ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী মাইজবাড়ির মিয়াঁ ছাহেব রাহ.
মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ
এক.
ঘুঘুডাকা গ্রামের রেশ এখনো জড়িয়ে আছে। গাছপালার ঘনত্ব অবশ্য কিছু কমেছে। বেড়েছে ঘরবাড়ি, দালানকোঠা। সেই মাইজবাড়িতে সেদিন গেলাম। এই জানুয়ারির ৩০ তারিখ। প্রশান্তি ও ঐতিহ্যের বিনয়ী মুখ ফকিরবাড়ির আঙ্গিনাজুড়ে। জুমার পর সওতুল হেরা মাদরাসার দফতরে। তারপর গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়ির গোরস্তানের সামনে। পুণ্যবান বহু মানুষের মাটির বিছানা। আগেও তো গিয়েছি। পাঁচ-দশ, বিশ বছর আগে এবং তারও আগে। হঠাৎ হঠাৎ এমনিতেই। মাহফিল, বিশেষ মজলিস, আত্মীয়তার নিসবত- ছিল এমনই সব উপলক্ষ। কিন্তু সেদিনের অনুভ‚তি ছিল একটু ভিন্ন।
ময়মনসিংহ শহর থেকে ৮/১০ কি. মি. পশ্চিমে। টাঙ্গাইল মহাসড়কের দক্ষিণে। আমাদের প্রজন্মের সামনে এই বাড়ির দুটি নাম এবং মুখ ছিল বড় উজ্জ্বল। ব্রিটিশবিরোধী অমর সংগ্রামী শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর লড়াকু শাগরিদ মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ. এবং তাঁর চাচাতো ছোট ভাই ফরযন্দে দেওবন্দ মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান রাহ.। ছিলেন সংগ্রামের মননে নিঃসঙ্গ এক পথিক মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.। কী দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব! ধবধবে ফর্সা মুখ। উঁচু কিশতী টুপির নিচে ঈগলের মতো খাড়া নাক। গালভরা সাদা দাড়ির মাঝে টানা টানা দুটি চোখ। সরাসরি দৃষ্টিপাত, স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে বক্তব্য উপস্থাপন কিংবা কথোপকথন। আমাদের দেখা ও শোনা- দুটোতেই থাকতো অপেক্ষমাণ মুগ্ধতা। কিন্তু আমরা তাঁর আগে তাঁর পরিবারের আর কারো ব্যাপারে তেমন কিছু জানতাম না। অথচ দ্বীন ও ব্যক্তিত্বের এই নিদর্শনেরও আগে ছিল আরো বড় উৎস। তাঁর দাদা, তাঁর দাদার দাদা এবং তাঁর বাবা সবাই ছিলেন দ্বীন-কেন্দ্রিক ইতিহাসের গর্বিত উপাদান। আমাদের সেসব জানাই ছিল না। পরে জানা সম্ভব হয়েছে যে, ইরানী সুন্নী মুসলিম বংশোদ্ভুত হযরত আরিফ রাব্বানী রাহ.-এর দাদা মাওলানা জব্বার বখশ রাহ.-সর্বসাধারণে যার উপাধি ছিল মিয়াঁ ছাহেব- ছিলেন উঁচু স্তরের এক বুযুর্গ এবং একই সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থানীয় একজন সংগঠক। বালাকোট-উত্তর উপমহাদেশব্যাপি পরিচালিত জিহাদ আন্দোলন, ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব এবং অসফল সিপাহী বিপ্লবের পরে আলেমদের নেতৃত্বে সংঘটিত সীমান্ত জিহাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। জানা গেছে, পরবর্তীকালে তুর্কী খেলাফত রক্ষার সংগ্রামেও তিনি অর্থকড়ি পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। বিশেষভাবে সেই সাধক-সংগ্রামী মনীষীর স্মৃতির ক্ষেত্রটি ঘুরে আসা এবং তাঁর কবর যিয়ারত করাই ছিল সেদিনের বিশেষ উদ্দেশ্য।
দুই.
