মুহাম্মাদ বিন আব্দুল কারীম আল খাত্তাবী
আমীরুল মাগরিব আল-ইসলামী
আব্দুর রহমার আজ্জাম পাশা ( জামিয়া দুয়ালিল আরাবিয়্যার প্রথম ডীন) তার চোখকে বিশ্বাষ করতে পারছিলেন না। ১৯৪৭ সালে তখন চোখের সামনে ছিল ঐ ছোট্ট বার্তাটি যা ইয়ামেনের এক আরব মুজাহিদ গ্রুপ তার কছে পাঠিয়েছিল।আমীরুল মাগরিব আল-ইসলামী
{ সর্বোচ্চ গোপনীয় ও জরুরী ... আজ এডেন বন্দরে ফ্রান্সের একটা জাহাজ অবতরণ করেছে, যেটা শিকল পরিহিত একজন শাইখকে বহন করছে। যিনি ২০ বছর ধরে গোপন থাকা মহান ইসলামী বীরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। জাহাজটি এখন ফ্রান্স অভিমুখী। আগামী কাল মিনা থেকে মিসরের পোর্ট সাঈদে পৌঁছাবে। তাই সতর্ক থাকা জরুরী }
সাথে সাথেই তিনি বাদশা ফারুকের সাথেই বিষয়টা আলোচনার জন্য গেলেন। বাদশার প্রাসাদে তাদের মাঝে গোপনে বৈঠক হল। কিছুক্ষণের ভিতর সেনাবাহিনীর কাছে খবর পৌছাল যে, সুইস চ্যানেলে জাহাজটাকে আটক করে শাইখকে বাদশার দরবারে নিয়ে আসতে। চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ে তারা বাদশার দরবারে বরফের মত সাদা দাড়ীওয়ালা একজন শাইখকে নিয়ে আসল। ধীর হওয়া স্বত্বেও দৃঢ় পদক্ষেপে আগিয়ে আসছেন। সবার কাছেই তার উন্নত ললাট থেকে মহান এবং মর্যাদার দ্যুতি চমকাচ্ছিল। সাদা বড় যোব্বা পরিধান করে আছেন। তার হাতে এবং টাখনুতে হাত কড়া ও বেড়ীর দাগ এত স্পষ্ট হয়ে আছে যেন এগুলো তার চামড়ার সাথে মিশে গিয়েছিল। যখন তিনি ফারুকের সামনে এসে পৌঁছালেন তখন সে উনাকে নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তখন সেই মহান শাইখ মাথা তুললেন এবং আহত বাজের মত দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকালেন ও পূর্ণ আত্ববিশ্বাষ ও দৃঢ়তার সাথে বললেনঃ ( আমি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল কারীম আল-খাত্তাবী ) ...
