শহীদ বুরহান ওয়ানি : কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম বীর প্রতীক
প্রারম্ভিকা:
বুরহান ওয়ানি (১৯৯৪-২০১৬) হিন্দুত্ববাদী ভারতের দখল থেকে কাশ্মীরকে মুক্ত করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী টগবগে এক যুবক। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সেই কাশ্মীরি মুসলিমদের চোখে প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। একাধারে একজন দুর্ধর্ষ কমান্ডার ও সফল এই গেরিলা নেতা ভারতীয় দখলদার বাহিনীর কাছে হয়ে উঠেছিলেন যেন এক মূর্তিমান আতংক।
জন্ম ও শিক্ষা:
বুরহান ওয়ানি ১৯৯৪ সালে ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার দাদাসারা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুজাফফর আহমেদ ওয়ানী, যিনি ছিলেন এই অঞ্চলের একটি স্কুলের অধ্যক্ষ। তাঁর সম্মানিতা মা আনিসা মাইমুন মুজাফফর। তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর এই অঞ্চলের শিশুদের কুরআনের পাঠ দিতেন।
বুরহান ওয়ানি প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর মমতাময়ী মায়ের কাছে গ্রহণ করেন। এরপর এলাকারই একটি স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যান। তিনি তাঁর ক্লাসে খুব সফল ছাত্র ছিলেন। উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাতেও খুব ভালো ফলাফল করেন তিনি। পড়ালেখার বাইরে তিনি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন। হাসিখুশি স্বভাবের ওয়ানির একমাত্র পছন্দ বলতে এটাই ছিল।
ওয়ানী পেশায় একজন চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে হয়তো লিখা ছিল এর থেকে ভিন্ন কিছুই। ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে ভারতীয় দখলদারিত্ব এবং ক্রমবর্ধমান জুলুম তাঁকে ভিন্ন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যায়।
প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদান:
ছোটবেলা থেকেই বুরহান ওয়ানি এমন এক ভূখণ্ডে বড় হয়েছেন, যেখানে সর্বত্রই হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় দখলদারিত্বের প্রভাব বিদ্যমান। মুসলিমরা সেখানে ভারতীয়দের হাতে অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। মুসলিমদের এই করুণ অবস্থা ধীরে ধীরে বুরহান ওয়ানিকে প্রভাবিত করতে থাকে। ১৫ বছরের তরুণ বুরহান তাই ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন।
সময়টা তখন অক্টোবর, ২০১০ সাল। ভারতীয় দখলদার বাহিনী কর্তৃক কাশ্মীরে দমন-পীড়ন অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে- যা তাকে কঠিনভাবে প্রভাবিত করে। ফলে বুরহান ওয়ানি তাঁর শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে বাধ্য হন এবং এই অঞ্চলের অন্যতম প্রতিরোধ বাহিনী হিজবুল মুজাহিদিনে যোগ দেন।
হিজবুল মুজাহিদিনে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সকলের নজর কারেন ওয়ানি। শিক্ষিত পরিবারের হওয়ায় স্যোশাল মিডিয়াকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তা ভালো করেই জানতেন তিনি। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়াকে দাওয়াতের বড় একটি মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি কাশ্মীরের যুবসমাজকে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। অল্প সময়েই তিনি এই অঞ্চলে প্রতিরোধ যুদ্ধের এক সুপরিচিত নাম হয়ে উঠেন।
দখলদার ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য কাশ্মীরি জনগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন ওয়ানি। এটি তাকে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধে আরও সুপরিচিত মুখ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। এসময় তাঁর দাওয়াতে আকৃষ্ট হয়ে বহু মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিতে থাকেন।
বুরহান ওয়ানিকে ধরতে মরিয়া দিল্লি:
এই প্রক্রিয়ায় যুবক বুরহান ওয়ানি ভারতীয় দখলদার বাহিনীর কাছে মূর্তমান এক আতংকের নাম হয়ে উঠেন। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় প্রশাসন কোনো ভাবেই তাকে গ্রেফতার করতে পারছিল না। এর প্রতিশোধ তারা নেয় ওয়ানির ভাই এবং তার কয়েকজন আত্মীয়কে খুন করে।
