ইসলামের তারকাগণ।।পর্ব-২২।। দাগিস্তানের সিংহ ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ (চতুর্থ কিস্তি)
(সংক্ষিপ্ত পরিচিতি) ইমাম শামিল- একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। ১৮৩৪ সাল থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া এক লড়াকু যোদ্ধার নাম ইমাম শামিল। আগ্রাসী রাশিয়ার অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্রও অকেজো হয়ে পড়েছিল যে মহান বীরের নগন্য ও আদিযুগের যুদ্ধাস্ত্রের সামনে, তিনিই হলেন ইমাম শামিল। রাশিয়ার রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে অজপাড়া গাঁয়ের কুঁড়েঘর পর্যন্ত সবার কাছেই যিনি “শেরে দাগিস্তান” বা দাগিস্তানের সিংহ নামে পরিচিত, তিনিই ইমাম শামিল। ইতিহাসে আজও তিনি আযাদীর শ্রেষ্ঠ সিপাহসালার হিসেবেই প্রসিদ্ধ। আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের জনক মনে করা হয় তাঁকে। যুগের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও অভিনব রণকৌশল মুখ থুবড়ে পড়েছিল এই মহান বীরের সামনে। সন্ত্রাসী রাশিয়ার এমন কেউ ছিল না, যে ইমাম শামিলকে ভয় করত না। রাশিয়ার সৈনিকদের জন্য তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। রাশিয়ার মায়েরা নিজ সন্তানদের ঘুম পাড়াত ইমাম শামিলের নাম শুনিয়ে।
পূর্ব প্রকাশের পর…
আবারও জিহাদের ডাক:
২৯-শে আগস্ট, টানা দুই মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ঐতিহাসিক উখলগুর যুদ্ধ শেষ হয়। এই যুদ্ধে ইমাম শামিলের অভাবনীয় ক্ষতি হয়ে যায়। প্রায় সব মুজাহিদ শহীদ হয়ে যান। ইমাম শামিলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অল্প যে কয়জন নদী সাঁতরে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন তারা সময়ক্ষেপণ না করে পুনরায় জিহাদের তাবলীগে বেরিয়ে পড়েন৷ সমস্ত দাগিস্তানে রুশদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় তন্ন-তন্ন করে ইমাম শামিল ও তাঁর বেঁচে থাকা সৈনিকদের খোঁজা হয়। তারাও কৌশল অবলম্বন করেন। সারাদিন কোন ঝোপঝাড়ে আত্মগোপন করে থাকেন আর রাতের বেলায় মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জিহাদের তাবলীগ করেন। দাগিস্তানের জনগণ এতদিন পর্যন্ত ইমাম শামিল ও তাঁর নায়েবদের কথায় তেমন কোন কর্ণপাত করেনি। কিন্তু এখন তাদের উপর রাশিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা নিজেরাই রুশ সেনাদের বর্বরতা ও নৃশংসতার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে গেছে। তাই তারা সহজেই জিহাদের দাওয়াত গ্রহণ করতে শুরু করেছে। যে সকল গোত্রপতিরা এতদিন পর্যন্ত ইমাম শামিলের বিরোধিতা করে আসছিল তারা এখন খুব সহজেই বুঝে যান যে, রাশিয়ানদের কাছে তাদের মূল্য গোলামের সমতুল্যও নয়; এরচেয়েও কম। তাই তারাও ইমাম শামিলের দাওয়াত গ্রহণ করে জিহাদের পণ নেন।
ইমাম শামিল বুঝতে পারলেন যে, দাগিস্তানে অবস্থান করা তার জন্য মোটেই সমীচীন নয়৷ যে কোন সময় গ্রেফতার হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তাই তিনি চেচনিয়া চলে যান। সেখানে তাঁর শৈশবের কিছু সহপাঠী ছিলেন এবং মোল্লা মুহাম্মদের কিছু মুরীদও ছিলেন, তারা সকলেই ইমাম শামিলের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। তিনি তাদেরকে সাথে নিয়ে জিহাদের তাবলীগ করতে শুরু করেন। কখনো কারো বাড়ির আঙ্গিনায়, কখনো কোন উন্মুক্ত ময়দানে আবার কখনো কোন পাহাড়ের গুহায়-এভাবেই কাটতে থাকে তাঁর দিন-রাত। আল্লাহর ইচ্ছায় দাওয়াতের কাজে তিনি সফলতার স্বাক্ষর রাখেন।
