#সুলতান_সালাহুদ্দিন_আইয়্যুবী রহঃ-এর ইন্তেকাল
পূর্বে প্রকাশের পর...
পর্ব -২
কাযি সাহেব এটাই ভাল মনে করলেন যে, আমরা ফিরে যাই আর কালাসার ইমাম- শায়খ আবূ জা'ফরকে রাতে দূর্গে অবস্থান করার জন্য ডেকে আনা হোক। কেননা, ইমাম সাহেব খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। আল্লাহ না করুন, রাতে সুলতান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে তিনি নারীদেরক সরিয়ে (মুমূর্ষু সুলতানকে) কালিমায়ে শাহাদাত তালকিন ও আল্লাহর যিকির করাতে পারবেন। তিনি তাই করলেন। আমরা দূর্গ থেকে নেমে এলাম। আমরা প্রত্যেকইই কামনা করছিলাম, যদি সুলতানের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা যেত। সে রাতটি সুলতান মৃত্যুপথের যাত্রীর ন্যায় কাটালেন। শায়েখ জা'ফর তার কাছে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন এবং তাঁকে আল্লাহর যিকিরের তালকিন করছিলেন। নবম রাত থেকেই তিনি অচেতন ছিলেন। মাঝেমধ্যে চৈতন্য ফিরে পেতেন। শায়েখ জা'ফর বলেছেন, (তিলাওয়াত করতে করতে) যখন তিনি
هوا الله الذي لا اله الا هو، عالم الغيب والشهادة
পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন তখন মুমূর্ষু সুলতান বলে উঠলেন, 'সহীহ'। এটা ছিল প্রয়োজনের মূহুর্তে চৈতন্য এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সুলতানের বিরাট সাহায্য। সুতরাং সকল প্রশংসা আল্লাহর। বুধবার বাদ ফজর ২৭ সফর ৫৮৯ হিজরী সুলতান ইন্তেকাল করলেন। ফজরোদয়ের পরই ইন্তিকালের মূহুর্তে কাযি ফাযেল ছুটে এসেছেন। আমি পৌঁছতে পৌঁছতে সুলতানের ইন্তেকাল হয়ে গেছে-তিনি রওনা করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টির পানে, তাঁর করুণার আশ্রয়ে এবং তাঁর পরম প্রতিদানের উদ্দেশ্যে। আমাকে বলা হয়েছে যে শায়েখ জা'ফর যখন এই আয়াতে পৌঁছলেন
[ لا اله الا هو عليه توكلت]
তখনি সুলতান মুচকি হাসেন, তাঁর চেহারা আনন্দোদ্ভাসিত হয়, নিজেকে তিনি সঁপে দিলেন আপন প্রতিপালকের সমীপে। এ ছিল এমন কঠিন এক দিন, খোলাফায়ে রাশেদাকে হারানোর পর ইসলাম ও মুসলমান আর কখনো এমন দিনের সম্মুখীন হয়নি। দূর্গ-প্রাসাদ থেকে থেকে শুরু করে সারা দেশে; বরং সমগ্র পৃথিবীতে এমন বিষন্নতা ছেয়ে গেল, মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আল্লাহর কসম, আমি কিছু মানুষকে দেখেছি, তারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে সুলতানের 'মৃত্যু-মুক্তি' কামনা করছে।
ইতোপূর্বে আমি এ-ধরণের কথা শুধু 'কথার কথা' হিসাবেই শুনে এসেছি, কিন্তু সেদিন আমার নিজের ক্ষেত্রে এবং অন্যদের ক্ষেত্রে বুঝতে পেরেছিলাম যে, সত্যিই যদি 'মুক্তিপণ' গ্রহণের সুযোগ থাকত তাহলে সুলতানের জন্য যে কেউ প্রাণ উৎসর্গ করত। সুলতানপুত্র মালিক আফযাল উত্তর দিকের বৈঠকখানায় সান্ত্বনার জন্য বসলেন। দূর্গের ফটক শুধু আমির-ওমারা ও বিশিষ্টজনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হল। এ ছিল এক ভয়াবহ দিন। প্রত্যেককে তার দুঃখ-কষ্ট, কান্না ও হা-হোতাশ অন্যের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা থেকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। কোনো কবির কবিতা আবৃতি অথবা কোন বক্তা ও বিশিষ্টজনের জন্য কথা বলা থেকে মজলিসকে (সেদিন) সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। সুলতানের সন্তানসন্ততি একটু সান্ত্বনার তালাশে সবার কাছে ছুটে যাচ্ছিল। তাদের এই করুণ দৃশ্য দেখে বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। যোহরের পর পর্যন্ত এই অবস্থাই অবস্থা অব্যাহত থাকল। এরপর সুলতানের গোসল ও কাফনের কাজ শুরু হল। তাঁর কাফনের ইন্তেযামের ক্ষেত্রে এক আনা মূল্যের বস্তুও করয ছাড়া ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না; এমনকি মাটিভেজা ঘাসের মূল্যটুকুও। ফকীও দাউলায়ি সুলতানকে গোসল করালেন। গোসলদানে শরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে গেলাম, কিন্তু সে দৃশ্য বরদাশত করার মতো শক্তি আমার হল না। যোহর নামাযের পর তোয়ালে পেঁচানো একটি কফিনে সুলতানের জানাযা বের করে আনা হল। এই তোয়ালে এবং কাফনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাপড় এনেছিলেন কাযি ফাযেল। কীভাবে ব্যবস্থা করেছিলেন তিনিই জানেন। সুলতানের খাটিয়া দেখে চিৎকার শুরু হয়ে গেল, কান্নার রোল পড়ে গেল, যা মানুষকে জানাযার নামায থেকে বিরত রাখল। (পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর) লোকেরা দলে দলে তার জানাযা পড়ল।
প্রথমবার যিনি ইমামতি করেছিলান তিনি হলেন কাযি মুহিউদ্দিন ইবনে যাকি। এরপর তাঁকে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসা হল। এখানেই তিনি অসুস্থতার দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। বাগানের পশ্চিম পাশে 'ছায়াঘেরা' একটি স্থানে তাকে দাফন করা হল। তাকে কবরে নামানো হল আসরের কাছাকাছি সময়ে। আল্লাহ তাঁর আত্নাকে পবিত্র করুন এবং তাঁর কবরকে নূর দ্বারা পরিপূর্ণ করুন। দিনের শেষভাগে সুলতানপুত্র মালিক যাফির মানুষকে সান্ত্বনা দিলেন এবং তাদের হৃদয়কে শান'ত করার চেষ্টা করলেন। সুলতানের শোক মানুষকে লুটপাট ও বিশৃঙ্খলা থেকে বিরত রেখেছিল। প্রতিটি হৃদয় ছিল ব্যথিত। প্রতিটি চক্ষু ছিল অশ্রুসিক্ত। আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেছেন শুধু তারা ব্যতিক্রম ছিল। এরপর মানুষ নিজনিজ ঘরে ফিরে গেল বীভৎসতম ফিরে যাওয়া। সে রাতে আমরা (কয়েকজন) ছাড়া আর কেউ প্রাসাদে ফিরে এল না। প্রাসাদে এসে আমরা কুরআন পড়লাম এবং বেদনার অবস্থাকে নবায়ন করলাম।
মালিক আফযাল পুরোটা সময় সেদিন থাকলেন তার চাচা ও ভাইদেরকে এই ঘটনার দুঃসংবাদ জানিয়ে পত্র লেখার কাজে। দ্বিতীয় দিন (প্রজাদের) সান্ত্বনার উদ্দেশ্যে সাধারণ বৈঠক করলেন এবং ফকীহ ও আলীমদের জন্য দূর্গের ফটক উন্মুক্ত রাখলেন। আলোচকরা আলোচনা করছিলেন। তবে কোন কবিই কবিতা আবৃত্তি করেনি। যোহরের সময় মজলিশ ভাঙল। সকাল-সন্ধ্যা মানুষের আগমন, কুরআন তিলাওয়াত এবং সুলতানের মাগফিরাত কামনা অব্যাহত থাকল। সুলতান আফযাল শাসনকার্য পরিচালনা এবং ভাই ও চাচাদের কাছে চিঠি পাঠানোর কাজে আত্ননিয়োজিত থাকলেন।
তাই কবির ভাসায়
ثم انقضت تلك السنون و اهلها
فكأنها وكأنهم أحلام.
