Announcement

Collapse
No announcement yet.

LIFE OF BIN LADEN (may Allah accept him)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • LIFE OF BIN LADEN (may Allah accept him)


    উসামা রহিমাহুল্লাহ এর জীবনের ওপর কিছু লেখা একটি ওয়েবসাইট এ পেলাম। আমি এটা পড়লাম এবং আমার মনে হলো সবার এ যমানার মহাপুরুষ এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় শাইখের জীবনী সবার জানা প্রয়োজন। তাই এই লেখাগুলো শেয়ার করলাম।
    LIFE OF BIN LADEN–বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক –বিন লাদেন –জীবনের কিছু স্মৃতি পর্ব ১-৭

    LIFE OF BIN LADEN–বিশ্ব মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেপথ্য নায়ক –বিন লাদেন –জীবনের কিছু স্মৃতি।

    আমার সকল বন্ধুদের দোয়া নিয়ে শুরু করলাম। আপনারা বেশী বেশী শেয়ার-কপি-পেষ্ট করে ছড়িয়ে দিন সকলের কাছে। আল্লাহ্ আমাদের কবুল করুন। আমিন
    পূর্বকথা——–
    উসামা বিন মুহাম্মাদ বিন লাদেন। একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, মহান সংস্কারক। উম্মাহর দুর্দিনের দরদী নেতা। তাঁর ব্যক্তিত্ব দুনিয়া বিমুখতার প্রতীক। লক্ষ কোটি মুসলমানের ভালোবাসার স্বর্ণমুকুট তাঁর মাথায়। মজবুত এক অদৃশ্য বন্ধনে তিনি জুড়ে আছেন প্রতিটি মুমিন হৃদয়ের সাথে। তাঁর ভালোবাসা একদিন অজ পাড়াগাঁ’য়ের মানুষকেও রাস্তায় বের করে এনেছিল। উসামার পক্ষে সে দিন তাদের বজ্রকণ্ঠ বেজে উঠেছিল। বড়দের সেই ভালোবাসা সেদিন আমাদের ছোটদের হৃদয়ও স্পর্শ করেছিল। সেই দৃশ্য এখনও আমার চোখে ভাসে। সেই কণ্ঠ এখনও আমার কানে বাজে।
    কিন্তু কালের কৌশলী অবিচার বহু মানুষের হৃদয়ের লালিত সেই ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে, মিডিয়ার অপপ্রচার বহু সংশয়ের জন্ম দিয়েছে তাদের মনে; ওসামার আঁচল যার দূষণ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।
    ওসামার প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আমাদের এক ভাই। (হাফিযাহুল্লাহ) দীর্ঘ এক যুগ তার কেটেছে জেলখানায়। আফগানিস্তানে যখন আমেরিকার আগ্রাসন শুরু হয় তখন তিনি জেলে। বিন লাদেন তখন মিডিয়ার সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। আমাদের দেশের বিখ্যাত একটি জাতীয় দৈনিকে শায়খকে নিয়ে এক মার্কিন গবেষকের প্রকাশিত লেখার অনুবাদ ও বিভিন্ন বিদেশী সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য ছাপা হয় ধারাবাহিকভাবে। এতে উঠে এসেছে শায়খের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক, যা কাফেরদের দৃষ্টিতে খারাপ হলেও একজন প্রকৃত মুমিনের গুণ। যেগুলো থেকে নিরপেক্ষ পাঠকের কাছে এটাই স্পষ্ট হবে যে, এমন মহৎ গুণাবলীর অধিকারী একজন মানুষ কখনই ‘সন্ত্রাসী’ হতে পারেন না। নিশ্চিত এটা দুশমনদের অপবাদ ও অপকৌশল মাত্র। আর এখানেই আমাদের শ্রমের স্বার্থকতা। লেখাগুলো তিনি পত্রিকার পাতা থেকে কেটে রাখেন। জেল থেকে বের হওয়ার সময় সেগুলো নিয়ে আসতে ভুলে যাননি। পরে তা পরম যন্তে রেখে দিয়েছেন। ঐ লেখাগুলো নিয়েই আমাদের এই আয়োজন, সেই অবিচার ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সামান্য প্রয়াস।
    লেখক শত্রুপক্ষের হলেও অনেক বাস্তব বিষয় তিনি এড়িয়ে যাননি। (তবে তার দেয়া আইএসআই সংক্রান্ত কিছু তথ্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক) যাতে রয়েছে ভালোবাসার খোরাক, পত্র-পত্রিকার উড়াল খবরে আস্থাশীলদের সংশয়ের নিরসন। সাহস ও আত্মবিশ্বাসের গল্প। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেয়ার প্রেরণা। আরো রয়েছে …
    লেখকের শব্দের বুলেটগুলো নিষ্ক্রিয় করার জন্য ইসলামী পরিভাষার ব্যবহার ছাড়া তেমন কোন পরিবর্তন আমরা করিনি। এসব পরিবর্তনের আরো একটি কারণ হলো, যেন এগুলোর সাথে আমাদের পরিচিতি ঘটে; এগুলোর ভীতি বিদূরীত হয়। পৃথিবীর ইতিহাস আসলে যুদ্ধ-বিগ্রহেরই ইতিহাস। নদীর এ কূল ভেঙ্গে ও কূল গড়ার মত এক জাতি ও সভ্যতার জয় ও অপরটির পরাজয়ের চিত্রই তাতে দেখা যায়। নিজেকে একজন শান্তিকামী ভাবা, যুদ্ধ-জিহাদ থেকে নিজেকে পৃথক মনে করার অর্থ হলো, নিজের আত্মরক্ষা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কে উদাসীন হওয়া, পৃথিবীর মূল স্রোত থেকেই নিজেকে সরিয়ে রাখা।
    যে চেতনা বিন লাদেনকে রাজপ্রাসাদ থেকে পাহাড়ের গুহায় এনেছিল মুসলিম উম্মাহ সেই চেতনায় উজ্জিবীত হবে, ইসলামী খেলাফতের পতাকা উড্ডীন হবে সেদিন বেশি দূরে নয়। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করেন। তিনিই একমাত্র সাহায্যকারী ও তাওফিকদাতা।
    মেহেরবান আল্লাহ শায়খের মর্যাদা আরো অনেক বাড়িয়ে দিন। আমীন।
    অনুবাদকের কথা
    আফগানিস্তানে আজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে পরাশক্তি আমেরিকা। ক্ষেপণাস্ত্র আর বোমার মুহুর্মুহু আঘাতে কেঁপে উঠছে আফগনিস্তানের মাটি। ধ্বংস হচ্ছে নগর, গ্রাম, জনপদ। অকাতরে মরছে নিরীহ মানুষ। দেশটি পরিণত হয়েছে এক বিশাল রক্তাক্ত প্রান্তরে। আমেরিকার এই হামলার লক্ষ্য বাহ্যত একটাই বিশ্ব জিহাদের প্রাণপুরুষ ওসামা বিন লাদেনকে বন্দী কিংবা হত্যা করা। কিন্তু বিন লাদেন যেন প্রহেলিকা তাঁকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আফগানিস্তানের কোন নিভৃত গুহায় বসে জিহাদ আন্দোলনের জাল বুনে চলেছেন লাদেন কেউ জানে না। এক সৌদি ধনকুবেরের পুত্র কিভাবে বিশ্ব জিহাদের নেতৃত্বে আসলেন? আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ জেসন বার্ক এখানে বিন লাদেনের সেই বিস্ময়কর উত্থানের বিবরণ দিয়েছেন।
    বিন লাদেনের বিস্ময়কর উত্থানের নেপথ্যে
    রাতের আঁধারে ঢাকা একটি গ্রাম। সে গ্রামের আনাচে কানাচে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে রক্ষীরা। কালাসনিকভ ও রকেট লাঞ্চার হাতে সদাপ্রস্তুত । সে গ্রামের মাটি, ইট ও কাঠের তৈরি একটি বাড়ির ভিতর ধূলিময় মেঝেতে চাদর বিছিয়ে বসে আহার করলেন দু’জন লোক। ভাত, ঝলসানো মাংস আর নিরামিষ। মাথার অনেক ওপরে অন্ধকার রাতের আকাশ চিরে ছুটে চলা আমেরিকার যুদ্ধ বিমানগুলোর গর্জন শোনা যাচ্ছিল। লোক দু’টোর উভয়ের বয়স মধ্য চল্লিশের কোঠায়। শ্মশ্রুমন্ডিত। পরনে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী ঢিলেঢালা পোশাক লম্বা জামা ও সালোয়ার। খাওয়া সেরে তারা হাত মুখ ধুলেন। নামাজ পড়লেন। তারপর বসলেন আলোচনায়। এদের একজন বিশ্বের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান’ বলে পরিচিত ওসামা বিন লাদেন এবং অন্যজন তালেবান সরকারের প্রধান মোল্লা ওমর। তাঁদের আলোচনা করার মতো অনেক কিছুই ছিলো। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে জিহাদী হামলার প্রতিশোধস্বরূপ কিছুদিন আগে ৩০ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ন’টায় মার্কিন ও ব্রিটিশ ক্রুজ মিসাইল আফগানিস্তানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে শুরু করে। ফলে আফগানিস্তানজুড়ে শহর-নগর-গ্রাম-সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এসেছে। বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর যে গ্রামে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন তার অনতিদূরে বেশ কয়েকটি ক্ষেপনাস্ত্র এসে পড়েছিল।
    আরও কয়েকটি আঘাত হেনেছিলো তালেবানদের আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক ঘাঁটি দক্ষিণাঞ্চলীয় নগরী কান্দাহারে। তারা দু’জন সেখানে মিলিত হয়েছিলেন একটা সিদ্ধান্তের জন্য। হঠাৎ করেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে এখন তাদের করণীয় কী হবে তা নির্ধারণ করাই ছিল বৈঠকের উদ্দেশ্য। উপসাগরীয় অঞ্চলের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে ব্রিটেনের ‘দ্য অবজার্ভার’ পত্রিকার প্রতিনিধি জানতে পারেন যে বৈঠক বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। না হবার অংশত কারণ ছিল নিরাপত্তার ভাবনা। একটা টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিখুঁত নিশানায় নিক্ষিপ্ত হলে পেন্টাগনের মূল টার্গেট এই দুই ব্যক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারত। বৈঠকে প্রায় সকল- বিষয়েই এ দু’জনের ঐকমত্য হয়েছিল। বৈঠক তাড়াতাড়ি শেষ হবার এটাও ছিল অংশত কারণ। মোল্লা ওমর তাঁর সৌদি বংশোদ্ভুত বন্ধুর প্রতি সমর্থন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। বিন লাদেনের জবাবও ছিল অনুরূপ।