যতদূর জানা যায়, মাইজবাড়িতে এই খান্দানের প্রথম পুরুষটি ছিলেন নিরাপদ মুসলিম জনপদের সন্ধানে ইরান থেকে হিজরত করে আসা ফার্সীভাষী এক সাধক সুন্নি মুসলিম। নাম শাহ বারাতুল্লাহ রাহ.। এ অঞ্চলে তিনি দাওয়াতী, তালীমী, ইসলাহী কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে কাছাকাছি অঞ্চলেই বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তার পুত্রের নাম ছিল শাহ কলন্দর রাহ.। শাহ কলন্দরের পুত্রেরই নাম হচ্ছে শায়খ জব্বার বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.। এই মিয়াঁ ছাহেবের জন্ম ১৮২৬ সনে। ৪/৫ বছর বয়সে তিনি ইয়াতিম হন। এরপর ইলমেদ্বীন অর্জন করেন ময়মনসিংহ শহরের বর্তমান বড় বাজার এলাকায় অবস্থানরত ঢাকা-নিবাসী একজন সাধক আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান রাহ.-এর কাছে। তাঁর কাছ থেকেই তিনি অধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ ও দীক্ষাও গ্রহণ করেন। এরপর মাইজবাড়ি গ্রামে নিজের দেয়া নাম ‘ফকিরবাড়িতে’ অবস্থান করেই কুরআনী তালীমের প্রচার, শিরক-বিদআতমুক্ত মুসলিমসমাজ গঠন এবং কমজানা মুসলমানদের মাঝে সহীহ মাসায়েলের চর্চার ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। এরই মধ্যে যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের উল্লেখযোগ্য একটি সময় তিনি পার করেন বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামের জিহাদী তৎপরতায়। দীর্ঘ ১০৮ বছর হায়াত তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছে বালাকোটের ঘটনার মাত্র ৫ বছর আগে। ইন্তেকাল হয় উপমহাদেশ (পাকিস্তান ও ভারত) স্বাধীন হওয়ার ১৩ বছর আগে ১৯৩৪ সনে। বর্ণাঢ্য দীর্ঘ জীবনে তিনি কয়েক পর্যায়ে বিপ্লব-সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। তবে তাঁর ব্যক্তিত্বের সাধক ও দরবেশ রূপটিই জনসমক্ষে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। এজন্য হেদায়েতী ও ইসলাহী নানা সক্রিয়তায় যেমন লোকজন তাঁর কাছে আসতেন, তেমনি দুআ-খায়ের, ঝাড়ফুঁক-তদবিরের জন্যও ভিড় কম হতো না। তাঁর জীবনটি ছিল তাকওয়া, তাওয়াক্কুল ও জিহাদের সমন্বিত পাঠশালা। বহু কারামাতের ঘটনাও তাঁর জীবনে ঘটেছে।
তিন.
বুযুর্গ মুজাহিদ জব্বর বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর প্রপৌত্র মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদীর রচনা ও যবানীতে জানা যায়, মিয়া ছাহেব রাহ. তাঁর যৌবন থেকেই তৎকালীন আলেম সমাজের নেতৃত্বে পরিচালিত ফিরিঙ্গি-বিরোধী সংগ্রামে বরাবর যুক্ত ছিলেন। বিশেষত ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব কালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বা নিম্নবঙ্গের গ্রামপ্রধান এলাকাগুলোতে বিপ্লবের অনুকূলে সাংগঠনিক কাজ করার যে অধ্যায় ইতিহাসে স্বীকৃত, তাতে গভীরভাবেই তাঁর যুক্ততা ছিল। মাইজবাড়ির ফকিরবাড়ির জামাতা প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা তফজ্জুল হক হবিগঞ্জীও এক স্মৃতিচারণে সিপাহী বিপ্লব ও তুর্কী খেলাফত রক্ষার আন্দোলনে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর সম্পৃক্ততার কথা শুনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
বৃদ্ধ মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-কে শৈশব ও কৈশোরে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তার পৌত্র মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.। তাঁর ত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রামের টুকরো টুকরো ঘটনা, স্মৃতি বা জীবনদৃষ্টি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। নিজের সংগ্রামী জীবনেও সেসব কিছুর অনুসরণ করেছেন। অধস্তন বংশধর ও শাগরিদদের সামনে সেসব কাহিনীর কিছু কিছু দ্যুতিও তিনি ছড়িয়ে গিয়েছেন। তবে বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে সেসব বর্ণনা বা ইতিহাসের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষিত রাখা সম্ভব হয়নি।
