ইসলামের ঘোরতর বিরোধী এবং অন্য ধর্মে বিশ্বাসী, কিন্তু জীবনের কোনো এক পর্যায়ে আল্লাহর ইচ্ছায় হিদায়াত লাভ করে ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন – এমন ব্যক্তি ও তাঁর ঘটনা সত্যিই রোমাঞ্চকর ও বিরল। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অসংখ্য। চলমান গ্লোবাল জিহাদেও এমনই এক ঘটনার নায়ক আল কায়েদার অত্যন্ত চৌকস যোদ্ধা শায়েখ আদাম ইয়াহইয়া গাদান। ইহুদি বাবা ও খ্রিষ্টান মায়ের সন্তান, আমেরিকার ওরেগন অঞ্চলে যার জন্ম, তিনি কিভাবে দীক্ষিত হলেন দ্বীন ইসলামে? কিভাবেই বা তিনি সূদুর পথ পাড়ি দিয়ে বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়ালেন পাক-আফগানের রণাঙ্গন? কিভাবে তিনি হয়ে উঠলেন আল-কায়েদা ও তালিবানের আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব এবং আমেরিকার ‘ট্রেইটর’ বা বিশ্বাসঘাতকের লিস্টে থাকা একমাত্র মুসলিম?
আদাম ইয়াহইয়া গাদানের রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনের এসকল খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
শৈশব
আদাম ইয়াহইয়া গাদান, তার অপর নাম আযযাম আল আমরিকি। তিনি ১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর আমেরিকার ওরেগন রাজ্যের পোর্ট ওরফোর্ড অঞ্চলে এক খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় এ্যাডাম পার্লম্যান। তার পরিবারের ধর্মীয় পরিচয় ছিল বৈচিত্র্যময়। ১৯৭০ এর দশকে তার বাবা-মা খ্রিষ্টান ধর্মের শিরকি বিশ্বাস পরিত্যাগ করে ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিষ্ট ধর্মের সংমিশ্রণে তাওহীদবাদী এক মতবাদ গ্রহণ করেন। তারা নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতেন না, কিন্তু সালাত আদায় করতেন আবার রমাদান মাসে সাওম পালন করতেন। তারা মুসলিম কমিউনিটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করতেন। আদাম নিজের বাবা-মা সম্পর্কে বলেন, তারা তাকে স্কুলে পাঠাতেন না এই বলে যে, আমেরিকায় প্রচলিত সংস্কৃতিতে আদামের বেড়ে উঠা উচিত নয়। তারা এরূপ শিক্ষাকে মানব ফিতরাতের পরিপন্থি বলে আখ্যায়িত করতেন। এর পরিবর্তে তাকে হোম-স্কুলিং এর মাধ্যমে পড়ালেখা শিখানো হয়। তার বাবা-মা, দাদা-দাদি শিক্ষিত ছিলেন, তারাই তাকে হোমস্কুলিংয়ের মাধ্যমে হাইস্কুল পর্যায়ের শিক্ষাদান করেন।
হিদায়াতের পথে যাত্রা
আদাম কৈশোর বয়সে বাস্কেটবল খেলা এবং ‘মেটাল’ ধাঁচের গানবাজনার প্রতি আকৃষ্ট হন। তার পারিবারিক অনুশাসন তাকে টেলিভিশন ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেয়নি। অল্প বয়স থেকেই আদাম তার বাবার দেখাদেখি তাওহীদবাদের ধারণা ও ইসলাম নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠেন।
১৫-১৬ বছর বয়স থেকে তিনি তার দাদার বাড়িতে থাকা শুরু করেন। সেখানে ছিল এক বিশালাকারের লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটি ইসলাম নিয়ে গবেষণায় আদামকে অনেক সহায়তা করে। বই এবং ইন্টারনেটের আর্টিকেল ঘেঁটে তিনি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৫ সালে তিনি দ্বীনে ইসলাম গ্রহণ করেন। ওরেগন রাজ্যের অরেঞ্জ কাউন্টির ইসলামিক সেন্টারে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন দেশ ও মতাদর্শের মুসলিমদের সাথে উঠাবসা শুরু করেন। প্রত্যেক মতাদর্শের মুসলিমদের নিজ নিজ মজলিস বা সার্কেল ছিল, এমনকি অনেকক্ষেত্রে তাদের মসজিদও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা সভার আয়োজন করতেন। তিনি সবার কথাই শুনতেন এবং সবার সাথেই যোগযোগ রাখতেন।
তামান্না শাহাদাত, আফগানে প্রথম হিজরত
আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি যেখানে চাকুরি করতেন, সেখানে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন একজন মুসলিম। ঘটনাক্রমে একদিন তিনি অফিসের কোন একটি কাজে ভুল করে ফেলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ভুলের কারণে তার মন খারাপ হয়ে যায়, তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়েন। তখন তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, দেখো, এই দুনিয়া তো নশ্বর, আখিরাতের তুলনায় নগণ্য। নগণ্য এই দুনিয়ার একটি কাজে ব্যর্থ হয়ে এত মন খারাপ করলে কিভাবে হবে? মুসলিমদের এসব ছোট-খাটো বিষয়ে মন খারাপ করা উচিত না। দেখো, তুমিও হয়তো একদিন জিহাদ করবে, শহীদ হবে। কথাগুলো বলে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে সান্ত্বনা দেন। কিন্তু আদামের কাছে কথাগুলো একটু অন্য রকম মনে হল। এভাবে কেউ কখনো তাকে সান্ত্বনা দেয়নি। তিনি নিজেও কখনো জিহাদ করে শহীদ হবার কথা চিন্তাও করেন নি। কিন্তু তিনি কেন হঠাৎ তাকে এই কথা বললেন? জিহাদ করে শহীদ হবার সেই কথা তার কানে বারবার বাজছিল, কেন এমন হচ্ছিল তিনি বুঝতে পারছিলেন না। তিনি কৌতুহল নিয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলেন।
এমতাবস্থায় আফগানে তালিবান মুজাহিদগণ ক্ষমতা দখল করে ইসলামি ইমারাত ঘোষণা করেন। আমরিকান মুসলিম কমিউনিটিতে এই সংবাদ নিয়ে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। একদিন আদাম এক ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে জানতে পারলেন, তিনি নাকি আফগান জিহাদের ময়দান থেকে এসেছেন। সবাইকে খুব গর্ব করে তিনি আফগানের জিহাদের ময়দানের কাহিনীগুলো শুনাচ্ছিলেন। আদাম ধীরে ধীরে তার সাথে বন্ধুত্ব পাতালেন।
একদিন সেই আফগান ফেরত ভাইটি আদামকে কিছু ভিডিও দেখালেন, বললেন যারা সেখানে যেতে চায়, তাদের জন্য তিনি ব্যবস্থা করতে পারবেন। আদাম ভাবলেন, এই তো সুযোগ! জিহাদের ময়দান দেখার এই সুযোগ কিভাবে হাতছাড়া করা যায়? যদিও আদামের তখন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর ময়দানের কঠিন প্রশিক্ষণ এবং একজন মুজাহিদের নিয়মতান্ত্রিক জীবন নিয়ে কোনো ধারণাই ছিলনা, এর জন্য তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন না।
ভিসার জন্য আদাম ক্লিন শেইভ করে ছবি তুললেন। তার মুসলিম বন্ধুরা তো তাকে দেখে অবাক। তারা বলতে লাগলেন ‘আদাম! তুমি দাড়ি কেটে ফেলেছ?’ অনেকে না বুঝে কানাঘুষা করতে থাকে। কিন্তু আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহির তো এসবে কর্ণপাত করার সময় নেই। তিনি কাউকে না জানিয়ে সেই আফগান ফেরত ভাইয়ের সাথে সরাসরি পাকিস্তান চলে এলেন। সেখান থেকে আরো অনেক ঝামেলা পেরিয়ে আফগানিস্তান।
সাধারণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত আদাম এমনিতেই বহুপথ সফরের পর ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। এর মধ্যে কোনো বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে দায়িত্বশীল মুজাহিদগণ সোজা তাকে ট্রেনিং ক্যাম্পের দিকে পাঠিয়ে দেন। আদামের আসলে তখনো নিয়ত ছিলনা জিহাদের ময়দানে অংশ নেওয়ার। কাউকে তিনি বলতেও পারছিলেন না যে তিনি শুধু আফগান রণাঙ্গন দেখার জন্য এসেছেন, ট্রেনিং নেয়ার জন্য না। কিন্তু এক ট্রেনিং ক্যাম্পে টিকতে পারছেন না দেখে, মুজাহিদগণ তাকে অন্য ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। এদিকে হঠাৎ করে এত শারীরিক পরিশ্রমে তার অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে লাগল।
পাকিস্তান থেকে আফগানে আসার পথে কিছু ভাইয়ের সাথে তার পরিচয় করে দিয়েছিল আফগান ফেরত সেই ভাইটি। তাদের একজনকে একদিন তিনি পেয়ে গেলেন। এরপর তার মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। কিছুটা সুস্থ হবার পর তিনি আমরিকা ফেরত যাবার জন্য রওনা হলেন। পথে সেই পরিচিত ভাইটির সাথে দেখা। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “আরে আদাম, কোথায় যাচ্ছ তুমি? চলে যাচ্ছ বুঝি? কষ্ট তো আসবেই, কিন্তু এত বড় সুযোগ ক’জনকেই বা আল্লাহ তা’আলা দেন?” তিনি কিছু নাসীহাহ করলেন। কিন্তু ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আদামের মনোবল তখন একেবারে ভেঙে পড়েছে, জিহাদের ময়দান তো দূর, ট্রেনিং নেবার শক্তিও তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তিনি আমেরিকা ফেরত চলে আসলেন।