    কৌশলগত প্রশ্নে তাঁরা দু’জনে দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। ঠিক হলো যে, তাঁরা যৌথভাবে যে কোন আগ্রাসন প্রতিহত করবেন। তারা তাদের বিরুদ্ধে গঠিত কোয়ালিশনে বিভেদ সৃষ্টির জন্য কাজ করবেন এবং সেই বিভেদের সদ্ব্যবহার করবেন এবং তারা বোমা হামলার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জোয়ার সৃষ্টির জন্য মানবিক সঙ্কটকে, বিশেষ করে নিরীহ অসামরিক জনগোষ্ঠীর হতাহতের ঘটনাগুলো কাজে লাগাবেন। বৈঠক শেষে তারা পরস্পর কোলাকুলি করে যে যার পথে প্রস্থান করেন। তারপর থেকে তাদের মধ্যে আর বৈঠক হয়নি বলে ধারণা করা হয়। যে মানুষটিকে জীবিত ধরার অথবা হত্যা করার জন্য আজ আমেরিকা তার প্রায় গোটা সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই ওসামা বিন লাদেনের জীবনচিত্র পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৩০ সালে ইয়েমেনের দারিদ্র্যপীড়িত প্রদেশ হাদ্রামাউতে। সেখানে একজন ডক শ্রমিককে চোখে পড়বে। ছ’ফুট লম্বা, বলিষ্ঠ গড়ন তবে এক চোখ অন্ধ এই মানুষটি একদিন অনেক ভেবে ঠিক করলেন যে, বন্দরে বন্দরে জাহাজে মাল বোঝাইয়ের কাজ ছাড়াও জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে।

    যেই ভাবা সেই কাজ। লোকটি একটা ব্যাগে কিছু কাপড় চোপড় ও টুকিটাকি জিনিস নিয়ে উটের কাফেলায় করে রওনা দিলেন সদ্য গঠিত রাষ্ট্র সৌদি আরবের উদ্দেশে। এভাবে ভাগ্যান্বেষণে শুরু হলো তার সহস্র মাইলের পথপরিক্রমা। এই মানুষটিই ওসামা বিন লাদেনের বাবা মোহাম্মাদ বিন লাদেন। মোহাম্মাদ বিন লাদেন সৌদি আরবের মাটিতে পৌঁছে প্রথম যে কাজটি পেলেন সেটা আরব আমেরিকান তেল কোম্পানি আরামকোর ‘রাজমিস্ত্রি’র কাজ। দিনে মজুরি পেতেন এক রিয়াল, যার তখনকার মূল্য ছিল ১০ পেন্সের সমান। জীবন যাপনে অত্যন্ত মিতব্যয়ী ছিলেন তিনি। কঠোর কৃচ্ছ্রের মধ্য দিয়ে সঞ্চয় করতেন। সেই সঞ্চয় সার্থকভাবে বিনিয়োগ করতেন। এভাবেই এক সময় তিনি ব্যবসায় নেমে পড়েন। ১৯৫০ এর দশকের প্রথম দিকে মোহাম্মদ লাদেনকে রিয়াদে সৌদি রাজপরিবারের প্রাসাদ নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করা হয়। স্থানীয় ফার্মগুলোকে সুকৌশলে ঘায়েল করে তিনি এই নির্মাণ ঠিকাদারী লাভ করেছিলেন। ওটা ছিল এক ধরনের জুয়াখেলার মতো, যেখানে তার জিত হয়েছিলো। মদীনা জেদ্দা মহাসড়ক নির্মাণের চুক্তি থেকে এক বিদেশী ঠিকাদার সরে গেলে মোহাম্মদ লাদেনের জন্য এক বিরাট সুযোগ এসে ধরা দেয়। এই সুযোগ তার বড় ধরনের সাফল্যের সোপান রচনা করে। তিনি ঐ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি একজন ধনী ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান এবং একজন ব্যতিক্রম ধরনের ধনী। তিনি লিখতে বা পড়তে পারতেন না এবং সারা জীবন টিপসই দিয়ে কাজ করেছেন। তবে তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ছিল । ষাটের দশকে তার সঙ্গে কাজ করেছেন এমন একজন ফরাসী ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে এ তথ্যটি জানা যায়। শ্রমিক থেকে ধনী হলেও মোহাম্মদ লাদেন তার শিকড় কোথায় তা কখনই ভুলে যাননি। গরিবদের দেয়ার জন্য তিনি সর্বদাই এক তোড়া নোট বাড়িতে রেখে যেতেন। এ ধরনের দান খয়রাত ইসলামের শিক্ষা। মোহাম্মদ লাদেন ছিলেন অতি ধর্মপ্রাণ মুসলমান। সুন্নী ইসলামের কঠোর ও রক্ষণশীল ওয়াহাবী ভাবধারায় লালিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি গর্ব করে বলতেন যে, নিজের হেলিকপ্টার কাজে লাগিয়ে তিনি একদিনে ইসলামের তিন পবিত্রতম স্থানে যথা মক্কা, মদীনা এবং জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন। মক্কা ও মদীনায় যাওয়া তার জন্য নিশ্চয়ই বিশেষ পরিতৃপ্তির কারণ ছিলো। কারণ হজ পালন ও রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কা ও মদীনায় আগত লোকদের জন্য বিভিন্ন স্থাপনার সংস্কার ও সম্প্রাসারণ কাজের মধ্য দিয়ে তার কোম্পানির সুনাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্টতার মধ্য দিয়ে তার ব্যক্তিগত স্ট্যাটাস নিশ্চিত হয় এবং সেই সঙ্গে তিনি অমিত ধনসম্পদের অধিকরী হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে তিনি এতই ধনী ছিলেন যে, দুঃসময়ে সৌদি রাজ পরিবারকে অর্থ সাহায্য দিয়ে তিনি তাদের সঙ্কট ত্রাণে সহয়তা করতেন। তথাপি যে জীর্ণ, পুরানো ব্যাগটি নিয়ে তিনি একদিন ইয়েমেন থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন সেটি তার প্রাসাদোপম বাড়িতে প্রদর্শনীর জন্য রক্ষিত ছিল।
    শোনা যায়, বড়লোকরা যেভাবে গাড়ি বদলায়, পুরনোটি বাদ দিয়ে নতুনটি কিনে আনে, মোহাম্মাদ লাদেনও সেভাবে বউ বদলাতেন। তার তিন সৌদি স্ত্রী ছিল এবং তারা মোটামুটিভাবে ছিলো স্থায়ী। তবে চতুর্থ স্ত্রীটি নিয়মিত বদলানো হতো। ধনকুবেরের লোকেরা মধ্যপ্রাচ্যের তল্লাট ঘুরে তার পছন্দের কনে যোগাড় করে আনত। কারও কারও বয়স ছিলো পনেরো বছর। তাদের আপদামস্তক বোরখায় ঢাকা থাকত। তবে সবাই ছিল অনিন্দ্যসুন্দরী।
    ছেলেবেলা
    বিন লাদেনের মায়ের নাম হামিদা। তিনি সৌদিয়ানও নন, ওয়াহাবীও নন। তিনি এক সিরীয় বণিকের কন্যা। অসামান্য সুন্দরী হামিদা ছিলেন অত্যন্ত সরলপ্রকৃতির। বিদুষীও ছিলেন তিনি। ২২ বছর বয়সে মোহাম্মদ লাদেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ লাদেনের দশম বা একাদশ স্ত্রী। তার মানে এই নয় যে, এক সঙ্গে দশ বারোটা বউ রাখতেন মোহাম্মদ লাদেন। তিনি অনেক স্ত্রীকেই তালাক দিয়েছিলেন। তবে তালাক দিলেও জেদ্দা বা হেজাজে তাঁদের জন্য বাসস্থান ও খোরপোষের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই দশম বা একাদশ স্ত্রী হামিদার গর্ভে মোহাম্মদ লাদেনের সপ্তম পুত্র ওসামা বিন লাদেনের জন্ম ১৯৫৭ সালে। পিতার বিপুল বিত্ত ও বৈভবের পরিবেশে বিন লাদেন বড় হয়ে উঠতে থাকেন।
    ওসামা ১১ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। বাবার সান্নিধ্য কখনই খুব বেশি একটা লাভ করেননি তিনি। ১৯৯৮ সালে বিন লাদেনের এক ঘনিষ্ঠ সূত্রের মাধ্যমে আমেরিকার এবিসি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক লাদেন পরিবারের ওপর একটি দলিল হস্তগত করে। তা থেকে লাদেনের ছেলেবেলার অনেক কথা জানা গেছে। তাঁর বাবা ছিলেন অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপরায়ণ। নিজের সব সন্তানকে তিনি এক জায়গায় রাখতে চাইতেন। তাঁর শৃঙ্খলা ছিল অত্যন্ত কঠিন। সন্তানদের সবাইকে কঠোরভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে হত। একই সঙ্গে আমোদ প্রমোদও পছন্দ করতেন তিনি। সন্তানদের নিয়ে তিনি সমুদ্র ভ্রমণে যেতেন। মরুভূমি পাড়ি দিতে যেতেন।
    ছেলে মেয়েদের তিনি বড়দের মতো জ্ঞান করে সেভাবেই তাদের সঙ্গে আচরণ করতেন। তিনি চাইতেন কচি বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা আত্ম বিশ্বাসের পরিচয় দিক। কৈশোরে বিন লাদেনকে জেদ্দায় ‘আল আগ’ নামে এক স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিলো। পাশ্চাত্য স্টাইলের এক অভিজাত সৌদি স্কুল। ১৯৬৮-৬৯ সালে বিন লাদেন যখন এ স্কুলে পড়তেন তখন সেখানে ব্রায়ান কাইফিল্ড শাইলার (৬৯) নামে একজন ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন। তিনি সে সময় লাদেনসহ ত্রিশজন বিত্তবান পরিবারের ছেলেকে সপ্তাহে চারদিন এক ঘণ্টা করে ইংরেজী পড়াতেন। ব্রায়ান শাইলার বিন লাদেনকে ভদ্র ও বিনয়ী হিসাবে উল্লেখ করে বলেছেন, ছেলেটা বেশ লাজুক ছিল। নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করত। শাইলারের ভাষায়ঃ ‘ক্লাসের যে কোন ছেলের চেয়ে ঢের বেশি বিনয়ী ও ভদ্র ছিল বিন লাদেন। শারীরিক দিক দিয়েও সে ছিল অসাধারণ। অধিকাংশ ছেলের চেয়ে সে ছিল লম্বা, সুদর্শন ও উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের অধিকারী। শুধু ভদ্র ও বিনয়ী নয়, তাঁর ভিতরে প্রবল আত্মবিশ্বাসও ছিলো। কাজকর্মে অতি সুচারু, নিখুঁত ও বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলা। নিজেকে মোটেই প্রকাশ করতে চাইত না সে। বেশিরভাগ ছেলে নিজেদের বড় বুদ্ধিমান বলে ভাব দেখাত। বিন লাদেন তাদের মতো ছিল না। কোন প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে সে নিজ থেকে বলত না। তাকে জিজ্ঞেস করা হলেই শুধু বলত।’
    বিন লাদেন যে একজন কঠোর ধর্মানুরাগী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন কৈশোরের প্রথমদিকে তেমন কোন লক্ষণ ধরা পড়েনি। ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ লাদেনের পরিবার সদলবলে সুইডেনের তাম্র খনিসমৃদ্ধ ছোট শহর ফালুনে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। সে সময় একটা ক্যাডিলাক গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো হাল্কা সবুজ টপ ও নীল রঙের ফ্লেয়ার পরা হাস্যোজ্জ্বল ওসামার একটা ছবি তোলা আছে। ওসামা সে সময় কখনও নিজেকে “স্যামি” বলে উল্লেখ করতেন। ওসামার বয়স তখন ১৪ বছর। এর এক বছর আগে ওসামা ও তাঁর অগ্রজ সালেম প্রথমবারের মতো ফালুনে গিয়েছিলেন। সৌদি আরব থেকে বিমানযোগে কোপেনহেগেনে আনা একটা রোলস্রয়েস গাড়ি চালিয়ে তাঁরা ফালুনে গিয়ে পৌঁছেন। আশ্চর্যের কথা হলো, তাঁরা এস্টোরিয়া নামে একটা সস্তা হোটেলে ছিলেন। হোটেলের মালিক ক্রিস্টিনা আকের ব্রাদ নামে এক মহিলা সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে জানিয়েছেন যে, ওরা দিনের বেলা বাইরে কাজকর্ম করে বেড়াত আর সন্ধার পর নিজেদের রুমে খাওয়া দাওয়া করে কাটাত। মহিলা বলেন, ‘আমার মনে আছে ওদের কথা। সুন্দর দুটো ছেলে। ফালুনের মেয়েরা ওদের খুব পছন্দ করত। ওসামা আমার দুই ছোট ছেলের সঙ্গে খেলত।’