আমরা ইতিহাসে ফিরে যাচ্ছি , দৃষ্টিটাকে মিশর থেকে মাগরেবের দিকে ফিরাচ্ছি। বিশেষ করে ১৩০১ হিঃ/১৮৮৩ খ্রীঃ মাগরেব আল-ইসলামীর উগাডির শহরের দিকে। সেখানে কোন এক বারবার আমাজেগ ক্বাবিলায় এক শাইখ ছিলেন। যাকে আব্দুল কারীম আল-খাত্তাবী নামে ডাকা হত। তার ঘরে একটা সন্তান জন্মগ্রহন করল। যাকে তিনি নাম রাখলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহিস সাল্লামের নামে মুহাম্মদ। মায়ের কোল থেকেই শাইখ তার সন্তানকে উত্তম ভাবে প্রতিপালন করছিলেন। তাকে আরবী শিক্ষা দিলেন এবং কোরআন হিফজ করালেন। তারপর তাকে ফাস শহরের জামেয়া কারওয়িনে হাদীস ও ফিক্বহ শিক্ষা করতে পাঠালেন। কিছু দিনের ভিতর তিনি মাগরেবের মালিলিয়্যাহ শহরে প্রধান কাজীর পদে অধিগ্রহণ করলেন।
তখন মাগরেবে কল্পনাতীত দুরবস্থা বিরাজ করছিল। সাম্রাজ্য বিস্তারকারী রাষ্ট্রসমূহ ইসলামী মাগরেবের রাষ্ট্রগুলোকে ঐতিহাসিক বীর তৈরির উৎস মনে করছিল। কারণ এখান থেকেই দাওলাতে মুরাবিতিন এর মুজাহিদরা আন্দালুসে আক্রমন করেছিল। এখান থেকেই ইউরোপে মুরাবিতিনরা নৌ-যোদ্ধ্য পরিচালনা করেছিলেন। এখান থেকেই বারবার সেনাপতি ত্বারেক বিন জিয়াদের নেতৃতে মুজাহিদরা ইউরোপে সর্বপ্রথম আক্রমন পরিচালনা করেছিলে। এই জন্য ঐ সমস্ত রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিল যে, ইহাই সবচেয়ে বড় ইসলামী বিপদ। তাই ইউরোপের ১২টি রাষ্ট্র মিলে {সবুজ আল-জাজিরা} নামের একটা চুক্তি করল। আমরিকান লেখক - মাবদা’ মুনিরিউ - তার বইয়ে লেখেন: এই সমস্ত রাস্ট্র সমূহ আবহমান কাল ধরে চলে আসা ইসলামী ঐতিহ্যকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য একত্রিত হয়েছিল। এই নীল নকসার উদ্দ্যেশ্য ছিল: ইসলামী মাগরেবের দেশ সমূহকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়া !
অবাক করার বিষয় হচ্ছে এই রাস্ট্রগুলো মাগরেবকে ভাগ করেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং এমন নিকৃষ্ট ভাবে ভাগ করেছে যা ইতিপূর্বে মানব সভ্যতা প্রত্যক্ষ করে নি। যাতে তা চরমভাবে ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায়। ফ্রান্স দখল করেছে মাগরেবের দক্ষিন পার্শ { মৌরিতানিয়া }, তারপর স্পেন নিয়েছে তার উত্তরে { পশ্চিম মরুভূমি } , তারপর আবার ফ্রান্স তার উত্তরে বর্তমান মধ্য মাগরেব দখল করেছে, তারপর স্পেন আবার মাগরেবের উত্তর অংশ দখল করেছে। জার্মানী এবং বৃটেন এখানে সেখানে বিভিন্ন শহর দখল করা ধ্বংস করা শুরু করল। এমনকি সবাই ধারণা করতে লাগল তারা মাগরেবে চিরকালের ইসলামকে নাম-নিশানা সহ মুছে দিবে। কিন্তু শাইখ খাত্তাবী ও তার ছেলে মুহাম্মদের ছিল ভিন্ন চিন্তা। ( আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন)। তারা নিপিড়িত কাবিলাগুলোকে এক তাওহিদের পতাকা তলে সমাবেত করতে লাগলেন। এবং উসমানী খালিফার কাছে দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু তখন স্পেন শাইখ আব্দুল কারীমকে হত্যা করে ও তার ছেলে মুহাম্মদকে বন্দী করে ফেলে। এবং তাকে মাগরেবের এক পাহাড়ের গুহায় বন্দী করে রাখে। সীমাহীন নিরাপত্তার সাথে। কিন্তু বীরের ছেলে বীর তার বিছানা কাপড় দ্বারা একটা রশি বানাতে সক্ষম হয়। যাতে করে জেলখানার ঘুঘলি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু রশিটা পাহাড়ের উপর থেকে তাকে মাটিতে নামানোর মত লম্বা ছিল না। কিন্তু পাহারাদাররা জেনে যাওয়ার আগেই আমাদের বীর উচু চূড়া থেকে শক্ত পাথরের উপর ঝপিয়ে পড়েন তার ফলে তার পায়ের হাড্ডি ফেটে যায় ও প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
বন্দী করার কয়েকদিনের ভিতরই আমীর মুহাম্মদ বিন আব্দুল কারীম আল-খাত্তবী জেল থেকে বের হয়ে আসেন। এবং ক্বাবিলার পুরুষদেরকে নিয়ে তিন হাজারের একটি দল তৈরি করেন। এবং তিনি তাদেরকে নিয়ে যোদ্ধবিদ্যার এক নতুন দিক উদ্ভাবন করলেন। এবং পৃথিবীর যোদ্ধ ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম এই কৌশল ব্যবহার করেন যাকে হারবুল আসাবাত বা গেরিলা যোদ্ধ বলা হয়। এরপর বিশ্বের সমস্ত বিপ্লবীরাই তা ব্যবহার করেছেন। যার ভিত্তি তিনটি কৌশলের উপর (المباغتة و الكر و الفر ) অত:পর আমীর মুহাম্মাদ যোদ্ধের আরেক কৌশল উদ্ভাবন করলেন, ভিয়েতনাম যোদ্ধে তাদের মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার যেটা আমেরিকানদের বিরোদ্ধে কিছু বছর পড়েই ব্যবহার করেছিলেন। আর সেই পদ্ধতিটা হচ্ছে মাটির নিচে শত্রুর ঘাটি পর্যন্ত বিশাল খানদাক তৈরি করা। আর ইহার মাধ্যমেই মুজাহিদরা স্পেনকে যোদ্ধের প্রতিটা দিন নতুন শিক্ষা দিতে সক্ষম হলেন।
যখন স্পেন প্রচন্ডভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল; স্পেনের বাদশাহ (তেরতম আলফুনিসু ) তার বন্ধু জেনারেল ( সালফাসতারি) এর নেতৃত্বে মাদ্রিদ ( ইসলামী নাম: مجري الماء) থেকে পূর্ণ একটি সেনা বাহিনী পাঠায়। (আনওয়াল) নামক যোদ্ধে দুই দল একত্রিত হয়। স্পেন এসেছে বিমান ও ট্যান্ক দ্বারা সজ্জিত ৬০ হাজারের একটা বাহিনী নিয়ে। বিপরিতে পুরাতন কিছু বন্দুক হতে মুসলিম যোদ্ধারা ছিল মাত্র তিন হাজার। একদল আল্লাহর রাস্তায় অন্য দল ক্রুশের পথে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো বলেছেন: (মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব। রোম:৪৭)। বাস্তবেই ৬০ হাজারের বিপক্ষে তিন হাজারই জয়ী হয় আমীর মুহাম্মদের নেতৃত্বে। ১৮ হাজার স্পেনীকে ময়দানেই হত্যা করা হয়। ৬০০ সৈন্য স্পেনের দিকে কুকুরের মত পলায়ন করা ছাড়া তাদের আর কেহ ধ্বংশ ও গ্রেফতারীর হাত থেকে বাচতে পারে নি। যাতে করে তারা তাদের পরাজয়ের কথা মানুষকে বলতে পারে।
