আফগান : পাক লহুতে সিঞ্চিত যে জমিন
[উম্মাতুন ওয়াহিদা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত শায়খ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফি.-এর মুহতারামা স্ত্রী উমাইমা হাসান আহমাদের লেখা স্মৃতিকথা]
[উম্মাতুন ওয়াহিদা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত শায়খ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফি.-এর মুহতারামা স্ত্রী উমাইমা হাসান আহমাদের লেখা স্মৃতিকথা]
প্রথম পর্ব
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি।
অনেক মুহাজির বোনের আবদার ছিল, আফগানিস্তানে ক্রুসেডারদের আক্রমণ চলাকালে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো যেন লিখে রাখি। যে ঘটনাগুলোর সাক্ষী হয়েছি আমি নিজে। কিছুদিন আগে অবশ্য এ বিষয়ে লেখার সুযোগও হয়েছিল। কিন্তু, লেখাগুলো হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। তাই, আবারও স্মৃতিগুলো কাগজের পাতায় লিখে রাখার ইচ্ছা করেছিলাম। কিন্তু, ধারাবাহিক হিজরতের দরুন সুযোগ হয়ে উঠছিল না।
অবশেষে একদিন খাতা-কলম নিয়ে বসার সুযোগ হলো। এই লেখাটি মুসলিমদের ওপর আমেরিকার করা একেকটি অন্যায় আর অপরাধের বিরুদ্ধে আমার সাক্ষ্য। আমার জাতি যেন জানতে পারে, ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর আমেরিকার অত্যাচার আর নির্যাতনের দাস্তান কতটা দীর্ঘ। আফগানের পবিত্র মাটিতে ক্রুসেডারদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুহাজির মুজাহিদদের আত্মত্যাগ আর কুরবানীর এক না-বলা উপাখ্যানও এই লেখা।
আমেরিকার আগ্রাসন
আফগানিস্তানে মুজাহিদদের হিজরতের ধারা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে৷ পুরো দুনিয়া তখন মুজাহিদদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, পৃথিবীর সকল দেশের দরজা ছিল তাদের জন্য বন্ধ; ঠিক সে সময় মোল্লা মুহাম্মদ ওমর রহ.-এর নেতৃত্বে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান৷ ফলে মুজাহিদগণও হিজরত করতে শুরু করেন পবিত্র এই ভূমির দিকে, খাঁটি মুজাহিদ এই মানুষগুলোর কাছে৷ আফগান জাতিও মুজাহিদদের অভ্যর্থনা জানায় খুশি মনে, দিল খুলে। মুজাহিদদের সম্মান প্রদর্শন করে সর্বোত্তম উপায়ে, তাদের জন্য বিছিয়ে দেয় হৃদয়ের দস্তরখান৷ ইমারতে ইসলামিয়ার ছায়ায় কাটানো সেই সময়গুলো ছিল আমাদের যাপিত জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম সময়৷
কিন্তু, আমেরিকা ও তার অনুচরেরা তা মেনে নিতে পারছিল না৷ আরব ও আফগান মুজাহিদদের পুনরায় একত্রিত হওয়া ছিল তাদের জন্য গলার কাঁটা স্বরূপ; ইতঃপূর্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা একত্রিত হয়েছিল৷ ফলে, আল্লাহ তায়ালা তাদের শক্তি দিয়েছিলেন ও সাহায্য করেছিলেন। অপরাজেয় রুশবাহিনী পর্যন্ত আফগানের মাটি থেকে পরাজিত ও বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল৷
এবার আফগান ও আরব মুজাহিদগণ একত্রিত হচ্ছিলেন ন্যায়ের পতাকাবাহী ইমারতে ইসলামিয়ার ছায়াতলে। তারা ছিলেন পূর্ণ স্বাধীন। নিজেদের ও সন্তানদের প্রস্তুত করছিলেন ইহুদি-খ্রিষ্টান ও তাদের বিশ্বাসঘাতক সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য; যারা মুসলিমদের ভূমিগুলো কলুষিত করেছে, লুণ্ঠন করেছে তাদের ধনসম্পদ এবং লাঞ্ছিত করেছে মুসলিম বাসিন্দাদের৷ তাই, আমেরিকা, ইহুদি ও তাদের সহযোগীরা ঘাবড়ে গেল। সদ্য-জন্ম-নেওয়া ইসলামী ইমারতকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত যেন তাদের শান্তি নেই।
