ফাঁসির মঞ্চে যিনি হেসেছিলেন বিজয়ের হাসি
ষাট বছর বয়সে সদ্য বুড়োর খাতায় নাম লেখানো নব-বৃদ্ধদের বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠে। নারী, বাড়ি, গাড়ি এসবে যেনো তাদের আর মন নেই। বাঁচতে পারলেই হলো। যৌবনের সোনালী-রূপালী অধ্যায় পাড়ি দিয়ে গোধূলী বেলায় শরীর একটু বিশ্রাম চায়। ষাট বছর বয়সে ‘দাদু ভাই’ হয়ে নাতি-নাতনীর সাথে একটু মজা, হৈ-হুল্লোর করবে; এই তো জীবন। ঠিক এই বয়সের একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর (!) কথা বলবো।
ষাট বছর বয়সী লোকটাকে অপমান, অপদস্থ করার জন্য ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তিনি যদি জীবন-ভিক্ষা চান, তাহলে হয়তো ফাঁসি মওকুফ করা হবে, তাঁর সাজা কমানো হবে। জীবনের মায়া তো সবারই আছে। কে চায় এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া বিসর্জন করে মারা যেতে? তারউপর এই ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত লোকটি টানা দশবছর জেলে ছিলেন। দশ বছরের কারাদণ্ড শেষে দুনিয়ার মুক্ত বাতাস এক বছর উপভোগ করতে না করতে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এবার ফাঁসির হুকুম।
আহমাদ ফাররাগ নামের একজন অফিসার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁকে বুঝালেন, “আপনি যদি ওজরনামায় কোনো কিছু লিখে দেন, তাহলে আমি আপনার মুক্তির ব্যবস্থা করবো।” কী সুবর্ণ সুযোগ! ওজরনামায় প্রাণভিক্ষা চাইলে মুক্তির সম্ভাবনা আছে। পৃথিবীর সুন্দর, নির্মল আলো-বাতাস আরো কিছুদিন উপভোগ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। দশ বছর ধরে তিনি যখন জেল কাটেন, তাঁকে নির্মম অত্যাচার করা হয়েছিলো। পাগলা কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, শরীরে আগুনের ছেঁক দেওয়া হয়েছিলো, শরীর কখনো উত্তপ্ত গরম পানি, আবার কখনো হিমশীতল পানি ঢেলে দেওয়া হয়েছিলো।
এতো অত্যাচার-নির্যাতন করেও যাকে তাঁর আদর্শ থেকে ঠলানো যায়নি, ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়ে হয়তোবা তাঁকে একটু আতঙ্কিত করা যাবে। এবার নিশ্চয়ই তিনি মেনে নিবেন সবকিছু। আহমাদ ফারাগ উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছেন। তার এই প্রস্তাব হয়তো তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত। শাহাদাত আঙ্গুল উঁচিয়ে আহমাদ ফারাগের প্রাণ-ভিক্ষার প্রস্তাবে তিনি বললেন: “যেই শাহাদাত আঙুল আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করে আসমানের দিকে উত্থিত হয়, স্বেচ্ছাচারীর সমর্থনে ওজরনামা লিখতে সে আঙুল কোনোভাবেই ব্যবহৃত হবে না।”
সাইয়্যিদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ) এমন বজ্রকণ্ঠে আহমাদ ফারাগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তাঁকে ফাঁসি দিতে যেনো ফাঁসি দেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই অনিচ্ছুক। এরকম একজন মানুষকে তারা হারাতে চাচ্ছে না। ফাঁসির কাষ্ঠে উঠার আগে ফুয়াদ আল্লাম নামের একজন অফিসার বললেন, “জনাব! আপনাকে তো আমরা ফাঁসি দিতে চাই না। আপনি মুখে অন্তত ক্ষমাপ্রার্থনা করুন, আপনাকে ক্ষমা করা হবে।” যালিমরা কম্প্রোমাইজ করছে, কিন্তু মযলুম তাঁর কথায় অটল, অবিচল। আগেরবার চাওয়া হয়েছিলো লিখিত ক্ষমাপ্রার্থনা, এবার চাওয়া হচ্ছে অন্তত মৌখিক ক্ষমাপ্রার্থনা।