মাত্র ৬ মাসের মাথায় তাঁর দাওয়াত ব্যাপকতা লাভ করে। তিনি দাগিস্তান ও চেচনিয়ার অবিসংবাদিত নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং চেচনিয়া থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে জিহাদের ডাক দেন। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দাগিস্তান ও চেচনিয়ায় দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে তাঁর এই জিহাদের ডাক। পুরো ককেশাসে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মানুষের জীবনে পরাধীনতা না আসলে স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বুঝে আসে না। তাদের বেলায়ও এমনটিই ঘটেছিল। ইমাম শামিল পূর্বের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তবে তিনি এবার যুদ্ধ-কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। তাঁর বাহিনী গোপনে হানা দিয়ে রুশ অফিসারদের বন্দী করতে শুরু করে। সাধারণ সৈনিকদের চেয়ে তিনি এবার বেছে বেছে অফিসারদের হত্যা ও বন্দী করার নীতি গ্রহণ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল দু’টি,
১৷ অফিসাররা নিহত বা বন্দী হলে সাধারণ সৈনিকদের মনোবল ভেঙে যায়। সৈন্যদের মাঝে শৃঙ্খলা ঠিক থাকে না।
২৷ গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদের বন্দী করতে পারলে এদের বিনিময়ে ছেলে জামালুদ্দীনকে ছাড়িয়ে আনা যাবে। যিনি পরবর্তীতে ইমাম শামিলের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে জিহাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।
মুজাহিদদের এই নতুন জাগরণ আর ইমাম শামিলের এই নতুন কৌশলে রুশ-সেনাদের, বিশেষত অফিসারদের পিলে চমকে যায়। এতদিন পর্যন্ত ইমাম শামিলের নেতৃত্ব ছিল শুধু দাগিস্তানে আর এখন চেচনিয়ার স্বাধীনতাকামীরাও তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। রুশসেনাদের জন্য এটাও ছিল অনেক বড় উদ্বেগের কারণ। জার নিকোলাস ক্রোধে ফেটে পড়ে। ইমাম শামিল পুনরায় জড়িয়ে পড়েন দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধে।
প্রতিশোধ:
ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ এবার তার ক্যাম্প তৈরি করেন দারগীন নামক স্থানে৷ তবে পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবার দারগীন ক্যাম্প ছাড়াও অতিরিক্ত আরও দুটি ক্যাম্প তৈরি করে রাখেন। যাতে, রুশ সেনাদের দ্বারা একটি ক্যাম্প অবরুদ্ধ হলেও মুজাহিদদের বড় একটা অংশ অবরোধের বাহিরে থেকে যায় এবং পিছন থেকে রুশ ফৌজের উপর গেরিলা হামলা পরিচালনা করা যায়। এছাড়াও ইমাম শামিলের আরেকটি নতুন কৌশল এই ছিল যে, তিনি নিজের অবস্থান অস্পষ্ট রাখতেন। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানত না যে তিনি কোথায় আছেন, কোন এক স্থানে তিনি বেশিদিন অবস্থান করতেন না।
তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে রুশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম। মুজাহিদদের প্রবল আক্রমণের মুখে রুশ সেনাদের অধিকৃত দুর্গগুলো এক এক করে মুজাহিদদের দখলে আসতে থাকে। চেচনিয়া ও দাগিস্তান, সবখানেই মুজাহিদদের শক্তিশালী আক্রমণ পরিচালিত হয়। রুশ সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই নতুন উত্থান তারা কীভাবে ঠেকাবে? উখলগুর সেনাপতি গ্রেবকে আবার দায়িত্ব দেওয়া হয় দারগীন অবরোধের। ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে গ্রেব দারগীন অভিমুখে রওয়ানা হয়। কিন্তু এবার তাকে ছেড়ে দেননি ইমাম শামিল। পথেই তার বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গেরিলা আক্রমণের শিকার হয়। ফলে দারগীন পর্যন্ত যাওয়ার সাহস তার হয়নি। মাঝপথ থেকেই সে ফিরতি পথ ধরে। অধিকাংশ সৈন্য ও যাবতীয় যুদ্ধ-সামগ্রী ফেলে রেখে পলায়ন করে। রাগ,ক্ষোভ আর আফসোসে সেনাপতি গ্রেব নিজেই নিজের প্রত্যাহার দাবী করে। দাগিস্তান ছেড়ে যখন সে সেন্টপিটার্সবার্গের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তখন ইমাম শামিলের একটি পত্র এসে পৌঁছে তার কাছে। সেটাতে লেখা ছিল:
“উখলগুর ময়দানে তুমি আমার যে ক্ষতি করেছে সেটার হিসাব-নিকাশ তো এখনো শেষ হয়নি। আর যে প্রতারণা তুমি আমার সাথে করেছো সেটার হিসাব তো শুরুই করিনি! তোমার এখানে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা জরুরী ছিল। এই পত্রের পরিবর্তে একটি ধারালো খঞ্জরও বিদ্ধ করতে পারতাম তোমার বুকে৷ কিন্তু আমরা প্রতারণা করিনা৷ কারণ, আমরা তোমাদের মত অসভ্য নই”।