    হোটেলের মালিক সেই মহিলা ছেলে দুটোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে তাদের যে সম্পদের পরিচয় পেয়েছিলেন সে কথাও স্মরণ করেছেন তিনি। বলেছেনঃ ‘উইকএন্ডগুলোতে আমরা দেখতাম ওরা ওদের রুমে একটা বাড়তি বিছানায় কাপড় চোপড় বিছিয়ে রাখত। সেলোফিনে প্যাকেট করে রাখা অসংখ্য সাদা সিল্কের শার্ট ছিলো ওদের। মনে হয় প্রতিদিন নতুন একটা শার্ট গায়ে চড়াত। ময়লা কাপড়গুলো কখনও দেখিনি, ওগুলো কি করত কে জানে। বড় একটা ব্যাগ ভর্তি অলঙ্কারও ছিলো তাদের। হীরা, চুনি, পান্নার আংটি ছিল। টাইপিনও ছিল।’ লাদেন ভ্রাতারা ঐ বছর গ্রীষ্মের ছুটি কটাতে লন্ডনেও গিয়েছিলেন। ওখানে টেমস নদীতে তাঁরা নৌকা ভ্রমণও করেছিলেন। এ সময়ের তোলা বিন লাদেন ও তাঁর ভ্রাতাদের ছবিও কারও কারও কাছে পাওয়া গেছে।
    উত্তরাধিকার সূত্রে বিন লাদেন কি পরিমাণ ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন নিশ্চিতভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না। অনেক সময় বলা হয়, বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি। ২৫ কোটি ডলার কি তারও বেশি। কিন্তু প্রকৃত অর্থের পরিমাণ হয়ত তার চেয়ে অনেক কম। অর্থের জন্য কখনও লালায়িত ছিলেন না তরুণ লাদেন। বস্তুত পক্ষে তাঁর পিতা যেভাবে অমিত ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন সেই বিষয়গুলো বিন লাদেনকে পীড়িত করতে শুরু করেছিল। সত্তরের দশকের প্রথমভাগে মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল এক সাংস্কৃতিক রুপান্তর ঘটে গিয়েছিলো। তেল রাজস্ব, ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ এবং সর্বোপরি পাশ্চাত্যের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান যোগাযোগ এই ঘটনাগুলো আগের স্থিরকৃত বিষয়গুলোকে নতুন করে পর্যালোচনা করতে বাধ্য করে। নতুন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে এ প্রশ্ন তুলে ধরে। মোহাম্মদ বিন লাদেনের অসংখ্য ছেলেমেয়ের অধিকাংশই সে প্রশ্নের জবাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বারা অধিকতর প্রভাবিত হওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়ে। পরিবারের বড়রা মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার ভিক্টোরিয়া কলেজ, হর্ভার্ড, লন্ডন কিংবা মায়ামিতে পড়তে চলে যায়। কিন্তু বিন লাদেন যাননি। সে সময় এ অঞ্চলের আরও হাজার হাজার তরুণের মতো ওসামা বিন লাদেন কঠোর ইসলামী ভাবাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন।

    র*্যডিকেল ভাবধারার পথে
    ১৯৭৪ সালে জেদ্দায় হাই স্কুলে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ওসামা বিন লাদেন ঠিক করলেন যে, উচ্চ শিক্ষার জন্য অন্য ভাইদের মত তিনি বিদেশে পাড়ি জমাবেন না, দেশেই থাকবেন। তার ভাই সেলিম তখন পরিবারের প্রধান। তিনি ইংল্যান্ডের মিলফিল্ডে সমারসেটের এক বোডিং স্কুলে থেকে লেখাপড়া করেছিলেন। আরেক ভাই ইসলাম প্রথমে সুইডেনে ও পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। ওসামা কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি অনুষদে ভর্তি হন। গুজব আছে যে, ১৭ বছর বয়সে ওসামা তার মায়ের এক সিরীয় আত্মীয়কে বিয়ে করেছিলেন এবং তিনিই নাকি তার প্রথম স্ত্রী। অবশ্য এটা আজ পর্যন্ত কোন মহল থেকেই সমর্থিত হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর লাদেনের ব্যবসায় সম্রাজ্য পরিচালনা করছিলেন বড় ভাই সেলিম। তিনি আশা করেছিলেন যে, ওসামা পারিবারিক ব্যবসায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসামার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিন লাদেনের পছন্দ ছিল ইসলামী শিক্ষা। পরবর্তীকালে তিনি এই দুটি বিষয়কে আশ্চর্য উপায়ে সমন্বিত করেছিলেন।
    বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী জর্দানী শিক্ষাবিদ ও অনলবর্ষী বক্তা আব্দুল্লাহ আযযামের টেপ রেকর্ডকৃত বক্তব্য শোনেন। এগুলো তার ওপর সুগভীর প্রভাব ফেলে। আযযামের বাণীবদ্য উপদেশাবলী অনেকটাই ছিল আজকের ওসামার ভিডিও টেপের মতো। আযযামের সেই সব বক্তব্য শুধু ওসামাকেই নয়; তার মতো আরো অনেক বিক্ষুব্ধ তরুণ মুসলমানের মনকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল।
    জেদ্দা তো বটেই বিশেষ করে সেখানকার বাদশাহ আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামী চিন্তাধারার প্রাণকেন্দ্র। জেদ্দার মসজিদ ও মাদরাসাগুলোতে বিরুদ্ধবাদীরা র*্যডিকেল ভাবধারা প্রচার করত। বলত যে, একমাত্র রক্ষণশীল ইসলামী মূল্যবোধের সর্বাত্মক পূনর্প্রতিষ্ঠাই মুসলিম বিশ্বকে পাশ্চাত্যের বিপদ ও অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে। বিন লাদেনের এক ভাই আব্দুল আজিজ এসময়ের কথা স্মরণকরে বলেছেন যে, ওসামা তখন সর্বক্ষণ বই পড়তেন আর নামায কালাম নিয়ে থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় ক্রিয়া কলাপে, বিশ্লেষণকরে ধর্ম বিষয়ক বিতর্ক ও কুরআন শিক্ষার পর্যালোচনায় তিনি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। ওসামা এসময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তোলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো সৌদি রাজ পরিবারের তরুণ সদস্য ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার ভাবী প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের সংঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা।
    তবে এসময়ের ঘটনা প্রবাহ তার মনে গভীর রেখাপাত করে। যেমন ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ইরান প্রত্যাবর্তন, পরাক্রান্ত শাহকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এ ঘটনায় মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র যুগপৎ উত্তেজনা ও আতঙ্কের স্রোত বয়ে যায়। সে বছরের নভেম্বর মাসে শিয়া চরমপন্থীরা মক্কার কাবা শরীফের মসজিদুল হারাম দখল করে নেয়। ওসামা বিন লাদেন তখন বয়সে তরুণ। সহজে প্রভাবিত হবার মতো মন তখন তার। তিনি উত্তরোত্তর গোঁড়া মুসলমান হয়ে উঠছিলেন বটে, তবে কোন্ পথ বেছে নেবেন সে ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত হয়ে উঠতে পারছিলেন না। কাবা শরীফে উগ্রপন্থী হামলা ও মসজিদ দখলের ঘটনায় তিনি রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রচুর রক্ত পাতের পর শিয়া চরমপন্থীদের পারাস্ত করা হয়েছিলো। তবে এই উগ্রপন্থী বিদ্রোহীরা তাকে অনুপ্রাণিত করে। এদেরকে তার ন্যায় ও সত্যের পথ অনুসরণকারী খাঁটি মুসলমান বলে মনে হয়। অচিরেই ওসামা বিন লাদেন এদের পদাঙ্ক অনুসরণের সুযোগ পেয়ে যান। ঐ বছরের শেষ দিকে সোভিয়েত ট্যাংক বহর আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে এক নতুন পরিস্থিতির জন্ম দেয়। সোভিয়েত হামলার বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় আফগান জনগনের জিহাদ এবং সেই জিহাদে অংশ নিতে ওসামা বিন লাদেন এক পর্যায়ে সুদূর সৌদি আরব থেকে পাড়ি জমান আফগানিস্তানে।
    রণাঙ্গনে
    পেশোয়ার থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকলেই দেখা যাবে একটা ছোট্র গ্রাম। নাম জাজি। ১৯৮৬ সালে এই গ্রামে সোভিয়েত গ্যারিসনের ওপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায় আফগান মুজাহিদ বাহিনী। একদিন সকালে এই বাহিনীর এক সিনিয়র কমান্ডার সোভিয়েত সৈন্যদের মুহুর্মুহু মর্টার হামলার মুখে একটি বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মর্টারের গোলায় একের পর এক বিষ্ফোরণে মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এমনি সময় কোথা থেকে সেই বাঙ্কারে ডাইভ মেরে প্রবেশ করেন দীর্ঘদেহী একে আরব। তিনি আর কেউ নন ওসামা বিন লাদেন। লাদেন নিজে তখন সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। তাঁর ‘স্থলযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। আশির দশকের মাঝামাঝি আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধ জোরদার হয়ে ওঠে। পেশোয়ারের ডর্মিটরিগুলো হাজার হাজার মুসলমান তরুণে ছেয়ে যায়। সবাই যে একই উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল তা নয়। কেউ এসেছিলো এ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। কেউ সহকর্মী বা বন্ধুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতার টানে। কেউ বা আইনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায়। তবে বেশিরভাগই এসেছিলো ইসলামের পক্ষে ধর্মীয় যুদ্ধ তথা জেহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য। এখানে আরও একটা কথা বলে নেয়া ভালো যে, সে সময় আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধ তীব্রতর হয়ে ওঠার আংশিক কারণ ছিল প্রতিরোধ সংগ্রামে আমেরিকার আর্থিক সাহায্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া। ১৯৮৬ সালের গোটা গ্রীষ্মকাল বিন লাদেন জাজি গ্রামটির আশপাশের লড়াইয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। একবার তিনি প্রায় ৫০ জন আরব যোদ্ধার একটি বাহিনী নিয়ে সোভিয়েত হেলিকপ্টার ও পদাতিক বাহিনীর টানা আক্রমণ প্রতিহত করেন। মিয়া মোহাম্মদ আগা নামে তখনকার এক সিনিয়র আফগান কমান্ডার বর্তমানে তালেবান বাহিনীতে রয়েছেন, তিনি সে সময় বিন লাদেনের যুদ্ধ তৎপরতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তার বিবরণ দিয়েছেন। পরবর্তী তিন বছর বিন লাদেন আরও কঠিন লড়াই চালিয়ে যান। এতে অনেক সময় তাঁর নিজেরও জীবন বিপন্ন হয়েছিলো।
