শাইখ উমর আব্দুর রহমান : দ্বীনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
.
.
উমর আব্দুর রহমান- হাজার তারার মাঝে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র৷ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের সম্পর্কে বলেছেন-
.
إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ
(আলেমগণ নবীদের উত্তরসূরী)৷
শায়খ উমর আব্দুর রহমান তাঁদেরই একজন৷ তিনি ১৯৩৮ সালে মিশরের জামালিয়াতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বয়স যখন মাত্র দশ মাস; তখন তিনি চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারান৷ পৃথিবীর আলো দেখতে পারেননি। তবে হ্যাঁ! তিনি নিজেই তো ছিলেন প্রদীপতুল্য৷ চর্মচক্ষু তাঁর দৃষ্টি হারালেও; দৃষ্টি হারায়নি তাঁর অন্তরচক্ষু। অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন- ইসলামি শরিয়ার জ্ঞানের জাহাজ৷ মহান আল্লাহ তাআলা তার প্রতি দানের ভান্ডার এতটাই প্রশস্ত করেছিলেন যে, মাত্র এগার বৎসর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন মাজিদ সম্পূর্ণ হিফয করেন৷ তাঁর কুরআন তিলাওয়াত খুবই সুন্দর ছিল৷ অন্তরে প্রভাব ফেলত৷ প্রতিটি হরফের উচ্চারণ কতই না সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করতেন তিনি; যা শুনতেই মন চায়। তাঁকে ব্লাইন্ড শাইখও বলা হত।
হিফয শেষ করার পর, তিনি দিমইয়াতে একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। সেখানে তিনি চার বছর পড়ালেখা শেষে সফলতার সাথে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর, তিনি ‘মানসুরা’ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৬০ সালে ভালো রেজাল্টের সহিত মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তারপর শাইখ উমর আব্দুর রহমান রহ. কায়রোর ‘উসূলুদ্দীন’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। সেখানে তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর অধ্যায়ন শেষে ১৯৬৫ সালে সম্মানের সহিত ডিগ্রি লাভ করেন। পাশাপাশি তিনি ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের অধিনে এক মসজিদে ইমাম হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন৷ এবং সহকারী শিক্ষক হিসেবে উক্ত কলেজে তিনি কর্মরত থাকেন৷ তিনি শরিয়াহ বিভাগের ওপর তাঁর স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করে পরবর্তীতে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাফসীরের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
যে পথে চলেছেন আদম আ.; নূহ আ. যে পথের ওপর চলতে গিয়ে কেঁদেছিলেন; আল্লাহর খলীল ইবরাহিম আ. যে রাহের ওপর অটল থেকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন: ইউসুফ আ. যে পথে দৃঢ় থেকে কারাবরণ করেন; যে পথে অবিচল থেকে আল্লাহর হাবীব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্যাতন ভোগ করেন; যে পথে ইমাম আবু হানীফা রহ. বন্দিত্ব বরণ করেন; ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. কারার নির্যাতন সহ্য করেন; ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. যে পথে অটল থাকার কারণে, জেলে গিয়েছিলেন- শাইখ উমর আব্দুর রহমান সে পথেরই এক সাহসী পথিক। এই বিজ্ঞ আলেমও সত্য প্রকাশে ছিলেন- সর্বদা নির্ভীক। জামাল আব্দুন নাসেরের পাশবিক সরকারের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন৷ তিনি নির্ভয়ে মুসলিমদেরকে বলেছিলেন- এই অত্যাচারী মুরতাদের মৃত্যুর পর তার জানাযা না পড়তে। তিনি বলেছিলেন- ‘‘জামাল আব্দুন নাসের কাফের হওয়ার কারণে, তার জানাযা পড়া যাবে না।’’ এই ফতোয়া প্রদানের পর তাঁকে গ্রেফতার করে ‘আল-কালাহ’ জেলে বন্দী করে রাখা হয়।
আনোয়ার সাদাত যখন ইহুদিদের সাথে চুক্তি করে; উমর আব্দুর রহমান তখন তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করেন। তাঁর এ ফতোয়ায় মুজাহিদ খালিদ ইস্তাম্বুলী রহ. ইসলামের তৎকালীন শত্রু মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করেন। এরপর পুনরায় তিনি বন্দী হন। কারাগারে তাঁকে বেদম প্রহার করা হয়। ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয়। ডায়াবেটিকস ও হাই ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও; তাঁর জন্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাবার সরবরাহ করা হয়নি।