নতুন সেনাপতি হয়ে আসে নেডহার্ট। সে এসেই ইমাম শামিলের মাথার মূল্য ধার্য করে ৪৫ হাজার রুবেল। এটা শুনে ইমাম তার নিকট একটি পত্র পাঠান। যেটাতে তিনি লেখেন “তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ, তোমার পূর্বে আমার মাথার এত বেশি মূল্য আর কেউ ধার্য করেনি। তবে আমি কিন্তু তোমার মাথার বিনিময়ে কাউকে একটা কানাকড়িও দেব না। কেউ যদি তোমাদের জারের মাথাও আমার কাছে নিয়ে আসে তাহলে তাকেও একটা কানাকড়ি আমি দেব না। কারণ, একটা কানাকড়িও জারের মাথার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান”।
এরই মধ্যে দারগীন অভিমুখে আরও কয়েকবার সেনা প্রেরণ করা হয়। কিন্তু মুজাহিদদের তীব্র আক্রমণের মুখে সবগুলো অভিযান ব্যর্থ হয়৷ ১৯৪৫ সাল নাগাদ ইমাম শামিল ওই সকল দুর্গ বিজয় করে নিজ শাসনের অধীন করেন যেগুলো রুশ সেনারা দখল করে নিয়েছিল। রুশ সেনারা ধীরে ধীরে দাগিস্তান থেকে পিছু হটে৷
রাশিয়ার ঘরে ঘরে শেরে দাগিস্তানের আলোচনা:
জার নিকোলাস, তার মন্ত্রীপরিষদ, সেনাপতি, লাখ লাখ রুশ সৈনিক ও রাশিয়ার জনসাধারণের কাছে ইমাম শামিল এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম হয়ে উঠে। রাশিয়ার এমন কোন পরিবার নেই, যাদের কেউ না কেউ ককেশাসের এই যুদ্ধে নিহত বা আহত হয়নি বা এখানে লড়াইরত নেই৷ সমকালীন ইতিহাসে ইমাম শামিলের দৃষ্টান্ত বিরল। ইমাম শামিলের বিরুদ্ধে লড়াই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রুশ ঐতিহাসিক জেনারেল কাদিউফ লেখেছে, “ককেশাস অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ে আমাদের এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিহত হয় যে,তা ভারতবর্ষ থেকে জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জয় করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল”।
রাশিয়ার প্রতিটি ঘরে ঘরে ইমাম শামিলের আলোচনা শুরু হয়। সকলের কাছেই ইমাম শামিল ভয় ও শ্রদ্ধার পাত্র। সকলেই ইমাম শামিলকে ভয় যেমন পায়, তেমনি তাকে এক নজর দেখতেও চায়। রুশ সেনাপ্রধান, সাধারণ সৈনিক ও জনসাধারণ- কেউ-ই এই পর্যন্ত ইমাম শামিলকে স্বচক্ষে দেখতে পায়নি৷ একবার সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার সুবাদে কলগনু নামক এক সেনাপতি শুধু দেখেছিল। এই জন্য ইমামকে এক নজর দেখার আকাঙ্খা সবার মাঝেই ছিল।
রাশিয়ার বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক লিও টলষ্টয় (Leo Tolstoy)। অল্পবয়সেই তার মা-বাবা মারা যায় এবং স্বীয় খালার কাছেই সে প্রতিপালিত হতে থাকে। খালার শখ ছিল যে, আমার ভাগিনা শামিলকে দেখবে। টলষ্টয়েরও আগ্রহ ছিল শামিলকে দেখার। এই উদ্দেশ্যে সে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে ককেশাসে যুদ্ধ করতে যায়। ১৮৫১ সালের গ্রীষ্মকালে সে ককেশাস পৌঁছে। দীর্ঘ চার বছর সে ইমাম শামিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তাকে দেখার সুযোগ তার হয়নি। ইমাম শামিলের একসময়কার প্রধান উপদেষ্টা হাজী মুরাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। হাজী মুরাদ তখন রাশিয়ানদের ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। কিন্তু কাঙ্খিত শামিলকে দেখার সুযোগ তার হয়নি। অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়েই সে রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তন করে। পরবর্তীতে সে ককেশাস নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছে। “War and Peace (যুদ্ধ ও শান্তি), Hadji Murad (হাজী মুরাদ)” ককেশাসের বন্দী ও কাস্ক, জীবন সবেমাত্র শুরু হল” নামক গ্রন্থগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ছেলে জামালুদ্দীন:
উখলগুর রণাঙ্গন থেকে ইমাম শামিলের শিশু সন্তান জামালুদ্দীনকে প্রতারণার মাধ্যমে ছিনিয়ে নেয় সেনাপতি গ্রেব। তাকে সরাসরি রাশিয়ার সম্রাট জার নিকোলাসের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জামালুদ্দীনকে নিয়ে জারের অনেক বড় স্বপ্ন। সে তাকে শাহী মর্যাদা দিয়ে লালন পালন করতে থাকে৷ শাহী স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেয়৷ রাজপুত্রের মতই তাকে সবধরনের অধিকার দিয়ে বড় করে৷ জারের স্বপ্ন ছিল, জামালুদ্দীন বড় হলে তাকে জারের পক্ষ থেকে ককেশাসের শাসনকর্তারূপে পাঠানো হবে। ইমাম শামিলের প্রতি অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধার দরুন কোহেস্তানীরা জামালুদ্দীনের নেতৃত্ব মেনে নেবে আর জামালুদ্দীন রক্তে-মাংসে কোহেস্তানী হলেও চিন্তা-চেতনায় হবে রাশিয়ান। তাকে দিয়ে জার নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখে।
দিন যেতে থাকে। ১৮৩৯ সালে প্রতারণার শিকার হয়ে গ্রেফতার হওয়া ৮ বছরের শিশু জামালুদ্দীন টগবগে তরুণে পরিণত হয়। বাবার সঙ্গে থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই সে একজন লড়াকু যোদ্ধার শিক্ষা পেত বাবার থেকে। কিন্তু রাশিয়ার রাজমহলে তাকে যুদ্ধ শেখানো হয়নি। তার মগজধোলাই করা হয়। তাকে বোঝানো হয়, ককেশাসে যারা মহান জারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তারা বিদ্রোহী।
এদিকে ইমাম শামিলও বসে নেই। তিনি একের পর এক সেনাপতিদের বন্দী করছেন। কিন্তু জার এরকম হাজারটা সেনাপতির বিনিময়েও জামালুদ্দীনকে ফেরৎ দিতে নারাজ। ইমাম শামিল এবার শেষ চেষ্টা চালালেন। জর্জিয়ার সম্রাট জর্জ বারো-এর দুই কন্যাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন তিনি। জার নিকোলাস এবার চরম বিপাকে পড়ে যায়৷ এদেরকে মুক্ত করতে হলে জামালুদ্দীনকে ফেরৎ দেওয়ার কোন বিকল্প নেই। আবার শাহজাদীদের ফেরৎ না আনলে জর্জিয়ায় বড় ধরনের বিদ্রোহের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর জর্জিয়া হাতছাড়া হয়ে গেলে এই দক্ষিণাঞ্চলে রুশ আধিপত্যের অবসান ঘটে যাবে চিরতরে। কারণ, ইমাম শামিলের উপর্যুপরি তীব্র আক্রমণের ফলে ইতিমধ্যেই দাগিস্তান ও চেচনিয়া থেকে তার বাহিনী পিছনে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে রুশ বাহিনীর মূল কেন্দ্র জর্জিয়ার তিবলীসে। এটাও যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে এতদিনের সব শ্রম পণ্ড হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে জার নিকোলাস পাগলপারা হয়ে যায়। তার এতদিনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে চলে। উপায়ান্তর না দেখে জামালুদ্দীনকে ফেরৎ দেয় জার নিকোলাস। ১৮৫৫ সালের ১১-মার্চ জামালুদ্দীন ফিরে আসে বাবার কাছে। ইমামের স্ত্রী ফাতেমা ছেলের বিরহে কাঁদতে কাঁদতে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন ১৮৪৫ সালেই। দীর্ঘ ১৫ বছর পর পিতা-পুত্রের এই মিলনে আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। উপস্থিত দর্শকরা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, রাশিয়ার রাজপ্রাসাদে বেড়ে ওঠা জামালুদ্দীন এই বন্য পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি৷ অল্পদিনেই মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। দিন দিন তার অবস্থা অবনতির দিকেই যেতে থাকে। অবশেষে মাত্র চার মাসের মাথায় জামালুদ্দীন দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়৷ যুদ্ধের ময়দান তখন উত্তপ্ত ছিল। তাই ইমাম শামিল পুত্রের তেমন কোন খোঁজখবর নিতে পারেন নি। পুত্রের ভালোবাসার উপর তিনি সর্বদায় দ্বীনের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন।
চলবে…. ইনশাআল্লাহ
লেখক : মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
তথ্যসূত্র :
(১) https://tinyurl.com/ypuc473s
(২) https://tinyurl.com/bdf5net7
(৩) https://tinyurl.com/ycy5tmep
(৪) যুলফিকার।
পড়ুন আগের পর্বগুলো-
প্রথম কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/06/12/57525/
দ্বিতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/08/57940/
তৃতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/16/58004/
(সংক্ষিপ্ত পরিচিতি) ইমাম শামিল- একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। ১৮৩৪ সাল থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া এক লড়াকু যোদ্ধার নাম ইমাম শামিল। আগ্রাসী রাশিয়ার অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্রও অকেজো হয়ে পড়েছিল যে মহান বীরের নগন্য ও আদিযুগের যুদ্ধাস্ত্রের সামনে, তিনিই হলেন ইমাম শামিল। রাশিয়ার রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে অজপাড়া গাঁয়ের কুঁড়েঘর পর্যন্ত সবার কাছেই যিনি “শেরে দাগিস্তান” বা দাগিস্তানের সিংহ নামে পরিচিত, তিনিই ইমাম শামিল। ইতিহাসে আজও তিনি আযাদীর শ্রেষ্ঠ সিপাহসালার হিসেবেই প্রসিদ্ধ। আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের জনক মনে করা হয় তাঁকে। যুগের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও অভিনব রণকৌশল মুখ থুবড়ে পড়েছিল এই মহান বীরের সামনে। সন্ত্রাসী রাশিয়ার এমন কেউ ছিল না, যে ইমাম শামিলকে ভয় করত না। রাশিয়ার সৈনিকদের জন্য তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। রাশিয়ার মায়েরা নিজ সন্তানদের ঘুম পাড়াত ইমাম শামিলের নাম শুনিয়ে।
পূর্ব প্রকাশের পর…
আবারও জিহাদের ডাক:
২৯-শে আগস্ট, টানা দুই মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ঐতিহাসিক উখলগুর যুদ্ধ শেষ হয়। এই যুদ্ধে ইমাম শামিলের অভাবনীয় ক্ষতি হয়ে যায়। প্রায় সব মুজাহিদ শহীদ হয়ে যান। ইমাম শামিলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অল্প যে কয়জন নদী সাঁতরে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন তারা সময়ক্ষেপণ না করে পুনরায় জিহাদের তাবলীগে বেরিয়ে পড়েন৷ সমস্ত দাগিস্তানে রুশদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় তন্ন-তন্ন করে ইমাম শামিল ও তাঁর বেঁচে থাকা সৈনিকদের খোঁজা হয়। তারাও কৌশল অবলম্বন করেন। সারাদিন কোন ঝোপঝাড়ে আত্মগোপন করে থাকেন আর রাতের বেলায় মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জিহাদের তাবলীগ করেন। দাগিস্তানের জনগণ এতদিন পর্যন্ত ইমাম শামিল ও তাঁর নায়েবদের কথায় তেমন কোন কর্ণপাত করেনি। কিন্তু এখন তাদের উপর রাশিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা নিজেরাই রুশ সেনাদের বর্বরতা ও নৃশংসতার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে গেছে। তাই তারা সহজেই জিহাদের দাওয়াত গ্রহণ করতে শুরু করেছে। যে সকল গোত্রপতিরা এতদিন পর্যন্ত ইমাম শামিলের বিরোধিতা করে আসছিল তারা এখন খুব সহজেই বুঝে যান যে, রাশিয়ানদের কাছে তাদের মূল্য গোলামের সমতুল্যও নয়; এরচেয়েও কম। তাই তারাও ইমাম শামিলের দাওয়াত গ্রহণ করে জিহাদের পণ নেন।
ইমাম শামিল বুঝতে পারলেন যে, দাগিস্তানে অবস্থান করা তার জন্য মোটেই সমীচীন নয়৷ যে কোন সময় গ্রেফতার হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তাই তিনি চেচনিয়া চলে যান। সেখানে তাঁর শৈশবের কিছু সহপাঠী ছিলেন এবং মোল্লা মুহাম্মদের কিছু মুরীদও ছিলেন, তারা সকলেই ইমাম শামিলের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। তিনি তাদেরকে সাথে নিয়ে জিহাদের তাবলীগ করতে শুরু করেন। কখনো কারো বাড়ির আঙ্গিনায়, কখনো কোন উন্মুক্ত ময়দানে আবার কখনো কোন পাহাড়ের গুহায়-এভাবেই কাটতে থাকে তাঁর দিন-রাত। আল্লাহর ইচ্ছায় দাওয়াতের কাজে তিনি সফলতার স্বাক্ষর রাখেন।
