শাহাদাত প্রেয়সী এক যুবকের ইতিকথা
প্রিয় যুবক ভাই !
তারিখের কিতাবে বর্ণিত আছে-উম্মতের চিন্তায় যারা যুগে যুগে সর্বদা পেরেশান থাকতেন । যাদের ওপর উম্মতের হেদায়াতের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার কাজ বর্তেছে। ইতিহাস বলে তাদের মধ্য থেকে একজন হলেন শহীদ আবু-মুহাম্মাদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহ ।
যিনি ছিলেন নীরব সাধকদের একজন এবং সেই সমস্ত দায়ীদের একজন যাদের বীরত্ব আর মিষ্টি হাসি বহু যুবক বৃদ্ধদের হৃদয়কে কেড়ে নিয়েছে। হঠাৎ যাদের প্রতি মানুষ অন্যরকম আকর্ষণ অনুভব করে। যাদের মাঝে রয়েছে নেতৃত্বের ও পিতৃত্বের গুণ। তিনি সে সমস্ত ব্যক্তিদেরই একজন। আবু মুহাম্মদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহ যখন কাউকে কষ্টের শেকায়েত করতে শুনতেন তখন তিনি তার কাছে সবর ও সান্তনার বাণী তুলে ধরতেন। কষ্টের বিপরীতে ধৈর্যের ফজিলত শোনাতেন । দুনিয়ার তুচ্ছ জিনিসের পরিবর্তে শাহাদাতের মর্যাদার অতি উচ্চ বিলাসিতার শীখড়(শিকড়) গেঁড়ে দিতেন।
আর যখন কোনো ভাই যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যেতে চাইতো তখন তিনি ইতিহাসের পাতায় থেকে যাওয়া মর্দে মুজাহিদদের রণাঙ্গনের অবিচলতা ও দৃঢ়তার চিত্র তুলে ধরতেন। তাদের গল্পগুলো বাস্তবতার ফুলঝুড়িতে সাঁজিয়ে রাখতেন। আর খোশগল্প করে করে তাদের হারানো মানিককে ফিরিয়ে দিতেন।
তার সার্বক্ষণিক কাজ ছিল যুবকদের তারবিয়াতি শিক্ষাদান করা। আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক আরো গভীর ও নিভীড়(নিবিড়) করে তুলা। ফিরে পাওয়া সন্তানের মত করে যত্ন নিতেন মুসাফির ভাইদের। নিজের পাত্র থেকে খাবারের দানাগুলো অতি উৎসাহের সাথে তুলে দিতেন শাহাদাতের স্বপ্নবুনা যুবক ভাইদের দস্তরখানায়।
সালাতে তাঁর চোখের অশ্রুতে ভিজে যেতো জায়নামাজ। হাঁটতে গেলে পিঠ বাঁকা হয়ে থাকতো বিনয়ের ভারে। কথা বলতে গেলে সাবলীলতার সুবাস ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। সুন্নাহর পাবন্দিতে ভাই ছিলো সেরাদের কাতারে। মেসওয়াক করা ছিলো তাঁর নিত্যদিনের বেশ পছন্দনীয় আমল।
প্রিয় যুবক ভাই!