তাকে দেখে তার পরিবার বন্ধু-বান্ধব তো অবাক। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, “এতদিন পর কোথা থেকে উদয় হলি? তোর কোনো খোঁজ-খবরই পাইনি।” তিনি বিভিন্ন কথা বলে তাদের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু দিন অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলেছেন। আল্লাহর রাস্তায় যারা নিহত হয় তারা তো জীবিত। আর জান্নাতে যাবার পথে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো বাধা তাদের সামনে নেই। অল্প কিছুদিন পরই তিনি পুনরায় এবং স্থায়ীভাবে আফগানিস্তানে পাড়ি জমান।
একনিষ্ঠতা: উন্নতির চাবিকাঠি
আফগানিস্তানে বিদেশি মুজাহিদদের আরব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তালিবান পরিচালিত আফগান ক্যাম্পগুলো ছাড়াও আদাম ইয়াহইয়া গাদান- আবু মুসআব আস সুরি, আইমান আয যাওয়াহিরি, আবু ইয়াহইয়া আল লিবি, আবু মুহাম্মাদ আল মিসরি, উসামা বিন লাদেন – এসকল মহান নেতার আরব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ পর্যায়ে নিষ্ঠা, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ও আমেরিকান সংস্কৃতির সাথে ভালো পরিচয় থাকার কারণে তিনি ক্যাম্প কমান্ডারদের নজরে পড়ে যান। এক পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে তিনি আল-কায়েদার সাথে যুক্ত হন।
এক সাক্ষাৎকারে আদাম বলেন, যেসকল ভাই নাইন-ইলেভেন পরিচালনা করেছেন, তিনি তাদের সাথে একই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ অনেক বেশি জটিল হবার কারণে তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি, অন্যথায় তিনিও নাইন ইলেভেনের স্কোয়াডে যুক্ত হতে পারতেন। তিনি ২০০১ সালে মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাক্ষাত লাভ করেন। মোল্লা মুহাম্মাদ উমর সম্পর্কে আদাম বলেন, তাকে দেখে তিনি অন্য সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা করতে পারছিলেন না।
নিজের কর্মদক্ষতার গুণে তিনি তালিবান মুজাহিদের ইংরেজি ম্যাগাজিন “Islamic Emirate of Afghanistan” এর সম্পাদনার দায়িত্ব পান। এক বছরের ম্যাগাজিনটির ৮টি ইস্যু প্রকাশিত হয়। আদামের ভাষ্যমতে, এই ম্যাগাজিনের অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে তার আরবী আরো মজবুত হয়েছিল।
আদাম ইয়াহইয়া একে একে আল-কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন। শায়েখ উসামা বিন লাদেন রহমাতুল্লাহি আলাইহির একটি জনপ্রিয় ভিডিও, যেখানে দেখানো হচ্ছিল তিনি একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে বসে টার্গেট প্র্যাকটিস করছেন – সেই ভিডিওতে শায়েখ উসামার পিছনে দাঁড়ানো উৎসুক জনতার মাঝে আদাম ছিলেন একজন।
ড.আইমান আয যাওয়াহিরিকে দেখে আদাম খুবই অনুপ্রাণিত হন। আযযাম আল-আম্রিকি নামে আদামের প্রকাশিত লেখনিগুলো শাইখ যাওয়াহিরীর নজর কাড়ে, তার কাছে খুব ভালো লাগে। তিনি আদামকে ইংরেজি ভাষায় ভিডিও বানানোর নির্দেশ দেন। তিনি ভিডিও বানিয়ে শাইখ যাওয়াহিরীকে দেখান। শাইখ তাকে বিভিন্ন বিষয়ে নসীহা দেন এবং ভিডিওর ব্যাপারে কিছু দিক নির্দেশনা দেন।
এক পর্যায়ে আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে শাইখ উসামার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি আল কায়েদার অনুবাদক, ভিডিও নির্মাতা এবং মিডিয়া শাখার প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। আদাম এক ভিডিওতে আমেরিকাকে ‘Enemy Soil’ বা শত্রুদের ভূমি বলে আখ্যায়িত করেন এবং আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি নয়-এগারোর হামলাকারীদের প্রশংসা করেন।