    সুদানে নির্বাসন
    কয়েক মাস আগে ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েতে আক্রমণ করেন। ওসামা বিন লাদেন সে সময় তাঁর জন্মস্থান জেদ্দা শহরে বসবাস করছিলেন। ইরাকী হামলা শুরু হবার পরপরই তিনি সৌদি রাজপরিবারের কাছে একটা বার্তা পাঠান। তাতে তিনি সাদ্দামকে পরাজিত করার জন্য আফগান যুদ্ধাভিজ্ঞ ত্রিশ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সৈনিকের একটি বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। বার্তায় লাদেন বলেন, যারা রুশ বহিনীকে হারিয়ে দিয়েছে তারা সহজেই সাদ্দাম হোসেনকেও হারাতে পারবে। এমন একটা বাহিনী গঠিত হলে তিনি যে সে বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন তা আর বলার অপেক্ষা ছিল না।
    কিন্তু প্রস্তাবটা দিয়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেয়েছিলেন বিন লাদেন। বড়ই নির্মম, বড়ই হৃদয়হীনভাবে। সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আল সৌদ পরিবার ধর্মানুরাগী ইসলামপন্থীদের কোনো বাহিনী চাননি। একেবারে কিছুতেই না। রাজ পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা লাদেনকে সাক্ষাত দিয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রস্তাবটা সটান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তারা। প্রিন্স আব্দুল্লাহর সঙ্গে তার সাক্ষাতকারটি ছিলো সেগুলোরই একটি। কিন্তু তার চেয়েও আরও খারাব কিছু অপেক্ষা করছিলো বিন লাদেনের জন্য। ইসলামের সূতীকাগার সৌদি আরব তথা পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদীনাকে রক্ষা করার জন্য যেখানে তিনি একটা ইসলামী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন। সেখানে দেখতে পেলেন এই দায়িত্বটাই তুলে দেয়া হয়েছে আমেরিকানদের হাতে। রাগে অপমানে ফুঁসতে লাগলেন বিন লাদেন। তাঁর দেশে তিন লাখ মার্কিন সৈন্য এসে পৌঁছল। তারা ঘাঁটি নির্মাণ শুরু করে দিল। মদ্যপান ও সানবাথিং করতে লাগল। এসব দেখে যাওয়া ছাড়া বিন লাদেনের আর কিছুই করার রইল না। তিনি এই সৈন্যদের উপস্থিতিকে বিদেশীদের আগ্রাসন বলে গণ্য করতে লাগলেন। বিন লাদেন একেবারে চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি গোটা উপসাগরের আলেম সমাজ ও জিহাদপন্থী মুসলমানদের মধ্যে প্রচার কাজ চালাতে শুরু করলেন। ইতোমধ্যে তিনি একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। সেই পরিচিতিকে পুঁজি করে তিনি সৌদি আরবের সর্বত্র বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। মসজিদগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার অডিও টেপ প্রচার করতে লাগলেন। বিন লাদেনের তৎপরতা এখানেই সীমাবদ্ধ রইল না। তিনি তার সেনাবাহিনীর লোক রিক্রুট করার কাজ শুরু করলেন। ট্রেনিং লাভের জন্য প্রায় চার হাজার রিক্রুটকে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সৌদি শাসকগোষ্ঠী অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। একদিন হানা দেয়া হলো লাদেনের বাড়িতে। গৃহবন্দী করা হল তাকে। উদ্বিগ্ন হলো বিন লাদেনের পরিবার। ওসামার কার্যকলাপের ফলে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ভেবে ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হলো। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। পরিশেষে তাঁরা বিন লাদেনকে সত্যিকার অর্থে ত্যাজ্য করতে বাধ্য হলো। লাদেনের উপর চাপ আরও বৃদ্ধি পেল।
    ১৯৯০ সালের শেষ দিকে লাদেনের জন্য একটা পালনের পথ দেখা দিল। বিন লাদেন সুদানের স্বনামধন্য ইসলামী তাত্বিক ও পন্ডিত হাসান আল তুরাবির কাছ থেকে আশ্রয়ের প্রস্তাব পেলেন। এই কিংবদন্তি পুরুষ তখন ছিলেন কার্যত সুদানের প্রকৃত শাসক। তুরাবি বিশ্বাস করতেন যে, সাদ্দাম হোসেনকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে এবং ধর্মনিরপেক্ষ আরব সরকারগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করতে পারলে মুসলিম বিশ্বজুড়ে একটা ‘বিশুদ্ধ’ ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়া যাবে। যাই হোক বিন লাদেনকে দেয়া তুরাবির প্রস্তাবটি সত্যই প্রলুব্ধকর ছিলো। সৌদি সরকারও লাদেনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার এমন একটা সুযোগ পেয়ে নিজেদের কপালকে ধন্যবাদ দিলো। তারা বিন লাদেনের ওপর চাপের মাত্রাটা আরও বাড়াল, যাতে তিনি সৌদি আরব ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। চাপের মুখে বিন লাদেন এক সময় ভাগলেন। তিনি সৌদি আরব থেকে সুদানের রাজধানী খার্তুমে পালিয়ে গেলেন। সেই যে গেলেন আর তিনি স্বদেশে ফিরতে পারলেন না।
    ওসামা বিন লাদেন খার্তুমের অভিজাত শহরতলীতে চার স্ত্রী, সন্তানসন্ততি এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন নিয়ে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলেন। তারপর এক বৃহত্তর সংগঠনের ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য আফগানিস্তান থেকে বিমানে করে যুদ্ধাভিজ্ঞ বেশ কয়েক শ’ আরব স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে এলেন। সুদানে জীবনযাত্রায় বৈচিত্র ছিল। ফুটবল ম্যাচ হতো। নীল নদে সাঁতার প্রতিযোগিতা হতো। অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বার জন্য শিয়া-সুন্নী ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন কি না এ নিয়ে কমনরুম টাইপের বিতর্ক হতো। বিতর্ক হতো ইসলামী মতবাদের বিভিন্ন দিক নিয়ে। সুদানে বিন লাদেন নিজের নামে ব্যক্তিগত ব্যাংক এ্যাকাউন্টও খুললেন। তখন লাদেনের বেশিরভাগ সময় বিশ্বব্যাপী জিহাদের আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার চাইতে বরং অর্থোপার্জনের কাজেই ব্যয় হচ্ছিল।
    ওসামা বিন লাদেনের সহায় সম্পদ নিয়ে কল্পনার শেষ নেই। লন্ডনে নিযুক্ত সৌদি আরবের প্রবীণ রাষ্ট্রদূত গাজী আল গোসাইবি সম্প্রতি বলেছেন: আমি এমন খবরও পাঠ করেছি যে, লাদেন ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলার সরাসরি লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কথাটা মোটেই ঠিক নয়। সৌদি আরব ছেড়ে চলে যাবার সময় তিনি ঐ পরিমাণ অর্থ সঙ্গে নেননি। অন্যদিকে সৌদি কর্তৃপক্ষও সর্বদা শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিল। যাতে সৌদি আরব থেকে লাদেন কানাকড়িও না নিয়ে যেতে পারেন।
    খার্তুমে বিভিন্ন সংগঠনের অফিস ছিল। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অফিসটি ছিল লাদেনের আল কায়েদা সংগঠনের। তাঁর সংগঠনটি অন্য যে কোনো সংস্থার মতোই পরিচালিত হত। সংগঠনের বোর্ড অব ডিরেক্টর বা পরিচালকমন্ডলী ছিল। বেশ কয়েকটি উপকমিটি ছিল। এসব কমিটি আর উপকমিটির অনবরত বৈঠক লেগেই থাকত। তার সংগঠন একটি ব্যবসায় কোম্পানি চালাত। যার নাম ছিল লাদেন ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া চালাত বৈদেশিক মুদ্রার ডিলারশিপ। চালাত একটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং একটি কৃষিপণ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিন লাদেন রাজধানী খার্তুম থেকে পোর্ট সুদান পর্যন্ত সাতশ’ মাইল দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। তারই বিনিময়ে সুদান সরকার তাকে তিলের বীজ রপ্তানীর একক অধিকার প্রদান করে। সুদান হল বিশ্বের সর্বাধিক তিল উৎপাদনকারী তিনটি দেশের অন্যতম একটি দেশ। সুতরাং বলাই বাহুল্য সুদান থেকে তিল রপ্তানীর ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক ছিল। এই ব্যবসা থেকে বেশ ভালো মুনাফা করেছিলেন বিন লাদেন। তবে তার অন্যান্য ব্যবসা অতটা সফল হতে পারেনি।