মাত্র ৬ মাসের মাথায় তাঁর দাওয়াত ব্যাপকতা লাভ করে। তিনি দাগিস্তান ও চেচনিয়ার অবিসংবাদিত নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং চেচনিয়া থেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে জিহাদের ডাক দেন। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দাগিস্তান ও চেচনিয়ায় দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে তাঁর এই জিহাদের ডাক। পুরো ককেশাসে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মানুষের জীবনে পরাধীনতা না আসলে স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বুঝে আসে না। তাদের বেলায়ও এমনটিই ঘটেছিল। ইমাম শামিল পূর্বের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তবে তিনি এবার যুদ্ধ-কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। তাঁর বাহিনী গোপনে হানা দিয়ে রুশ অফিসারদের বন্দী করতে শুরু করে। সাধারণ সৈনিকদের চেয়ে তিনি এবার বেছে বেছে অফিসারদের হত্যা ও বন্দী করার নীতি গ্রহণ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল দু’টি,
১৷ অফিসাররা নিহত বা বন্দী হলে সাধারণ সৈনিকদের মনোবল ভেঙে যায়। সৈন্যদের মাঝে শৃঙ্খলা ঠিক থাকে না।
২৷ গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদের বন্দী করতে পারলে এদের বিনিময়ে ছেলে জামালুদ্দীনকে ছাড়িয়ে আনা যাবে। যিনি পরবর্তীতে ইমাম শামিলের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে জিহাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।
মুজাহিদদের এই নতুন জাগরণ আর ইমাম শামিলের এই নতুন কৌশলে রুশ-সেনাদের, বিশেষত অফিসারদের পিলে চমকে যায়। এতদিন পর্যন্ত ইমাম শামিলের নেতৃত্ব ছিল শুধু দাগিস্তানে আর এখন চেচনিয়ার স্বাধীনতাকামীরাও তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। রুশসেনাদের জন্য এটাও ছিল অনেক বড় উদ্বেগের কারণ। জার নিকোলাস ক্রোধে ফেটে পড়ে। ইমাম শামিল পুনরায় জড়িয়ে পড়েন দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধে।
প্রতিশোধ:
ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ এবার তার ক্যাম্প তৈরি করেন দারগীন নামক স্থানে৷ তবে পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবার দারগীন ক্যাম্প ছাড়াও অতিরিক্ত আরও দুটি ক্যাম্প তৈরি করে রাখেন। যাতে, রুশ সেনাদের দ্বারা একটি ক্যাম্প অবরুদ্ধ হলেও মুজাহিদদের বড় একটা অংশ অবরোধের বাহিরে থেকে যায় এবং পিছন থেকে রুশ ফৌজের উপর গেরিলা হামলা পরিচালনা করা যায়। এছাড়াও ইমাম শামিলের আরেকটি নতুন কৌশল এই ছিল যে, তিনি নিজের অবস্থান অস্পষ্ট রাখতেন। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানত না যে তিনি কোথায় আছেন, কোন এক স্থানে তিনি বেশিদিন অবস্থান করতেন না।
তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে রুশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম। মুজাহিদদের প্রবল আক্রমণের মুখে রুশ সেনাদের অধিকৃত দুর্গগুলো এক এক করে মুজাহিদদের দখলে আসতে থাকে। চেচনিয়া ও দাগিস্তান, সবখানেই মুজাহিদদের শক্তিশালী আক্রমণ পরিচালিত হয়। রুশ সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই নতুন উত্থান তারা কীভাবে ঠেকাবে? উখলগুর সেনাপতি গ্রেবকে আবার দায়িত্ব দেওয়া হয় দারগীন অবরোধের। ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে গ্রেব দারগীন অভিমুখে রওয়ানা হয়। কিন্তু এবার তাকে ছেড়ে দেননি ইমাম শামিল। পথেই তার বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গেরিলা আক্রমণের শিকার হয়। ফলে দারগীন পর্যন্ত যাওয়ার সাহস তার হয়নি। মাঝপথ থেকেই সে ফিরতি পথ ধরে। অধিকাংশ সৈন্য ও যাবতীয় যুদ্ধ-সামগ্রী ফেলে রেখে পলায়ন করে। রাগ,ক্ষোভ আর আফসোসে সেনাপতি গ্রেব নিজেই নিজের প্রত্যাহার দাবী করে। দাগিস্তান ছেড়ে যখন সে সেন্টপিটার্সবার্গের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তখন ইমাম শামিলের একটি পত্র এসে পৌঁছে তার কাছে। সেটাতে লেখা ছিল:
“উখলগুর ময়দানে তুমি আমার যে ক্ষতি করেছে সেটার হিসাব-নিকাশ তো এখনো শেষ হয়নি। আর যে প্রতারণা তুমি আমার সাথে করেছো সেটার হিসাব তো শুরুই করিনি! তোমার এখানে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা জরুরী ছিল। এই পত্রের পরিবর্তে একটি ধারালো খঞ্জরও বিদ্ধ করতে পারতাম তোমার বুকে৷ কিন্তু আমরা প্রতারণা করিনা৷ কারণ, আমরা তোমাদের মত অসভ্য নই”।