আবু মুহাম্মদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহর জন্ম তাইয শহরে। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী এক তাগড়া নওজোয়ান। প্রখর মেধার অধিকারী। বুদ্ধি দীপ্ততার পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জনকারী। তিনি ময়দানে আসা অবস্থায় জামিয়াতুস সউথ [রিয়াদ] ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত ছিলেন।
সে সময় জাজিরাতুল আরবের দলগুলোর সাথে তিনিও খোরাসানে আসলেন। তখনকার সময়টা ছিল প্রচন্ড শীতকাল। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। সেখানে আসার সেটাই ছিল উত্তম সময়। সে দলগুলোর সাথে আবু মোহাম্মদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহও এসেছিলেন। তখনই তার অন্তরে জিহাদের প্রতি সত্তিকারের ভালবাসা জন্মেছিলো।
সফর শেষে তিনি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন কিন্তু তার অন্তর পরে রইলো মুজাহিদীনদের(মুজাহিদদের/মুজাহিদীনের) মাঝে। মুজাহিদীন ভাইদের আচার-আচরণ, আমল আখলাক, তরবিয়তী জলসা, গবেষণা, দিনাতিপাত তাঁকে খুবই মুগ্ধ করে। অনুপ্রাণিত করে বাস্তবমুখী হওয়ার। সত্যান্বেষী হবার ছোঁয়া তাঁকে বারবার তাড়া করে।
রিয়াদে শুধু তার দেহটাই ফিরে গেলো। তাঁর অন্তরে কেমন জানি অশান্তি বিরাজ করছে! সবার সাথেই পানাহার করে কিন্তু এখানে সেখানে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। শহরের চারপাশ শুধু ঘুরে বেড়ায়। কেমন যেন সবকিছু ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা মনে হয় অথচ তার সমগ্র সত্তা ও আত্মা জুড়ে শুধুই জিহাদ আর মুজাহিদীন। যারা কিনা উম্মতের জন্য রক্ত ঝরাতে কোন দ্বিধা করেন না ।
তবুও শান্তি চাই। তবুও ইসলাম ও মুসলমানের বিজয় চাই। তবুও ভূমিহারারা ফিরে পাক একমুঠো ভিটেমাটি। মায়ের আর না ঝরাক চোখের অশ্রু। বোনেরা আর না গড়াক রক্তের বন্যা। শিশুরা আর না হোক কাবাব। বাবারা আর না হোক পরিবারহারা। এটাই তাঁদের স্বপ্ন।
এক পর্যায়ে ভাই মুহাম্মাদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করাটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো। এখানে শুধু রসায়ন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। মিশ্রণের বিভিন্ন প্রকারাদি, কোনটা মৌলিক পদার্থ, কোনটা যৌগিক পদার্থ, কোনটা অপরিহার্য আর কোনটা না হলেও চলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিরস ও নিষ্পয়োজনীয় আলোচনা ।
সেখানে সাধারণত বলাবলি হতো এসবের আবিষ্কারকরা কবে বিগত হয়েছেন। অথচ কয়েক শতাব্দি ধরে এসব আলোচনা চলে আসছে। এসব মিশ্রন ও যৌগিকের আলোচনা শুনতে শুনতে ছাত্রদের কান ব্যথা হয়ে যেতো, ঝালাপালা হয়ে যেতো। সেখানে আবু মুহাম্মাদ ইয়ামানির কি অবস্থা তা বলাই বাহুল্য!
সুতরাং সে যে কোনো মূল্যে এই অবস্থার অবসান ঘটানো অতি জরুরী। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং জিহাদ ফি- সাবিলিল্লাহ পথে যাত্রা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে কাফেলার সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন । তাঁর সৌন্দর্য দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতে লাগলেন। বাক-সংযম, যিকির-আযকার , কোরআন তেলাওয়াত , স্বভাবসুলভ আচরণ, অসুস্থদের সেবা-শুশ্রূষা, সর্বদা সাথি-সঙ্গীদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা ও চলাফেরা করা ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অমায়িক আচরণ।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অল্পদিনেই তিনি প্রিয়পাত্রে পরিণত হলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার সময় কেটে আসা হল এপথে। একদিন ক্যাম্পের দিকে একটি গোলা ছুঁড়ে এলো। শূন্যে থাকতেই সেটি বিস্ফোরিত হলো। আবু মোহাম্মাদ ইয়ামানী ও তাঁর দুই সাথী এ হামলার শিকার হলেন। কিছুক্ষণ পর মুজাহিদীনদের(মুজাহিদদের/মুজাহিদীনের) একজন ডাক্তার ছুঁটে এলেন এবং আবু মোহাম্মদ ইয়ামানি ও তাঁর সাথীদের প্রাথমিক চিকিৎসা করলেন। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো।