তবে এসব কোন কিছুই বুরহান ওয়ানিকে প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বরং তিনি আগের চেয়ে আরও ক্ষিপ্র হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে থাকেন এবং কাশ্মীরের জনগণকে প্রতিরোধ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানাতে থাকেন।
বুরহান ওয়ানির এই আহ্বান যখন কাশ্মীরের অলি-গলিতে গুঞ্জন উঠাতে শুরু করে, তখন হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার তাকে ধরতে পুরষ্কার ঘোষণা করে। সেই সূত্র ধরেই ২০১৫ সালের আগস্টে বুরহান ওয়ানির মাথার মূল্য ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) রুপি ঘোষণা করে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার।
এই সময়টাতে বুরহান ওয়ানি তাঁর বিশ্বস্ত কিছু সাথীদের নিয়ে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হন। তিনি এই অঞ্চলে একটি স্বাধীন ইসলামি প্রতিরোধ (জিহাদি) বাহিনী গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করেন। সেই সাথে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান এবং কাশ্মীরি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে এক করতে যুদ্ধের ময়দানকে বিদেশি প্রভাব থেকে বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রভাব থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।
এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ায় তিনি হিজবুল মুজাহিদিনের নেতৃত্বের সাথে মতানৈক্যের সম্মুখীন হন। (যদিও তিনি তখন হিজবুল মুজাহিদিনের সর্বোচ্চ নেতা)। কেননা দলটির কলকাঠি নাড়তো গাদ্দার পাকিস্তান। দলের অধিকাংশ কমান্ডার পূর্বে থেকেই পাকিস্তানের সাথে সংযোগ রেখে কাজ করে আসছিল।
এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই বুরহান ওয়ানি নতুন একটি বক্তব্য প্রচার করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, শুধুমাত্র কাশ্মীরে নয়, সারা বিশ্বে একটি ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সংগ্রাম চলবে। মূলত বুরহান ওয়ানির এই বক্তব্যের পর পরই তাঁকে অঘোষিতভাবে হিজবুল মুজাহিদীন থেকে একঘরে করে রাখা হয়। ফলে বুরহান ওয়ানিও তাঁর অধীনস্থদের নিয়ে একটি নতুন এবং স্বাধীন প্রতিরোধ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। (যেটি পরবর্তীতে জাকির মুসার হাত ধরে পূর্ণতা লাভ করে।) নতুন প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার ১০ দিন পূর্বেই বুরহান ওয়ানিকে শহীদ করা হয়।
বুরহান ওয়ানি তাঁর সর্বশেষ ভিডিও, নিবন্ধ এবং অন্যান্য বিষয়বস্তুতে বার বার জনগণকে ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। পাশাপাশি কাশ্মীরি মুসলিমদেরকে তিনি শরিয়ত ও শাহাদাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি এও বলেন যে, ভারত কাশ্মীরে ইসরাইলের নীতি অবলম্বন করছে। [১]
বুরহান ওয়ানির শাহাদাত ও কাশ্মীর জিহাদের নতুন অধ্যায়:
অবশেষে ৮ জুলাই ২০১৬ তারিখে বুরহান ওয়ানির অবস্থানের খোঁজ পেয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী। কাশ্মীরের কোকেরনাগ জেলার বুমডোরা গ্রামে তাঁর খোঁজে অভিযান চালায় দখলদার বাহিনী। অভিযান ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে শাহাদাত বরণ করেন বুরহান ওয়ানি ও তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ সাথী।
বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের পর কাশ্মীরের সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে দখলদার ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বুরহান ওয়ানির জানাজায় প্রায় ২ লাখ মানুষ অংশ গ্রহণ করে। তাঁর শাহাদাতের পর কয়েক মাস ধরে কাশ্মীর জুড়ে তীব্র সংঘর্ষ চলে। এতে বহু মুসলিম প্রাণ হারান, আহত হন অসংখ্য।
তাঁর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধে শুরু হয় নতুন এক বিপ্লব, যা ভারতকে চিন্তিত করে তুলে। কেননা ভারত ভেবেছিল বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধের সূর্য অস্তমিত হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। বিভিন্ন সূত্রমতে, বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক যুবক প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দান করেন।