অবশ্য লোকমুখের চর্চা এবং আদর্শিক ও পারিবারিক পরম্পরাগত বর্ণনার সূত্রে সেসব ঘটনা প্রায় প্রামাণ্যের পর্যায়ভুক্ত হয়ে আছে। কাগুজে দলিল সেখানে কোনো মুখ্য বিষয় থাকতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। প্রথমত ব্রিটিশ সিভিলিয়ন উইলিয়াম হান্টারের লেখা ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে বালাকোটের (১৮৩১) পর উপমহাদেশব্যাপি জিহাদ আন্দোলনের অংশ হিসেবে পূর্ববঙ্গে বা নিম্নবঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী যে বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা একদমই সঙ্গত যে, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার বিভিন্ন পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী হক্কানী আলেমরা সক্রিয় ভ‚মিকা রেখে গেছেন। হযরত মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর জন্ম ১৮২৬ সনে হওয়ায় সিপাহী বিপ্লবের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। তাঁর তখন পূর্ণ যৌবন। বালাকোটের পর থেকে আফগানিস্তান সন্নিহিত সীমান্ত এবং সিত্তানা-মুলকা কেন্দ্রিক যে দীর্ঘ সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাস পাওয়া যায় তা চালু ছিল প্রায় ১৮৯০ সন পর্যন্ত। বিহারের পাটনায় তার বড় একটি ঘাঁটি ছিল। মাওলানা এনায়েত আলী, বেলায়েত আলীসহ সর্বভারতীয় অন্য আলেমদের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের বহু যুবক-প্রাণ আলেম তখন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। সিপাহী বিপ্লবকালে ওই সংগ্রামীরা ব্যাপক ভ‚মিকা রাখেন। এর পরেও তারা নিরস্ত হননি। ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধ-লড়াই হয়। সে প্রেক্ষাপটেই ১৮৬৪ সনে আম্বালায়, ১৮৬৮ সনে পাটনায়, ১৮৭০ সনে মালদহ ও রাজমহলে এবং ১৮৭১ সনে কলকাতায় বালাকোট-উত্তর সংগ্রামী মুজাহিদদের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ওই সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের ‘ওহাবী আন্দোলন’ ও ওহাবী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও সেটি ছিল ডাহা মিথ্যা। ওহাবী আন্দোলনের সঙ্গে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কোনো যোগসূত্র ছিল বলে জানা যায়নি। মূলত শিরক থেকে সংস্কারবাদী এবং জিহাদ ও তাসাওউফের মিলিত সংগ্রামেরই তাঁরা কর্মী ছিলেন। পূর্বাপর পরিস্থিতি ও বংশ পরম্পরার বর্ণনায় বোঝা যায়, সিপাহী বিপ্লব ও আগের-পরের বালাকোট-উত্তর জিহাদী আন্দোলনেই মিয়াঁ ছাহেব গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে ‘বৃহত্তর মোমেনশাহী: উলামা ও আকাবির’ গ্রন্থের ৪৭ তম পৃষ্ঠায় মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী লেখেন: ‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বিতাড়ন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে মিয়াঁ ছাহেব রাহ. অত্র এলাকার আঞ্চলিক সংগঠক ছিলেন এবং মুক্তিসংগ্রামীদের রসদ সরবরাহে তাঁর বিরাট চেষ্টা ও কোশেশের কথা জানা যায়। মুক্তিসংগ্রামীদের নিরাপদ আশ্রয়ের এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে তাদের পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার জন্য তিনি আঞ্চলিক দায়িত্বশীল ছিলেন।’
বাকি অংশ নিচে.......
মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ
এক.