নতুন সেনাপতি হয়ে আসে নেডহার্ট। সে এসেই ইমাম শামিলের মাথার মূল্য ধার্য করে ৪৫ হাজার রুবেল। এটা শুনে ইমাম তার নিকট একটি পত্র পাঠান। যেটাতে তিনি লেখেন “তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ, তোমার পূর্বে আমার মাথার এত বেশি মূল্য আর কেউ ধার্য করেনি। তবে আমি কিন্তু তোমার মাথার বিনিময়ে কাউকে একটা কানাকড়িও দেব না। কেউ যদি তোমাদের জারের মাথাও আমার কাছে নিয়ে আসে তাহলে তাকেও একটা কানাকড়ি আমি দেব না। কারণ, একটা কানাকড়িও জারের মাথার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান”।
এরই মধ্যে দারগীন অভিমুখে আরও কয়েকবার সেনা প্রেরণ করা হয়। কিন্তু মুজাহিদদের তীব্র আক্রমণের মুখে সবগুলো অভিযান ব্যর্থ হয়৷ ১৯৪৫ সাল নাগাদ ইমাম শামিল ওই সকল দুর্গ বিজয় করে নিজ শাসনের অধীন করেন যেগুলো রুশ সেনারা দখল করে নিয়েছিল। রুশ সেনারা ধীরে ধীরে দাগিস্তান থেকে পিছু হটে৷
রাশিয়ার ঘরে ঘরে শেরে দাগিস্তানের আলোচনা:
জার নিকোলাস, তার মন্ত্রীপরিষদ, সেনাপতি, লাখ লাখ রুশ সৈনিক ও রাশিয়ার জনসাধারণের কাছে ইমাম শামিল এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম হয়ে উঠে। রাশিয়ার এমন কোন পরিবার নেই, যাদের কেউ না কেউ ককেশাসের এই যুদ্ধে নিহত বা আহত হয়নি বা এখানে লড়াইরত নেই৷ সমকালীন ইতিহাসে ইমাম শামিলের দৃষ্টান্ত বিরল। ইমাম শামিলের বিরুদ্ধে লড়াই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রুশ ঐতিহাসিক জেনারেল কাদিউফ লেখেছে, “ককেশাস অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ে আমাদের এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিহত হয় যে,তা ভারতবর্ষ থেকে জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জয় করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল”।
রাশিয়ার প্রতিটি ঘরে ঘরে ইমাম শামিলের আলোচনা শুরু হয়। সকলের কাছেই ইমাম শামিল ভয় ও শ্রদ্ধার পাত্র। সকলেই ইমাম শামিলকে ভয় যেমন পায়, তেমনি তাকে এক নজর দেখতেও চায়। রুশ সেনাপ্রধান, সাধারণ সৈনিক ও জনসাধারণ- কেউ-ই এই পর্যন্ত ইমাম শামিলকে স্বচক্ষে দেখতে পায়নি৷ একবার সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার সুবাদে কলগনু নামক এক সেনাপতি শুধু দেখেছিল। এই জন্য ইমামকে এক নজর দেখার আকাঙ্খা সবার মাঝেই ছিল।
রাশিয়ার বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক লিও টলষ্টয় (Leo Tolstoy)। অল্পবয়সেই তার মা-বাবা মারা যায় এবং স্বীয় খালার কাছেই সে প্রতিপালিত হতে থাকে। খালার শখ ছিল যে, আমার ভাগিনা শামিলকে দেখবে। টলষ্টয়েরও আগ্রহ ছিল শামিলকে দেখার। এই উদ্দেশ্যে সে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে ককেশাসে যুদ্ধ করতে যায়। ১৮৫১ সালের গ্রীষ্মকালে সে ককেশাস পৌঁছে। দীর্ঘ চার বছর সে ইমাম শামিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তাকে দেখার সুযোগ তার হয়নি। ইমাম শামিলের একসময়কার প্রধান উপদেষ্টা হাজী মুরাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। হাজী মুরাদ তখন রাশিয়ানদের ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। কিন্তু কাঙ্খিত শামিলকে দেখার সুযোগ তার হয়নি। অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়েই সে রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তন করে। পরবর্তীতে সে ককেশাস নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছে। “War and Peace (যুদ্ধ ও শান্তি), Hadji Murad (হাজী মুরাদ)” ককেশাসের বন্দী ও কাস্ক, জীবন সবেমাত্র শুরু হল” নামক গ্রন্থগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ছেলে জামালুদ্দীন:
উখলগুর রণাঙ্গন থেকে ইমাম শামিলের শিশু সন্তান জামালুদ্দীনকে প্রতারণার মাধ্যমে ছিনিয়ে নেয় সেনাপতি গ্রেব। তাকে সরাসরি রাশিয়ার সম্রাট জার নিকোলাসের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জামালুদ্দীনকে নিয়ে জারের অনেক বড় স্বপ্ন। সে তাকে শাহী মর্যাদা দিয়ে লালন পালন করতে থাকে৷ শাহী স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেয়৷ রাজপুত্রের মতই তাকে সবধরনের অধিকার দিয়ে বড় করে৷ জারের স্বপ্ন ছিল, জামালুদ্দীন বড় হলে তাকে জারের পক্ষ থেকে ককেশাসের শাসনকর্তারূপে পাঠানো হবে। ইমাম শামিলের প্রতি অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধার দরুন কোহেস্তানীরা জামালুদ্দীনের নেতৃত্ব মেনে নেবে আর জামালুদ্দীন রক্তে-মাংসে কোহেস্তানী হলেও চিন্তা-চেতনায় হবে রাশিয়ান। তাকে দিয়ে জার নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখে।
দিন যেতে থাকে। ১৮৩৯ সালে প্রতারণার শিকার হয়ে গ্রেফতার হওয়া ৮ বছরের শিশু জামালুদ্দীন টগবগে তরুণে পরিণত হয়। বাবার সঙ্গে থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই সে একজন লড়াকু যোদ্ধার শিক্ষা পেত বাবার থেকে। কিন্তু রাশিয়ার রাজমহলে তাকে যুদ্ধ শেখানো হয়নি। তার মগজধোলাই করা হয়। তাকে বোঝানো হয়, ককেশাসে যারা মহান জারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তারা বিদ্রোহী।
এদিকে ইমাম শামিলও বসে নেই। তিনি একের পর এক সেনাপতিদের বন্দী করছেন। কিন্তু জার এরকম হাজারটা সেনাপতির বিনিময়েও জামালুদ্দীনকে ফেরৎ দিতে নারাজ। ইমাম শামিল এবার শেষ চেষ্টা চালালেন। জর্জিয়ার সম্রাট জর্জ বারো-এর দুই কন্যাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন তিনি। জার নিকোলাস এবার চরম বিপাকে পড়ে যায়৷ এদেরকে মুক্ত করতে হলে জামালুদ্দীনকে ফেরৎ দেওয়ার কোন বিকল্প নেই। আবার শাহজাদীদের ফেরৎ না আনলে জর্জিয়ায় বড় ধরনের বিদ্রোহের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর জর্জিয়া হাতছাড়া হয়ে গেলে এই দক্ষিণাঞ্চলে রুশ আধিপত্যের অবসান ঘটে যাবে চিরতরে। কারণ, ইমাম শামিলের উপর্যুপরি তীব্র আক্রমণের ফলে ইতিমধ্যেই দাগিস্তান ও চেচনিয়া থেকে তার বাহিনী পিছনে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে রুশ বাহিনীর মূল কেন্দ্র জর্জিয়ার তিবলীসে। এটাও যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে এতদিনের সব শ্রম পণ্ড হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে জার নিকোলাস পাগলপারা হয়ে যায়। তার এতদিনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে চলে। উপায়ান্তর না দেখে জামালুদ্দীনকে ফেরৎ দেয় জার নিকোলাস। ১৮৫৫ সালের ১১-মার্চ জামালুদ্দীন ফিরে আসে বাবার কাছে। ইমামের স্ত্রী ফাতেমা ছেলের বিরহে কাঁদতে কাঁদতে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন ১৮৪৫ সালেই। দীর্ঘ ১৫ বছর পর পিতা-পুত্রের এই মিলনে আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। উপস্থিত দর্শকরা কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, রাশিয়ার রাজপ্রাসাদে বেড়ে ওঠা জামালুদ্দীন এই বন্য পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি৷ অল্পদিনেই মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। দিন দিন তার অবস্থা অবনতির দিকেই যেতে থাকে। অবশেষে মাত্র চার মাসের মাথায় জামালুদ্দীন দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়৷ যুদ্ধের ময়দান তখন উত্তপ্ত ছিল। তাই ইমাম শামিল পুত্রের তেমন কোন খোঁজখবর নিতে পারেন নি। পুত্রের ভালোবাসার উপর তিনি সর্বদায় দ্বীনের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন।
চলবে…. ইনশাআল্লাহ
লেখক : মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
তথ্যসূত্র :
(১) https://tinyurl.com/ypuc473s
(২) https://tinyurl.com/bdf5net7
(৩) https://tinyurl.com/ycy5tmep
(৪) যুলফিকার।
পড়ুন আগের পর্বগুলো-
প্রথম কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/06/12/57525/
দ্বিতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/08/57940/
তৃতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/16/58004/
Comment