মোল্লা উমর, উম্মাহর এক অকৃত্রিম বন্ধুর গল্প
...মুসাল্লাহ কাতিব
...মুসাল্লাহ কাতিব
আমীরুল মুমিনীন মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রহ. ছিলেন এ বিজয়ী উম্মাহর এক কিংবদন্তী মহানায়ক এবং ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক সুদৃঢ় ঢাল। যিনি বাদশাহী ত্যাগ করেছেন; তবুও দ্বীনের পতাকাকে নিচু হতে দেননি। পৃথিবীর বুকে দ্বীনের সূর্যকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করে আবারও প্রমাণ করেছিলেন যে, ইসলাম কখনো কারো অধীনতা বরদাশত করে না; বরং সর্বদা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই পছন্দ করে। বন্ধুত্ব এবং শত্রুতার ক্ষেত্রে কিছু অনুপম দৃষ্টান্ত মোল্লা মুহাম্মাদ উমর রহ. এর জীবনকে আজও স্মরণীয় ও অলংকৃত করে রেখেছে। মুমিনদের প্রতি তাঁর দায়িত্বশীলতা ও ভালোবাসা আর কুফরের প্রতি তাঁর কঠোরতা ও বিদ্বেষ ছিল সত্যিই বেনজির। ‘ওয়ালা-বারা’ এর মূলনীতির ক্ষেত্রে তিনি কারো রক্তচক্ষু বা নিন্দাকে পরওয়া করেননি। নিম্নে তাঁর জীবন থেকে দু’টি ঘটনা পেশ করছি; যা দ্বারা তাঁর ব্যক্তিত্ব ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রমাণিত হয়।
এক. ২০০১ সালের মার্চ মাস। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীন ও সর্ব বৃহৎ দু’টি বৌদ্ধমূর্তি; যা আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে অবস্থিত ছিল। তৎকালীন ইসলামী ইমারাতের আমীর মোল্লা উমর রহ. মূর্তির অপবিত্রতা থেকে ইসলামী ইমারাতকে পবিত্র করার এক সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। মিথ্যা ও শিরকের ‘সিম্বল’ সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হারানো সুন্নাহকে আবার বাস্তবায়ন করলেন। এক্ষেত্রে বামিয়ানের প্রাচীন ও বৃহৎ মূর্তিদু’টিও রক্ষা পায়নি। পৃথিবীর সমস্ত শয়তানি শক্তি ও তাদের আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, এমনকি নামধারী মুসলিম দেশসমূহ পর্যন্ত এই মূর্তি রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বিশ্বের অনেক উলামায়ে-সূ মূর্তি রক্ষার পক্ষে ফতওয়াও দিয়েছিল। হিকমত পন্থীরাও আপাতত মূর্তি না ভাঙতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। মোল্লা উমর রহ. এর এই অটল সিদ্ধান্তের কারণে সমস্ত কাফের-মুশরিকদের ভ্রান্ত আকীদাতে এক চরম আঘাত লেগেছিল। মোট কথা, গোটা বিশ্ব তখন এই নাপাক মূর্তি রক্ষায় এক জোট হয়ে তালেবানদের বিরোধিতা করেছিল; কিন্তু তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর নিন্দার ঝড় আমীরুল মুমিনীন রহ. কে হক্ব থেকে একটুও টলাতে পারেনি। আর এভাবেই আল্লাহ তাআলা সত্য দ্বারা মিথ্যার উপর এমনভাবে আঘাত করলেন যে, মিথ্যা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ফলে বামিয়ানের মিথ্যা রবের প্রতিকৃতি ধুলার সাথে মিশে গেল এবং ইসলামী ইমারাত পবিত্র হয়ে গেল মূর্তি থেকে। নিশ্চয়ই তাঁর এ পদক্ষেপ কুফরের প্রতি ‘বারাআত’ বা শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ বৈ কিছুই ছিল না।
দুই. মুসলমানদের প্রতি মোল্লা উমর রহ. ছিলেন অনেক সদয় ও উদার। বিশেষ করে, আরব মুজাহিদীনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। ৯/১১ এর বরকতময় হামলার পর আমেরিকা যখন শহীদ শায়খ উসামা রহ. কে তাদের নিকট হস্তান্তর করতে চাপ দেয়, এমনকি গোটা বিশ্বের উলামায়ে কেরাম আমীরুল মুমিনীনকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, একজন ব্যক্তির জন্য বহুল প্রতীক্ষিত এবং পৃথিবীর বুকে একমাত্র ইসলামী ইমারাতকে ধ্বংস হতে না দিয়ে বরং উসামাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়াই উত্তম হবে। জবাবে আমীরুল মুমিনীন যা বলেছিলেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি বলেছিলেন, “উসামা আমাদের মেহমান। তাঁকে শত্রুদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এমনকি যদি হারামাইনের ভূমি থেকে একটি কুকুরও আমাদের নিকট আশ্রয় নিতো; তবুও আমরা তাকে তাদের নিকট হস্তান্তর করতাম না।” উলামায়ে কেরামকে তিনি বলেছিলেন, “আপনারা উসামাকে হস্তান্তরের জন্য একটি শরয়ী দলীল নিয়ে আসেন; তাহলে আমি তাঁকে হস্তান্তর করতে দ্বিধা করবো না।” তাঁর এই উত্তর শুনে উলামায়ে কেরাম লা-জওয়াব হয়ে গিয়েছিলেন। এবং তারা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ইনি তো এ যুগের মানুষ নন; বরং ইনি সাহাবায়ে কেরামের যামানার মানুষ। শায়খ উসামা রহ. কে হস্তান্তর না করায় আমেরিকা আফগানিস্তানে ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ও বর্বরোচিত হামলা শুরু করে। ফলে ইসলামী ইমারাত এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। আমীরুল মুমিনীন একজন মুমিনের জান-মাল হেফাজতের জন্য নিজেদের জান-মাল এমনকি একটা বিশাল রাজত্ব পর্যন্ত নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়ে দিলেন। পতনের সঙ্গিন মুহূর্তেও আশ্রিত আরব মুজাহিদীন ও তাঁদের পরিবারকে নিরাপদে বের হওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। যা তাঁর দায়িত্বশীলতা, ভালোবাসা ও যোগ্য নেতৃত্বের প্রমাণ বহন করে। নিশ্চয়ই এ পদক্ষেপ ছিল তাঁর ‘আল ওয়ালা’ অর্থাৎ ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কিঞ্চিৎ নমুনা মাত্র।
আমীরুল মুমিনীন মোল্লা উমর রহ. এর জীবনে ‘ওয়ালা-বারা’র এমন অনেক আপোষহীন ঘটনা রয়েছে, যা এ উম্মাহর জন্য অনুসরণীয়। উম্মাহর এ ক্রান্তিলগ্নে এমন নিবেদিতপ্রাণ, আত্মমর্যাদার অধিকারী নেতার খুবই প্রয়োজন ছিল।
......al-balagh 1439 | 2017 | issue 6......
Comment