ঘুঘুডাকা গ্রামের রেশ এখনো জড়িয়ে আছে। গাছপালার ঘনত্ব অবশ্য কিছু কমেছে। বেড়েছে ঘরবাড়ি, দালানকোঠা। সেই মাইজবাড়িতে সেদিন গেলাম। এই জানুয়ারির ৩০ তারিখ। প্রশান্তি ও ঐতিহ্যের বিনয়ী মুখ ফকিরবাড়ির আঙ্গিনাজুড়ে। জুমার পর সওতুল হেরা মাদরাসার দফতরে। তারপর গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়ির গোরস্তানের সামনে। পুণ্যবান বহু মানুষের মাটির বিছানা। আগেও তো গিয়েছি। পাঁচ-দশ, বিশ বছর আগে এবং তারও আগে। হঠাৎ হঠাৎ এমনিতেই। মাহফিল, বিশেষ মজলিস, আত্মীয়তার নিসবত- ছিল এমনই সব উপলক্ষ। কিন্তু সেদিনের অনুভ‚তি ছিল একটু ভিন্ন।
ময়মনসিংহ শহর থেকে ৮/১০ কি. মি. পশ্চিমে। টাঙ্গাইল মহাসড়কের দক্ষিণে। আমাদের প্রজন্মের সামনে এই বাড়ির দুটি নাম এবং মুখ ছিল বড় উজ্জ্বল। ব্রিটিশবিরোধী অমর সংগ্রামী শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর লড়াকু শাগরিদ মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ. এবং তাঁর চাচাতো ছোট ভাই ফরযন্দে দেওবন্দ মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান রাহ.। ছিলেন সংগ্রামের মননে নিঃসঙ্গ এক পথিক মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.। কী দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব! ধবধবে ফর্সা মুখ। উঁচু কিশতী টুপির নিচে ঈগলের মতো খাড়া নাক। গালভরা সাদা দাড়ির মাঝে টানা টানা দুটি চোখ। সরাসরি দৃষ্টিপাত, স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে বক্তব্য উপস্থাপন কিংবা কথোপকথন। আমাদের দেখা ও শোনা- দুটোতেই থাকতো অপেক্ষমাণ মুগ্ধতা। কিন্তু আমরা তাঁর আগে তাঁর পরিবারের আর কারো ব্যাপারে তেমন কিছু জানতাম না। অথচ দ্বীন ও ব্যক্তিত্বের এই নিদর্শনেরও আগে ছিল আরো বড় উৎস। তাঁর দাদা, তাঁর দাদার দাদা এবং তাঁর বাবা সবাই ছিলেন দ্বীন-কেন্দ্রিক ইতিহাসের গর্বিত উপাদান। আমাদের সেসব জানাই ছিল না। পরে জানা সম্ভব হয়েছে যে, ইরানী সুন্নী মুসলিম বংশোদ্ভুত হযরত আরিফ রাব্বানী রাহ.-এর দাদা মাওলানা জব্বার বখশ রাহ.-সর্বসাধারণে যার উপাধি ছিল মিয়াঁ ছাহেব- ছিলেন উঁচু স্তরের এক বুযুর্গ এবং একই সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থানীয় একজন সংগঠক। বালাকোট-উত্তর উপমহাদেশব্যাপি পরিচালিত জিহাদ আন্দোলন, ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব এবং অসফল সিপাহী বিপ্লবের পরে আলেমদের নেতৃত্বে সংঘটিত সীমান্ত জিহাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। জানা গেছে, পরবর্তীকালে তুর্কী খেলাফত রক্ষার সংগ্রামেও তিনি অর্থকড়ি পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। বিশেষভাবে সেই সাধক-সংগ্রামী মনীষীর স্মৃতির ক্ষেত্রটি ঘুরে আসা এবং তাঁর কবর যিয়ারত করাই ছিল সেদিনের বিশেষ উদ্দেশ্য।
দুই.