সাইয়্যিদ কুতুব এবার আরো দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠলেন: “আমি এই প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চার্যান্বিত হচ্ছি যে, মযলুমকে যালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবুও আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাজি নই। আমি তো আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।”
ফাঁসির আগের রাতে একজন হুজুর সাইয়্যিদ কুতুবকে কালেমা পড়াতে যান। এটা নিয়ম। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী যেনো কালিমা পড়ে মারা যায়। সাইয়্যিদ কুতুব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমাকে কালিমা পড়িয়ে কী পাও? সরকার তোমাকে ‘পারিশ্রমিক’ দেয়?” “হ্যাঁ, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে কালিমা পড়ানোর বিনিময়ে আমি অর্থ পাই।”
এটা শুনে সাইয়্যিদ কুতুব বলেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত কথাটি: “তোমার কালিমা তোমার রুটি জোগায়, আর আমার কালিমা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলায়।” অর্থাৎ, যেই কালিমা পড়ানোর বিনিময়ে হুজুর সরকার থেকে অর্থ পাচ্ছেন, সেই কালিমার ব্যাখ্যা মানুষকে বুঝানোর ‘অপরাধে’ সাইয়্যিদ কুতুবের ফাঁসি হচ্ছে!
১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়। যাইনাব আল-গাজালিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “সাইয়্যিদ কুতুবকে কেনো হত্যা করা হয়েছিলো? কী অপরাধ ছিলো তাঁর?” জবাবে তিনি ছোট্ট একটা কথা বলেন: “মা’আলিম ফিত তারিক পড়ো।” ‘মা’আলিম ফিত তারিক’ হলো সেই বই, যেই বইয়ের কারণে সাইয়্যিদ কুতুবকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে। যে বইয়ের কারণে তাঁর ফাঁসি হয়, যে বইটি নিষিদ্ধ হয়, আজ সেই বইটি পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। নানান ভাষায় বইটির অনুবাদ বের হয়েছে। বইটির ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘Milestone’, বাংলা অনুবাদের নাম ‘ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা’। একটা বই লেখার কারণে শাহাদাতবরণ? আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হলেও সাইয়্যিদ কুতুবের কাছে তো এটা ছিলো তাঁর শাহাদাতের পেয়ালা পানের উপলক্ষ্য মাত্র। তিনি তো উন্মুখ ছিলেন এমন শহীদী মরণের।
তিনি বলেছিলেন: “আমাদের শব্দগুলোতো নিষ্প্রাণ, নিষ্ফল আর আবেগহীন; যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা আমাদের কথার জন্য শাহাদাতবরণ করি। তখন শব্দেরা জীবন্ত হয়ে উঠে। তারা প্রাণহীন হৃদয়গুলোতে ঠাই নেয়, আর সেই হৃদয়গুলোকেও জাগিয়ে তোলে।”
Milestone/ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা বইটি পড়ার পর কোনো বিশ্বাসী হৃদয় কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে? হিরোসিমা-নাগাসাকিতে ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’ বোমা পড়েছিলো। তাতেই জাপান তথা পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠেছিলো। সাইয়্যিদ কুতুব তো তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় বোমা-বর্ষণ করেছেন। শাসকগোষ্ঠী কিভাবে সেগুলো সহ্য করবে? পাশ্চাত্য সভ্যতার গুণমুগ্ধ মুসলিম সমাজের কাছে তিনি যে বার্তা নিয়ে আসেন, সেই বার্তা কিভাবে পারে একজন মুসলিমকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে?