শুরু হয় ষড়যন্ত্র৷ আফগানিস্তানের ওপর আক্রমণ করে ইমারতে ইসলামিয়াকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা৷ যেন মুসলিমদের আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো ইসলামী রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে থাকতে না পারে৷ এর জন্য ৯/১১-কে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের ওপর আক্রমণ করার অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করে৷ যেন বিশ্ববাসী মনে করে, ‘আমেরিকা ৯/১১ হামলার প্রতিশোধ নিচ্ছে৷ আর তাদের এই প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকারও আছে।’ কিন্তু, তারা ভুলে গিয়েছিল; বরং বলা ভালো, ভুলে যাওয়ার ভান ধরেছিল যে, আমেরিকার ওপর নাইন-ইলেভেনের এই আক্রমণ করাই হয়েছিল মুসলিম-বিশ্বের ওপর তাদের তীব্র অত্যাচারের প্রতিশোধস্বরূপ৷ নিরীহ ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরাইলের চালানো বর্বর অত্যাচারের পক্ষ অবলম্বনের শাস্তিস্বরূপ৷ আরব ও সমগ্র মুসলিম-বিশ্বের ওপর মুনাফিক শাসক চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিদানস্বরূপ; দেশের সম্পদ আত্মসাৎ করা আর জনগণের ওপর অত্যাচার চালানোই যাদের একমাত্র লক্ষ্য।
হিজরতের সূচনা
হঠাৎ একদিন শুরু হয়ে যায় আফগানিস্তানের ওপর আমেরিকার বর্বরোচিত হিংস্র আগ্রাসন৷ সকালের আলো ফুটতেই কাবুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হই আমরা৷ আমি ও আমার সাবেক স্বামী তারেক আনওয়ার সাইয়িদ রহ., সাথে ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাইয়িদা আহমাদ হালাওয়া ও তার পাঁচ সন্তান৷ সাইয়িদা হালাওয়া ছিলেন শহীদ আহমদ নাজ্জার রহ.-এর বিধবা স্ত্রী৷ আহমদ নাজ্জার রহ. শহীদ হওয়ার পর তারেক আনওয়ার তাকে বিয়ে করেছিলেন৷ এরপর মাত্র আট মাসের মাথায় তিনিও (তারেক আনওয়ার) শাহাদাত বরণ করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সকলের ওপর রহমত বর্ষণ করুন৷
সে যাত্রায় আমাদের সাথে আরও ছিলেন- নাসর ফাহমী নাসর, তার স্ত্রী উম্মে আয়াত সাদিয়া আহমদ বায়ুমী ও তাদের সন্তানেরা৷ উম্মে আয়াত ছিলেন শহীদ নাযিহ নুসহী রাশেদ রহ.-এর বিধবা স্ত্রী৷ নাযিহ রাশেদ রহ. শহীদ হওয়ার পর নাসর ফাহমী নাসর তাকে বিয়ে করেছিলেন৷ পরে তাঁরা উভয়ে একত্রে শাহাদাত বরণ করেন৷ রহিমাহুমুল্লাহ৷ আরও ছিলেন ডা. আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফি.-এর স্ত্রী উম্মে ফাতেমা ইযযা আনওয়ার নুয়াইর এবং তাঁর চার সন্তান৷ সে সময় ড. আইমান আয-যাওয়াহিরী শাইখ উসামা রহ.-এর সাথে তোরাবোরা পাহাড়ে ছিলেন৷ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ সাইয়িদ ও তার স্ত্রী খাদিজা বিনতে শায়েখ শহীদ আবু ইসমাইল আহমদ বাসিয়ুনী আদ-দুয়াইদার এবং তার ছোটো দুই ছেলেমেয়েও ছিলেন আমাদের সাথে৷ আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন৷
আমরা সবাই খোস্ত এলাকার এক বন্ধুপ্রতিম ভাই আবু হামযা আল-জাওফী রহ.-এর বাড়ি যাই৷ প্রায় এক সপ্তাহ সেখানে থাকার পর উম্মে ফাতেমা, উম্মে আয়াত, খাদিজা এবং তাদের সন্তানদেরকে উম্মে হামযা জাওফীর কাছে রেখে আমরা ওয়ারদাকে চলে আসি৷ ওয়ারদাকে উস্তাদ মুহাম্মদ ইয়াসিরের বাড়িতে দুই মাস থেকে চারখ জেলার বড়ো এক বাড়িতে গিয়ে উঠি। এখানে আমি, সাইয়িদা হালাওয়া, উম্মে আয়াত সাদিয়া আহমদ বায়ুমী, উম্মে ফাতেমা ইযযা আনওয়ার নুয়াইর, তাদের সকলের সন্তান এবং আমাদের সবার স্বামী- সবাই ছিলাম। শুধু ডা. আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফি. তখন আমাদের সাথে ছিলেন না।