যতদূর জানা যায়, মাইজবাড়িতে এই খান্দানের প্রথম পুরুষটি ছিলেন নিরাপদ মুসলিম জনপদের সন্ধানে ইরান থেকে হিজরত করে আসা ফার্সীভাষী এক সাধক সুন্নি মুসলিম। নাম শাহ বারাতুল্লাহ রাহ.। এ অঞ্চলে তিনি দাওয়াতী, তালীমী, ইসলাহী কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে কাছাকাছি অঞ্চলেই বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তার পুত্রের নাম ছিল শাহ কলন্দর রাহ.। শাহ কলন্দরের পুত্রেরই নাম হচ্ছে শায়খ জব্বার বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.। এই মিয়াঁ ছাহেবের জন্ম ১৮২৬ সনে। ৪/৫ বছর বয়সে তিনি ইয়াতিম হন। এরপর ইলমেদ্বীন অর্জন করেন ময়মনসিংহ শহরের বর্তমান বড় বাজার এলাকায় অবস্থানরত ঢাকা-নিবাসী একজন সাধক আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান রাহ.-এর কাছে। তাঁর কাছ থেকেই তিনি অধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ ও দীক্ষাও গ্রহণ করেন। এরপর মাইজবাড়ি গ্রামে নিজের দেয়া নাম ‘ফকিরবাড়িতে’ অবস্থান করেই কুরআনী তালীমের প্রচার, শিরক-বিদআতমুক্ত মুসলিমসমাজ গঠন এবং কমজানা মুসলমানদের মাঝে সহীহ মাসায়েলের চর্চার ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। এরই মধ্যে যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের উল্লেখযোগ্য একটি সময় তিনি পার করেন বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামের জিহাদী তৎপরতায়। দীর্ঘ ১০৮ বছর হায়াত তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছে বালাকোটের ঘটনার মাত্র ৫ বছর আগে। ইন্তেকাল হয় উপমহাদেশ (পাকিস্তান ও ভারত) স্বাধীন হওয়ার ১৩ বছর আগে ১৯৩৪ সনে। বর্ণাঢ্য দীর্ঘ জীবনে তিনি কয়েক পর্যায়ে বিপ্লব-সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। তবে তাঁর ব্যক্তিত্বের সাধক ও দরবেশ রূপটিই জনসমক্ষে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। এজন্য হেদায়েতী ও ইসলাহী নানা সক্রিয়তায় যেমন লোকজন তাঁর কাছে আসতেন, তেমনি দুআ-খায়ের, ঝাড়ফুঁক-তদবিরের জন্যও ভিড় কম হতো না। তাঁর জীবনটি ছিল তাকওয়া, তাওয়াক্কুল ও জিহাদের সমন্বিত পাঠশালা। বহু কারামাতের ঘটনাও তাঁর জীবনে ঘটেছে।
তিন.
বুযুর্গ মুজাহিদ জব্বর বখশ ওরফে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর প্রপৌত্র মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদীর রচনা ও যবানীতে জানা যায়, মিয়া ছাহেব রাহ. তাঁর যৌবন থেকেই তৎকালীন আলেম সমাজের নেতৃত্বে পরিচালিত ফিরিঙ্গি-বিরোধী সংগ্রামে বরাবর যুক্ত ছিলেন। বিশেষত ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব কালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বা নিম্নবঙ্গের গ্রামপ্রধান এলাকাগুলোতে বিপ্লবের অনুকূলে সাংগঠনিক কাজ করার যে অধ্যায় ইতিহাসে স্বীকৃত, তাতে গভীরভাবেই তাঁর যুক্ততা ছিল। মাইজবাড়ির ফকিরবাড়ির জামাতা প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা তফজ্জুল হক হবিগঞ্জীও এক স্মৃতিচারণে সিপাহী বিপ্লব ও তুর্কী খেলাফত রক্ষার আন্দোলনে মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর সম্পৃক্ততার কথা শুনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
বৃদ্ধ মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-কে শৈশব ও কৈশোরে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তার পৌত্র মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.। তাঁর ত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রামের টুকরো টুকরো ঘটনা, স্মৃতি বা জীবনদৃষ্টি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। নিজের সংগ্রামী জীবনেও সেসব কিছুর অনুসরণ করেছেন। অধস্তন বংশধর ও শাগরিদদের সামনে সেসব কাহিনীর কিছু কিছু দ্যুতিও তিনি ছড়িয়ে গিয়েছেন। তবে বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে সেসব বর্ণনা বা ইতিহাসের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষিত রাখা সম্ভব হয়নি।