    আজারবাইজান থেকে বাইসাইকেল আমদানির একটা উদ্যোগ সম্পূর্ণ মার খেয়েছিল। আরও কিছু হঠকারী স্কিমও নেয়া হয়েছিল। সেগুলো আধাআধি বাস্তবায়িত হবার পর চোরাবালির মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু তারপরও আল কায়েদার মূল ব্যবসা কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ বিন লাদেনের হাতে ছিল। তবে সমস্ত ক্রিয়াকলাপের পিছনে মূল যে উদ্দেশ্য সেটা কখনও বিন লাদেনের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়নি। জর্ডানের জিহাদপন্থী ইসলামীদের নগদ এক লাখ ডলারেরও বেশি দেয়া হয়েছিল। চেচনিয়ায় ইসলামী জিহাদীদের গোপনে নিয়ে আসার জন্য বাকুতে অর্থ পাঠিয়ে দেয়া হয়। আরও এক লাখ ডলার পাঠানো হয় ইরিত্রিয়ার ইসলামী সংগঠনের জন্য।
    এক পর্যায়ে বিন লাদেন আড়াই লাখ ডলার দিয়ে একটা প্লেন কেনেন। এবং এক পাইলটকে ভাড়া করেন। ক’দিন পরই বিমানটি দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। তিনি সুদানে বেশ কয়েকটি সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেন। শত শত আলজেরীয়, ফিলিস্তিনী, মিসরীয় ও সৌদি নাগরিক এসব শিবিরে বোমা তৈরির কৌশলসহ নানা ধরনের জিহাদী কলাকৌশল শিক্ষা লাভ করে। এদের অনেকে আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এসব ইসলামী মুজাহিদের মধ্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারককে হত্যার কথাবার্তা ওঠে। কিন্তু সেই হত্যা পরিকল্পনা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত ছিল না। নাইরোবিতে মার্কিন দূতাবাসসহ পূর্ব আফ্রিকায় বোমা হামলার সম্ভাব্য টার্গেটগুলোর ওপর কিছু এলোমেলো গুপ্তচরগিরিও চালানো হয়েছিল।
    ১৯৯৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে সুদান তার বিশেষ অতিথি বিন লাদেনকে নিয়ে উত্তরোত্তর অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। হাসান আল তুরাবি তখন আফগানিস্তানে নিযুক্ত সুদানী রাষ্ট্রদূত আতিয়া বাদাবির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাদাবি পেশোয়ারে থাকতেন। রুশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় তিনি পশতু ভাষা শিখেছিলেন। আফগান মুজাহিদদের অনেকের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এবং কারোর কারোর সঙ্গে চমৎকার যোগাযোগও ছিল। আফগানিস্তান তখন বিবাদমান সেনা কমান্ডারদের নিয়ন্ত্রণাধীন শত শত এলাকায় খন্ড বিখন্ড ছিল। আতিয়া বাদাবি এমন এক পটভূমিতে জালালাবাদের সবচেয়ে সিনিয়র তিনজন কমান্ডারকে সহজেই একথা বুঝাতে পেরেছিলেন যে একজন ধনবান সৌদিকে তারা যদি নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারে তাহলে তাদের অনেক লাভ হবে। বিশেষ করে প্রতিপক্ষের ওপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে তিন কমান্ডার এরপর সুদানে গিয়ে সরাসরি বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করে তাকে আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এই তিনজন কমান্ডারের কেউই আজ জীবিত নেই।
    ১৯৯৬-৯৮ মুজাহিদ বাহিনী গঠন
    কাবুলে শরতের এক সন্ধা। উত্তরাঞ্চলীয় শহরতলী ওয়াজির আকবর খানের উঁচু দালানঘেরা এক বাড়ির বাইরে ডজনখানেক জাপানী পিক আপ ট্রাক দাঁড়ানো। ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রক্ষী ও ড্রাইভাররা রুশ বাহিনী চলে যাওয়ার পর থেকে সাত বছরে বড় ধরনের কোন লড়াই এখানে না হলেও প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে এবং সেগুলোর সামনে স্তূপ করে রাখা বালির বস্তার গায়ে গুলির বা বোমার টুকরার আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে ১৯৯৬ সালের অক্টবর মাস তখন। ওসামা বিন লাদেন তালেবান নেতাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কাবুলে এসেছেন। নগরীতে ওটাই ছিল তার প্রথম আগমন এবং একমাস আগে ক্ষমতা দখলকারী কট্টর ইসলামী মিলিশিয়া বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে ওটাই ছিল তার প্রথম সাক্ষাত। সে বছরের মে মাসের বিশষভাবে ভাড়া করা এক পরিবহন বিমানে করে ৩৯ বছর বয়স্ক বিন লাদেন তার চার স্ত্রীর মধ্যে তিন স্ত্রী, আধ ডজন ছেলে মেয়ে ও তার অনুসারী শ খানেক আরব যোদ্ধা জালালাবাদ বিমান বন্দরে এসে পৌঁছান। কিন্তু যে তিনজন মুজাহিদ কমান্ডার সুদান থেকে তাকে আফগানিস্তানে চলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন তারা এ কয়েক মাসের মধ্যে উৎখাত হয়ে যান এবং এ অবস্থায় বিন লাদেনের আফগানিস্তানের নতুন সরকারের অনুগ্রহভাজন হবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এক মাস আগে বিন লাদেন তার এক লিবীয় সহযোগীকে কান্দাহারে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের কাছে পাঠিয়েছিলেন। মোল্লা ওমর তখন তালেবান উপনেতা ও কাবুলের মেয়র মোল্লা মোহাম্মদ রব্বানীকে বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাত করার নির্দেশ দেন এবং তিনি সত্যি কতটা বন্ধুভাবাপন্ন তা যাচাই করে দেখতে বলেন। সে অনুযায়ী তাদের মধ্যে এক বৈঠক হয় এবং ঐ বৈঠক উপলক্ষেই কাবুলে এসেছিলেন বিন লাদেন। বৈঠকে দু’পক্ষই ছিলেন সতর্ক অথচ বন্ধুভাবাপন্ন। লাদেনই প্রথম কথা বলেন। নিজেদের মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ভুলে গিয়ে তিনি মিলিশিয়াদের লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য এবং অর্জিত সাফল্যের প্রশংসা করেন এবং নিঃশর্তভাবে নৈতিক ও আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। রব্বানী খুবই খুশি ও তুষ্ট হন। তিনি বিন লাদেনকে সরকারের তরফ থেকে নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। বৈঠক থেকে সবাই হাসি মুখে বেরিয়ে আসে। লাদেন ও তালেবানদের মধ্যে এই মৈত্রী নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এটা ছিল বিন লাদেনের বিকাশের চূড়ান্ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা। তালেবানদের নিরাপত্তা আদায় করতে সক্ষম হয়ে তিনি এবার বিশ্বের এযাবতকালের সবচেয়ে দক্ষ একটি জিহাদী সংগঠন গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের অংশ নিয়ে বিন লাদেন অতি প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাসই কেবল অর্জন করেননি, গোটা ইসলামী বিশ্বে যোগাযোগের এক ব্যাপক বিস্তৃত নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছিলেন। তদুপরি খ্যাতি, শ্রদ্ধা ও প্রশংসার স্বাদও পেয়েছিলেন তিনি। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা লাদেনের পরিচিতি ও কর্তৃত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। সুদানে তিনি গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য স্থানের অনৈসলামীক সরকারগুলোকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত মুসলিম জিহাদীদের ছত্রছায়া সংগঠন আল কায়েদা গঠনের কাজে গুরুত্বের সাথে হাত দিতে সক্ষম হন।
    তবে সামরিক শক্তি-সামর্থ্য ও রণকৌশলগত চিন্তাধারার দিক দিয়ে বিন লাদেনের এই সংগঠনটি তখনও যথেষ্ট দুর্বল ছিল। আফগানিস্তানে এসে তিনি এ সমস্যার দ্রুত একটা সমাধান খুঁজে পান। তিনি এমন একটি দেশে ফিরে আসেন যেখানে ছয় বছর ধরে নৈরাজ্য চলছিল। হাজার হাজার জিহাদপন্থী মুসলিম দেশের পূর্বাঞ্চলে মুজাহিদদের পুরনো কমপ্লেক্সগুলোতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। এদের অনেককে পৃষ্ঠপোষকতা করতো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যারা এই ধর্মানুরাগী যুদ্ধাদেরকে কাশ্মীরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করতে চাইতো। অন্যরা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতো সমগ্র বিশ্বের নানা মত ও পথের ইসলমী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে।
    এসব জিহাদীদের শিবিরে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হতো। এই স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকে তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। আফগানিস্তানে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিন লাদেনের প্রথম সমস্যাটির আংশিক সমাধান হয়ে যায়। তিনি একটা তৈরি সেনাবাহিনী পেয়ে যান।
    আফগানিস্তানে বিন লাদেনকে সাহায্য করার জন্য তাঁর চার পাশে অসংখ্য লোক এসে জড়ো হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো ছিল কয়েক ডজন প্রবাসী মিসরীয় কট্টোর ধর্মানুরাগী মুসলিম। এদের মধ্যে ছিলেন ৩৭ বছর বয়স্ক শল্য চিকিৎসক ও মিসরের আল-জিহাদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ডা. আইমান আল জাওয়াহিরি। আরেকজন ছিলেন ঐ গ্রুপেরই লৌহমানব ও সুযোগ্য সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ আতেফ। আল জাওয়াহিরি বিন লাদেনকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধের রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে শিখিয়েছিলেন। আর মোহাম্মদ আতেফ তাকে সামরিক ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো একান্ত প্রয়োজন সে গুলোর গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন। বেশ কিছু নিরাপত্তাগত ঝুঁকি দেখা দেয়ার পর বিন লাদেন তার আবাসস্থল জালালাবাদের দক্ষিণে পাহাড়ি অঞ্চলের তোরাবোরা নামক একটি স্থানে এক প্রাক্তন মুজাহিদ ঘাঁটিতে সরিয়ে নেন।
