের দাবি প্রত্যাখান করে দেন এবং বাকি রহ.কে হাদিস ও ইলমের প্রচার প্রসারে উৎসাহ দেন। এভাবে আস্তে আস্তে আন্দালুস ভূমিতে হাদিসের বিস্তার হতে থাকে। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৩৮০-৩৮১)
গ্রন্থাদি
তার বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে। তবে দু’টি গ্রন্থ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। একটি তাফসিরে কুরআন, আরেকটি হাদিস গ্রন্থ।
ইবনু হাযম রহ. (৪৫৬হি.) তাফসির গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেন,
أقطع أنه لم يؤلف في الإسلام مثل (تفسير) بقي، لا (تفسير) محمد بن جرير، ولا غيره . اهـ
“একথা অকাট্য সত্য যে, বাকি রহ. এর তাফসিরের সমকক্ষ তাফসির ইসলামে দ্বিতীয়টি লিখা হয়নি। তাফসিরে ইবনে জারিরও না, অন্য কোন তাফসিরও না।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৩৭৯তাফসিরে ইবনে জারির ত্ববারি সম্পর্কে আশাকরি আমরা সকলে কমবেশ জানি। এটি একটি নজীরবিহীন তাফসির। ইবনে হাযম রহ. এর মতে বাকি ইবনু মাখলাদের তাফসিরের মান এরও উর্ধ্বে।
হাদিস গ্রন্থটি মুসনাদে বাকি ইবনু মাখলাদ নামে পরিচিত। এটি মুসনাদে আহমাদ ইবনু হাম্বলের সমমানের মানের কিতাব। অবশ্য মুসনাদে আহমাদের চেয়ে অতিরিক্ত একটি ফায়েদা এ কিতাবে আছে। তা হলো, তিনি শুধু হাদিস বর্ণনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি, প্রত্যেক সাহাবির হাদিস ফিকহের অধ্যায় অনুপাতে বিন্যস্ত করেছেন।
ইবনে হাযম রহ. বলেন,
(مسند) بقي روى فيه عن ألف وثلاث مائة صاحب ونيف، ورتب حديث كل صاحب على أبواب الفقه، فهو مسند ومصنف، وما أعلم هذه الرتبة لأحد قبله. اهـ
“মুসনাদে বাকিতে তেরোশোরও বেশি সাহাবি থেকে হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে। প্রত্যেক সাহাবির হাদিস ফিকহের আবওয়াব অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে। এজন্য গ্রন্থটি একই সাথে মুসনাদ ও মুসান্নাফ। তার আগে এই মর্যাদা আর কারো অর্জন হয়েছে বলে আমার জানা নেই।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৩৮১ কারামত
তিনি মুসতাজাবুদ দাওয়াহ ছিলেন। ইবনে কাসির রহ. (৭৭৪হি.) তার একটি কারামত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
وكان مع ذلك رجلا صلاحا عابدا زاهدا مجاب الدعوة، جاءته امرأة فقالت: إن ابني قد أسرته الإفرنج، وإني لا أنام الليل من شوقي إليه، ولي دويرة أريد أن أبيعها لأستفكه، فإن رأيت أن تشير على أحد يأخذها لاسعى في فكاكه بثمنها، فليس يقر لي ليل ولا نهار، ولا أجد نوما ولا صبرا ولا قرارا ولا راحة. فقال: نعم انصرفي حتى أنظر في ذلك إن شاء الله. وأطرق الشيخ وحرك شفتيه يدعو الله عز وجل لولدها بالخلاص من أيدي الفرنج، فذهبت المرأة فما كان إلا قليلا حتى جاءت الشيخ وابنها معها فقالت: اسمع خبره يرحمك الله. فقال: كيف كان أمرك؟ فقال: إني كنت فيمن يخدم الملك ونحن في القيود، فبينما أنا ذات يوم أمشي إذ سقط القيد من رجلي، فأقبل علي الموكل بي فشتمني وقال: لم أزلت القيد من رجليك؟ فقلت: لا والله ما شعرت به ولكنه سقط ولم أشعر به، فجاؤوا بالحداد فأعادوه وأجادوه وشدوا مسماره وأيدوه، ثم قمت فسقط أيضا فأعادوه وأكدوه فسقط أيضا، فسألوا رهبانهم عن سبب ذلك، فقالوا: له والدة؟ فقلت: نعم، فقالوا: إنها قد دعت لك وقد استجيب دعاؤها، أطلقوه. فأطلقوني وخفروني حتى وصلت إلى بلاد الإسلام. فسأله بقي بن مخلد عن الساعة التي سقط فيها القيد من رجليه، فإذا هي الساعة التي دعا فيها الله له ففرج عنه. اهـ
“(প্রভূত ইলমের অধিকারী হওয়ার) পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন নেককার, আবেদ, যাহেদ ও মুসতাজাবুদ দাওয়াহ ব্যক্তি। কুশায়রি রহ. (তার একটি কারামত) উল্লেখ করেছেন যে, একবার এক মহিলা এসে তার কাছে আরজ করল, আমার ছেলেকে ফরাসীরা বন্দী করে নিয়ে গেছে। ছেলে হারানোর ব্যথায় আমি রাত্রে ঘুমাতে পারছি না। আমার ছোট্ট একটি কুটির আছে। ছেলেকে ছাড়ানোর জন্য আমি এটি বিক্রি করতে চাচ্ছি। আপনি যদি কাউকে এটি ক্রয় করার পরামর্শ দিতেন, যাতে আমি এর মূল্য নিয়ে ছেলেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে পারি- তাহলে অনেক ভাল হত। দিন-রাত কখনোও আমি প্রশান্তি পাচ্ছি না। আমার ঘুম আসে না। আমি সবর করতে পারছি না। আমি স্থির হতে পারছি না। আমার কোন শান্তি নেই।
তিনি উত্তর দিলেন, ঠিক আছে। তুমি যাও। ইনশাআল্লাহ আমি কিছু করতে পারি কি’না দেখি। এরপর শায়খ মাথা নিচু করলেন। ঠোঁট নাড়িয়ে আল্লাহর কাছে ছেলেকে ফরাসীদের হাত থেকে মুক্ত করে দেয়ার দোয়া করতে লাগলেন। মহিলা চলে গেল।
অল্প (ক’দিন) পরেই মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে শায়খের কাছে হাজির হল। এসে আরজ করল, আল্লাহ তাআলা আপনার উপর রহম করুন! এর কাহিনিটা একটু শুনুন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি কাহিনি ঘটলো তোমার?
