হযরত হাসান বসরি রহিমাহুল্লাহ || জীবনের ধুলোমলিন একটি অধ্যায়
[১]
হযরত হাসান বসরি রহ.। নামটি শুনলেই মনের কোটায় একটি চিত্র ভেসে উঠে। মনের অজান্তেই চিত্রায়িত হয় একটি সুফি সাধক মানুষের ছবি। যে সারাদিন ইবাদতগুজার করেন। যার দিন কাটে তাসবিহ আর মানুষকে ওয়াজ করে। দুনিয়াবি কোনো বিষয়েই যার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। শুধু ইবাদত আর আখিরাতের কথাই যিনি শুধু ভাবেন। অর্থাৎ সুফিসাধক বললে আমাদের অন্তরে যে চিত্রটা ভেসে উঠে ঠিক তেমন একটা চিত্র আমরা এই মহানিয়ে নাম্বারে এসিউ তাবেয়ীর ব্যাপারে ভেবে থাকি। কিন্তু মহান এই সুফি তাবেয়ীর জীবনের আরেকটি অধ্যায় আছে,যা ক্রমশ আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। সামনে কখনো আসলেও সেভাবে গুরুত্ব দেইনি। মনের অজান্তেই তার জীবনের সে অংশটি আলোচনা থেকে আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। ফলাফল একদল মানুষ তার জীবনের যে চিত্রটি আমাদের সামনে রেখেছে সেটাকেই মহান এই মানুষটির জীবনের পুরো অধ্যায় ভেবে বসে আছি। অন্তত আমি হযরত হাসান বসরি রহ.কে শুধুই একজন সুফি আর কিছু হাদিসের রাবী— এতটুকুই চিনতাম। এর বাহিরে আর কিছুই না।
[২]
সুফি এই মহান তাবেয়ীর ধুলোমলিন সে অধ্যায়টি হলো তিনি ছিলেন উম্মাহের একজন মহান মুজাহিদ। জি হা দে র ময়দানে সামনের কাতারে থেকে তিনি লড়াই করতেন। সাহসি এবং নির্বাক মনে শাহাদাতের তামান্নায় লড়ে যেতেন। উমাইয়াদের শাসনামলে রোমানদের সাথে জি হা দে হাসান বসরি রহ. স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতেন। মুহাল্লাব ইবনে আবি সফরাহ ছিলেন উমাইয়া শাসনামলের একজন জাদরেল জেনারেল। জীবনের পুরোটি অংশ যার কেটেছে জি হা দের ময়দানে। তিনি যখন রোমানদের সাথে জি হা দের সেনাপতির দায়িত্ব পেলেন, তখন প্রতিটি যুদ্ধে সামনের ফ্রণ্ট লাইনে হযরত হাসান বসরি রহ.কে রাখতেন। এবং এই মহান সুফি তাবেয়ি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং বীরবিক্রমে জি হা দ করতেন।
জাফর ইবনে সুলাইমান রহ. বলেন, হযরত হাসান বসরি রহ. ছিলেন একজন শক্তিশালী কঠোর মানুষ। মুহাল্লাব ইবনে আবি সফরাহ যখনই মুশরিকদের সাথে জি হা দে যেতেন তখন হাসান বসরি রহ.কে সামনের কাতারে রাখতেন। (১)
(যদিও জিহাদ তখন ফরজে কিফায়া ছিলো তারপরও) এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিলো তার নিয়মিত আমল। বরকত অর্জন করার জন্য মাঝেমধ্যে অংশগ্রহণ করতেন এমন নয়। হযরত সোলাইমান আততাইমি রহ. বলেন, হযরত হাসান রহ. নিয়মিত জি হা দে অংশগ্রহণ করতেন। (২)
মহান এই সুফি তাবেয়ীর জীবনের এইদিকটিকে ইমাম যাহাবী রহ. এভাবে মূল্যায়ন করেন,
كان الحسن كثير الجهاد
হযরত হাসান বসরি রহ. অনেক বেশি জি হা দে অংশগ্রহণ করতেন। (৩)
