ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীর; নৈসর্গিক পাহাড় আর প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারামণ্ডিত মহান রবের নিয়ামতে পরিপূর্ণ এক মুসলিম ভূমি। ব্রিটিশ ও তৎপরবর্তী হিন্দু শাসনের পূর্বে প্রায় ৬শত বছর ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যনিষ্ঠার সাথে ভূস্বর্গ কাশ্মীর সমেত গোটা উপমহাদেশ শাসন করেছেন মুসলিমরা। তবে কালের পরিক্রমায় উপমহাদেশে মুসলিমরা হারিয়েছেন তাদের ছয়শত বছরের রাজত্বের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সেই সাথে ভূস্বর্গ কাশ্মীরও হারিয়েছে তার স্বাধীনতা ও প্রকৃত সৌন্দর্য। হিন্দুত্ববাদের পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে কাশ্মীরসহ গোটা উপমহাদেশের মুসলিমরা।
তবে এই পরাধীনতার শিকল ভাঙতে সময়ে সময়ে জন্ম নিয়েছেন অনেক বীর মুজাহিদ, যাঁরা তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েই মুসলিমদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। সৈয়দ আহমেদ বেরলবি, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবি, মীর নিসার আলী আর হাজী শরীয়তুল্লাহদের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে আধুনিক সময়েও যারা বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হক্কের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কমাণ্ডার ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি)।
ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বর্তমান পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার দাবীদার রুশ ও আমেরিকা এবং উপমহাদেশের দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সবার বিরুদ্ধেই জিহাদ করেছিলেন। তাঁর মেধা আর রণকৌশল ছিলো বিস্মিত করার মতো। তিনি ছিলেন কাশ্মীরের জিহাদি আন্দোলনের সফল একজন গেরিলা যোদ্ধা। তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী জামাআত কায়দাতুল জিহাদের শুরা কমিটির প্রথম অনারব সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন :
কাশ্মীর জিহাদের এই কিংবদন্তি নেতার জন্ম সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি ১৯৬৪ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের সামহানী উপত্যকার বিম্বুর (আদি মিরপুর) এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক তাঁর শারীরিক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, পরিপক্ব বয়সে তিনি “আনুমানিক ছয় ফুট লম্বা” ছিলেন।
কমান্ডার ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন খুবই মেধাবী, সত্যবাদী এবং সৎ চরিত্রের অধিকারী একজন যুবক। তিনি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত আল্লামা ইকবাল ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে গণযোগাযোগ বিভাগে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। এছাড়াও তিনি করাচির জামিয়া উলূম-উল-ইসলামিয়াতেও অধ্যয়ন করেছিলেন বলে জানা যায়। কিছু মিডিয়া সূত্র এই প্রচারণা চালায় যে, তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলিট স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপে (SSG) কাজ করেছেন। তবে সাংবাদিক সৈয়দ সেলিম শাহজাদের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি তা অস্বীকার করেন।
জিহাদের পথে যাত্রা :
১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আগ্রাসি সোভিয়েত বাহিনী প্রতিবেশি আফগানিস্তানে প্রবেশ করে তাদের তাঁবেদার আফগান সরকারের সহায়তায় মুসলিমদের উপর গণহত্যা ও লুটপাট চালাতে থাকে।
এসব জুলুম-অত্যাচার দেখে উম্মাহর ব্যথায় ব্যথিত ইলিয়াস কাশ্মীরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন এবং ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া দখলদার রুশ বিরোধী আফগান জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। অসীম সাহসিকতা আর বীরত্বের সাথে তিনি রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। মুজাহিদদের সাহায্য করতে ছুটতে থাকেন যুদ্ধের এক ময়দান থেকে আরেক ময়দানে।