আদালতে বিচারকের সামনে অকুণ্ঠচিত্তে বলে গেলেন- ‘‘আমি আমার আকিদা অনুসারে নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলে যাব। চাই তাতে আমার জীবন বিলীন হয়ে যাক না কেন।… আমি একজন মুসলমান৷ আমি আমার দ্বীনের জন্য বাঁচি; আর এ পথেই মরতে চাই।’’ অথচ ফাঁসির রশি তখনও তাঁর ঘাড়ে ঝুলছে।
তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে লাগলেন- ‘‘হে বিচারপতি! সরকারের ক্ষমতার চাইতে আল্লাহর ক্ষমতা বেশি। সরকার মান্য হওয়ার চাইতে আল্লাহ মান্য হওয়ার অধিক হকদার৷ যেহেতু সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই৷ শাসকদের আদেশগুলোকে মহান আল্লাহর বাণীর সাথে মিলিয়ে দেখ৷ যা কিছু তুমি এর সাথে সামঞ্জশ্যশীল পাবে তা গ্রহণ কর। যা কিছু তুমি এর বিপরীত পাবে তা ছুঁড়ে ফেলে দাও।’’
আশির দশকে তিনি আফগানিস্তানে গমন করেন। মিসরে জন্ম নেওয়া উম্মাহর মুজাহিদ আলিমদের অনেকের উস্তাদ এই প্রতিভাবান অন্ধ আলিম তাওহীদ ও জিহাদের এক বিরাট স্তম্ভের ভূমিকা পালন করেছেন। তারপর তিনি নব্বইয়ের দশকে আমেরিকায় গমন করেন।
আমেরিকার ভিসা পাওয়ার পর এবং আমেরিকায় ইসলাম প্রচারের ইমাম হয়ে শায়খ তাঁর দাওয়াতি মেহনত অব্যাহত রাখেন৷ তাঁর দীপ্ত দাওয়াতি প্রচারণা অনেক মুজাহিদের চোখ খুলে দেয়। আল্লাহর শত্রুকে আক্রমণের প্রেরণা যোগায়। ১৯৯৩ সালে আমেরিকার কুফরী প্রশাসন তাঁর উপর চারটি অপবাদ আরোপ করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়।
১. যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ২.হুসনি মুবারককে হত্যার অভিযোগ৷ ৩.সামরিক স্থাপনাসমূহ বিস্ফোরিত করা। ৪. যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শহরে যুদ্ধের জন্য উস্কানি।
তখন তিনি সিংহের গর্জন দিয়ে বলে উঠলেন-
‘‘যদি কেউ ন্যায্য অধিকার পেতে হয় জঙ্গি; তাহলে আমরা জঙ্গিই। আর আমরা জঙ্গি হওয়াকে স্বাগত জানাই । কেননা, কুরআনই এই জঙ্গিবাদ তৈরী করে। কারণ, আল্লাহর পথে জিহাদ করার অন্যতম মাধ্যম হল আল্লাহর শত্রুদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করা।’’
১৯৯৩ সাল থেকে বর্তমান তথা ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি আমেরিকার কারাগারে বন্দী ছিলেন। এছাড়া মিসরের তগুত শাসক আনোয়ার সাদাতকে হত্যার অভিযোগে তিনি ১৯৮১ সালের পর মিসরে তিন বছর কারা বরণ করেন। ৭৯ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। তার মধ্যে ২৭ বছরই কেটেছে জেলে!
সুবহানাল্লাহ! উনারাই হচ্ছেন- সেইসব দুঃসাহসী আলিম; যাদেরকে উম্মাহর গুরাবারা অনুসরণ করে থাকেন। কুফফার-মুরতাদদের উচ্ছিষ্টভোগী দালালদেরকে নয়৷
তিনি মুসলিম উম্মাহর প্রতি তাঁর অন্তিম নসিহতে বলেন-
‘‘আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান টার্গেট হল- সত্য উচ্চারণকারী আলেমদেরকে চিরতরে মিটিয়ে দেয়া। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পৃথিবীর সব জারগায় তারা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে, কুরআনের দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট কথাগুলো আমরা বারবার ভুলে যাই। এটা বিরাট এক সমস্যা।’’
.
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন-
وَ لَا یَزَالُوۡنَ یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ حَتّٰی یَرُدُّوۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِکُمۡ اِنِ اسۡتَطَاعُوۡا
‘‘তারা তোমাদের সাথে লড়াই করেই যাবে; যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে সরিয়ে দিতে পারে; যদি তারা সক্ষম হয়।’’ -সূরা বাকারা: ২১৭
.
لَا یَرۡقُبُوۡنَ فِیۡ مُؤۡمِنٍ اِلًّا وَّ لَا ذِمَّۃً ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُعۡتَدُوۡن
.
.
‘‘তারা কোন মুসলমানের ব্যাপারে আত্মীয়তার মর্যাদাও রক্ষা করে না, আর না অঙ্গীকারের।’’ -সূরা তাওবা: ১০
.