তারপর আমীর মুহাম্মদ মাগরেবের সমস্ত দেশ নিয়ে ( ইমারাত ) গঠন করেন। এবং তার ইমারাতের পাচ বছরে মানুষকে তিনি সঠিক ইসলাম শিক্ষা দিতেন। যা ছিল দরবেশী ও বাতিল আকীদা মুক্ত। এবং বিভিন্ন আলেমদের দলকে পূরা দেশে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন যাতে করে সমস্ত কাবীলা এক পতাকা তলে একত্রিত হয়।
প্রত্যেক ইসলামী বিজয়ের পর যা হয়ে থাকে ...... ক্রুসেডার সমস্ত রাস্ট্র দ্বিতীয় বার মুসলমানদের বিরোদ্ধে একত্রিত হয়। যখন তারা অনুভব করল যে, এই ইমারা যদি টিকে থাকে তাহলে তা ইতিহাসের গতিকেই পাল্টে দিবে। তখন তারা বিমান, ট্যান্ক ও কামান সজ্জিত ৫ লাখ সৈন্যের একটা চুক্তি করল, যার মাধ্যমে তারা ২০ মুজাহিদের বিরোদ্ধে যোদ্ধ করবে।
এখানেও তাদের জন্য বড় বিষ্ময় অপেক্ষা করছিল ! মুজাহিদরা আমীর মুহাম্মাদের অধীনে সমস্ত যোদ্ধে জয়ী হচ্ছিল। যোদ্ধের ময়দানে তারা পরাজয়ের পর পরাজয়ে পতিত হচ্ছিল। এর ফলে ইউরোপিয়ানরা বেদাতী সূফি ত্বারিকার কিছু শাইখকে কিনে নিতে বাধ্য হল। আমীর মুহাম্মাদ আগে থেকেই এই আকীদার বিরোধী ছিলেন। তখন এই গাদ্দার বেদাতী সূফীরা ঐমুহুর্তে খাত্তবীর সাথে যোদ্ধ হারামের ফাতাওয়া প্রকাশ করল, যখন ফ্রান্স ও স্পেনের বিমানগুলো জনগণের উপর রাশায়নিক অস্ত্র ও বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করছিল। এবং সাথে সাথে ইংরেজরা মাগরেবের সীমান্ত অবরোধ করে নিয়ে ছিল। তখন আমাদের বীর আমীর খাত্তবী এক সাথে গাদ্দার এবং ক্রুসেডারদের বিরোদ্ধে যোদ্ধ করেছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত তার নেতৃত্বে আল্লাহ তায়ালার সাথে শাহাদাতের ওয়াদাকারী ২০০ জন ছাড়া আর কেহ রইল না। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে; এরাই এমন সিংহের মত যোদ্ধ করতে লাগল যে, ক্রুসেডাররা তাদরকে পরাজিত করা থেকে নিরাশ হয়ে গেল। তখন তারা পুরাতন একটা চাল গ্রহন করল যা আপনি মুসলিম মনীষীদের ইতিহাসে অসংখ্যবার পাবেন। ক্রুসেডাররা মুজাহিদদের নিরাপত্তার পূর্ণ জামানত সহ মাগরেবের মুসলমানদের পূর্ণ স্বাধীনতা ও সয়ংসম্পূর্নতার শর্তে তারা তার কছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠাল।
তাদের অভ্যাস অনুযায়ী ..... সন্ধি চুক্তি ভন্গ করল। এবং তারা আমীর মুহাম্মদকে গ্রেফতার করে ভারত সাগরের এক অজানা দ্বীপে নির্বাসন করল। এক বছর দুই বছর নয়, পুরা বিশ বছর মানবতার ধ্বজাধারীরা এই বীরকে বন্দি করে রাখে।
তারা এখন বের হয়েছে ফ্রান্সের স্লোগান নিয়ে : ( স্বাধীনতা, সমতা, বন্ধুত্ব) । একজন দুর্বল শাইখকে ২০ বছর বন্দি রেখে তোমরা কোন স্বাধীনতার কথা বল ?! বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে নারী শিশুদেরকে হত্যা করে তোমরা কোন সমতার কথা বলছ ?! তোমাদের সভ্যতা থেকে দূরে থাকা দুর্বল ব্যক্তিদের রক্ত নিয়ে তোমরা কোন বন্ধূত্বে ঠাট্টা করছ ?!
দুর্বলদেরকে হত্যা করাই যদি হয় তোমদের সভ্যতার নির্মান ...
তাহলে শত দুর্ভোগ তোমাদের ও তোমাদের সেই সভ্যতার !
Comment