পূর্বে প্রকাশের পর...
পর্ব -২
কাযি সাহেব এটাই ভাল মনে করলেন যে, আমরা ফিরে যাই আর কালাসার ইমাম- শায়খ আবূ জা'ফরকে রাতে দূর্গে অবস্থান করার জন্য ডেকে আনা হোক। কেননা, ইমাম সাহেব খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। আল্লাহ না করুন, রাতে সুলতান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে তিনি নারীদেরক সরিয়ে (মুমূর্ষু সুলতানকে) কালিমায়ে শাহাদাত তালকিন ও আল্লাহর যিকির করাতে পারবেন। তিনি তাই করলেন। আমরা দূর্গ থেকে নেমে এলাম। আমরা প্রত্যেকইই কামনা করছিলাম, যদি সুলতানের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা যেত। সে রাতটি সুলতান মৃত্যুপথের যাত্রীর ন্যায় কাটালেন। শায়েখ জা'ফর তার কাছে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন এবং তাঁকে আল্লাহর যিকিরের তালকিন করছিলেন। নবম রাত থেকেই তিনি অচেতন ছিলেন। মাঝেমধ্যে চৈতন্য ফিরে পেতেন। শায়েখ জা'ফর বলেছেন, (তিলাওয়াত করতে করতে) যখন তিনি
هوا الله الذي لا اله الا هو، عالم الغيب والشهادة
পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন তখন মুমূর্ষু সুলতান বলে উঠলেন, 'সহীহ'। এটা ছিল প্রয়োজনের মূহুর্তে চৈতন্য এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সুলতানের বিরাট সাহায্য। সুতরাং সকল প্রশংসা আল্লাহর। বুধবার বাদ ফজর ২৭ সফর ৫৮৯ হিজরী সুলতান ইন্তেকাল করলেন। ফজরোদয়ের পরই ইন্তিকালের মূহুর্তে কাযি ফাযেল ছুটে এসেছেন। আমি পৌঁছতে পৌঁছতে সুলতানের ইন্তেকাল হয়ে গেছে-তিনি রওনা করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টির পানে, তাঁর করুণার আশ্রয়ে এবং তাঁর পরম প্রতিদানের উদ্দেশ্যে। আমাকে বলা হয়েছে যে শায়েখ জা'ফর যখন এই আয়াতে পৌঁছলেন
[ لا اله الا هو عليه توكلت]
তখনি সুলতান মুচকি হাসেন, তাঁর চেহারা আনন্দোদ্ভাসিত হয়, নিজেকে তিনি সঁপে দিলেন আপন প্রতিপালকের সমীপে। এ ছিল এমন কঠিন এক দিন, খোলাফায়ে রাশেদাকে হারানোর পর ইসলাম ও মুসলমান আর কখনো এমন দিনের সম্মুখীন হয়নি। দূর্গ-প্রাসাদ থেকে থেকে শুরু করে সারা দেশে; বরং সমগ্র পৃথিবীতে এমন বিষন্নতা ছেয়ে গেল, মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আল্লাহর কসম, আমি কিছু মানুষকে দেখেছি, তারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে সুলতানের 'মৃত্যু-মুক্তি' কামনা করছে।
ইতোপূর্বে আমি এ-ধরণের কথা শুধু 'কথার কথা' হিসাবেই শুনে এসেছি, কিন্তু সেদিন আমার নিজের ক্ষেত্রে এবং অন্যদের ক্ষেত্রে বুঝতে পেরেছিলাম যে, সত্যিই যদি 'মুক্তিপণ' গ্রহণের সুযোগ থাকত তাহলে সুলতানের জন্য যে কেউ প্রাণ উৎসর্গ করত। সুলতানপুত্র মালিক আফযাল উত্তর দিকের বৈঠকখানায় সান্ত্বনার জন্য বসলেন। দূর্গের ফটক শুধু আমির-ওমারা ও বিশিষ্টজনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হল। এ ছিল এক ভয়াবহ দিন। প্রত্যেককে তার দুঃখ-কষ্ট, কান্না ও হা-হোতাশ অন্যের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা থেকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। কোনো