ছেলে উত্তর দিল, আমি ঐসব বন্দীদের মধ্যে ছিলাম যারা বাদশার খেদমত করতো। আমাদের শিকল পরিয়ে রাখা হত। একদিন (কাজের সময়) আমি হাঁটছিলাম। হঠাৎ পা থেকে আমার শিকল খুলে পড়ে গেল। আমার পেছনে নিযুক্ত সৈন্যটি আমাকে গালি দিয়ে বললো, অ্যাই! শিকল খুলেছিস কেন? আমি উত্তর দিলাম, ‘না! আল্লাহর কসম! আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। শিকল এমনি এমনি খোলে গেলে। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি’। তারা শিকলওয়ালাকে ডেকে এনে পুনর্বার শিকল পরালো। ভাল করে লাগাল। পিনগুলো শক্ত করে লাগাল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। পরক্ষণে আবার খুলে গেল। তারা আবার লাগাল। আবার খুলে গেল। অবস্থা দেখে তারা তাদের আলেমদের কাছে এর কারণ জিজ্ঞেস করল। আলেমরা জানতে চাইল, এর কি মা আছে? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ! আমার মা আছে’। তারা বলল, তোর মা তোর জন্য দোয়া করেছে এবং দোয়া কবুল হয়েছে। তোমরা একে ছেড়ে দাও। তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। পথ খরচও দিয়ে দেয়। এভাবে আমি মুসলিম ভূমিতে পৌঁছে যাই।
বাকি রহ. জিজ্ঞেস করলেন যে, কোন্ সময়টাতে তার বেড়ি খুলে পড়েছিল? মিলিয়ে দেখা হল, ঠিক ঐ সময়ে, যখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। তার দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা তাকে মুক্ত করে দেন।”- আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ১১/৬৬
দু’টি মুনকার বর্ণনা
অনেকে বাকি রহ. এর ব্যাপারে বলে থাকেন যে, তিনি ভিক্ষুকের বেশে আহমাদ রহ. এর কাছ থেকে হাদিস শিখেছেন। যাহাবি রহ. এ বর্ণনাকে মুনকার তথা ভিত্তিহীন বলেছেন।
তেমনিভাবে বলা হয়ে থাকে যে, খিযির আলাইহিস সালামের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটেছে। এ বর্ণনাকে তিনি আগেরটার চেয়েও বেশি মুনকার বলেছেন। অতএব, বর্ণনা দু’টি ভিত্তিহীন।
জিহাদে বাকি ইবনু মাখলাদ রহ.
যাহাবি রহ. বলেন,
ومن مناقبه أنه كان من كبار المجاهدين في سبيل الله، يقال: شهد سبعين غزوة. اهـ
“তার একটি বিশেষ মর্যাদা এই যে, তিনি আল্লাহর রাস্তার একজন বড় মাপের মুজাহিদ ছিলেন। সত্তরেরও বেশি জিহাদে তিনি শরীক হয়েছেন।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৩৮৪ আরো বর্ণনা করেন,
كان بقي يختم القرآن كل ليلة، في ثلاث عشرة ركعة، وكان يصلي بالنهار مائة ركعة، ويصوم الدهر. وكان كثير الجهاد، فاضلا، يذكر عنه أنه رابط اثنتين وسبعين غزوة. اهـ
“বাকি রহ. প্রতি রাত্রে তেরো রাকাআতে কুরআনে কারীম এক খতম করতেন। দিনে একশো রাকাআত নফল পড়তেন। আজীবন রোযা রাখতেন। অনেক বেশি জিহাদ করতেন। মর্যাদাশীল ব্যক্তি ছিলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি বাহাত্তরটি জিহাদে রিবাতের দায়িত্ব পালন করেছেন।”- সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৩৮২
আজ যারা আমরা ইলম নিয়ে এতোই ব্যস্ত যে, সারা দিনে দু’চার রাকাআত নফলেরও সুযোগ মিলে না; সারা মাসেও এক খতম কুরআনের সৌভাগ্যও হয় না; আর জিহাদের কথা তো বলাই বাহুল্য: তাদের উচিৎ আমাদের পূর্বসূরি ইমামদের জীবনীর দিকে একটু নজর দেয়া। কিভাবে তাদের জীবনে ইলম, ইবাদত, যুহদ ও জিহাদ সবকিছুর সমাহার ঘটেছিল? একটু ফিকির করা উচিৎ। হে আল্লাহ! পূর্বসূরিদের পথে চলার তাওফিক আমাদের দাও।
***
Comment