চারখের বাড়িটায় দু-তিন সপ্তাহের মতো ছিলাম। মনে তখন কিছুটা স্বস্তির অনুভূতি ছিল। কিন্তু বিপদাপদ দ্রুতই ধেয়ে আসছিল। দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছিল। নর্দান অ্যালায়েন্সের হাতে একের পর এক জেলার পতন হচ্ছিল। চারখ হলো লোগার প্রদেশের একটি জেলা। যখন লোগার প্রদেশের পতন হলো, আমার স্বামীসহ অন্যান্য মুজাহিদ ভাইয়েরা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ, নর্দান অ্যালায়েন্সের সৈন্যরা কাছাকাছি চলে এসেছিল। তাই কান্দাহার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। তখন ঠিক দুপুর। স্থানীয় লোকজন বলল, ট্যাংক দিয়ে কান্দাহারের সব রাস্তা আটকে রাখা হয়েছে। আকাশেও ঘনঘন হেলিকপ্টার ও বিমান উড়ছে। এই পথে গেলে আমেরিকান বোমারু বিমানের নিশানা হতে হবে। আমরা ঘর থেকে বের হয়ে গাড়িতে চড়ে বসার পর স্থানীয় লোকজন আমাদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনলেন। বললেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। আমরা আপনাদের সাথে আছি।’
কিন্তু, আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেও মাথার ওপর ঘনঘন বিমান উড়ছিল। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো কিছুর আভাস দিচ্ছিল না। ফলে ভাইয়েরা ঠিক করলেন, আমরা রাতের বেলা খোস্ত যাব। সিদ্ধান্তমতে অল্প কিছু দরকারি জিনিস নিয়ে গাড়িতে চড়লাম। এক বাসে উঠলাম আমি ও আমার মরহুম স্বামী তারেক, সাথে সাইয়িদা হালাওয়া ও তাঁর পাঁচ সন্তান। অন্য আরেকটি বাসে নাসর ফাহমী নাসর ও তাঁর স্ত্রীসহ সাতজন ছেলেমেয়ে। ডা. আইমানের স্ত্রী উম্মে ফাতেমা ও তাঁর চার সন্তানও এই বাসে ছিলেন। আরেকটি গাড়িতে ছিলেন মুহাম্মদ সাইয়িদ ও তাঁর স্ত্রী খাদিজা বিনতে আবু ইসমাইল, সাথে তাদের দুই সন্তান।
জালালুদ্দিন হক্কানি রাহি.-এর মেহমানখানায়
২০০১ সালের নভেম্বর মাস। রাত আনুমানিক আটটার দিকে আমরা রওনা দিই। শীত নেমে এসেছে তখন পুরোদমে। গাড়ির বহর ছুটে চলছে দ্রুত গতিতে। তালেবান সদস্যরা পুরো রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে ছিলেন। নর্দান অ্যালায়েন্সের মিলিশিয়ারা যেসব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল, সেগুলো এড়িয়ে নিরাপদ রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা। আমরা সকলেই খুব ভয়ে ছিলাম। সারাটা পথ যিকিরে মশগুল থেকেছি। একটু পরপর মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দে বোমারু বিমান উড়ে যাচ্ছিল। পাকতিয়া প্রদেশের রাজধানী গারদেজে পৌঁছালে বহুসংখ্যক তালেবান সদস্যকে রাস্তায় অবস্থান করতে দেখলাম। রাত তখন এগারোটা। তারা বললেন, সামনে রাস্তা বন্ধ, তাই খোস্তের দিকে যাবেন না।
অবশেষে, গারদেজে শায়খ জালালুদ্দিন হক্কানি রাহি.-এর একটি বাড়িতে উঠলাম। বাড়িটি বেশ বড়ো ছিল। মেহমানখানা হিসেবেই এটি ব্যবহার হতো। আমরা দ্বিতীয় তলায় গিয়ে উঠলাম। নারী ও ছোটো শিশুরা এক কামরায় আর পুরুষ ও বড়ো ছেলেরা আমাদের পাশের কামরায়। দুই কামরার মাঝখানে লম্বা করিডর। তার একপাশে একটা বাথরুম।
শাহাদাতের পূর্বাভাস
আকাশে তখনও প্রচণ্ড শব্দে বিমান উড়ছে। এক বোন খাদিজা বিনতে আবু ইসমাইলকে বললেন, ‘আপনার স্বামীকে একটু জিজ্ঞাসা করবেন, এই বিমানগুলো কেন উড়ছে?’