এই নতুন যুবকের দল আর বুরহান ওয়ানির ঘনিষ্ঠ সাথীরা কাশ্মীরের প্রতিরোধ যুদ্ধে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেন। তাঁরা বুরহান ওয়ানির অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। কয়েক মাসের ব্যবধানে তাঁরা হিজবুল মুজাহিদীনের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা কমান্ডার জাকির মুসার নেতৃত্বে নতুন পথ চলা শুরু করেন। তাঁরা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার আনুগত্যের পথ ছেড়ে আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ নামে নতুন এক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীর ঘোষণা দেন।
প্রতিরোধ যুদ্ধের এই প্রক্রিয়ায় যুবকরা কাশ্মীর যুদ্ধের স্লোগানই পরিবর্তন করে ফেলেন। ‘কাশ্মীর বনেগা পাকিস্তান’ স্লোগানের পরিবর্তে তাঁরা আওয়াজ তুলেন ‘কাশ্মীর বনেগা দারুল ইসলাম’। এই স্লোগানে সাড়া দিতে থাকেন তাওহিদপ্রেমী কাশ্মীরিরা। যুবকরা কাশ্মীর আযাদের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ধীরে ধীরে নতুন এই প্রতিরোধ বাহিনীতে যুক্ত হতে থাকেন।
এই বাহিনীতে যুক্ত হন বুরহান ওয়ানী রহিমাহুল্লাহ’র আপন ভাই ‘ইমতিয়ায শাহ’। যিনি আনসার গাযওয়াতুল হিন্দের একজন ডেপুটি ছিলেন। ২০২১ সালের ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ানে তিনি সহ আনসার গাজওয়াতুল হিন্দের মোট ৫ জন মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের আগে তাঁরা দীর্ঘ ২৪ ঘন্টা ধরে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় দখলদার বাহিনীর সাথে লড়াই করেন, এবং কাশ্মীরে শরিয়াহ্ ও শাহাদাতের আওয়াজকে বুলন্দ কারেন। সেই ধরা আজও চলমান রয়েছে কাশ্মীরের উপত্যকায়।
গতকাল ৮ জুলাই ছিল শহীদ বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের দিন। বুরহান ওয়ানি মরেননি। বুরহান ওয়ানিরা মরেন না। তিনি যুগ যুগ ধরে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর শাহাদাতকে কবুল করুন।
টীকা:
[১] বুরহান ওয়ানির এধরণের কিছু বক্তব্য ও চিন্তাধারা পরবর্তীতে ‘আল-হুর’ মিডিয়ায় এবং জাকির মুসা সহ ওয়ানির একাধিক ঘনিষ্ঠ সঙ্গী প্রকাশ করেন।
তথ্যসূত্র:
1. Burhan Wani, Age, Death, Cast, Wife, Family, Biography, & More
– https://tinyurl.com/4mhpjftv
2. কাশ্মীরে নিহত হিজবুল কম্যান্ডার বুরহান ওয়ানির জঙ্গি হয়ে ওঠার কাহিনি
– https://tinyurl.com/rktrcrjh
3. Burhan Wani – WIKIPEDIA
– https://tinyurl.com/3ns7t4me
প্রারম্ভিকা:
বুরহান ওয়ানি (১৯৯৪-২০১৬) হিন্দুত্ববাদী ভারতের দখল থেকে কাশ্মীরকে মুক্ত করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী টগবগে এক যুবক। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সেই কাশ্মীরি মুসলিমদের চোখে প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। একাধারে একজন দুর্ধর্ষ কমান্ডার ও সফল এই গেরিলা নেতা ভারতীয় দখলদার বাহিনীর কাছে হয়ে উঠেছিলেন যেন এক মূর্তিমান আতংক।
জন্ম ও শিক্ষা:
বুরহান ওয়ানি ১৯৯৪ সালে ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার দাদাসারা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুজাফফর আহমেদ ওয়ানী, যিনি ছিলেন এই অঞ্চলের একটি স্কুলের অধ্যক্ষ। তাঁর সম্মানিতা মা আনিসা মাইমুন মুজাফফর। তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর এই অঞ্চলের শিশুদের কুরআনের পাঠ দিতেন।
বুরহান ওয়ানি প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর মমতাময়ী মায়ের কাছে গ্রহণ করেন। এরপর এলাকারই একটি স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যান। তিনি তাঁর ক্লাসে খুব সফল ছাত্র ছিলেন। উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাতেও খুব ভালো ফলাফল করেন তিনি। পড়ালেখার বাইরে তিনি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন। হাসিখুশি স্বভাবের ওয়ানির একমাত্র পছন্দ বলতে এটাই ছিল।
ওয়ানী পেশায় একজন চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে হয়তো লিখা ছিল এর থেকে ভিন্ন কিছুই। ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে ভারতীয় দখলদারিত্ব এবং ক্রমবর্ধমান জুলুম তাঁকে ভিন্ন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যায়।
প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদান:
ছোটবেলা থেকেই বুরহান ওয়ানি এমন এক ভূখণ্ডে বড় হয়েছেন, যেখানে সর্বত্রই হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় দখলদারিত্বের প্রভাব বিদ্যমান। মুসলিমরা সেখানে ভারতীয়দের হাতে অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। মুসলিমদের এই করুণ অবস্থা ধীরে ধীরে বুরহান ওয়ানিকে প্রভাবিত করতে থাকে। ১৫ বছরের তরুণ বুরহান তাই ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন।
