ভোরের বাতাসে আজও পাই তোমার সৌরভ
শাইখ আবু হুজাইফা আস সুদানী হাফি.
ভাষান্তর: নাসীম মাহমুদ
কত দিন হয়ে গেল তুমি নেই। কিন্তু তোমার স্মৃতি? সে তো অমলিন এই হৃদয়ে। আজও বুকজুড়ে বিরহের সুর তোলে তোমার বিয়োগব্যথা। হৃদয়ের গহীনে কোথাও যেন বিঁধে আছে একটি তীক্ষ্ণ কাঁটা—ফোঁটায় ফোঁটায় যেন গড়িয়ে পড়ে টকটকে লাল রক্তবিন্দু। অন্তরের যে উচ্চতম আসন তুমি অলংকৃত করতে, সেটি আজও শূন্য পড়ে আছে। আনমনে উল্টে যাই স্মৃতির পাতাগুলো—খুঁজে বেড়াই তোমার একটি হাসিমাখা শুভ্র ছবি। কখনো খুশির হাওয়ায় কখনো বেদনার ঝাপ্টায় হারানো দিনের অনুপম দৃশ্যগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হৃদয়ের রুপোলি পর্দায়।
কীভাবে ভুলি তোমায়? সেই আলোকিত ভালোবাসা আজও দোলা দেয় আমার মনে। তোমার প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ আজও সুধা বর্ষণ করে আমার কর্ণকুহরে। ভালোবাসার রক্তিম সূর্য যেন প্রতিদিন উদিত হয় আমার হৃদয়-দিগন্তে। তারই আলোয় বিমোহিত আমি গাফলতির ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠি বারেবারে। কত ভালোবাসি তোমায় হে শাইখ, আমার আল্লাহ জানেন। কীভাবে লুকিয়ে রাখি এই ভালোবাসা! আমার হৃদয়ের বাঁধ যে ধসে যায়। প্রতিদিন ভোরের বাতাসে আজও আমি পাই তোমার সৌরভ হে উসামা!
ইলম ও আলেমপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব
শাইখ উসামাকে আল্লাহ রহম করুন। আলিমদের তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন—বড়ই সমাদর করতেন। তাঁদের সান্নিধ্যে থাকতে, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করতে এবং তাদের সিদ্ধান্ত শুনতে তার আগ্রহের সীমা ছিল না। কতবার তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন মক্কা-মদিনার দেশে আহলে ইলমদের কাছে! অন্যদেরও পাঠাতে দেখেছি অসংখ্যবার। তিনি আলেমদেরকে তাঁর পরিকল্পনার কথা বলতেন। তাঁদেরকে হিজরত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে অনুপ্রাণিত করতেন। একবার তিনি আমায় বলেছিলেন: ‘একজন বড় আলিম যদি আমাদের কাছে চলে আসেন, তবে আলে-সৌদের সিংহাসন উল্টে যাবে।’
প্রফুল্ল হৃদয়ের এক উদার মানুষ
একবার তিনি শাইখ হামুদ আল-উকলা রহ. এর কাছে কী একটা ব্যাপারে পরামর্শ চেয়ে চিঠি পাঠানোর ইচ্ছা করলেন। চিঠিটি লেখার দায়িত্ব দিলেন আমাকে। আমি কোনো কারণে এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছিলাম। আমি শাইখকে বললাম, ‘শাইখ আমাকে যদি চিঠি লেখার কাজ থেকে অব্যাহতি দিতেন—ভাড়া করে আনা শোকপ্রকাশকারী কখনো সন্তানহারা মায়ের মতো শোকাতুর হবে কি?! (আপনার মনের ব্যথা যথার্থভাবে আমার দ্বারা প্রকাশ করা কি সম্ভব!?) আমার কথা শুনে শাইখ হাসিতে যেন ফেটে পড়বেন। তিনি দ্রুত দুহাতে মুখ চেপে ধরলেন, যেন হাসির আওয়াজ শোনা না যায়। তিনি কখনো উচ্চস্বরে হাসতেন না। কেবল মুচকি হাসতেন। হাসতে গিয়ে কখনো তার ভেতরে জিভ দেখা যেতে আমি দেখিনি। আল্লাহর কসম! সেদিন আমি কী নিয়ে খুশি হবো বুঝতে পারিনি—চিঠি লেখা থেকে অব্যাহতি পাওয়া নিয়ে নাকি শাইখকে খুশি করতে পারা নিয়ে।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ এক নেতা