বর্তমানে আল কায়েদার মিডিয়া আস-সাহাবের সর্বপ্রথম ভিডিও প্রকাশ করা হয় ২০০১ সালে, এবং ধারণা করা হয় আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই ভিডিও তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। আমেরিকা এবং ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্বাস, আদাম আস-সাহাব মিডিয়ার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ২০০৬ সালে ‘An Invitation to Islam’ নামে আল-কায়েদার প্রকাশিত ভিডিও ডকুমেন্টারিতে শায়েখ যাওয়াহিরি পশ্চিমে বসবাসরত মুসলিমদের আদামের মত হবার জন্য নাসিহা করেন এবং আদামকে ‘একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করেন, যিনি মানুষকে ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে চান’। এর আগে আল-কায়েদার কোনো সদস্যকেই এরূপ সরাসরি উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি, যেমনটা আদামকে করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, একজন আমেরিকান হয়েও আদাম নিজের কর্মদক্ষতার গুণে আল-কায়েদার নেতাদের কতটা আস্থাভাজন হতে পেরেছিলেন।
আল-কায়েদার ভিডিওতে আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহির উপস্থিতি
আদাম ইয়াহইয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে আল-কায়েদার অনেকগুলো ভিডিওতে দেখা গেছে। ২০০৪ সালের অক্টোবরে আদাম ৭৫ মিনিট দীর্ঘ একটি ভিডিও তৈরি করেন। এবিসি নিউজ সেটি সম্প্রচার করে। ভিডিওতে আদাম আমেরিকার উপর হামলা চালানোর হুমকি দেন। ২০০৫ সালে নাইন-ইলেভেনের হামলার চার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১১ মিনিট ব্যাপি একটি ভিডিওবার্তায় উক্ত হামলার প্রশংসা জ্ঞাপন করেন। তিনি লস এ্যাঞ্জেলস এবং মেইলবোর্ন শহরে হামলার ইঙ্গিত দেন। এর কিছুদিনের মধ্যে তিনি আল-কায়েদার ‘Knowledge is for acting upon: The Manhattan Raid’ শিরোনামের আরেকটি ভিডিও ডকুমেন্টারিতে বক্তব্য প্রদান করেন।
২০০৬ সালের জুলাই মাসে তিনি একটি ভিডিওতে ইরাকে আমেরিকান সেনাদের গণহত্যা ও ধর্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ‘An Invitation to Islam’ নামক ভিডিওতে ৪৪ মিনিট যাবত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। ২০০৭ সালের মে মাসে আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি আরেকটি ভিডিওতে আমেরিকার প্রতি ৫টি দাবি উত্থাপন করে বলেন, এসব দাবি পূরণে ব্যর্থ হলে আমেরিকাকে ইনশাআল্লাহ এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে যা নাইন-ইলেভেনের দূর্বিষহ স্মৃতিকেও ভুলিয়ে দিবে। এছাড়া ২০০৮ এর অক্টোবর, ২০০৯ এর মে ও ডিসেম্বর, ২০১০ এর মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর এবং ২০১৪ সালের মার্চ মাসে আদাম ইয়াহইয়া সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন।
আমেরিকার চোখের বালি
একজন আমেরিকার নাগরিক যে আমেরিকার প্রধান শত্রুদলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে চলে যাবে, আমেরিকা এটি কল্পনাও করতে পারেনি। আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহির কার্যক্রম অনেকটা শত্রুকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে শত্রুর বুকে খঞ্জর বসিয়ে দেবার মতো। এজন্য আদামের প্রতি আমেরিকার বিদ্বেষও ছিল মারাত্মক। তাকে প্রথমে ২০০৪ সালে এফবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। ২০০৫ সালে আদাম লস এ্যাঞ্জেলস শহরে আক্রমণ চালানোর হুমকি দেন, এজন্য তাকে আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস আল-কায়েদাকে ‘ম্যাটেরিয়াল সাপোর্ট’ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। এরপর ‘An Invitation to Islam’ ভিডিওচিত্রে ড. আইমান তার প্রশংসা করার কারণে তাকে আমেরিকার সাথে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে এফবিআই এর মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তার সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য এক মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়।