শুধু জিহাদে অংশগ্রহণই নয়,জি হা দের বিষয়ে উনার ঐতিহাসিক ফতোয়া ছিলো, বর্তমান জামানায় কাফেরদের সাথে লড়াই করার জন্যে তাদেরকে হাদিসের ভাষ্যনুযায়ী প্রথমে দাওয়াত, অত:পর জিযিয়া তা না মানলে জি হা দ এটার আর প্রয়োজন নেই। কারণ কাফেররা জানে মুসলমানরা কী চায়, ইসলাম ধর্ম কী এবং তা মানুষকে কিসের দাওয়াত দেয়। তাই জি হা দের শুরুতে দাওয়াত দেওয়া এখন আর আবশ্যক নয়। বরং মুস্তাহাব। হযরত হাসান বসরি রহ.-র ইনতেকাল হয় ১১০হি.তে। আল্লাহ আমাদেত সালাফদের প্রতি রহমতের বারিস বর্ষন করুক। আমীন। (৪)
তথ্যসূত্র :
[১] সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/৫৭৯ -ইমাম যাহাবী রহ.।
[২] সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/৫৭২ -ইমাম যাহাবী রহ.।
[৩] সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/৫৭৯ -ইমাম যাহাবী রহ.।
[৪] ইমাম আবু হানিফা ও মাজহাবে হানাফিয়্যার ফতোয়া এটার উপরেই। দেখুন, শরহু মাআনিল আছার।
[সংগৃহীত]
 ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄
জিহাদী কাফেলায় আইম্মায়ে দ্বীন: এক. হাসান বসরী (১১০হি.) রহ.
লেখক: মুহতারাম ‘ইলম ও জিহাদ’
লিংক: https://dawahilallah.com/showthread.php?14061
লেখক: মুহতারাম ‘ইলম ও জিহাদ’
লিংক: https://dawahilallah.com/showthread.php?14061
হাসান বসরী রহ. (১১০হি.)
বিশিষ্ট তাবিয়ী। অনেক সাহাবি থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাফসীর, হাদিস ও ফিকহে যামানার শ্রেষ্ঠ ইমাম। খলিফায়ে রাশেদ উমার ইবনু আব্দুল আজিজ রহ. এর খেলাফতকালে তিনি বসরার কাযি ছিলেন।
হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের দুই বছর বাকি থাকতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের সময় তার বয়স ছিল চৌদ্দ।
তার পিতা-মাতা উভয়ই যুদ্ধবন্দী দাস ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরই ঔরসে এ মহামানবের জন্ম দেন। তার মা উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘরে কাজ করতেন। অনেক সময় তিনি কাজের ব্যস্ততায় শিশু হাসান রহ.কে দুধ পান করাতে পারতেন না। তিনি যখন কাঁদতে থাকতেন, অনেক সময় উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাকে দুধ পান করাতেন। বলা হয়, সে দুধের বরকতেই এ ইলম ও হিকমতের দৌলত তিনি লাভ করেন। তাছাড়া তার মা তাকে সাহাবায়ে কেরামের কাছে নিয়ে যেতেন এবং দোয়া চাইতেন। তারা জন্য দোয়া করতেন। হযরত উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু তার জন্য দোয়া করেন,
اللهم فقهه في الدين، وحببه إلى الناس. اهـ
“হে আল্লাহ! তুমি তাকে দ্বীনের সমঝ দান কর এবং মানুষের কাছে তাকে প্রিয় বানিয়ে দাও।”- আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৯/২৯৫
তার যামানায় তিনি সাহাবায়ে কেরামের সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন। এমনকি এও বলা হয় যে, তিনি নবীগণের সাদৃশ্য রাখতেন।
তিনি অত্যন্ত সুদর্শন, শক্তিশালী ও বীরবাহাদুর সুপুরুষ ছিলেন। বীরত্বের জন্য সুখ্যাত ছিলেন। শুরু শুরুতে তিনি জিহাদ নিয়েই পড়ে থাকতেন। এমনকি খুরাসানের আমীর আর-রবি ইবনু যিয়াদের কাতেবে পরিণত হন। তার হাতের কব্জি এক বিঘত প্রশস্ত ছিল- যা খুবই বিরল। উমাইয়া শাসনামলে তিনি খুরাসানে জিহাদ করতেন। তিনি এমনই প্রসিদ্ধ বীর ছিলেন যে, আমীরুল মুজাহিদিন আলমুহাল্লাব ইবনু আবি সুফরা যখন মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতেন, তখন হাসান বসরী রহ.কে সামনের কাতারে রাখতেন।