তাঁর আঘাত লেগেছিল দুই পায়ে এবং বুকে। বুকের আঘাত ছিল মারাত্মক। তাঁর এ অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি গাড়ি আনা হলো এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি গাড়ির মধ্যেও যিকির করছিলেন। এমন কঠিন মুহূর্তে যিকির করা হয়তো আল্লাহ তা'লার কাছে ভালো লেগেছিলো। তাই তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে তাঁর কাছে ডেকে নিলেন । সেটা ছিল রমজানের ১৯ তম দিন।
তাঁদের সাথী ভাই আবুল বাশার জিজ্ঞাসা করলেন- হে আমার ভাই আবু মোহাম্মদ! তুমি কেমন বোধ করছো! উত্তরে তিনি বললেন-ভাই! আমি পৌঁছে গেছি, পৌঁছে গেছি, আর সেটাই ছিলো তাঁর জবানের উচ্চারিত শেষ বাক্য। তাঁর ইন্তেকালের পর আকাশ বাতাস যেন জান্নাতি খুশবুতে ভরে গেলো।
ডাক্তার আবুল-বাশার সাহেব বলেন-আমি বুঝতে পারলাম যে, আবু মোহাম্মাদ ইয়ামানি রাহিমাহুল্লাহ আল্লাহর কাছে চলে গেছেন । তিনি এভাবেই শাহাদাত বরণ করলেন। তিনি ছিলেন আমাদের চোখের তাঁরা। তাঁর ভার্সিটি ছেড়ে আসা সেই ত্যাগ-তিতিক্ষার কথাগুলো এখনো আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। তাঁকে ঘিরে আমাদের কত আশা আকাঙ্ক্ষা ছিলো! তাঁর হৃদয়ে উম্মাহর প্রতি কত সবুজ সপ্নিল সপ্ন আঁকা ছিলো! স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কখনও ককিয়ে উঠতো! তাঁর এ চিত্র ভুলবার মত নয়। মনকে শীতল করার মত। আল্লাহ ভাইকে জান্নাতে রিযকে ওয়াছি দান করুক। তাঁর মেহমানিদারী নিজ হাতে করুন। রব! তুমি কিভাবে তাঁদের পুরষ্কৃত করবে সেটা তোমার মানশায়।
আসলে তিনি ছিলেন এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। বয়স তখনো তেইশের কোঠা পার করেননি। অথচ উম্মাহর চিন্তায় তাঁর চুল সাদা হতে শুরু করলো। চোখে মুখে বয়সের ছাপ পড়ে গিয়েছিলো। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে খোদাভীরু, মর্যাদাশীল এক তরুণ। তাঁর ছিলো মেধার তীক্ষ্ণতা, চরিত্রের কোমলতা, স্বভাবের স্বচ্ছতা। তাঁর চোখ থেকে ঝরে পড়তো প্রতিজ্ঞার বিন্দুকনা। তাঁর বুকে ছিলো সদা জাগ্রত এক আকাঙ্ক্ষা।
প্রিয় যুবক ভাই!
দুনিয়ার সার্টিফিকেট তো তিনিও অর্জন করেছিলেন। সেটাও আবার স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটি থেকে। কিন্তু ভাই এটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, দুনিয়ায় যত বড় সার্টিফিকেট অর্জন করি না কেন তা পরকালে আমার কোনই কাজে আসবে না! তাই তিনি তা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন! এবং সুউচ্চ মর্যাদা পথ শাহাদাতকে খুঁজে বের করলেন এবং শামিল হলে গেলেন জিহাদ ও মুজাহিদদের সাথে। আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য। সারা বিশ্বে কালিমার পতাকা উড্ডীন করার জন্য। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন। অবশেষে শাহাদাতের রক্তপথ পাড়ি দিয়ে চলে গেলেন জান্নাত নামক আপন গৃহে। এরচেয়ে বড় সার্টিফিকেট আর কি হতে পারে যুবক ভাই? এরচেয়ে বড় পুরষ্কার আর কি হতে পারে বন্ধু আমার?
ও যুবক ভাই!
সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন হতাশার কালো মেঘ কেটে যাবে। সারা বিশ্বে মুসলমানদের বিজয় পতাকা স্বাধীনভাবে খচিত হবে। যেদিন শাম আর কাশ্মীরের বোনেরা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাইতুল্লাহ যিয়ারত করবে। পথিমধ্যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পাবে না। জমিনে এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা করবে না। অন্তরে প্রিয় নাবীর ভালোবাসা ছাড়া আর কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে না।
যুবক ভাই! উম্মাহর মহব্বত যদি তোমাকে ঘর থেকে বের করতে না পারে। দ্বীনের মায়া যদি তোমাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারে। রবের আদেশ আর রাসূলে ভালোবাসা যদি তোমার কাঁধে তরবারি তুলে দিতে না পারে। তাহলে মনে রেখো মিথ্যা এ মায়া তোমাকে জাহান্নামের অতলান্তে নিয়ে যাবে। কোটি টাকার সার্টিফিকেট তোমাকে শয়তানের সাথী হওয়ার সুযোগ করে দিবে। সম্পদের পাহাড় তোমাকে দাজ্জালের হাতিয়ার হওয়ার পথ মসৃণ করে দিবে।
যুবক ভাই! রব তোমাকে শেষ বারের মত সজাগ করে দিচ্ছেন। এবার একটু জেগে উঠো না! উম্মাহর ফিকিরে একটু রুখে দাঁড়াও না! উম্মাহর দরদে একটুখানি মাথাকে খাটাও না! নিজেকে খাদের কিনারা থেকে বাঁচাও। ধ্বংসের স্তুপ থেকে আত্মাকে বের করে নিয়ে আসো। রবের সামনে নিক্ষেপ করো। আর বলো- দয়াময় রব! তুমি তাকে দুনিয়ার এ আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে প্রাণবন্ত করে তুলো কিন্তু পরকালের আযাবের সম্মুখীন করো না। পরকালের একক শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ো না। শোন! রব তোমাকে কি বলছেন-
الم يان للذين امنوا ان تخشع قلوبهم لذكر لله
যারা ঈমান এনেছে, তাদের কি আল্লাহর স্বরণে বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি?
যুবক ভাই এ সুযোগকে কাজে লাগাও। বলতে পারবে আল্লাহ আমি তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম। তোমার বাণী শোনার সাথে সাথে মুজাহিদীনদের সাথে একত্রিত হয়েছিলাম। ঝান্ডা উঁচু করে একত্ববাদের সাক্ষী দিয়েছিলাম।
উত্তর আসতে দেরি হবে না। বান্দা! তুমি আমার প্রতিশ্রুত ওয়াদা রক্ষা করেছো। যাও আমার ক্ষমা আজ তোমার জন্য অবধারিত। তুমি আমার হক পুঙ্খানো পুঙ্খানো রক্ষা করেছো। যাও আমার দিদার তোমার জন্য চিরলিখিত। সুবহানাল্লাহ!
প্রিয় যুবক ভাই !
তারিখের কিতাবে বর্ণিত আছে-উম্মতের চিন্তায় যারা যুগে যুগে সর্বদা পেরেশান থাকতেন । যাদের ওপর উম্মতের হেদায়াতের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার কাজ বর্তেছে। ইতিহাস বলে তাদের মধ্য থেকে একজন হলেন শহীদ আবু-মুহাম্মাদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহ ।
যিনি ছিলেন নীরব সাধকদের একজন এবং সেই সমস্ত দায়ীদের একজন যাদের বীরত্ব আর মিষ্টি হাসি বহু যুবক বৃদ্ধদের হৃদয়কে কেড়ে নিয়েছে। হঠাৎ যাদের প্রতি মানুষ অন্যরকম আকর্ষণ অনুভব করে। যাদের মাঝে রয়েছে নেতৃত্বের ও পিতৃত্বের গুণ। তিনি সে সমস্ত ব্যক্তিদেরই একজন। আবু মুহাম্মদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহ যখন কাউকে কষ্টের শেকায়েত করতে শুনতেন তখন তিনি তার কাছে সবর ও সান্তনার বাণী তুলে ধরতেন। কষ্টের বিপরীতে ধৈর্যের ফজিলত শোনাতেন । দুনিয়ার তুচ্ছ জিনিসের পরিবর্তে শাহাদাতের মর্যাদার অতি উচ্চ বিলাসিতার শীখড়(শিকড়) গেঁড়ে দিতেন।
আর যখন কোনো ভাই যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যেতে চাইতো তখন তিনি ইতিহাসের পাতায় থেকে যাওয়া মর্দে মুজাহিদদের রণাঙ্গনের অবিচলতা ও দৃঢ়তার চিত্র তুলে ধরতেন। তাদের গল্পগুলো বাস্তবতার ফুলঝুড়িতে সাঁজিয়ে রাখতেন। আর খোশগল্প করে করে তাদের হারানো মানিককে ফিরিয়ে দিতেন।
তার সার্বক্ষণিক কাজ ছিল যুবকদের তারবিয়াতি শিক্ষাদান করা। আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক আরো গভীর ও নিভীড়(নিবিড়) করে তুলা। ফিরে পাওয়া সন্তানের মত করে যত্ন নিতেন মুসাফির ভাইদের। নিজের পাত্র থেকে খাবারের দানাগুলো অতি উৎসাহের সাথে তুলে দিতেন শাহাদাতের স্বপ্নবুনা যুবক ভাইদের দস্তরখানায়।
সালাতে তাঁর চোখের অশ্রুতে ভিজে যেতো জায়নামাজ। হাঁটতে গেলে পিঠ বাঁকা হয়ে থাকতো বিনয়ের ভারে। কথা বলতে গেলে সাবলীলতার সুবাস ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। সুন্নাহর পাবন্দিতে ভাই ছিলো সেরাদের কাতারে। মেসওয়াক করা ছিলো তাঁর নিত্যদিনের বেশ পছন্দনীয় আমল।
প্রিয় যুবক ভাই!