اِنۡ یَّثۡقَفُوۡکُمۡ یَکُوۡنُوۡا لَکُمۡ اَعۡدَآءً وَّ یَبۡسُطُوۡۤا اِلَیۡکُمۡ اَیۡدِیَهُمۡ وَ اَلۡسِنَتَهُمۡ بِالسُّوۡٓءِ وَ وَدُّوۡا لَوۡ تَکۡفُرُوۡنَ
.
‘‘কাফেররা যদি তোমাদেরকে মুঠোর মধ্যে পায়; তবে শত্রুতা প্রকাশ করতে শুরু করবে। আর তোমাদের অনিষ্ট সাধনে হাতসমূহ এবং জিহবাসমূহ চালনা করতে থাকবে। আর তারা এই কামনা করে- তোমরা কাফের হয়ে যাও।’’ সূরা মুমতাহিনা: ২
এই কুফফার শক্তি কোন দেশেই ইসলামি আন্দোলনকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিবে না। তাদের লড়াই’ই হল- ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে। আর তাদের পরম লক্ষ্য হল দুনিয়াব্যাপী যিনা-ব্যভিচার, সুদ-মদ ইত্যাকার অন্যায় ছড়িয়ে দেয়া।
আল-কায়েদার মুজাহিদগণ কুফফার আমেরিকার বন্দীদের বিনিময়ে এই মুজাহিদ আলিমকে মুক্ত করার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু, আমেরিকা শাইখের মুক্তি দিতে রাজী হয়নি। সম্প্রতি শায়খ আইমান আয যাওয়াহিরি (আল্লাহ তাকে হেফাজত করুন) সহ আরও অনেক মুজাহিদিন শায়খরা তাঁর মুক্তির দাবি জানায়; অথচ সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ছিল নিশ্চুপ।
সুবহানাল্লাহ! একজন বয়স্ক অন্ধ আলিমকেও আমেরিকা কত ভয় পায়!
পরিশেষে, তারা ধীরে ধীরে শায়খকে হত্যা করে। সাইলেন্ট কিলিং। খাদ্য-পানিতে বিষ মিশিয়ে। শরীর বিধ্বংসী পাওয়ারফুল ওষুধ মিশিয়ে৷ মারাত্মক ক্ষতিকর ওষুধ সেবন করতে বাধ্য করে। কখনও কখনও চেতনানাশক ওষুধ খাওয়ায়; যাতে মারা যায় বা পাগল হয়ে যায়।
শায়খ বর্ণনা করেন- ‘‘বিশেষ করে আমি আমার উপরতলা থেকে ধেয়ে আসা বাতাসে প্রচন্ড রকমের অজানা দুর্গন্ধ পাই। সেই সাথে আসতে থাকে পুরোনো এসির ঘরঘর বিকট শব্দ। মনে হয়- গুলি করা হচ্ছে আমাকে৷ রাতদিন অনবরত এই দুর্গন্ধ ও বিকট শব্দে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত৷
তারা যদি আমাকে হত্যা করে, আর তারা অবশ্যই তা করবে; তাহলে আমার জানাযা পড়িয়ে আমার মরদেহ আমার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিবেন৷ যাতে করে, আমার রক্তকে আপনারা ভুলে না যান; বরং আমার এই রক্তের বদলা আপনারা সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে নিন। আর এই ভাইকে স্মরণে রাখবেন; যিনি সত্য প্রচার করেছিলেন। এবং আল্লাহর জন্য নিহত হয়েছেন।’’
প্রাণপ্রিয় শায়খকে আমেরিকা নামক জানোয়ার রাষ্ট্র কষ্টের পর কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলে৷ এটা মুসলিম উম্মাহর প্রতি হিংস্র সন্ত্রাসী ট্রাম্পের উপহার(!)।
দৃঢ়চেতা এই মহাপুরুষ দীর্ঘ ২৪ বছর আমেরিকার কারাগারে বন্দী অবস্থায় ৭৯ বৎসর বয়সে ১৯/০২/২০১৭ তারিখে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
পরিশেষে শাইখের সেই উক্তিই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই; যা তিনি আদালতে, কারাগারে, পারিবারিক সাক্ষাতে বলতেন- ‘‘জেল ফাঁসি আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে না; মুক্তি বা খালাস আমাকে মোটেও উৎফুল্ল করে না।’’
মহান আল্লাহ আমাদের এমন বীর মহাপুরুষদের পথে চলে শাহাদাতের সুমিষ্ট স্বাদ আস্বাদন করার সৌভাগ্য নসীব করুন! আমাদের একত্রিত করুন- জান্নাতে শুহাদাদের মিলন মেলায়। আমীন! ইয়া রব্বাল মুজাহিদীন!
.
তথ্যসূত্র: — আল বালাগ ম্যাগাজিন। ২০১৭। ইস্যু ২।
অনুলিখন: আবু আইমান আল হিন্দী (সালাবা)
অনুলিখন: আবু আইমান আল হিন্দী (সালাবা)
Comment