    মহানুভবতা
    প্রথম প্রথম নিজেকে একটু আড়ালে-অন্তরালে রাখতেন ওসামা বিন লাদেন। কখনই পাদপ্রদীপের আলোয় আসতেন না তিনি। পাকিস্তানী সাংবাদিকদের মনে আছে, আশির দশকের প্রথম দিকে তারা একজন সৌদি শেখ সম্পর্কে অনেক রকম কাহিনী শুনেছিলেন। এই শেখ পেশোওয়ার শহরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে আহত যোদ্ধাদের দেখতে আসতেন । তাদেরকে কাজুবাদাম, চকোলেট উপহার দিতেন। তাঁদের নাম ঠিকানা টুকে নিতেন। ক’দিন পরই মোটা অঙ্কের একটা চেক পৌঁছে যেত তাদের পরিবারের হাতে। এধরনের মহানুভবতা সম্ভবত বাবার কাছে শিখেছিলেন ওসামা বিন লাদেন। কারণ, বাবাকে মাঝে মাঝে গরিবদের মধ্যে থোকা থোকা নোট বিলাতে দেখতেন তিনি। যারা লাদেনের জন্য লড়েছেন কিংবা লাদেনের পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছেন তাঁদের প্রায় সবাইকে বিন লাদেনের এই মহানুভবতার কথা উল্লেখ করতে শোনা গেছে। কেউ কেউ জানিয়েছেন যে বিয়ের জন্য দেড় হাজার ডলার দান পেয়েছেন বিন লাদেনের কাছ থেকে। আবার কেউ বলেছেন জুতা বা ঘড়ি কেনার জন্য বিন লাদেনের কাছ থেকে নগদ অর্থ সাহায্য পেয়েছেন। তাঁর অনুসারীরা বলেন, বাইআ’ত বা শপথ উচ্চারণের যে কাজ এধরনের দান-সাহায্য বা উপহারও সেই একই কাজ করেছে। তাঁদের আমীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। বিন লাদেনের সময় ছিল তাঁর অর্থের মতোই মূল্যবান। তা সত্ত্বেও যে কাউকে যে কোন রকম সাহায্য করতে তিনি কখনই বিমুখ হতেন না। একজন আফগান মুজাহিদ স্মরণ করেছেন কিভাবে বিন লাদেনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। সেই মুজাহিদ একবার আরবী শিখতে চাইলেন। বিন লাদেন সে সময় ব্যস্ত ছিলেন। তথাপি এই সৌদি যুবক তাঁকে কুরআনের ভাষা- আরবী ভাষা শিখানোর কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিলেন। বিন লাদেন একজন র*্যডিক্যাল বা কট্টোর ধর্মানুরাগী হিসেবে সুপরিচিত। তথাপি আচার-ব্যবহারে তিনি বরাবরই শান্ত, নম্র ও মিতভাষী। যেমনটি তিনি ছেলেবেলায় ছিলেন; বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর শিক্ষকরা।
    ১৯৮৪ সালে বিন লাদেন ও আযযাম পেশোয়ারের শহরতলিতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে নগরীতে আগমনরত হাজার হাজার আরব মুজাহিদের জন্য একটি সরবরাহ ঘাঁটি স্থাপন করেন। এবং সেটার নাম দেন বায়তুল আনসার বা বিশ্বাসীদের গৃহ। বিন লাদেন সেখানে আরব স্বেচ্ছসেবকদের গ্রহন করতেন। তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে দেখতেন। তার পর বিভিন্ন আফগান সংগঠনের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। বিন লাদেনের এসব কাজ-কর্ম “সিআইএ” পাকিস্থানের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএস আই” এবং সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা “ইশতেকবরাতের” জানা ছিল। কিন্তু এদের সকলেই এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে ছিল। তবে এদের কেউই বিন লাদেনকে আমেরিকান সাহায্য দেয়নি। কোনভাবেই না। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান শাহজাদা তুর্কী আল ফয়সাল হলেন বিন লাদেনের সহপাঠী ও বাল্যবন্ধু। সে সময় তিনি এ পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। “বায়তুল আনসার” কার্যালয়টি ছিল সৈয়দ জামালুদ্দীন আফগানী সড়কের পাশে। এলাকাটি শান্ত, নিস্তরঙ্গ। চারদিকে বোগেইন ভিলার গাছ এবং স্থানীয় অভিজাতদের বড় বড় বাড়ি। আশির দশকের মাঝামাঝি এলাকাটি আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন সংগঠন সেখানে অফিস খুলে বসেছিল। ওখান থেকে দু’টো খবরের কাগজ বের হতো যার একটির প্রকাশক ছিলেন আব্দুল্লাহ আযযাম ও বিন লাদেন। একটা নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ অফিসও ছিল ওখানে। অফিসটা ছিল বিন লাদেনের ভাড়া নেয়া একটা ভবন, যেখানে বসে মুজাহিদ সংগঠনের নেতারা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের তাদের মতপার্থক্য দূর করতে পারতেন। ওখানকার পরিবেশ ছিল ক্লেশকর। আরাম-আয়েশের কোন ব্যবস্থাই ছিলনা ওখানে। অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। বিন লাদেনসহ দশ-বারোজন স্বেচ্ছাসেবক মিলে একটা রুমে ঘুমাতেন। অফিস রুমের কঠিন মেঝেতে পাতলা তোশক বিছিয়ে শয্যা রচনা করা হতো। বিন লাদেন গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে বসে ইসলাম ও মধ্যপ্রচ্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতেন। তখন পর্যন্ত বিন লাদেনের মধ্য র*্যডিক্যাল ভাবাদার্শ গড়ে ওঠেনি। বরং তাঁর তখনকার চিন্তাধারার মধ্যে খানিকটা ইতিহাসের স্মৃতি এবং খানিকটা চলমান ঘটনার ভুল ও অসম্পূর্ণ তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণে মিশেল ছিল। বিন লাদেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরবদের সঙ্গে বৃটেনের বিশ্বাসঘাতকতায় বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সৌদি রাজপরিবারের উপরও তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এবং বলতেন যে ক্ষমতা করায়ত্ব করার জন্য তারা ওহাবীদেরকে কাজে লাগিয়েছে। বিন লাদেন স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ধর্মীয় বিতর্ক পরিচালনা করতেন। অনেক সময় বিতর্কের বিয়বস্তু হতো “সূরায়ে ইয়সিন”। ইসলামী ইতিহাসের বীর যোদ্ধাদের নিয়ে অনেক আলোচনা করতেন তিনি। সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর কথা বলতেন। বলতেন অন্য বীরদের কাহিনী। এভাবে যেন তিনি নিজেই নিজেকে বৃহত্তর কোন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন।
    ধর্মীয় অনুরাগ
    সুদানে নির্বাসিত জীবনযাপন শুরুর আগেই আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে বিন লাদেন অসমসাহসিকতার বেশ কিছু স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কট্টোরপন্থী সংগঠন হিজবে ইসলামীর এক নেতা জানান যে, তিনি নিজে দেখেছেন একবার সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা অবরুদ্ধ হবার পর প্রচন্ড গোলাবর্ষণের মুখে বিন লাদেন কিভাবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। বর্তমানে বিন লাদেনের ঘোরবিরোধী এমন অনেকেও যোদ্ধা হিসাবে তাঁর বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিবরণ দিয়েছেন। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি যে আদৌ ভাবতেন না সে কথা তাঁদের সবাই উল্লেখ করেছেন। এভাবে একজন ধর্মপ্রাণ যুবক ক্রমান্বয়ে একজন সাচ্চা জিহাদীতে পরিণত হন। বিন লাদেনের ধর্মীয় অনুরাগ তার লোকদেরকেও প্রভাবিত করেছিল। ওসামার নিজের বর্ণিত একটি ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ঘটনাটি ছিল ১৯৮৯ সালে পূর্বাঞ্চালীয় নগরী জালালাবাদ দখলের লড়াইয়ের সময়কার। ওসামার নিজের ভাষায়: “আমি তিনজন আফগান ও তিনজন আরবকে এনে একটা অবস্থান দখল করে রাখতে বললাম। তারা সারা দিন লড়াই চালাল। সন্ধ্যায় তাদের অব্যাহতি দেয়ার জন্য আমি ফিরে গেলে আরবরা কাঁদতে শুরু করে দিল। বলতে লাগল তারা শহীদ হতে চায়। আমি বললাম ওরা যদি এখানেই থেকে গিয়ে লড়াই চালিয়ে যায় তাহলে তাদের মনোবাঞ্ছনা পূরণ হতে পারে। পরদিন তারা সবাই শহীদ হল।” ওসামা পরে বলেন, তিনি তাদের বুঝিয়েছিলেন যে রণাঙ্গনের ট্রেঞ্চই হলো তাদের বেহেশতে যাবার পথ।
    সঙ্গী ও অনুসারীদের সাথে অনেক দিক দিয়ে নিজের কোন পার্থক্য রাখতেন না ওসামা বিন লাদেন। তিনি যে এত ধনী ছিলেন কিংবা একজন কমান্ডার ছিলেন অনেকেই তা জানত না। সবার সাথে বন্ধুর মতো একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করতেন ও ঘুমাতেন তিনি। কখনও কখনও আফগানদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ মেটানোর জন্য নিজ উদ্যোগে সমঝোতার চেষ্টা চালাতেন।
    আফগান প্রতিরোধযুদ্ধে মুজাহিদ যোগান দেয়ার যে দায়িত্ব তিনি নিজ উদ্যোগে গ্রহণ করেছিলেন তা অব্যাহত থাকে। সিআইএ সূত্রে হিসাব করে দেখা গেছে যে, জিহাদের জন্য আফগানিস্তানে বছরে তিনি ৫ কোটি ডলার সাহায্য নিয়ে এসেছিলেন।
    প্রত্যক্ষদর্শী এক যোদ্ধার কাছ থেকে জানা যায় জালালাবাদ দখলের লড়াই চলাকালে তিনি পথের পাশে ধূলি ধূসরিত বিন লাদেনকে মুজাহিদদের জন্য খাদ্য, কাপড়চোপড়, বুট জুতা প্রভৃতি সরবরাহের আয়োজন করতে দেখেছিলেন।