ইমাম যাহাবি রহ. (৭৪৮হি.) ‘সিয়ারু আ’লামিন নুবালা’ গ্রন্থে হিশাম ইবনু হাসসান রহ. থেকে বর্ণনা করেন (৪/৫৭৮),
كان الحسن أشجع أهل زمانه. اهـ
“হাসান রহ. যামানার সর্বশ্রেষ্ট বীর ছিলেন।”
আছমায়ী রহ. এর সূত্রে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন (৪/৫৭২),
ما رأيت زندا أعرض من زند الحسن البصري، كان عرضه شبرا. قلت: كان رجلا تام الشكل، مليح الصورة، بهيا، وكان من الشجعان الموصوفين. اهـ
“হাসান বসরীর কব্জির চেয়ে প্রশস্ত কোন কব্জি দেখিনি। তার কব্জি এক বিঘত প্রশস্ত ছিল। আমি বলি- অর্থাৎ যাহাবি রহ. বলেন- শারীরিকভাবে তিনি পূর্ণ গড়নবিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। সুদর্শন ও চক্ষুশীতলকারী ছিলেন। প্রসিদ্ধ বীরদের একজন ছিলেন।”
আরো বলেন (৪/৫৭২),
لم يطلب الحديث في صباه، وكان كثير الجهاد، وصار كاتبا لأمير خراسان الربيع بن زياد
وقال سليمان التيمي: كان الحسن يغزو، وكان مفتي البصرة جابر بن زيد أبو الشعثاء، ثم جاء الحسن، فكان يفتي. اهـ
“তিনি বাল্যকালে হাদিস অন্বেষণ করেননি। খুব বেশি জিহাদ করতেন। এমনকি খুরাসানের আমীর আর-রবি ইবনু যিয়াদের কাতেবে পরিণত হন।
সুলাইমান আততাইমি রহ. বলেন, হাসান রহ. জিহাদ করতেন। তখন বসরার মুফতি ছিলেন, আবুশ শা’ছা জাবির ইবনু যায়দ রহ.। এরপর যখন হাসান রহ. আসলেন, তখন তিনিই ফতোয়া দিতেন।”
ইতিহাসবিদ ফাসাবি রহ. (২৭৭হি.) ‘আলমা’রিফাতু ওয়াততারিখ’ কিতাবে জা’ফর ইবনু সুলাইমান রহ. থেকে বর্ণনা করেন (২/৪৯),
كان الحسن من أشد الناس إذا حضر الناس ... وكان المهلب إذا قاتل المشركين فكان الحسن من الفرسان الذين يقدمون. اهـ
“যুদ্ধ যখন বেঁধে যেতো, তখন হাসান রহ. অতীব জানবাজ ব্যক্তি পরিগণিত হতেন। … (আমীর) মুহাল্লাব যখন মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতেন, তখন হাসান রহ. ঐসকল বীর ঘোড়সওয়ারদের অন্তর্ভুক্ত থাকতেন, যাদেরকে অগ্রে রাখা হতো।”
আব্দুল্লাহ ইবনু আউন রহ. থেকে বর্ণনা করেন (২/৪৯),
سألت محمدا عن شيء من أمر الطعام في الغزو. فقال: سل الحسن فإنه كان يغزو. اهـ
“আমি মুহাম্মাদ ইবনু সিরিন রহ. এর কাছে যুদ্ধের ময়দানে খাদ্য সংক্রান্ত একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘হাসানকে জিজ্ঞেস কর। কারণ, তিনি জিহাদ করতেন’।”
আবু খালিদ মুহাজির রহ. থেকে বর্ণনা করেন (২/৫২),
ذكر لأبي العالية الحسن، فقال: رجل مسلم يأمر بالمعروف وينهى عن المنكر. اهـ
“আবুল আলিয়া রহ. এর কাছে হাসান রহ. এর আলোচনা উঠল। তিনি বললেন, তিনি এমন একজন মুসলিম ছিলেন, যিনি আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার করতেন।”
হাসান বসরী রহ. ১১০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
***
Comment