‘ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা’ বইয়ে তিনি লিখেন: “ইসলাম মাত্র দু’ধরণের সমাজ স্বীকার করে। একটি হচ্ছে ইসলামি সমাজ, অপরটি জাহেলী সমাজ। যে সমাজের সার্বিক কর্তৃত্ব ইসলামের হাতে এবং মানুষের আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত, আইন-কানুন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, নৈতিক চরিত্র, পাস্পরিক লেনদেন ইত্যাদি সকল বিষয়ে ইসলামের প্রাধান্য বিদ্যমান, সেই সমাজই ‘ইসলামি সমাজ’। অন্যদিকে, যে সমাজের ব্যবহারিক ক্ষেত্র থেকে ইসলামকে বর্জন করা হয়েছে এবং সেখানে ইসলামি আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ ও বর্জনে ইসলামি মানদণ্ড, ইসলামি আইন-কানুন ও রীতিনীতি, ইসলামি নৈতিকতা ও আদান-প্রদান নীতির শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেনি, সে সমাজ ‘জাহেলী সমাজ’।” [ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা, পৃষ্ঠা ১২৩]
আমরা তো মনে করি, একটা সমাজের মেজোরিটি যদি মুসলিম হয়, একটা দেশ যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তাহলেই বুঝি সেটা ইসলামি সমাজ, ইসলামি রাষ্ট্র। কিন্তু সাইয়্যিদ কুতুব বলছেন ‘না’। তিনি বলেন: “যে সমাজ ‘মুসলিম’ নামধারী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলামি শরীয়তকে আইনগত মর্যাদা দান করেনি, সে সমাজ ‘ইসলামি সমাজ’ নয়। নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতের ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সেই সমাজ ইসলামি সমাজ হতে পারে না।” [ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা, পৃষ্ঠা ১২৩]
এরকম ‘শব্দ-বোমা’ কিভাবে রাষ্ট্রশক্তি সহ্য করবে? এরকম ‘শব্দ-বোমা’ কিভাবে তাগূতী শক্তি মেনে নিবে? দূর্বল হৃদয়ের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এগুলো মানতে পারে না!
রাষ্ট্র কিভাবে সাইয়্যিদ কুতুবের বইগুলো বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করেছিলো সেটা নিয়ে শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সুবিখ্যাত ‘তাফসীরে সূরা তাওবা’য় লিখেন: “যেদিন তাঁকে হত্যা করা হয়েছিলো, সেদিন মিসরে তাঁর রচিত ‘তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন’ –এর ৬৪০০০ কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো, ‘যার কাছে সাইয়্যিদ কুতুবের কোনো বই পাওয়া যাবে, তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে।’
অথচ তাঁর শাহাদাতের পর তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মানুষজন আগ্রহী হয়ে উঠলো, ‘কে এই সাইয়্যিদ কুতুব? তাঁর বইয়ে কী এমন আছে যার জন্য তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হলো?’ তখন বৈরুতের প্রকাশকরা প্রকাশনা জগতে কোনো খ্রিস্টান লোকসান খেলে তাকে বলতো, আরে, তুমি যদি বাঁচতে চাও তাহলে সাইয়্যিদ কুতুবের ‘তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন’ ছাপো। বইটি এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, খ্রিস্টান প্রকশকরা পর্যন্ত মার্কেটে টিকে থাকতে বইটি ছাপানোর চিন্তা করেছিলো!
তাঁর জীবদ্দশায় ‘তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন’ ছাপানো হয়েছিলো একবার। অথচ যে বছর তিনি শাহাদাতবরণ করেন সে বছরই বইটির সাত সংস্করণ ছাপা হয়। আর এখন অবস্থা তো এই যে, পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত পাওয়া যাবে না যেখানে সাইয়্যিদ কুতুবের এই তাফসীরগ্রন্থ গিয়ে পৌঁছেনি। এমন কোনো ভাষা পাওয়া যাবে না, যে ভাষায় তা অনূদিত হয়নি।” [তাফসীরে সূরা তাওবা, শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম: ১/২৮৪]
আল্লাহ যাকে সম্মানিত করতে চান, পৃথিবীর কোনো শক্তি তাতে বাধা দিতে পারে না। আর আল্লাহ যাকে অপদস্থ করতে চান, সমগ্র পৃথিবীবাসী মিলেও তাকে কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহ যার প্রচার-প্রসার চান, পৃথিবীর সমস্ত জালেম মিলে তা দমিয়ে রাখতে পারবে না।
“তারা তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা দান করবেন; যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।” [সূরা আত-তাওবা ৯:৩২]
Collected
Comment