হিন্দুস্তানের মুফতীয়ে আ'যম
হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ)
জন্মঃ ১৮৭৫ ঈসায়ী - মৃত্যুঃ ১৯৫২ ঈসায়ী
হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ)
জন্মঃ ১৮৭৫ ঈসায়ী - মৃত্যুঃ ১৯৫২ ঈসায়ী
উপমহাদেশের রক্তিম ইতিহাসের পাতায় একজন বীর মুজাহিদ এবং অদ্বিতীয় ফকীহ এর উজ্জল চেহারা বিদ্যমান। তাঁর উজ্জ্বল কীর্তি এবং অনুপম চরিত্রের দীপ্তি ইতিহাসের পত্র-পল্লবের ছত্রে ছত্রে আজও ভাস্কর হয়ে আছে। হালকা গড়ন, বন শ্মশ্রু, বিস্তৃত শীর, মাঝারি উচ্চতা, ঠান্ডা মেজায, অকৃত্রিম ও স্বল্প ভাষী, সুদর্শন চেহারা এসবের প্রলেপ দিয়েই হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ্ (রহঃ) -এর দেহ গড়া। এসব অনুপম বৈশিষ্টাবলী যেন তার গোটা দেহ জুড়ে বিচ্ছুরিত হতে থাকে প্রতিনিয়ত।
হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) শাহজাহানপুর (রোহিলা খন্ড, ইউ.পি.ইন্ডিয়া) এর “যই” নামক এলাকায় ১২৯২ হিজরী সনে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের মাত্র পাঁচ বৎসরের মাথায় তিনি পবিত্র কুরআনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। এরপর সেখানেই তিনি মাওলানা ই'যায হাছান (রহঃ) -এর মাদ্রাসায়ে ই'যাযিয়ায় পর্যায়ক্রমে আরবী কিতাবাদী শিখতে শুরু করেন। ১৫ বৎসর বয়সে তিনি জ্ঞান-পিপাসা নিবারণের জন্য মুরাদাবাদের শাহী মাদ্রাসায় চলে যান। সেখানে হযরত মাওলানা আবদুল আলী মিরাঠী (রহঃ) -এর নিকট তিনি ইলমে হাদীসের জ্ঞান অর্জন শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাছান (রহঃ) -এর নিকট এর সমাপ্তি টানেন। ছাত্র জীবন থেকে ফারেগ হওয়ার পর হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) মাওলানা দেহলভী (রহঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা- মাদ্রাসায়ে আইনুল উলুমে (তৎকালীন) মাত্র ১৫ টাকা বেতনে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই ব্যস্ত সময় অতিবাহনের ফাঁকে তিনি কাদিয়ানী মতবাদ ও কাদিয়ানী ফেতনার বিরুদ্ধে 'আল বুরহান' নামে একটি মাসিক পত্রিকা করেন। এই মাদ্রাসায় অধ্যাপনাকালে তিনি খৃষ্টান ও আরিয়া সম্প্রদায়ের সাথে এতিহাসিক দু'টি বিতর্ক অনুষ্ঠান করে ইসলামের সততা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দেখান । খৃষ্টানদের সাথে তার বিতর্ক অনুষ্ঠানের পর শ্রোতাদের একাংশের মন্তব্য ছিল এমন যে, দেখলে! এ দুর্বল, হালকা মানুষটি সিংহের মত হুংকার ছাড়ছে এবং তার প্রতিটি কথায় খৃষ্টানদের ধর্ম জাযক (পাদ্রী) রীতিমত ঘর্মাক্ত হয়ে পড়েছে। তাঁর প্রতিটি কথা যেন পাদ্রীকে একের পর এক বুলেট বিদ্ধ করছে।
১৯০৩ সালে হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) দিল্লী চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি হযরত মাওলানা আমীনুদ্দীন (রহঃ) -এর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা-মাদ্রাসায়ে আমীনিয়্যাহ এর প্রধান শিক্ষক হিসেবে মনোনীত হন। আর জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি সেই আসনটি অলংকৃত করে রাখেন।
মুফতীয়ে আজম হযরত মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ দেহলভী (রহঃ) সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী একজন প্রখর প্রতিভাবান আলেমে দ্বীন ছিলেন৷ তিনি ছিলেন অনুপম স্মৃতিশক্তি, প্রখর মেধা, এবং ক্রমবর্ধমান ইলম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জান্নাতী সম্পদে সম্পদশালী৷ মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) ইলমী পরিপক্কতা- ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে এত প্রসিদ্ধ ছিলেন যে, গোটা হিন্দুস্তান তার সারগর্ভ ফতোয়া ও মাসআলা দান নিয়ে গর্ব করতো। সর্বতো বিচারে হিন্দুস্তানের ইতিহাসের পাতায় তিনি 'হিন্দুস্তানের মুফতীয়ে আযম' হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
দ্বীনের দাওয়াত ও প্রচার-প্রসারের পাশাপাশি ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে ব্যাঘ্র হুংকার দিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) ১৯১৫ সালে রাজনীতির কন্টকাকীর্ণ ভূমিতে পদাপণ করেন। তখন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মিলিত সাধারণ সভায় যোগ দান করে। এ বৈঠকে মিস্টার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং কংগ্রেসের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দও যোগদান করেন।
হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) -এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে তার উস্তাদবর্গ; এমন কি গোটা ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণ-পুরুষ, বীর মুজাহিদ শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহঃ) -এর উক্তি ছিল এমন যে,-“নিশ্চয় তোমরা রাজননীতিবিদ, তবে মৌলভী কেফায়াতুল্লাহ -এর মেধা, প্রজ্ঞা সবই রাজনীতিবিদ।
মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) ১৯১৮ সালে বহুসংখ্যক উলামায়ে কেরাম সহ মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯১৯ সালে তিনি দিল্লীর খেলাফত কনফারেন্সে “বৃটিশদের সন্ধি উৎসব' বয়কট করার ঐতিহাসিক প্রস্তাব পেশ করেন। যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ বছরই মুফতী কেফায়েতুল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ভারত উপমহাদেশের সকল আলেমকে একই সূত্রে গ্রথিত করে সুশৃংখলভাবে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের স্রোত ধারাকে তরান্বিত করার মহৎ অভিপ্রাণে “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” নামক সংগঠনের গোড়াপত্তন করেন। এই সংগঠনের প্রথম বৈঠকে ২৫ জন আলেম যোগদান করেন । এ বৈঠকে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি মনোনীত হন৷ তখন থেকে একটানা ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সুদীর্ঘ ৯ বৎসর যাবত তিনি এ দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আঞ্জাম দিতে সক্ষম হন।
মুফতী কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিচালিত প্রতিটি সংগ্রামেই অংশ গ্রহণ করেন ।
হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে মু'তামারে আলমে ইসলামীর ভারত প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এই প্রতিনিধি দলটি ইসলামী জগতের সকল উলামায়ে কেরামের সব চেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে।
হযরত মাওলানা মুফতী কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ১৯৩০ সালের ১১ অক্টোবর ইংরেজ স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে প্রথম বারের মত গ্রেফতার হন। এর এক বৎসর পর গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর যখন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে তখন আবার তাঁকে দ্বিতীয়বারের মত গ্রেফতার করা হয়। সেই সময় তাঁকে মুলতানের কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মাওলানা হাবীবুর রহমান লুধিয়ানভী, মাওলানা শাহ আতউল্লাহ বুখারী এবং মাওলানা দাউদ গজনভী সহ আরো কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমও তাঁর সাথে কারাবরণ করেন। সুদীর্ঘ ১৮ মাসের এই অন্তরীণ জীবনে ইংরেজ স্বৈরাচারীদের হাতে তাঁকে নিদারুণ কষ্ট পোহাতে হয়।
মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ)-এর জীবনীকারের বর্ণনা অনুযায়ী মুলতানের জেলখানায় তিনি বুখারী শরীফের দরসও দিয়েছেন। বন্দীদশার এই সময়ে কিছু দিনের জন্য তাঁকে গুজরাটের জেলখানায়ও স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
জীবনীকার লেখেন, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী মুফতী কেফায়েতুল্লাহ দেহলতী (রহঃ) কে সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করেছে। চেষ্টায় তারা কোন রকম ক্রটি করেনি । কিন্তু তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা বার্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাই পরিশেষে তারা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহঃ) -এর নিকট এই মর্মে আবেদন পত্র প্রেরণ করে যে, “বৃটিশ সরকার এই আবেদন করছে যে, আপনি (মুফতী কেফায়াতুল্লাহ) রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে বিরত থাকুন। বিনিময়ে সফদর জঙ্গ মাদ্রাসার রাজকীয় অট্টালিকা এবং তৎসংলগ্ন বিশাল মাঠটি আপনাকে উপঢৌকন স্বরূপ প্রদান করা হবে। আমাদের এই আবেদনের উদ্দেশ্য এই নয় যে, আপনি আমাদের পক্ষে প্রচার-প্রোপাগন্ডা করবেন; বরং আপনি শুধু মৌনতা অবলম্বন করলেই হবে।”
বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রলোভন হযরত মুফতী সাহেবকে বিন্দু মাত্রও টলাতে পারেনি। তাদের দেয়া প্রলোভনের উত্তরে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, “মাতৃভূমির আযাদী আন্দোলনে আমি ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অংশগ্রহণ করিনি। আপনাদের প্রস্তাবের শোকরিয়া আদায় করছি। তবে জেনে রাখুন! কোন প্রলোভন আমার প্রতিবাদ ধ্বনিকে স্তব্ধ করতে পারবে না।”
মুফতী কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ১৯৩৮ সালে মিসরের মু'তামারের ফিলিস্তীনী-সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। মুফতী কেফায়াতুল্লাহ (রহঃ) ছিলেন উঁচুমানের একজন পরহেযগার, মুত্তাকী ও বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন। তাঁর দরস থেকে বড় মাপের আলেম তৈরী হয়েছে। বর্তমান যুগের সর্বমহলে সমাদৃত ও প্রসিদ্ধ কিতাব 'তালীমুল ইসলাম' তাঁরই সংকলিত। এছাড়াও তার লেখা আরো অনেক কিতাব আছে। যা উম্মতের বিরাট সম্পদ হিসেবে কাজ করছে।
১৯৫২ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা, শিক্ষা, তাসাওউফ ও জিহাদের এই মহান সূর্য জাতিকে অশ্রুসিক্ত করে চিরদিনের জন্য অস্তমিত হয়ে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন৷ আমীন।
Comment