সময়টা তখন অক্টোবর, ২০১০ সাল। ভারতীয় দখলদার বাহিনী কর্তৃক কাশ্মীরে দমন-পীড়ন অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে- যা তাকে কঠিনভাবে প্রভাবিত করে। ফলে বুরহান ওয়ানি তাঁর শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে বাধ্য হন এবং এই অঞ্চলের অন্যতম প্রতিরোধ বাহিনী হিজবুল মুজাহিদিনে যোগ দেন।
হিজবুল মুজাহিদিনে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সকলের নজর কারেন ওয়ানি। শিক্ষিত পরিবারের হওয়ায় স্যোশাল মিডিয়াকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তা ভালো করেই জানতেন তিনি। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়াকে দাওয়াতের বড় একটি মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি কাশ্মীরের যুবসমাজকে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। অল্প সময়েই তিনি এই অঞ্চলে প্রতিরোধ যুদ্ধের এক সুপরিচিত নাম হয়ে উঠেন।
দখলদার ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য কাশ্মীরি জনগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন ওয়ানি। এটি তাকে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধে আরও সুপরিচিত মুখ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। এসময় তাঁর দাওয়াতে আকৃষ্ট হয়ে বহু মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিতে থাকেন।
বুরহান ওয়ানিকে ধরতে মরিয়া দিল্লি:
এই প্রক্রিয়ায় যুবক বুরহান ওয়ানি ভারতীয় দখলদার বাহিনীর কাছে মূর্তমান এক আতংকের নাম হয়ে উঠেন। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় প্রশাসন কোনো ভাবেই তাকে গ্রেফতার করতে পারছিল না। এর প্রতিশোধ তারা নেয় ওয়ানির ভাই এবং তার কয়েকজন আত্মীয়কে খুন করে।
তবে এসব কোন কিছুই বুরহান ওয়ানিকে প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বরং তিনি আগের চেয়ে আরও ক্ষিপ্র হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে থাকেন এবং কাশ্মীরের জনগণকে প্রতিরোধ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানাতে থাকেন।
বুরহান ওয়ানির এই আহ্বান যখন কাশ্মীরের অলি-গলিতে গুঞ্জন উঠাতে শুরু করে, তখন হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার তাকে ধরতে পুরষ্কার ঘোষণা করে। সেই সূত্র ধরেই ২০১৫ সালের আগস্টে বুরহান ওয়ানির মাথার মূল্য ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) রুপি ঘোষণা করে হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার।
এই সময়টাতে বুরহান ওয়ানি তাঁর বিশ্বস্ত কিছু সাথীদের নিয়ে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হন। তিনি এই অঞ্চলে একটি স্বাধীন ইসলামি প্রতিরোধ (জিহাদি) বাহিনী গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করেন। সেই সাথে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান এবং কাশ্মীরি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে এক করতে যুদ্ধের ময়দানকে বিদেশি প্রভাব থেকে বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রভাব থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।
এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ায় তিনি হিজবুল মুজাহিদিনের নেতৃত্বের সাথে মতানৈক্যের সম্মুখীন হন। (যদিও তিনি তখন হিজবুল মুজাহিদিনের সর্বোচ্চ নেতা)। কেননা দলটির কলকাঠি নাড়তো গাদ্দার পাকিস্তান। দলের অধিকাংশ কমান্ডার পূর্বে থেকেই পাকিস্তানের সাথে সংযোগ রেখে কাজ করে আসছিল।
এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই বুরহান ওয়ানি নতুন একটি বক্তব্য প্রচার করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, শুধুমাত্র কাশ্মীরে নয়, সারা বিশ্বে একটি ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সংগ্রাম চলবে। মূলত বুরহান ওয়ানির এই বক্তব্যের পর পরই তাঁকে অঘোষিতভাবে হিজবুল মুজাহিদীন থেকে একঘরে করে রাখা হয়। ফলে বুরহান ওয়ানিও তাঁর অধীনস্থদের নিয়ে একটি নতুন এবং স্বাধীন প্রতিরোধ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। (যেটি পরবর্তীতে জাকির মুসার হাত ধরে পূর্ণতা লাভ করে।) নতুন প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার ১০ দিন পূর্বেই বুরহান ওয়ানিকে শহীদ করা হয়।