ইলমের পরিমণ্ডলে শাইখ উসামার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও প্রতিভা ছিল—যার মাধ্যমে তিনি শরিয়াহর দলিলগুলো পর্যালোচনা করতে পারতেন এবং বহু মতের মধ্য থেকে সঠিক মতটি গ্রহণ করতে পারতেন। আল্লাহ তাআলা তাকে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় ধরনের জ্ঞান দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। একবার জিহাদ বিষয়ক একটি মাসআলা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমি পর্যালোচনা করছিলাম। আমি তাঁকে বললাম: শাইখ! অমুক শাইখ তো তার অমুক কিতাবে এই এই বলেছেন। তিনি উত্তর দিলেন: হাঁ আমি তাঁর রায় পড়েছি; কিন্তু তা আমি গ্রহণ করিনি। আমি শাইখ উসামার এই বিরোধিতা দেখে আশ্চর্য হলাম। অথচ ওই সময় অনেক মানুষ ওই শাইখের অনুসরণ করত।
একজন প্রাজ্ঞ সমরবিশারদ
শাইখ উসামা অভিজাত সমরবিশারদ ছিলেন। রণনৈপুণ্য ও সামরিক কৌশল নিয়ে তাঁর আলোচনা শুনলে বুক টানটান হয়ে যায়। মনে হয় কোনো সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ প্রশিক্ষক ছাত্রদের সামনে লেকচার দিচ্ছেন। তাঁর উচ্চারিত শব্দমালা হৃদয়ে যেন সুধা বষর্ণ করে। ধীর-স্থিরভাবে প্রশান্ত কণ্ঠে নিজের চিন্তা ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করার এক অদ্ভুত শক্তি আছে তাঁর। ফিকহের মূলনীতি, গাণিতিক ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি নিজের পরিকল্পনাগুলো বুঝিয়ে দিতেন। কখনো ইতিহাসের নজির টেনে তার বক্তব্যকে দৃঢ় করে তুলতেন। গাণিতিক যুক্তি ও উদাহরণের মাধ্যমে আলোচনা করতে খুব পছন্দ করতেন। আল্লাহর বিশেষ রহমতে বেশ কিছু দুর্লভ গুণ ছিল তার। টার্গেট নির্বাচন ও পরিকল্পনা প্রণয়নে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার উদ্ভাবনী শক্তি ছিল অবাক করার মতো। তাঁর প্ল্যানগুলোকে আমি বলতাম, সহজসাধ্য অসম্ভব। একবার আমি বিলাদুল হারামাইনের অভ্যন্তরে একটি টার্গেটে হামলার প্রাথমিক পরিকল্পনা তাঁর সামনে পেশ করেছিলাম। এই হামলার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আত্মোৎসর্গী মুজাহিদ আমাদের প্রয়োজন ছিল। প্ল্যানটি দেখে তিনি বললেন: ‘আলহামদুলিল্লাহ! পর্যাপ্ত সংখ্যক আত্মোৎসর্গী মুজাহিদ আমাদের আছে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্যবস্তুটি যে আক্রান্ত হতে পারে এই আশঙ্কা সরকারের আছে। তাই তারা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রস্তুত থাকবে। তাই এই ধরনের টার্গেটে হামলা করা হেকমত পরিপন্থী। শাইখ দীর্ঘক্ষণ শ্বাস আটকে রাখতে পারতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন: ধৈর্যশীল সতর্ক ব্যক্তিরাই লড়াইয়ের জন্য উযপুক্ত।’
উন্নত চরিত্র ও পরিচ্ছন্ন মেজাজের অধিকারী
শাইখ উসামা রহ. খুবই নির্লোভ ও পরিচ্ছন্ন মেজাজের লোক ছিলেন। একবার জনৈক সাক্ষাৎপ্রার্থী তার সঙ্গে মোলাকাত করতে আসেন। তিনি তানজিমের জন্য একটি বড় অনুদান দেন। তারপর কিছু অর্থ শাইখের হাতে গুঁজে দিয়ে বলেন, এগুলো আপনার জন্য! শাইখ মৃদু হেসে কোষাধ্যক্ষ হামজা আল-কাতারিকে বললেন: এগুলো নাও। অন্য সব মালের সাথে এগুলোও রেখে দাও।
