Announcement

Collapse
No announcement yet.

মরু সিংহ ওমর মুখতার ও একদল শকুন

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • মরু সিংহ ওমর মুখতার ও একদল শকুন

    ১৯৩১ সাল। লিবিয়ার বেনগাজির সামরিক আদালত। বিচারক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ‘আসামির কথোপকথন-

    -আপনি কি ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন?

    -হ্যাঁ।

    -আপনি কি ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করতে লোকজনকে উৎসাহিত করেন?

    -হ্যাঁ।

    -আপনি যা করেছেন তার দণ্ড সম্পর্কে কি আপনি জানেন?

    -হ্যাঁ।

    -আপনি কত বছর ধরে ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন?

    -২০ বছর।

    -আপনি যা করেছেন তার জন্য কি অনুশোচনা হয়?

    -না।

    -আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে?

    -হ্যাঁ।

    এ পর্যায়ে বিচারক বললেন- ‘আপনার মতো লোকের জন্য এটি করুণ পরিণতি।’

    কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মানুষটির জবাবও বেশ তীক্ষ্ম। তিনি বললেন, ‘বিপরীতভাবে বলতে পারি জীবন শেষ করার সবচেয়ে ভালো উপায় এটি।’

    না, এগুলো কোনো গল্প কিংবা উপন্যাসের কল্পিত লাইন নয়। এগুলো লিবিয়ার বেনগাজিতে সামরিক আদালতের বিচারকের সঙ্গে মরু সিংহ হিসেবে পরিচিত ইতালির দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করা মুজাহিদদের নেতা ওমর মুখতারের কথোপকথন।

    মুখতারের চূড়ান্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন জেনারেল রডোলফো গ্রাজিয়ানি। তার বর্ণনা মতে, মুখতার ছিলেন ‘মাঝারি উচ্চতার ও সুঠাম দেহের অধিকারী এবং সাদা দাড়ি গোঁফ বিশিষ্ট ব্যক্তি। ওমর মুখতার ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি সম্পন্ন, ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী, শক্তিসম্পন্ন ও ক্ষিপ্র, স্বার্থ ও আপোষহীন। তিনি খুব ধার্মিক ও দরিদ্র ছিলেন, যদিও তিনি ছিলেন সেনুসিদের (আধ্যাত্মিক গোষ্ঠী) মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে।’

    ওমর মুখতার লিবিয়ার পূর্ব সিরনিকার আল-বুতনান জেলায় জানযুর গ্রামে ১৮৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল আল মুখতার ইবনে মুহাম্মাদ। আর মায়ের নাম ছিল আয়েশা বিনতে মুহারিব। শৈশবেই বাবা-মা দুজনকে হারান মুখতার। পরে তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন শারিফ আল গারিয়ানি নামের এক ব্যক্তি।

    মুখতারের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়েছিল স্থানীয় মসজিদে । পরে তিনি সুফিদের আন্দোলন সেনুসির মূলকেন্দ্র জাগবুবের সেনুসি বিশ্ববিদ্যালয়ে আট বছর শিক্ষালাভ করেন। ১৮৯৯ সালে ফরাসিদের প্রতিহত করার জন্য রাবিহ আযযুবায়েরকে সাহায্য করতে অন্য সেনুসিদের সাথে তাকে অফ্রিকার চাদ ভুখণ্ডে পাঠানো হয়। সেখানে সেনুসি নেতা আল মাহমুদের মৃত্যুর পর ১৯০২ সালে মুখতারকে লিবিয়ায় ডেকে পাঠান সেনুসসিদের শীর্ষ নেতা আহমেদ শরীফ আস সেনুসি। তিনি মুখতারকে লিবিয়ার পূর্ব উপকূলীয় এলাকা সাইরেনাইসার উত্তরাঞ্চলের জাওইয়াত লকসর এলাকার নেতা করে পাঠান।