বুরহান ওয়ানি তাঁর সর্বশেষ ভিডিও, নিবন্ধ এবং অন্যান্য বিষয়বস্তুতে বার বার জনগণকে ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। পাশাপাশি কাশ্মীরি মুসলিমদেরকে তিনি শরিয়ত ও শাহাদাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি এও বলেন যে, ভারত কাশ্মীরে ইসরাইলের নীতি অবলম্বন করছে। [১]
বুরহান ওয়ানির শাহাদাত ও কাশ্মীর জিহাদের নতুন অধ্যায়:
অবশেষে ৮ জুলাই ২০১৬ তারিখে বুরহান ওয়ানির অবস্থানের খোঁজ পেয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী। কাশ্মীরের কোকেরনাগ জেলার বুমডোরা গ্রামে তাঁর খোঁজে অভিযান চালায় দখলদার বাহিনী। অভিযান ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে শাহাদাত বরণ করেন বুরহান ওয়ানি ও তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ সাথী।
বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের পর কাশ্মীরের সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে দখলদার ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বুরহান ওয়ানির জানাজায় প্রায় ২ লাখ মানুষ অংশ গ্রহণ করে। তাঁর শাহাদাতের পর কয়েক মাস ধরে কাশ্মীর জুড়ে তীব্র সংঘর্ষ চলে। এতে বহু মুসলিম প্রাণ হারান, আহত হন অসংখ্য।
তাঁর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধে শুরু হয় নতুন এক বিপ্লব, যা ভারতকে চিন্তিত করে তুলে। কেননা ভারত ভেবেছিল বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধের সূর্য অস্তমিত হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। বিভিন্ন সূত্রমতে, বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক যুবক প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দান করেন।
এই নতুন যুবকের দল আর বুরহান ওয়ানির ঘনিষ্ঠ সাথীরা কাশ্মীরের প্রতিরোধ যুদ্ধে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেন। তাঁরা বুরহান ওয়ানির অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। কয়েক মাসের ব্যবধানে তাঁরা হিজবুল মুজাহিদীনের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা কমান্ডার জাকির মুসার নেতৃত্বে নতুন পথ চলা শুরু করেন। তাঁরা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার আনুগত্যের পথ ছেড়ে আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ নামে নতুন এক ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীর ঘোষণা দেন।
প্রতিরোধ যুদ্ধের এই প্রক্রিয়ায় যুবকরা কাশ্মীর যুদ্ধের স্লোগানই পরিবর্তন করে ফেলেন। ‘কাশ্মীর বনেগা পাকিস্তান’ স্লোগানের পরিবর্তে তাঁরা আওয়াজ তুলেন ‘কাশ্মীর বনেগা দারুল ইসলাম’। এই স্লোগানে সাড়া দিতে থাকেন তাওহিদপ্রেমী কাশ্মীরিরা। যুবকরা কাশ্মীর আযাদের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ধীরে ধীরে নতুন এই প্রতিরোধ বাহিনীতে যুক্ত হতে থাকেন।
এই বাহিনীতে যুক্ত হন বুরহান ওয়ানী রহিমাহুল্লাহ’র আপন ভাই ‘ইমতিয়ায শাহ’। যিনি আনসার গাযওয়াতুল হিন্দের একজন ডেপুটি ছিলেন। ২০২১ সালের ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ানে তিনি সহ আনসার গাজওয়াতুল হিন্দের মোট ৫ জন মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের আগে তাঁরা দীর্ঘ ২৪ ঘন্টা ধরে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় দখলদার বাহিনীর সাথে লড়াই করেন, এবং কাশ্মীরে শরিয়াহ্ ও শাহাদাতের আওয়াজকে বুলন্দ কারেন। সেই ধরা আজও চলমান রয়েছে কাশ্মীরের উপত্যকায়।
গতকাল ৮ জুলাই ছিল শহীদ বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের দিন। বুরহান ওয়ানি মরেননি। বুরহান ওয়ানিরা মরেন না। তিনি যুগ যুগ ধরে কাশ্মীর প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর শাহাদাতকে কবুল করুন।
টীকা:
[১] বুরহান ওয়ানির এধরণের কিছু বক্তব্য ও চিন্তাধারা পরবর্তীতে ‘আল-হুর’ মিডিয়ায় এবং জাকির মুসা সহ ওয়ানির একাধিক ঘনিষ্ঠ সঙ্গী প্রকাশ করেন।
তথ্যসূত্র:
1. Burhan Wani, Age, Death, Cast, Wife, Family, Biography, & More
– https://tinyurl.com/4mhpjftv
2. কাশ্মীরে নিহত হিজবুল কম্যান্ডার বুরহান ওয়ানির জঙ্গি হয়ে ওঠার কাহিনি
– https://tinyurl.com/rktrcrjh
3. Burhan Wani – WIKIPEDIA
– https://tinyurl.com/3ns7t4me
Comment