আবু মুহাম্মদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহর জন্ম তাইয শহরে। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী এক তাগড়া নওজোয়ান। প্রখর মেধার অধিকারী। বুদ্ধি দীপ্ততার পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জনকারী। তিনি ময়দানে আসা অবস্থায় জামিয়াতুস সউথ [রিয়াদ] ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত ছিলেন।
সে সময় জাজিরাতুল আরবের দলগুলোর সাথে তিনিও খোরাসানে আসলেন। তখনকার সময়টা ছিল প্রচন্ড শীতকাল। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। সেখানে আসার সেটাই ছিল উত্তম সময়। সে দলগুলোর সাথে আবু মোহাম্মদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহও এসেছিলেন। তখনই তার অন্তরে জিহাদের প্রতি সত্তিকারের ভালবাসা জন্মেছিলো।
সফর শেষে তিনি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন কিন্তু তার অন্তর পরে রইলো মুজাহিদীনদের(মুজাহিদদের/মুজাহিদীনের) মাঝে। মুজাহিদীন ভাইদের আচার-আচরণ, আমল আখলাক, তরবিয়তী জলসা, গবেষণা, দিনাতিপাত তাঁকে খুবই মুগ্ধ করে। অনুপ্রাণিত করে বাস্তবমুখী হওয়ার। সত্যান্বেষী হবার ছোঁয়া তাঁকে বারবার তাড়া করে।
রিয়াদে শুধু তার দেহটাই ফিরে গেলো। তাঁর অন্তরে কেমন জানি অশান্তি বিরাজ করছে! সবার সাথেই পানাহার করে কিন্তু এখানে সেখানে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। শহরের চারপাশ শুধু ঘুরে বেড়ায়। কেমন যেন সবকিছু ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা মনে হয় অথচ তার সমগ্র সত্তা ও আত্মা জুড়ে শুধুই জিহাদ আর মুজাহিদীন। যারা কিনা উম্মতের জন্য রক্ত ঝরাতে কোন দ্বিধা করেন না ।
তবুও শান্তি চাই। তবুও ইসলাম ও মুসলমানের বিজয় চাই। তবুও ভূমিহারারা ফিরে পাক একমুঠো ভিটেমাটি। মায়ের আর না ঝরাক চোখের অশ্রু। বোনেরা আর না গড়াক রক্তের বন্যা। শিশুরা আর না হোক কাবাব। বাবারা আর না হোক পরিবারহারা। এটাই তাঁদের স্বপ্ন।
এক পর্যায়ে ভাই মুহাম্মাদ ইয়ামানী রাহিমাহুল্লাহর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করাটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো। এখানে শুধু রসায়ন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। মিশ্রণের বিভিন্ন প্রকারাদি, কোনটা মৌলিক পদার্থ, কোনটা যৌগিক পদার্থ, কোনটা অপরিহার্য আর কোনটা না হলেও চলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিরস ও নিষ্পয়োজনীয় আলোচনা ।
সেখানে সাধারণত বলাবলি হতো এসবের আবিষ্কারকরা কবে বিগত হয়েছেন। অথচ কয়েক শতাব্দি ধরে এসব আলোচনা চলে আসছে। এসব মিশ্রন ও যৌগিকের আলোচনা শুনতে শুনতে ছাত্রদের কান ব্যথা হয়ে যেতো, ঝালাপালা হয়ে যেতো। সেখানে আবু মুহাম্মাদ ইয়ামানির কি অবস্থা তা বলাই বাহুল্য!