    তুরস্কের অটোমন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে ১৯১১ সালে অ্যাডমিরাল লুইগি ফারাভেলির নেতৃত্বে ইতালির নৌবাহিনীর একটি দল লিবিয়ার উপকূলে পৌঁছায়। এসময় তারা ত্রিপোলি ও বেনগাজি অবরুদ্ধ করে ফেলে। তার তুর্কিদের ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু তুর্কি ও স্থানীয় সেনারা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে শহরের ভেতরের দিকে চলে যায়। ইতালীয়রা তিন দিন পর্যন্ত ত্রিপোলি ও বেনগাজির ওপর গোলাবর্ষণ করে। শেষ পর্যন্ত শহর দুটি ইতালির নৌবাহিনীর দখলে চলে যায়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইতালির সেনাবাহিনী এবং ওমর মুখতারের সঙ্গে দীর্ঘ ২০ বছরব্যাপী যুদ্ধের সূচনা হয়।

    পেশায় ওমর মুখতার ছিলেন কুরআন শিক্ষক। তবে মরুভূমিতে যুদ্ধ পরিচালনায় তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। স্থানীয় ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে থাকা জ্ঞান তিনি ইতালির সেনাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগান। ইতালীয়রা মরু অঞ্চলে যুদ্ধের সাথে পরিচিত ছিল না। মুখতার তার বাহিনী নিয়ে ইতালির সেনাদের ওপর গেরিলা হামলা চালাতে শুরু করেন। তার বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে ইতালি সেনাদের চৌকির ওপর হামলা চালিয়ে সরে পড়তো। তারা ইতালির সেনাদের যোগাযোগ ও রশদ সরবরাহে ব্যাপকভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

    পরপর কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ইতালির শাসক মুসোলিনি তার সেনা কর্মকর্তা জেনারেল গ্রাজিয়ানিকে লিবিয়ায় ইতালীয় সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে নির্বাচন করেন। গ্রাজিয়ানি দাবি করেছিলেন, লিবিয়াকে পুরোপুরি ইতালির নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে তাকে আইনের বালাই না রেখে যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে, এর জন্য তার কাছে কোন জবাবদিহি চাওয়া যাবে না। মুসোলিনি তা মেনে নেন।

    স্থানীয়রা যাতে মুজাহিদিনদের সহযোগিতা করতে না পারে সেজন্য গ্রাজিয়ানি হাজার হাজার লিবীয়কে ইতালির সেনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করেন। যে সব লিবীয় আল-জাবাল আল আকদার, মোরতাফ আত আল তাহির, বিনিনা উত্তর থেকে আশ শালাইতিমিয়া দক্ষিণ, তাওকিরা থেকে দক্ষিণের মরুভূমির বাল্ত আব্দেল হাফিতসহ যেসব উপজাতিদের অন্ততঃ একটি সন্তান মুখতার বাহিনীতে রয়েছে তাদের সবাইকে ১৯২৯ সাল নাগাদ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করা হয়।

    কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোর অবস্থা ছিল ভয়ংকর। মুজাহিদিনদের সহযোগিতা করছে- এই সন্দেহে প্রায়ই শিবিরের নারী, শিশু ও পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। এছাড়া অনাহার ও রোগে মৃত্যু ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

    ১৯৩৩ সালে ইতালির সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্য বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর টোডেস্কি তার সেরিনাইকা টুডে বইতে লিখেছেন, ১৯৩০ সালের মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০ হাজার লিবীয়কে তাদের গ্রাম ছেড়ে আসতে এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করা হয়। ১৯৩০ সালের শেষ নাগাদ যেসব লিবীয় তাবুতে বাস করতো তাদের সবাইকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করা হয়।

    লিবিয়ার ইতিহাসবিদ মাহমুদ আলি আততায়েব ১৯৭৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শিবিরগুলোতে থাকা ৫৫ শতাংশ লিবীয়র মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৩০ সালের নভেম্বরে ক্ষুধা ও অসুস্থতায় প্রতিদিন ১৭ জন করে লিবীয় মারা যেত।