    কিন্তু তাঁর মতো ইসলামী চিন্তাধারার অনুসারী যিনি নন তাঁর সঙ্গে বিন লাদেনের কিছুতেই বনিবনা হতো না। সৈয়দ মোহাম্মদ নামে আরেক আফগান মুজাহিদ জানান, একবার এক যুদ্ধে বিন লাদেন তাঁর সঙ্গে কোন রকম সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ শুধু একটাই- তিনি দাড়ি-গোফ সম্পূর্ণ কামানো ছিলেন। আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় বিন লাদেন মিডিয়ার শক্তিটা টের পেতে শুরু করেছিলেন। আফগানযুদ্ধে তাঁর ভূমিকার বিভিন্ন কাহিনী পেশোয়ারস্থ আরব সাংবাদিকদের হাত হয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর অনুকূল প্রভাব পড়ে। বন্যার ঢলের মতো দলে দলে স্বেচ্ছাসেবক এসে জড়ো হতে থাকে তাঁর পিছনে। তাঁর প্রতি লোকে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। এমন মর্যাদা এর আগে আর কখনও লাভ করেননি বিন লাদেন।
    ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়। কাবুলে রেখে যায় এক পুতুল সরকার। আফগানিস্তানে এবার শুরু হয় নতুন লড়াই। সে লড়াই আফগানদের নিজেদের মধ্যে- মুজাহিদে মুজাহিদে লড়াই। এ অবস্থায় আরব আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের যুদ্ধে পোড়খাওয়া হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক সৈনিকের আফগানিস্তানের মাটিতে পড়ে থাকার আর কোন কারণ ঘটেনি। তাদের অনেকেই জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আফগানিস্তান থেকে নিজ নিজ দেশে পাড়ি জমায়। আফগানদের এই ভ্রাতৃঘাতী লড়াই থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিন লাদেনও পাড়ি জমান নিজ দেশে। সত্যি বলতে কি, তিনি এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লক্ষ্য করে অতিমাত্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। নিজে অতি সৎ, অতি বিশ্বস্ত মানুষ বিন লাদেন। আফগানদের আত্মকলহে লিপ্ত হতে দেখে তিনি অত্যন্ত পীড়িত বোধ করেছিলেন। তিনি এ সময় তাদের বলেছিলেন যে সোভিয়েতের মতো একটা পরাশক্তিকে তাঁরা লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য করেছেন শুধু একটি কারণে- তাঁরা নিজেরা ছিলেন ঐক্যবদ্ধ এবং তাঁদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়েছিল।
    একতাবদ্ধ না থাকলে এ বিজয় অর্জন তাঁদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। এত বড় বিজয়ের পর আফগানদের নিজেদের মধ্যে নতুন করে রক্তক্ষরণ দেখে হতাশার গ্লানি নিয়ে বিন লাদেন ফিরে যান স্বদেশ সৌদি আরবে। তখন তাঁর বয়স ৩৩ বছর। সময়টা ১৯৯০- এর শরৎ। সৌদি আরবের প্রকৃত শাসক প্রিন্স আবদুল্লাহ যুবক ওসামা বিন লাদেনের কাঁধে তাঁর নরম থলথলে হাতটা রাখলেন। মৃদু হাসলেন। বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের কথা বললেন। তাঁর কথাগুলো মধুর শোনাচ্ছিল। তাঁর মধ্যে আপোসের সুর ছিল। তবে সন্দেহ নেই সেসব কথার আড়ালে লুকিয়ে ছিল কঠিন কঠোর হুমকি।

    ওসামা বিন লাদেন আফগানযুদ্ধাভিজ্ঞ একজন আরব স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে রিয়াদে প্রিন্স আবদুল্লাহর সাথে তাঁর প্রাসাদে দেখা করতে এসেছিলেন। মনোরমভাবে সাজানো লাউঞ্জে আফগান ভেটারেনদের উদ্দেশ্যে প্রিন্স আবদুল্লাহ বললেন, “মোহাম্মদ বিন লাদেনের পরিবার বরাবরই আমাদের এই রাজ্যের বিশ্বস্ত প্রজা। প্রয়োজনের সময় এই পরিবার আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, কাউকে এমন কিছু করতে দেয়া হবে না যাতে আমাদের এই সুসম্পর্ক ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
    উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ প্রিন্স আবদুল্লাহর কথায় শ্রদ্ধাবনতভাবে মাথা নেড়েছিল। কিন্তু যার উদ্দেশে কথাগুলো উচ্চারিত হয় সেই বিন লাদেন তাঁর অবদমিত ক্রোধ ভিতরেই চেপে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস পাচ্ছিলেন। বস্তুতপক্ষে আবদুল্লাহর কথায় তিনি এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, সেটা তাঁর চোখমুখের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ হয়ে পড়ে। আবদুল্লাহর কথায় তিনি অত্যন্ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সেদিন।
    বিশ্বজিহাদ ফ্রন্ট

    মিসরীয় সহকর্মীদের কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছিলেন বিন লাদেন। তা হলো, আক্রমণই আত্মরক্ষার সর্বোত্তম কৌশল। তাদের এই পরামর্শ মতো তিনি কাজ করেছিলেন। তোরাবোরা ঘাঁটিতে দু’মাস কাটানোর পর বিন লাদেন বারো পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ লিখেন ও বিলি করেন। তাতে কুরআন ও ইতিহাস থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি ও প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছিল। এবং অঙ্গিকার করা হয়েছিল যে, আমেরিকানরা সৌদি আরব থেকে সরে না গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। নিবন্ধে প্রথমবারের মতো তিনি ফিলিস্তিন ও লেবাননের পক্ষে বক্তব্য রাখেন এবং মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ইহুদী খৃস্টানদের হিংসার অপপ্রচারের উল্লেখ করে বলেন, তাদের এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা প্রত্যেক মুসলমানের পবিত্র দায়িত্ব। এ ধরনের অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়ভাবে প্রসারিত হয়। এর পিছনে মিসরীয়দের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য।
    আফগান মুজাহিদদের সিআইএ বেশ কিছু স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছিল। বিন লাদেন তাদের কাছ থেকে চারটি স্ট্রিংগার কিনে নিয়ে সৌদি ইসলামী গ্রুপগুলোর কাছে গোপনে পাচার করেন। ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলে রিয়াদ অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়। পাকিস্তানের মতো সৌদি আরবও আফগানিস্তানে রাশিয়া ও ইরানের প্রভাব খর্ব করার জন্য তালেবানদের সাহায্য সমর্থন দিয়েছিল। এখন সেই তালেবানরাই সৌদিদের ঘোরতর এক শত্রুকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাকে সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের দাবি অগ্রাহ্য করেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে অনুভব করছে সৌদি আরব।
    ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে তালেবানরা বিন লাদেনকে হত্যার একটি সৌদি ষড়যন্ত্র উদঘাটন করে। আফগানিস্তানের তখন প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকা এই মুজাহিদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। হত্যা ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হবার পর তালেবানরা বিন লাদেনকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য কান্দাহারে চলে যেতে বলে। বিন লাদেন রাজি হন এবং কান্দাহার বিমানবন্দরের কাছাকাছি সোভিয়েত বিমানবাহিনীর একটি পুরনো ঘাঁটিতে চলে যান। ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণ সামরিক সাজসরঞ্জাম কেনার অর্থ যুগিয়ে, মসজিদ তৈরি করে এবং নেতৃবৃন্দকে গাড়ি কিনে দিয়ে বিন লাদেন তালেবান হাই কমান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করে তুলেছিলেন। তিনি কান্দাহার নগরীর উপকণ্ঠে মোল্লা ওমর ও তাঁর পরিবারের জন্য একটি নতুন বাসভবনও তৈরি করে দিয়েছিলেন।
    বিন লাদেন আফগানিস্তানের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো থেকে সেরা শিক্ষার্থীদের আল-কায়েদায় নিয়ে নেয়ার একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রশাসকরা স্বেচ্ছাসেবকদের বলত যে, তাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবেন তাঁদের ‘আমীরের’ সামনে হাজির করা হবে। আমীর বিন লাদেনের সামনে হাজির করার পর তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে চৌকশ ও প্রতিভাবান যুবকদের বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ শিবিরের জন্য বেছে নেয়া হতো। এই বিশেষ শিবিরে তাদের পদাতিক বাহিনীর মৌলিক কলাকৌশল শিখানো হতো না বরং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা নেয়া হতো। যুদ্ধের মহড়ার আয়োজন করা হতো এবং পরিশেষে আধুনিক জিহাদের দক্ষতা ও কৌশল শিখানো হতো। এক বছরের মধ্যে বিন লাদেন মুজাহিদদের একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলেন। ডা. আইমান আল জাওয়াহিরির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিন লাদেন এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যে উদ্দেশ্যের জন্য লড়ছেন সেটাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা দরকার। ১৯৯৭ সালের শেষদিকে তিনি ইসলামী সংগঠনগুলোকে আল কায়েদার ছত্রছায়ায় একতাবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন। তিনি সারা বিশ্বের মুসলিম নেতাদের একই উদ্দেশ্যের পিছনে টেনে আনার জন্য নিজের অর্থবিত্ত, খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবকিছুই কাজে লাগিয়েছিলেন। স্থানীয় পর্যায়ের ইসলামী আন্দোলনগুলোর প্রতি তিনি তাঁর সাহায্য-সমর্থন জোরদার করেন। মসজিদ নির্মাণের জন্য গ্রামের ইমাম আলেমদের হাতে টাকা দেন। তালেবান সূত্রে জানা যায় যে, দুবাই থেকে তিনি তিন হাজার সেকেন্ডহ্যান্ড টয়োটা করোলা গাড়ি আমদানির ব্যবস্থা করেন। জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা হিসাবে এই গাড়িগুলো যুদ্ধে শহীদ তালেবানদের পরিবারের হাতে দেয়া হয়।