খাদিজা কামরা থেকে বের হয়ে তাঁর স্বামীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন, ‘আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। খারাপ কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।’ খাদিজা ফিরে এসে বোনদের এই কথা শোনালেন।
উম্মে আয়াত বললেন, ‘হয়তো আল্লাহ আমাদের শহীদী মৃত্যু দান করবেন। আর আমি আমার বাবাকে জান্নাতে দেখতে পাবো।’ তাঁকে অনেক আনন্দিত দেখাচ্ছিল। তিনি আরও বললেন, ‘এমনও তো হতে পারে, ঘুমন্ত অবস্থায় আল্লাহ আমাদের শাহাদাত দান করবেন।’
তার মেয়ে আয়াত তখন আমার সাথে কথা বলছিল। তার মায়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখলাম, তাকে আগের চাইতে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। বললাম, ‘তুমি তো অনেক সুন্দরী হয়েছ।’
আয়াত হেসে বলল, ‘খালাম্মা, আপনি সবসময়ই বলেন, আমি সুন্দর হয়ে গেছি।’ মেয়েটি কুরআনের হাফেযা ছিল। তার তিলাওয়াত ছিল খুবই হৃদয়কাড়া। আল্লাহ তাঁদের সকলকে কবুল করুন।
আমরা একসাথে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করি। খাদিজা আমাদের সাথে নামাজ পড়তে পারেননি। পরে তিনি নামাযে দাঁড়ান। তার ছোটো দুই সন্তান পায়ের কাছে বসে রইল। মাত্রই ঘুমানোর জন্য কামরা গুছিয়ে ডান কাতে শুয়েছি। ঘুমানোর দুয়াগুলো পড়ছি। ঠিক তখনই মনে হলো আশপাশের সব শান্ত হয়ে গিয়েছে, বিমানেরও কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আচমকাই প্রথম বোমাটি আঘাত করল। বোমার আঘাতে বাড়ির ছাদ ধসে পড়ল আমাদের ওপর।
ধ্বংসস্তূপের নিচে
মুহূর্তেই চারপাশের পরিস্থিতি পালটে গেল। প্রথমেই শাহাদাত লাভ করল আয়াত, তার মা এবং তার ছোটো মেয়ে আয়েশা। আয়েশা আর হাফসা ছিল যমজ বোন। তাদের বয়স ছিল, মাত্র এক বছর তিন মাস। আয়েশা শহীদ হলেও হাফসা বেঁচে যায়। উম্মে আয়াতের ছোটো ছেলে মুহাম্মাদ চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘খালা, আমাদের এখান থেকে বের করুন।’
তাকে বললাম, ‘বাবা, আল্লাহর শপথ, আমি নড়তে পারছি না। কীভাবে তোমাকে উদ্ধার করব। আমাদের ওপর ছাদ ধসে পড়েছে।’
উম্মে ফাতেমা আমাকে চিৎকার করে ডাকছিল আর বলছিল, ‘আমার ওপর থেকে পাথরটা সরান।’
কেঁদে কেঁদে বললাম, ‘আল্লাহর শপথ, আমিও নড়তে পারছি না।’