শাইখ বড়ই উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। বরং উন্নত চরিত্রের নামই ছিল উসামা। শুচিশুভ্র, মিষ্টভাষী, সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটির সান্নিধ্য ছিল সবার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। তাঁর সাহচর্যে গিয়ে কেউ কখনো তৃপ্ত হতো না। অত্যন্ত নম্রভাষী ছিলেন তিনি—বিশেষ করে যুবকদের সঙ্গে তার আচরণ ছিল বেশ অমায়িক। তাদের সঙ্গে বসে প্রাণ খুলে কথা বলতেন, ভাববিনিময় করতেন। কখনো কখনো তাদের সঙ্গে খেলাধূলায় শরিক হতেন। বিশেষ করে ভলিবল খেলায় তাঁকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত। ভলিবলে তিনি খুবই দক্ষ ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সবাইকে-ছাড়িয়ে-যাওয়া শারীরিক উচ্চতা দিয়েছিলেন। তরুণদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার বন্ধন ছিল বড়ই মজবুত।
এক বিবাহ অনুষ্ঠানের কথা এখনো আমার মনে পড়ে, যেখানে শাইখ অংশগ্রহণ করেছিলেন। জনৈক তরুণ নাশিদ গাইতে গিয়ে শাইখকে নিয়েই গাইতে শুরু করে। প্রসিদ্ধ একটি নাশিদের কিছু পঙক্তি ঈষৎ পরিবর্তন করে সে বলে: (نُرِيْدُ أُسَامَةَ بْنَ لَادِنْ وَلَيْسَ سِوَاهُ يَكْفِيْنَا) ‘আমরা চাই আমাদের উসামা, অন্য কাউকে দিয়ে আমাদের চলবে না।’ এই বাক্যগুলো শুনে শাইখ খুবই অসন্তুষ্ট হন। তিনি কেমন যেন সংকুচিত হয়ে পড়েন। নাশিদ শেষ হলে তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ব্যক্তির প্রশংসায় বাড়াবাড়ি নিয়ে কথা বলেন। অত্যন্ত কোমলভাবে দরদের সঙ্গে তিনি এই ধরনের প্রশংসা করতে নিষেধ করেন।
সংশোধন ও পরিশুদ্ধি প্রিয় এক বিরল রাহ্বার
শাইখ উসামা নাসিহা খুব পছন্দ করতেন। সমালোচনাকে সব সময় স্বাগত জানাতেন—কখনো বিরক্ত হতেন না। পরিশুদ্ধির যে কোনো আহ্বানে তিনি সাড়া দিতেন। একদিন তাঁকে আমি বললাম, শাইখ! আমাদের তানজিমের লিখিত কোনো শরয়ি মানহাজ ও নীতিমালা কেন নেই? তিনি উত্তর দিলেন: ‘আমরা এটি প্রয়োজন মনে করি না। আমাদের বক্তৃতা, আলোচনা ও কিতাবাদি থেকে মানহাজ লোকেরা বুঝে নেবে।’ আরেক বার তালিবান নেতৃবৃন্দের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে তাঁকে আমি প্রশ্ন করলাম। তিনি পরিপূর্ণ উদারতার সঙ্গে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন। অবশেষে ১৪২১ হিজরি সনের আরাফার দিন ইদুল আজহার রাত আল-ফারুক ট্রেনিং ক্যাম্পে আল্লাহর ইচ্ছায় সেই মুহূর্তটি এলো। আমরা তখন নাস্তার দস্তরখানে। একদল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সেদিন বড় দুই শাইখ উহাইশি রহ. ও আনাসি রহ.ও ছিলেন। শাইখ সেদিন মানহাজ নিয়ে বেশ বিন্যস্ত ও বিস্তারিত আলোচনা করলেন—যা আমি গভীর মনোযোগে শুনেছি এবং স্মৃতির পাতায় সংরক্ষণ করেছি।
আল্লাহ তাআলা শাইখের শাহাদাতকে কবুল করুন এবং তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করুন। তাঁর রেখে যাওয়া জিহাদের ঝাণ্ডা যেন আমরা উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারি, সত্যের পথ থেকে যেন আমরা বিচ্যুত না হই—সর্বদা এই দোয়াই করে যাই।
(শাইখ আবু-হুজাইফার ‘খাওয়াতিরু সাজীন’ গ্রন্থ থেকে চয়িত, অনূদিত ও পরিমার্জিত)
[আল-বালাগ ৭ম ইস্যু থেকে সংগৃহীত]
Comment