অবশ্য লোকমুখের চর্চা এবং আদর্শিক ও পারিবারিক পরম্পরাগত বর্ণনার সূত্রে সেসব ঘটনা প্রায় প্রামাণ্যের পর্যায়ভুক্ত হয়ে আছে। কাগুজে দলিল সেখানে কোনো মুখ্য বিষয় থাকতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। প্রথমত ব্রিটিশ সিভিলিয়ন উইলিয়াম হান্টারের লেখা ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে বালাকোটের (১৮৩১) পর উপমহাদেশব্যাপি জিহাদ আন্দোলনের অংশ হিসেবে পূর্ববঙ্গে বা নিম্নবঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী যে বিস্তৃত ও দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা একদমই সঙ্গত যে, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার বিভিন্ন পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী হক্কানী আলেমরা সক্রিয় ভ‚মিকা রেখে গেছেন। হযরত মিয়াঁ ছাহেব রাহ.-এর জন্ম ১৮২৬ সনে হওয়ায় সিপাহী বিপ্লবের সময় তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। তাঁর তখন পূর্ণ যৌবন। বালাকোটের পর থেকে আফগানিস্তান সন্নিহিত সীমান্ত এবং সিত্তানা-মুলকা কেন্দ্রিক যে দীর্ঘ সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাস পাওয়া যায় তা চালু ছিল প্রায় ১৮৯০ সন পর্যন্ত। বিহারের পাটনায় তার বড় একটি ঘাঁটি ছিল। মাওলানা এনায়েত আলী, বেলায়েত আলীসহ সর্বভারতীয় অন্য আলেমদের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের বহু যুবক-প্রাণ আলেম তখন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। সিপাহী বিপ্লবকালে ওই সংগ্রামীরা ব্যাপক ভ‚মিকা রাখেন। এর পরেও তারা নিরস্ত হননি। ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সরাসরি যুদ্ধ-লড়াই হয়। সে প্রেক্ষাপটেই ১৮৬৪ সনে আম্বালায়, ১৮৬৮ সনে পাটনায়, ১৮৭০ সনে মালদহ ও রাজমহলে এবং ১৮৭১ সনে কলকাতায় বালাকোট-উত্তর সংগ্রামী মুজাহিদদের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ওই সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের ‘ওহাবী আন্দোলন’ ও ওহাবী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও সেটি ছিল ডাহা মিথ্যা। ওহাবী আন্দোলনের সঙ্গে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কোনো যোগসূত্র ছিল বলে জানা যায়নি। মূলত শিরক থেকে সংস্কারবাদী এবং জিহাদ ও তাসাওউফের মিলিত সংগ্রামেরই তাঁরা কর্মী ছিলেন। পূর্বাপর পরিস্থিতি ও বংশ পরম্পরার বর্ণনায় বোঝা যায়, সিপাহী বিপ্লব ও আগের-পরের বালাকোট-উত্তর জিহাদী আন্দোলনেই মিয়াঁ ছাহেব গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে ‘বৃহত্তর মোমেনশাহী: উলামা ও আকাবির’ গ্রন্থের ৪৭ তম পৃষ্ঠায় মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী লেখেন: ‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বিতাড়ন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে মিয়াঁ ছাহেব রাহ. অত্র এলাকার আঞ্চলিক সংগঠক ছিলেন এবং মুক্তিসংগ্রামীদের রসদ সরবরাহে তাঁর বিরাট চেষ্টা ও কোশেশের কথা জানা যায়। মুক্তিসংগ্রামীদের নিরাপদ আশ্রয়ের এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে তাদের পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার জন্য তিনি আঞ্চলিক দায়িত্বশীল ছিলেন।’
বাকি অংশ নিচে.......
Comment