ইলিয়াস কাশ্মীরি ছিলেন একজন সামরিক বিষয়ক শিক্ষক ও গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ। সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে তিনি মিরানশাহতে আফগান মুজাহিদদের মাইন বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেন। উম্মাহকে রক্ষার এই যুদ্ধে তিনি তাঁর একটি চোখ ও একটি আঙুল হারালেও, আল্লাহর রাস্তায় তাঁর দৃঢ়তা ও সংকল্পে কখনই কমতি হয়নি।
খোরাসান থেকে কাশ্মীর :
অবশেষে মহান রবের সাহায্যে আরব-অনারব মুজাহিদদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও দৃঢ় মনোবলের ফলে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। আফগানিস্তানে দখলদার রাশিয়ার পরাজয়ের পর মুজাহিদগণ ছড়িয়ে পড়তে থাকেন চেচেন, দাগিস্তান ও বসনিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, যেসব জায়গায় স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছিল আগে থেকেই। শহীদ ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর মত আরও শত মুজাহিদের নিয়ে মুসলিম ভূমি কাশ্মীর পুনরুদ্ধার এবং সেখানকার মুসলিমদের হিন্দুত্ববাদী ভারতের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
পাকিস্তান সরকার নিজ স্বার্থ রাক্ষায় তখনও কিছু কিছু স্বাধীনতাকামীদেরকে ভারতের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে সহায়তা করত। কিন্তু যেসকল স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা শুধুমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টি ও উম্মাহর মুক্তির জন্য পরাধীন কাশ্মীরকে আজাদ করতে চাইতেন, তাদেরকে সহায়তা করা তো দূরের বিষয়, বরং পাকিস্তানের গোলামী করতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাঁদেরকে হয় বন্দী করতো, নয়তো ভারতের কাছে তাঁদের তথ্য প্রকাশ করে দিত পাকিস্তান। পাকিস্তান প্রশাসনের এই গাদ্দারি কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধীর থেকে আরও ধীরগতি করে দেয়।
শহীদ ইলিয়াস কাশ্মীরি ছিলেন ময়দান থেকে ফেরা একজন চৌকস গেরিলা যোদ্ধা ও অভিজ্ঞ কমান্ডার, যিনি প্রকৃতই কাশ্মীরিদের মুক্তি চাইতেন। এ কারণে পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হয় তিনি যেন কাশ্মীরিদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকেন এবং জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহারের অধীনে কাজ করেন। তিনি পাকিস্তানের এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাকে অধিক গুরুত্ব দেন। পাকিস্তানের কোন ধরনের সহায়তা ছাড়াই তিনি শরীক হন কাশ্মীরের রণাঙ্গনে।
ভারতের নতুন আতংক, হুজির ‘৩১৩ ব্রিগেড’ :
কাশ্মীরের ভূমিতে কমান্ডার ইলিয়াস কাশ্মীরির (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সামরিক পথচলার সূচনা হয় ‘তেহরিকে আজাদিয়ে কাশ্মীর’-এর মাধ্যমে। এরপর তিনি “হারকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি) ৩১৩ ব্রিগেড” প্রতিষ্ঠা করেন। হুজি এমন মজবুত আক্রমণাত্মক অপারেশন চালায় যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী এই দলের নাম শুনলে কেঁপে উঠত। বেশির ভাগ অপারেশনে তিনি নিজেই শাহাদাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যোগ দিতেন। তাঁর এ অতুলনীয় জযবার জন্য সাথীদের মধ্যেও তাঁর একটি বিশেষ স্থান ছিল।
এই দল তখন দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী দল ও বিস্তৃত জিহাদি নেটওয়ার্কে পরিণত হয়। হুজির সুগভীর নেটওয়ার্ক পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। CIA-এর কিছু নথিতে ইউরোপেও ৩১৩-ব্রিগেডের শাখা থাকার কথা উঠে আসে। পাকিস্তানের প্রয়াত সাংবাদিক সৈয়দ সেলিম শাহজাদ তাঁর সম্পর্কে বলেন, “বিশ্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁকে সর্বদাই সবচেয়ে কার্যকর, কৌশলী এবং মারাত্মক লোক হিসাবে বর্ণনা করেছে। সেই সাথে তিনি বর্তমান বিশ্বের একজন সফল গেরিলা কমান্ডারও ছিলেন।”
ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ :
কমান্ডার ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ৯০ দশকে কাশ্মীর জিহাদে অংশগ্রহণের পর থেকে সেখানে ধারাবাহিকভাবে হিন্দুত্ববাদী ভরতের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালাতে থাকেন। তাঁর এসব অভিযানের ফলে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের ক্যাম্পের বাহিরে একা বের হতো না। তাঁর এসব সফল অভিযানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো :
– ১৯৯৪ সালে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে আল-হাদীদ অপারেশন। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর কয়েজন সাথীকে মুক্ত করা। তাঁরা ছিলেন মাত্র ২৫ জনের একটি দল, যার ডেপুটি পদে ছিলেন শায়খ উমার সাঈদ (২০০২ সালে করাচীতে অপহৃত ইউএস রিপোর্টার ড্যানিয়েল পার্লের অপহরণকারী)।
মুজাহিদদের এই দলটি বন্দী ভাইদের মুক্ত করতে ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের নাগরিকসহ বেশকিছু বিদেশীকে অপহরণ করে দিল্লীর অদূরে গাজিয়াবাদে নিয়ে যায়। এরপর তাঁরা ভারত সরকারের নিকট তাঁদের সাথীদের মুক্তির দাবী জানান।
– ২০০০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি, হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা লাইন অব কন্ট্রোল রেখা অতিক্রম করে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে প্রবেশ করে। এরপর সেখানকার লনজট গ্রামে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গুলি চালিয়ে ১৪ জন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে। ফেরত যাবার সময় তারা মুসলিম মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং এর মাঝে তিনজনের ছিন্ন মস্তক অপরপ্রান্তে জড়ো হওয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের দিকে ছুঁড়ে মারে।
এই ঘটনার ঠিক পরদিনই ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর “৩১৩ ব্রিগেড” হতে ২৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নাকাইল সেক্টরে একটি গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানের সময় তাঁরা ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর একজন অফিসারকে আটক করেন এবং তার শিরোচ্ছেদ করেন। এরপর সাধারণ মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ওই অফিসারের কাটা মাথা পাকিস্তানের কোতিল বাজারে সাড়ম্বরে প্রদর্শন করা হয়।
– ইলিয়াস কাশ্মীরির সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপারেশন ছিল ২০০২ সালে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের আঙ্কুরছাউনির ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এ সময় গুজরাটে মুসলিমদের উপর কসাই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে হিন্দুরা গণহত্যা চালাচ্ছিল। এই অপারেশনে তিনি তাঁর ৩১৩-ব্রিগেডের সদস্যদের দুই ভাগে ভাগ করে দেন। প্রথম হামলার পর ভারতীয় জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার ও অন্যান্য সিনিয়র অফিসাররা ঘটনাস্থলে এসে একত্রিত হলে সেখানে দ্বিতীবার হামলা চালানো হয়। যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সাথে সংঘটিত তিন তিনটি যুদ্ধে একজন জেনারেলকেও আহত করতে সক্ষম হয়নি, সেখানে ইলিয়াস কাশ্মীরির এই দলটি সেই হামলায় ভারতীয় দুই জেনারেলকে আহত এবং কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার ও কর্নেলকে হত্যা করতে সক্ষম হন। কাশ্মীরে চলমান ভারতীয় আগ্রাসনের দীর্ঘ ইতিহাসে এটা ছিল ভারতের জন্য সুস্পষ্ট পরাজয়।
– বাস্কার পর্বত বিজয় ছিলো তাঁর আরেকটি সফল অপারেশন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাশ্মীরের এই বীর মুজাহিদ হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের আতংকিত করে তুলতে সক্ষম হন। তিনি তাঁর দক্ষ গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি বিজয় করে নেন। আজাদ কাশ্মিরের আয়ত্তে থাকা এই ঘাঁটিটি আসলে একটি পর্বত যা স্থানীয় ভাষায় বলা হয় “ভাল্লুক পর্বত”, আর মুজাহিদরা এটাকে ডাকতেন “বাস্কার পর্বত” নামে। এই পর্বতটি ছিল মুজাহিদদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই পর্বত হয়ে মুজাহিদগণ তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করেন। ফলে দখলকৃত কাশ্মীর উপত্যকায় কর্মরত মুজাহিদদের সাথে যোগাযোগ অনেকটা সহজ হয়ে যায়।