একটু পরেই তাদের আওয়াজ থেমে গেল। মুহাম্মাদ বিন উম্মে আয়াত ও উম্মে ফাতেমা শাহাদাত বরণ করলেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের কবুল করুন।
বিস্ফোরণের সময় খাদিজা বিনতে আবু ইসমাঈল নামায পড়ছিলেন। তখনই আমাদের ওপর ছাদটা ধসে পড়ে। তিনি আমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লেন। গলা থেকে গড়গড় শব্দ বের হচ্ছিল তাঁর। মনে হচ্ছিল, কম্বলের কারণে শ্বাস নিতে পারছেন না তিনি। হাত বাড়িয়ে কম্বলটা সরানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু, লাভ হলো না। বাম কাঁধে ছাদের ধ্বংসাবশেষ এমনভাবে পড়েছিল, একটুও নড়তে পারছিলাম না।
ছাদের নিচে আমার সাথে সাইয়িদা হালাওয়া, তাঁর আড়াই বছরের মেয়ে তাসনীম এবং চার বছরের ছেলে সালাহও আটকা পড়েছিল। সে (সালাহ) তিন বছর আগে আফগানিস্তানে শহীদ হয়েছে। রহিমাহুল্লাহ। আফগান মুরতাদ বাহিনীর ওপর মুজাহিদদের সাথে এক হামলার সময় সে শাহাদাত লাভ করে। তখন তার বয়স ছিল প্রায় বিশ বছর।
আমরা আলহামদুলিল্লাহ কোনো আঘাত পাইনি। আমাদের কামরাতেই একপাশে একটি বড়ো বইয়ের তাক ছিল। ছাদ ধসে পড়ার সময় সেটাও পড়ে যায়। ফলে, ছাদ পুরোপুরি আমাদের ওপর পড়েনি। এভাবে আল্লাহর রহমতে আমরা বেঁচে যাই। হঠাৎ ছাদের ওপর কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আশ্চর্য হয়ে ছাদের একটি ফুটো দিয়ে বাইরের থাকা মানুষটিকে ডাকতে লাগলাম। দেখলাম, উম্মে আয়াতের তেরো বছরের মেয়ে হাজার দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে তার ছোটো বোন হাফসা ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু, তাকে তখনও বের করতে পারেনি সে। পরে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে তাকেও বের করা হয়েছিল। তাদের এগারো বছরের বোন ঈমান এবং ডা. আইমান আয-যাওয়াহিরী রাহি.-এর এগারো বছরের মেয়ে খাদিজাও ধ্বংসস্তূপ থেকে ততক্ষণে বের হয়েছে।
আমরা তাদের ডেকে বললাম, ‘ধ্বংসাবশেষের ইট-পাথর সরিয়ে বের হওয়ার মতো একটু জায়গা করতে পারবে কি না দেখো? যাতে আমরা বের হতে পারি।’
তারা আমাদের বলল, ‘আমরা সবাই মিলেও দেওয়াল সরাতে পারব না।’ ধ্বংসস্তূপ এতটাই ভারি ছিল, তাদের পক্ষে সরানো সম্ভবও ছিল না।
হঠাৎ কয়েকজন পুরুষের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আরবিতে ডেকে বলছে, ‘আমাদের কথা কি কেউ শুনতে পাচ্ছেন?’