সুতরাং সে যে কোনো মূল্যে এই অবস্থার অবসান ঘটানো অতি জরুরী। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং জিহাদ ফি- সাবিলিল্লাহ পথে যাত্রা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে কাফেলার সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন । তাঁর সৌন্দর্য দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতে লাগলেন। বাক-সংযম, যিকির-আযকার , কোরআন তেলাওয়াত , স্বভাবসুলভ আচরণ, অসুস্থদের সেবা-শুশ্রূষা, সর্বদা সাথি-সঙ্গীদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা ও চলাফেরা করা ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অমায়িক আচরণ।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অল্পদিনেই তিনি প্রিয়পাত্রে পরিণত হলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার সময় কেটে আসা হল এপথে। একদিন ক্যাম্পের দিকে একটি গোলা ছুঁড়ে এলো। শূন্যে থাকতেই সেটি বিস্ফোরিত হলো। আবু মোহাম্মাদ ইয়ামানী ও তাঁর দুই সাথী এ হামলার শিকার হলেন। কিছুক্ষণ পর মুজাহিদীনদের(মুজাহিদদের/মুজাহিদীনের) একজন ডাক্তার ছুঁটে এলেন এবং আবু মোহাম্মদ ইয়ামানি ও তাঁর সাথীদের প্রাথমিক চিকিৎসা করলেন। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো।
তাঁর আঘাত লেগেছিল দুই পায়ে এবং বুকে। বুকের আঘাত ছিল মারাত্মক। তাঁর এ অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি গাড়ি আনা হলো এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি গাড়ির মধ্যেও যিকির করছিলেন। এমন কঠিন মুহূর্তে যিকির করা হয়তো আল্লাহ তা'লার কাছে ভালো লেগেছিলো। তাই তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে তাঁর কাছে ডেকে নিলেন । সেটা ছিল রমজানের ১৯ তম দিন।
তাঁদের সাথী ভাই আবুল বাশার জিজ্ঞাসা করলেন- হে আমার ভাই আবু মোহাম্মদ! তুমি কেমন বোধ করছো! উত্তরে তিনি বললেন-ভাই! আমি পৌঁছে গেছি, পৌঁছে গেছি, আর সেটাই ছিলো তাঁর জবানের উচ্চারিত শেষ বাক্য। তাঁর ইন্তেকালের পর আকাশ বাতাস যেন জান্নাতি খুশবুতে ভরে গেলো।
ডাক্তার আবুল-বাশার সাহেব বলেন-আমি বুঝতে পারলাম যে, আবু মোহাম্মাদ ইয়ামানি রাহিমাহুল্লাহ আল্লাহর কাছে চলে গেছেন । তিনি এভাবেই শাহাদাত বরণ করলেন। তিনি ছিলেন আমাদের চোখের তাঁরা। তাঁর ভার্সিটি ছেড়ে আসা সেই ত্যাগ-তিতিক্ষার কথাগুলো এখনো আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। তাঁকে ঘিরে আমাদের কত আশা আকাঙ্ক্ষা ছিলো! তাঁর হৃদয়ে উম্মাহর প্রতি কত সবুজ সপ্নিল সপ্ন আঁকা ছিলো! স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কখনও ককিয়ে উঠতো! তাঁর এ চিত্র ভুলবার মত নয়। মনকে শীতল করার মত। আল্লাহ ভাইকে জান্নাতে রিযকে ওয়াছি দান করুক। তাঁর মেহমানিদারী নিজ হাতে করুন। রব! তুমি কিভাবে তাঁদের পুরষ্কৃত করবে সেটা তোমার মানশায়।
আসলে তিনি ছিলেন এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। বয়স তখনো তেইশের কোঠা পার করেননি। অথচ উম্মাহর চিন্তায় তাঁর চুল সাদা হতে শুরু করলো। চোখে মুখে বয়সের ছাপ পড়ে গিয়েছিলো। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে খোদাভীরু, মর্যাদাশীল এক তরুণ। তাঁর ছিলো মেধার তীক্ষ্ণতা, চরিত্রের কোমলতা, স্বভাবের স্বচ্ছতা। তাঁর চোখ থেকে ঝরে পড়তো প্রতিজ্ঞার বিন্দুকনা। তাঁর বুকে ছিলো সদা জাগ্রত এক আকাঙ্ক্ষা।
প্রিয় যুবক ভাই!