এদিকে পাকিস্তানের গাদ্দার সেনারা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নামে সংগঠনের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করতে থাকে। ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে তাঁর। এসময় পাকিস্তানি সেনারা ইলিয়াস কাশ্মীরিকে তাঁর নিজের দলকে নিষ্ক্রিয় করা, গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে পরিচালিত জাইশে মুহাম্মদে যুক্ত হওয়া, বাস্কার পর্বতের উক্ত ঘাঁটিটি ভারতকে ফেরত দেওয়া ইত্যাদি ইস্যুতে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আল্লাহর পথের এই মহান বীর এসব করতে রাজি না হলে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ও জাইশে মুহাম্মদ তাঁর বাহিনীর উপর হামলা চালায়। ঠিক একই সময় ভারতীয় বাহিনীও ‘৩১৩-ব্রিগেডের’ ঘাঁটির উপর প্রবল বোমা বর্ষণ করতে থাকে। শত্রুরা এই যৌথ হামলার মাধ্যমে অনেক মুজাহিদকে শহীদ করে। সেই সাথে বাস্কার পর্বতের উক্ত ঘাঁটিটি ভারতকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেয় পাকিস্তান। তবে এই অভিযানের সময় পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ্ তায়ালার কুদরতে ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বেঁচে যান।
কারাগারে কমান্ডার ইলিয়াস কাশ্মীরি :
১৯৯৪ সালে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে ‘আল-হাদিদ’ অপারেশন চালান কমান্ডার ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি)। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় বাহিনী উক্ত হামলার বদলা নিতে কমান্ডার ইলিয়াস কাশ্মরীর ৩১৩-ব্রিগেডের গোপন আস্তানায় হামলা চালায়। এসময় শায়খ উমার আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। (পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান এয়ারক্রাফট হাইজ্যাকের মাধ্যমে অপহৃত যাত্রীদের সাথে বিনিময় চুক্তির ভিত্তিতে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।) অপরদিকে ইলিয়াস কাশ্মীরি অক্ষত অবস্থায় নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হন।
তবে পরবর্তীতে দখলকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী অন্য একটি অভিযানের মাধ্যমে ইলিয়াস কাশ্মীরি ও তাঁর এক সাথী নাসরুল্লাহ মনসুর লাংরাইলকে গ্রেফতার করে। ভারতীয় মুশরিক সেনাবাহিনী দুজনকেই জেলে পাঠায়। তাঁকে দুবছর ভারতের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। অবশেষে একদিন তাঁর সাথী নাসরুল্লহ মনসুর লাংরাইল জেলে থাকা অবস্থাতেই ইলিয়াস কাশ্মীরি আল্লাহর সাহায্যে জেল ভেঙে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ভারতীয় জেল থেকে পালানোর পর তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। কাশ্মীর জিহাদের উপর লেখা প্রকাশনাগুলোতে তাঁকে একজন বীর নায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
এরপর ২০০৩ এ গাদ্দার পারভেজ মোশাররফের উপর হামলার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ইলিয়াস কাশ্মীরিকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান। অথচ পারভেজ মোশাররফের উপর হামলার সময় তিনি কাশ্মীর উপত্যকায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিনি জাম্মুর টাণ্ডা এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপর হামলা করে অনেককে হত্যা করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে না পেরে অবশেষে তাঁকে ছেড়ে দেয়।