গোয়েন্দা ও ড্রোনের সাথে লুকোচুরি
আদাম ইয়াহইয়া গাদান অনেকবার আমেরিকার বন্ধুপ্রতীম পাকিস্তানি প্রশাসনের হাতে গ্রেফতার হওয়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। ২০১০ সালের ৭ই মার্চ কারাচির একটি বাড়িতে রেইড চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্ত আসলে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি ছিলেন আমেরিকান বংশোদ্ভুত আরেক মুজাহিদ আবু ইয়াহইয়া মুজাহিদীন আল-আদাম, যিনি ছিলেন পেনসিলভেনিয়ার অধিবাসী। তাদের দুইজনের নাম অনেকটা কাছাকাছি হওয়ায় পাকিস্তানী গোয়েন্দারা বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং আদামকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। একাধিকবার ধারণাবশত তার অবস্থান অনুমান করে আমেরিকা ড্রোন হামলাো চালিয়েছে।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকা আল-কায়েদা নেতা আবু লাইস আল-লিবিকে ড্রোন হামলা চালিয়ে শহীদ করে দেয় এবং দাবি করে আদাম রহমাতুল্লাহি আলাইহিও একই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু মার্চের ২ তারিখে এক শীর্ষস্থানীয় আল-কায়েদা নেতা দাবি করেন, আদাম বহাল তবীয়তে আছেন। এরপর আদাম আমেরিকাকে ব্যাঙ্গ করে বিবৃতি দেন, ‘পাসপোর্ট ছিড়ে কি আমার ভ্রমণ করা বন্ধ করতে পারবে?’, অর্থাৎ আমেরিকা যেখানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে সেখানে হয়তো শুধু তার পাসপোর্টটিই ছিল, আদাম নিজে ছিলেন না। পরের বছরের সেপ্টেম্বরে ওয়াজিরিস্তানে আরেকটি ড্রোন হামলায় আদাম নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়, কিন্তু আবারও আদাম আস-সাহাবের একটি ভিডিও বার্তায় নিজের উপস্থিতির জানান দিয়ে কুফফারদের চমকে দেন।
কাঙ্ক্ষিত শাহাদাত
২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জোস আরনেস্ট এক বিবৃতিতে জানায়, আদাম ইয়াহইয়া গাদান ও তার সহযোদ্ধা আহমাদ ফারুক পাকিস্তানে এক ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। এরপর বারাক ওবামা একই বিবৃতি দিয়ে বলে, ড্রোন হামলায় তাদের সাথে ত্রাণকর্মী জিওভানি লো পোরতো এবং ওয়ারেন ওয়েইনস্টেইন নিহত হয়েছে। আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত নয় – এমন দুইজন মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার ব্যাপারে নিঃসঙ্কোচে বিবৃতি প্রকাশ করে মানবতার ফেরিওয়ালারা। পরবর্তীতে আল-কায়েদার ‘Resurgence’ ম্যাগাজিনের একটি বিশেষ সংখ্যায় আদাম ইয়াহইয়া গাদান রহমাতুল্লাহি আলাইহির শাহাদাতবরণের সংবাদ নিশ্চিত করা হয়।
আদাম ইয়াহইয়া গাদান রহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যুর সময় বয়স ছিল মাত্র ৩৭ বছর। ৩৭ বছরে আল্লাহর এই বান্দা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, জিহাদের ময়দানের হিজরত করেছেন, বিশ্বের কথিত সুপারপাওয়ার আমেরিকার দম্ভ চূর্ণ করে দেওয়া বৈশ্বিক জিহাদি জামাত আল-কায়েদার নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছেছেন এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিক শক্তিধর দেশের সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে বারবার ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ্। তিনি আফগানে হিজরত করার পরপরই এক মাজলুম আফগান নারীকে বিবাহ করেন। গতানুগতিক মুসলিম যুবকরা যেখানে নিজেদের দুনিয়াবি ক্যারিয়ার গঠন করতেই ৩০-৩৩ বছর পার করে দেয় এবং এরপর পারিবারিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সেখানে আদাম ইয়াহইয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেকে ও পরিবারকে সামলে আত্মনিয়োগ করেছেন আল্লাহর দ্বীন কায়েমে।
আল্লাহ তার উপর রহম করুন, তার শাহাদাতকে কবুল করুন।
Comment