দুনিয়ার সার্টিফিকেট তো তিনিও অর্জন করেছিলেন। সেটাও আবার স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটি থেকে। কিন্তু ভাই এটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, দুনিয়ায় যত বড় সার্টিফিকেট অর্জন করি না কেন তা পরকালে আমার কোনই কাজে আসবে না! তাই তিনি তা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন! এবং সুউচ্চ মর্যাদা পথ শাহাদাতকে খুঁজে বের করলেন এবং শামিল হলে গেলেন জিহাদ ও মুজাহিদদের সাথে। আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য। সারা বিশ্বে কালিমার পতাকা উড্ডীন করার জন্য। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন। অবশেষে শাহাদাতের রক্তপথ পাড়ি দিয়ে চলে গেলেন জান্নাত নামক আপন গৃহে। এরচেয়ে বড় সার্টিফিকেট আর কি হতে পারে যুবক ভাই? এরচেয়ে বড় পুরষ্কার আর কি হতে পারে বন্ধু আমার?
ও যুবক ভাই!
সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন হতাশার কালো মেঘ কেটে যাবে। সারা বিশ্বে মুসলমানদের বিজয় পতাকা স্বাধীনভাবে খচিত হবে। যেদিন শাম আর কাশ্মীরের বোনেরা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাইতুল্লাহ যিয়ারত করবে। পথিমধ্যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পাবে না। জমিনে এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা করবে না। অন্তরে প্রিয় নাবীর ভালোবাসা ছাড়া আর কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে না।
যুবক ভাই! উম্মাহর মহব্বত যদি তোমাকে ঘর থেকে বের করতে না পারে। দ্বীনের মায়া যদি তোমাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারে। রবের আদেশ আর রাসূলে ভালোবাসা যদি তোমার কাঁধে তরবারি তুলে দিতে না পারে। তাহলে মনে রেখো মিথ্যা এ মায়া তোমাকে জাহান্নামের অতলান্তে নিয়ে যাবে। কোটি টাকার সার্টিফিকেট তোমাকে শয়তানের সাথী হওয়ার সুযোগ করে দিবে। সম্পদের পাহাড় তোমাকে দাজ্জালের হাতিয়ার হওয়ার পথ মসৃণ করে দিবে।
যুবক ভাই! রব তোমাকে শেষ বারের মত সজাগ করে দিচ্ছেন। এবার একটু জেগে উঠো না! উম্মাহর ফিকিরে একটু রুখে দাঁড়াও না! উম্মাহর দরদে একটুখানি মাথাকে খাটাও না! নিজেকে খাদের কিনারা থেকে বাঁচাও। ধ্বংসের স্তুপ থেকে আত্মাকে বের করে নিয়ে আসো। রবের সামনে নিক্ষেপ করো। আর বলো- দয়াময় রব! তুমি তাকে দুনিয়ার এ আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে প্রাণবন্ত করে তুলো কিন্তু পরকালের আযাবের সম্মুখীন করো না। পরকালের একক শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ো না। শোন! রব তোমাকে কি বলছেন-
الم يان للذين امنوا ان تخشع قلوبهم لذكر لله
যারা ঈমান এনেছে, তাদের কি আল্লাহর স্বরণে বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি?
যুবক ভাই এ সুযোগকে কাজে লাগাও। বলতে পারবে আল্লাহ আমি তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম। তোমার বাণী শোনার সাথে সাথে মুজাহিদীনদের সাথে একত্রিত হয়েছিলাম। ঝান্ডা উঁচু করে একত্ববাদের সাক্ষী দিয়েছিলাম।
উত্তর আসতে দেরি হবে না। বান্দা! তুমি আমার প্রতিশ্রুত ওয়াদা রক্ষা করেছো। যাও আমার ক্ষমা আজ তোমার জন্য অবধারিত। তুমি আমার হক পুঙ্খানো পুঙ্খানো রক্ষা করেছো। যাও আমার দিদার তোমার জন্য চিরলিখিত। সুবহানাল্লাহ!
Comment