তবে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ISI তাকে কাশ্মীরে অপারেশন বন্ধ করতে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু তিনি প্রতিবারের মতোই অস্বীকৃতি জানান এবং হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান জারি রাখেন। ফলে ISI দ্বিতীয়বারের মতো তাঁকে আটক করে কারাগারে তাঁর উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। তাঁর উপর চালানো সেসব লোমহর্ষক নির্যাতন দেখে হিজবুল মুজাহিদিনের উপরস্থ একজন নেতা বলতে বাধ্য হন যে, “ভারত ও পাকিস্তানের জেলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই লোকগুলো আমাদের বিশ্বাস করে না, কারণ আমরা কাশ্মীরি।”
দীর্ঘ এক বছর কারানির্যাতনের পর ২০০৫ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের মত পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
উত্তর ওয়াজিরিস্তান, কাশ্মীরির নতুন যুদ্ধের ময়দান :
২০০৮ সালে আল-কায়দা ও তালিবানকে কোণঠাসা করতে তোড়জোড় প্রস্তুতি নিয়ে ‘অপারেশন শেরদিল’ শুরু করে ক্রুসেডার মার্কিন বাহিনী ও পাকিস্তান। এদিকে আল-কায়েদার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যেমন উসামা আল কেনী, খালিদ হাবিব, আবু লাইস আল-লিব্বিসহ বেশকিছু দুর্লভ মেধা শত্রুর ড্রোন হামলায় শহীদ হন। আর এমন এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান গাদ্দার প্রশাসন কর্তৃক দ্বিতীয়বার জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কমান্ডার ইলিয়াস (রহমতুল্লাহি আলাইহি) কাশ্মীর ছেড়ে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে হিজরত করেন।
পাক-আফগান সীমান্ত অঞ্চলের সঙ্কীর্ণ গিরিপথে ইলিয়াস কাশ্মীরির উপস্থিতির সংবাদ ওয়াশিংটনের মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত প্রবাহিত করে দেয়। আর ইলিয়াস কাশ্মীরিও উত্তর ওয়াজিরিস্তানে এসে সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি ক্রুসেডার ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান তালিবানদের সহায়তা করবেন।
আল-কায়েদার নতুন মিশনে ইলিয়াস কাশ্মীরি :
ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন একজন প্রকৃত চিন্তাবিদ। তিনি অস্থিরপ্রবণ ছিলেন না এবং গভীর চিন্তাভাবনার প্রেক্ষিতে তিনি তার সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। আল-কায়েদার সাথে তাঁর যে আলাপ হয়েছিল, তা তাঁর চিন্তাধারার সীমানাকে বিস্ফোরিত করেছিল। ২০০৭ সালের মাথায় তিনি আল-কায়েদা শুরা কমিটির একজন স্থায়ী ও পূর্ণ সদস্যে পরিণত হন। তিনি আল-কায়েদার সেনা অভিযান শাখার প্রধান হিসেবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
শাহাদাত বরণ :
২০১১ সালের এপ্রিলে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘোষণা প্রদান করা হয় যে, ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার হিসেবে ৫০ লাখ ইউএস ডলার প্রদান করা হবে। এরপর ওই বছরের জুন মাসের ৩ তারিখ রাতে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের অন্যতম প্রধান শহর ওয়ানা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে লামান গ্রামে একটি ড্রোন থেকে প্রথমে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর ছোঁড়া হয় আরও দুটি ক্ষেপণাস্ত্র। এতে ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) সহ নয়জন মুজাহিদ শহীদ হন, ইনশা আল্লাহ্।
হুজির তৎকালীন মুখপাত্র আবু হানজালা পাকিস্তান টেলিভিশন সেন্টারে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত, আমাদের আমির (নেতা) ও কমান্ডার ইন চিফ মোহাম্মদ ইলিয়াস কাশ্মীরি ও তাঁর বন্ধুরা শুক্রবার রাত ১১টা ১৫ মিনিটে মার্কিন ড্রোন হামলায় শহীদ হয়েছেন। আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন…আমিন।’
ইলিয়াস কাশ্মীরি (রহমতুল্লাহি আলাইহি) বর্তমান যুগের ইসলাম ও জিহাদপ্রেমী যুবকদের প্রেরণা, আদর্শ। তাঁর দ্বীন ও উম্মাহর প্রতি একনিষ্ঠতা, কর্তব্য পালনের একাগ্রতা এবং ঈমানী দৃঢ়তার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, মুসলিম জাতি আজও শত্রুর মনোবলে চিঁর ধরিয়ে স্বমহিমায় ভাস্বর হতে সক্ষম।
Comment