কবির কবিতা আবৃতি অথবা কোন বক্তা ও বিশিষ্টজনের জন্য কথা বলা থেকে মজলিসকে (সেদিন) সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। সুলতানের সন্তানসন্ততি একটু সান্ত্বনার তালাশে সবার কাছে ছুটে যাচ্ছিল। তাদের এই করুণ দৃশ্য দেখে বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। যোহরের পর পর্যন্ত এই অবস্থাই অবস্থা অব্যাহত থাকল। এরপর সুলতানের গোসল ও কাফনের কাজ শুরু হল। তাঁর কাফনের ইন্তেযামের ক্ষেত্রে এক আনা মূল্যের বস্তুও করয ছাড়া ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না; এমনকি মাটিভেজা ঘাসের মূল্যটুকুও। ফকীও দাউলায়ি সুলতানকে গোসল করালেন। গোসলদানে শরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে গেলাম, কিন্তু সে দৃশ্য বরদাশত করার মতো শক্তি আমার হল না। যোহর নামাযের পর তোয়ালে পেঁচানো একটি কফিনে সুলতানের জানাযা বের করে আনা হল। এই তোয়ালে এবং কাফনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাপড় এনেছিলেন কাযি ফাযেল। কীভাবে ব্যবস্থা করেছিলেন তিনিই জানেন। সুলতানের খাটিয়া দেখে চিৎকার শুরু হয়ে গেল, কান্নার রোল পড়ে গেল, যা মানুষকে জানাযার নামায থেকে বিরত রাখল। (পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর) লোকেরা দলে দলে তার জানাযা পড়ল।
প্রথমবার যিনি ইমামতি করেছিলান তিনি হলেন কাযি মুহিউদ্দিন ইবনে যাকি। এরপর তাঁকে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসা হল। এখানেই তিনি অসুস্থতার দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। বাগানের পশ্চিম পাশে 'ছায়াঘেরা' একটি স্থানে তাকে দাফন করা হল। তাকে কবরে নামানো হল আসরের কাছাকাছি সময়ে। আল্লাহ তাঁর আত্নাকে পবিত্র করুন এবং তাঁর কবরকে নূর দ্বারা পরিপূর্ণ করুন। দিনের শেষভাগে সুলতানপুত্র মালিক যাফির মানুষকে সান্ত্বনা দিলেন এবং তাদের হৃদয়কে শান'ত করার চেষ্টা করলেন। সুলতানের শোক মানুষকে লুটপাট ও বিশৃঙ্খলা থেকে বিরত রেখেছিল। প্রতিটি হৃদয় ছিল ব্যথিত। প্রতিটি চক্ষু ছিল অশ্রুসিক্ত। আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেছেন শুধু তারা ব্যতিক্রম ছিল। এরপর মানুষ নিজনিজ ঘরে ফিরে গেল বীভৎসতম ফিরে যাওয়া। সে রাতে আমরা (কয়েকজন) ছাড়া আর কেউ প্রাসাদে ফিরে এল না। প্রাসাদে এসে আমরা কুরআন পড়লাম এবং বেদনার অবস্থাকে নবায়ন করলাম।
মালিক আফযাল পুরোটা সময় সেদিন থাকলেন তার চাচা ও ভাইদেরকে এই ঘটনার দুঃসংবাদ জানিয়ে পত্র লেখার কাজে। দ্বিতীয় দিন (প্রজাদের) সান্ত্বনার উদ্দেশ্যে সাধারণ বৈঠক করলেন এবং ফকীহ ও আলীমদের জন্য দূর্গের ফটক উন্মুক্ত রাখলেন। আলোচকরা আলোচনা করছিলেন। তবে কোন কবিই কবিতা আবৃত্তি করেনি। যোহরের সময় মজলিশ ভাঙল। সকাল-সন্ধ্যা মানুষের আগমন, কুরআন তিলাওয়াত এবং সুলতানের মাগফিরাত কামনা অব্যাহত থাকল। সুলতান আফযাল শাসনকার্য পরিচালনা এবং ভাই ও চাচাদের কাছে চিঠি পাঠানোর কাজে আত্ননিয়োজিত থাকলেন।
তাই কবির ভাসায়
ثم انقضت تلك السنون و اهلها
فكأنها وكأنهم أحلام.
Comment