মেয়েরা তাদের ডেকে আনল। এরইমধ্যে আবারও একটি বোমারু বিমান আসায় তারা চলে গেলেন। চারপাশে আবারও নীরবতা ছেয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বিমানটি থেকে একটি বোমা নিক্ষেপ করা হলো। মেয়েরা আকাশে বোমাটি দেখেই ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটো একটি দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ধসে পড়া ছাদের ওপর তীব্র শব্দে বিস্ফোরিত হলো বোমাটি। চারপাশে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু, এই বোমাটি অকল্পনীয়ভাবে আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দিলো। তীব্র বিস্ফোরণের ফলে আমাদের ওপর থাকা ছাঁদটি সামান্য সরে গেল। এতে আমরা কিছুটা নড়াচড়া করতে পারছিলাম, ডানে-বামে, এপাশ-ওপাশ করতে পারছিলাম। কিন্তু, মেয়েরা বোমার আঘাতে দেওয়ালের ওপর আছড়ে পড়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ তেমন বড়ো কোনো আঘাত তাদের লাগেনি।
তালেবানের উদ্ধারকাজ
এই দ্বিতীয় বিস্ফোরণের দরুন ড. আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফি.-এর মেয়ে নাবিলার ওপরে থাকা ছাদটি সরে যায়। সেখান দিয়ে সেও বের হয়ে যায়। তালেবানের ভাইয়েরা আবার এসে মেয়েদেরকে একটি নিরাপদ বাড়িতে নিয়ে যান আর আমাদের উদ্ধার করার জন্য তাঁরা ইট-পাথর সরাতে শুরু করেন।
প্রথমে তাঁরা নাসর ফাহমীর মেয়ে হাফসাকে উদ্ধার করে রেড ক্রিসেন্টের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। নাসর ফাহমীর ছেলে চার বছর বয়সী মুহাম্মাদকেও তাঁরা উদ্ধার করেন। তার আঘাত গুরুতর হওয়ায় সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু, কিছুক্ষণ পরই তার মৃত্যু হয়।
আমাদের উদ্ধার করতে যখন ছাদ ভাঙতে আরম্ভ করেন, তখন তাঁরা যিকির করছিলেন। আমাদেরও যিকির করতে বলছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, ‘আপনারা এই দুয়াটি পড়ুন,
لا إله إلا الله الحليم الكريم ,لا إله إلا الله العظيم الحليم، لا إله إلا الله رب السماوات و رب الأرض رب العرش الكريم”
ধ্বংসাবশেষের এক জায়গায় সামান্য ফাঁকা করে সেখান দিয়ে সাইয়িদা হালাওয়ার দুই সন্তান সালাহ আর তাসনীমকে তাঁরা উদ্ধার করেন। তাদেরও রেড ক্রিসেন্টের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর পুনরায় উদ্ধারকাজ শুরু করেন। এবার ফাঁকা জায়গাটি আরও বড়ো হয়। সাইয়িদা হালাওয়া সেখান দিয়ে বের হতে সক্ষম হন। আমাকে শায়েখ খলিল হক্কানী বললেন, ‘বোন, আপনার হাত বাড়িয়ে দিন।’ আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। তখনই আবার একটি বিমান আসলো। আমি ভাবলাম, মনে হয় আবার বোমা ফেলবে। তাই, দেরি করতে লাগলাম, যেন আমিও শাহাদাত লাভ করতে পারি এই আশায়। তখন তিনি জোর গলায় বললেন, ‘অনুরোধ করছি বোন, একটু দ্রুত করুন, বিমান আমাদের মাথার ওপর।’ তখন আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি শক্তভাবে, খুব দ্রুত আমাকে টান দিয়ে ভগ্নাবশেষের ওপর তুলে আনলেন।
ওপরে উঠে দেখি প্রিয় বোন সাইয়িদা হালাওয়া আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারপর আমাদেরকে তালেবান ভাইয়েরা একটি বড়ো বাসে ওঠালেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের উত্তম বদলা দান করুন, আমীন। আমাদের অভয় দিয়ে বললেন, ‘ভয় পাবেন না, খুব দ্রুতই আপনাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দেবো ইনশাআল্লাহ।’
আমরা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বেঁচে যাওয়া ছোটো বাচ্চারা কোথায়? মেয়েরা কোথায়?’ আমাদের অস্থিরতা দেখে তাঁরা আগে রেড ক্রিসেন্টের ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন। সাইয়িদা হালাওয়ার দুই সন্তান সালাহ ও তাসনীম আর নাসর ফাহমীর মেয়ে হাফসাকে আমরা সেখানে পেলাম। সাইয়িদা হালাওয়া কাঁদতে কাঁদতে তাঁর সন্তানদের কোলে তুলে নিলেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে নাসর ফাহমীর মেয়ে হাফসাকে বুকে টেনে নিলাম। বাচ্চাদের সঙ্গে থাকা এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘এটা আপনার মেয়ে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
মেয়েদের কাছে যাওয়ার জন্য আমরা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বের হলাম। তাদের নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল। এরই মধ্যে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন রাত দুটো।
চলবে ইনশাআল্লাহ.....
Comment