    মুখতার বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯২৪ সালে ইতালির গভর্নর আর্নেস্ট বমবেলি জেবেল আখদারের পার্বত্য অঞ্চলে পাল্টা গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। ইতালির এই নতুন বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের মুখে মুখতার দ্রুত তার যুদ্ধকৌশল পাল্টান। এসময় তিনি মিশর থেকেও কিছুটা সামরিক সাহায্য পেতে সমর্থ হন।

    ১৯২৭ সালের মার্চে ইতালীয়রা জাঘবুব দখল করে। ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত মুখতার সানুসি বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। ১৯২৯ সালে পিয়েত্রো বাদোগলি লিবিয়ার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ওমর মুখতারের সাথে শান্তি আলোচনায় বসেন। এসময় গভর্নরের পক্ষ থেকে মুখতারকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। শেষ পর্যন্ত এই আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং ওই বছরের অক্টোবরে মুখতার লিবিয়ায় ইতালির সেনাপ্রধান রডোলফো গ্রাজিয়ানির সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য লিবিয় যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।

    ১৯৩০ সালের জুনে গ্রাজিয়ানির বাহিনী মুখতারের কাছে পরাজিত হয়। খবর পেয়ে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মুসোলিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মুখতার বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিতে গ্রাজিয়ানির পরামর্শে মুসোলিনি জেবেল আখদার থেকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সরিয়ে উপকূল এলাকায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। এছাড়া গিয়ারাবুবে উপকূলের কাছে লিবিয়া ও মিশরের সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। মুখতারের যোদ্ধারা যাতে মিশর ও স্থানীয় জনতার সহযোগিতা না পায় সেজন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

    ১৯৩১ সালের প্রথম দিক থেকেই মুখতার বাহিনীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে দিতে সক্ষম হয় গ্রাজিয়ানির বাহিনী। আকাশ ও স্থল উভয় পথেই মুখতার বাহিনীর ওপর চলে আক্রমণ। এর পরেও মুখতার লড়াই চালিয়ে যান। ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্লোনটার কাছে অতর্কিত হামলা চালানো হয় মুখতার বাহিনীর ওপর। ইতালির সেনাদের গুলিতে মুখতারের ঘোড়াটি মারা গেলে পড়ে যান তিনি। এরপরেও নিজের বন্দুকটি নেওয়ার চেষ্টা করলে সেনারা তার হাত লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। শেষ পর্যন্ত আহত অবস্থায় ৭২ বছর বয়সে বন্দি হন মুখতার।

    মাত্র তিনদিনের মধ্যে মুখতারের বিচার সম্পন্ন হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয় বেনগাজির সামরিক আদালত। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সুলুকের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মুখতারকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

    মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে মুখতারকে মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিনিময়ে তাকে মুজাহিদদের কাছে চিঠি লিখে ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। জবাবে মুখতার বলেছিলেন, ‘আমরা কখনোই আত্মসমর্পন করবো না। হয় আমরা জিতব নতুবা মৃত্যুকে বরণ করবো। তোমাদেরকে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে লড়তে হবে এবং এর পরের প্রজন্মের সঙ্গে।’

    (collected)

    রবের প্রতি বিশ্বাস যত শক্তিশালী হবে, অন্তরে শয়তানের মিত্রদের ভয় তত কমে যাবে।

  • #2
    আল্লাহু আকবার!!
    হে আল্লাহ! আমার যেন পরকালে জান্নাতে এই মহান বীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়!
    আমি মোটামোটি ছোটকালে এই মহান আল্লাহ ওয়ালা বীরের নামে একটি উপন্যাস পড়ি। তারপর তার ছবি দেখার পর তার প্রতি আন্তরিক ভালবাসা সৃষ্টি হয়।আল্লাহ এই ভালবাসার কারণে পরকালে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটান! আমিন!

    Comment


    • #3
      হে মরু সিংহ আমরা আপনার কথার সাক্ষী,
      ‘আমরা কখনোই আত্মসমর্পন করবো না। হয় আমরা জিতব নতুবা মৃত্যুকে বরণ করবো। তোমাদেরকে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে লড়তে হবে এবং এর পরের প্রজন্মের সঙ্গে।’

      Comment

      Working...
      X