    পরিশেষে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিন লাদেন ‘বিশ্বজিহাদ ফ্রন্ট’ এর নামে ইহুদী ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে এক ফতওয়া জারী করেন। বিন লাদেন, আল জাওয়াহিরি এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ইসলামী আন্দোলনের নেতারা ফতওয়ায় স্বাক্ষর দেন। এবং গোটা অঞ্চলের ডজনখানেক সংগঠন ফতওয়া অনুমোদন করে। পাশ্চাত্যের ইসলাম সম্পর্কিত এক বিশেষজ্ঞের মতে ফতওয়াটি ছিল অলঙ্কারপূর্ণ আরবী গদ্যের এক অপরূপ সুন্দর দৃষ্টান্ত। এমনকি ওটাকে অসাধারণ কাব্যিকও বলা যায়।
    অবশ্য এর বক্তব্য বিষয়টা মোটেও কাব্যিক ছিল না। কারণ ফতওয়ায় বলা হয়েছিল যে, আমেরিকান ও তাদের মিত্রদের- এমনকি তারা যদি অসামরিক ব্যক্তিও হয় তাহলেও তাদের হত্যা করা মুসলমানদের দায়িত্ব। এর অল্পদিন পরই এক সাক্ষাতকারে বিন লাদেন বলেন যে, খবু শীঘ্রই র*্যডিকেল কার্যক্রম শুরু হবে। সেটা শুরু হলো ১৯৯৮ সালের সাত আগস্ট। ঐ দিন সকাল এগারো’টায় মুহাম্মাদ রশিদ দাউদ আল-ওহালী নামে ২২ বছরের এক সৌদি যুবক নাইরোবি শহরতলীর এক হাসপাতালের নিচ তলায় পুরুষদের একটি টয়লেটে দাঁড়ানো ছিল। যুবকটির মুখে দাড়ি। শীর্ণ কাঁধ। এক সেট চাবি ছিল তার হাতে এবং তিনটি বুলেট। যুবকটির পরনে ছিল জিনসের প্যান্ট, একটা সাদা রঙের কারুকাজ করা শার্ট। পায়ে মোজা ও কালো জুতা। তাঁর পোশাকে রক্তের দাগ ছিল। হাতে যে চাবিগুলো ছিল সেগুলো একটি হালকা বাদামী রঙের টয়োটা পিকাপ ট্রাকের পিছনের দরজার চাবি। ৩৪ মিনিট আগে গাড়িটি এক প্রচ- বিস্ফোরণে উড়ে যায়। বিস্ফোরিত বোমাটি ঐ গাড়ির ভিতরেই রাখা ছিল। বিস্ফোরণে মার্কিন দূতাবাস, একটি অফিস ব্লক এবং একটি সেক্রেটারিয়ান কলেজ বিধ্বস্ত হয়। নিহত হয় ২১৩ জন। আহত হয় ৪৬০ জন। প্রায় একই সময় তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে দ্বিতীয় একটি বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ১১ জন।
    আল ওহালীর ট্রাকের ড্রাইভার ছিল আযযাম নামে আরেক সৌদি যুবক। বিস্ফোরণে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তারা দু’জন টয়োটা ট্রাকটি নিয়ে সবেগে দূতাবাসে ঢুকে পড়ার সময় শাহাদাতবরণের আরবী গান গাইছিল। যদিও সে সময় তাঁরা ভেবেছিল যে, দু’জন একত্রে মৃত্যু বরণ করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয় না। চালকের আসনে বসা আযযাম ড্যশবোর্ডর সঙ্গে টেপদিয়ে আটকানো ডেটোনেটরের বোতামে চাপ দেয়ার সাথে সাথে বিষ্ফোরণে তার শরীর ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আল ওহালি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরে তিনি এফবিআই কে জানান যে, ১৯৯৭ সালের প্রথম ভাগে আফগানিস্তানে ট্রেনিং নেয়ার সময় তাকে বেছেনিয়ে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। এরপর তাকে সে বছরের গ্রীষ্মে তালেবানদের পক্ষে লড়াই করার জন্য পাঠানো হয়। অতপর তাঁকে ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে আল কায়েদার ইন্সট্রাক্টরদের হাতে জিহাদের উপর বিশেষ ধরণের ট্রেনিং নিতে পাঠানো হয়। পরিশেষে এপ্রিল মাসে তাকে নাইরোবিতে মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার মিশনে নিয়োগ করা হয়। আযযাম ও একই পথ অনুসরণ করেছিল।
    আফ্রিকায় বোমা বাজির দুটো ঘটনার তেরো দিন পর ৭৫ টি মার্কিন ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলিয় পার্বত্য এলাকার ছয়টি প্রশিক্ষণ শিবিরে আঘাত হানে। অপর ক্ষেপনাস্ত্রগুলো সুদানের একটি মেডিকেল কারখানা ধ্বংশ করে দেয়। মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভ ও ঘৃণায় ফেটে যায়। বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে পাদপ্রদীপের আলোয়ে আবির্ভূত হন ওসামা বিন লাদেন।

    —-চলমান।
    (collected)
    Last edited by Talhah Bin Ubaidullah; 02-24-2018, 09:11 PM.

  • #2
    পর্ব ১-৭ এর বাকি অংশঃ

    পর্ব ১-৭ এর বাকি অংশঃ

    অনুবাদকের ভূমিকা
    বিশ্বময় জিহাদিদের অবাধ বিচরণ। জিহাদের পদচারণা থেকে কোন রাষ্ট্র, কোন অঞ্চলই যেন বাকি নেই। মহা প্ররাক্রান্ত আমেরিকার মাটিও নয়। ইতোমধ্যে বলকান অঞ্চল থেকে আফগানিস্তান হয়ে ফিলিপিন্স পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে এক নতুন ধরণের জিহাদ। বিশ্ব কট্টরপন্থী মুসলিমদের জিহাদ। সেই জিহাদের প্রাণ পুরুষ আজ ওসামা বিন লাদেন। তার গুপ্ত বাহিনীর সদস্যরা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের দেশে দেশে। জিহাদ চালানোর জন্য তারা তৎপর রয়েছে বসনিয়া, আলবেনিয়া, কাশ্মিরে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বিন লাদেন হয়ে দাঁড়িয়েছেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত পুরুষ। আমেরিকার বিরুদ্ধে তিনি ঘোষণা করেছেন সর্বাত্মক যুদ্ধ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের ঘাঁটিতে ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র হেনে লাদেনকে হত্যা করার চেষ্টা করছে। পারেনি! পারেনি! এখন জীবিত হোক, মৃত হোক তাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। আমেরিকা লাদেনের মাথার দাম ঘোষণা করেছে ৫০ লাখ ডলার। কিন্তু লাদেন যেন প্রহেলিকা। তাকে ধরা যায় না-ছোঁয়া যায় না। বিশ্বজুড়ে লাদেন বাহিনীর জিহাদী কর্মকান্ডের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ১৯৯৮ সালের আগষ্টে নাইরোবি ও দারুস সালামে মার্কিন দূতাবাসের বাইরে যুগপত বোমা বিষ্ফোরণ তার অন্যতম। এ বছর প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের বাংলাদেশ সফর কালে জয়পুরা গ্রাম পরিদর্শনের কর্মসূচি শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ নাকি গোপন সূত্রে খবর পায় যে, লাদেন বাহিনী চোরাগোপ্তা আঘাত হানতে পারে।
    কে এই ওসামা বিন লাদেন? কিভাবে কোন পটভূমি থেকে ঘটল তার উত্থান? কেমন করেই বা চালিত হয় তার গুপ্ত বাহিনীর কর্মকাণ্ড-? তিনি কি পথভ্রষ্ট কোন সন্ত্রাসী মাত্র? নাকি নিশির মতো ঘোরে পাওয়া এক সৌদি বিলিওনেয়ার যিনি ঐশ্বর্য ও বিলাসী জীবন ছেড়ে সুদূর আফগাস্তিানের এক গুহায় বসে জাল বুনে চলেছেন তার বিশ্ব পরিকল্পনার?
    ইয়োসেফ বাদানস্কির ‘বিন লাদেন॥ দি ম্যান হু ডিক্লেয়ার্ড ওয়ার অন আমেরিকা’ গ্রন্থ এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অবলম্বনে এখানে পরিবেশিত হচ্ছে সেই বহুল আলোচিত মানুষটির বিচিত্র কাহিনী।
    প্রথম জীবন
    ওসামা বিন লাদেন। শীর্ণ একহারা গড়ন। শশ্রুমন্ডিত চেহারা। বয়স ৪৩ এর মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এই মানুষটির কম্পিউটারের ওপর ভাল দখল আছে। চার স্ত্রী ও ১৫টির মতো ছেলেমেয়ে। তাদের নিয়ে বসবাস করছেন আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের একটি গিরিগুহায়। সেখানে ট্যাপের পানি সেই। শীতের হিংস্র ছোবল থেকে বাঁচবার জন্য গুহাটিকে গরম রাখার কোনরকম ব্যবস্থা আছে মাত্র। আর সেই সঙ্গে আছে গুপ্তহত্যা, কমান্ডো আক্রমণ ও বিমান হামলার আশঙ্কা। এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয় লাদেনকে। অথচ এমনি ঝুঁকিময়, বিপদসঙ্কুল ও অনিশ্চিত জীবন যাপন করার কথা ছিলো না লাদেনের। বাবার পথ ধরে তিনি হতে পারতেন সৌদি আরবের একজন নামী নির্মাণ ঠিকাদার। হতে পারতেন একজন ধনকুবের, যার ব্যংক ব্যালেন্স থাকত শত শত কোটি ডলারের। অথচ তিনি প্রাচুর্যের জীবন ছেড়ে বেছে নিয়েছেন এক বন্ধুর পথ। অত্যন্ত কঠিন পরিবেশে থেকে তিনি নিজেকে উৎসর্গিত করেছেন এমন এক মিশনে যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘জেহাদ’। জিহাদের জন্য উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ও সুখ-স্বাচ্ছন্দময় জীবন পরিত্যাগ করেছেন এমন মানুষ অবশ্য বিন লাদেন একা নন, আরও অনেকেই আছেন। তাদের একজন ডা. আইমান আল জাওয়াহিরি। ইনি লাদেনের দক্ষিণ হস্ত। চল্লিশের শেষ কোটায় বয়স। মিসরের অন্যতম শীর্ষ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞহতে পারতেন তিনি। কিন্তু বিপুল সম্ভামনাময় ক্যারিয়ার ও প্রচুর্যের জীবন ছেড়ে তিনি মিসর সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেন এবং দেশত্যাগে বাধ্য হন। লোভনীয় পারিশ্রমিকে তাকে পশ্চিম ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বসবাস করতে থাকেন। লাদেন ও জাওয়াহিরী আজ পাশ্চাত্যের চোখে সবচেয়ে কুখ্যাত মুসলিম জিহাদী নেতা। তবে তাঁরাই একমাত্র নন। এঁদের মতো আরও শত শত অধিনায়ক আছেন এবং তাদেরও প্রত্যেকের অধীনে আছে হাজার হাজার জিহাদী। এঁরা সবাই যুক্তরাষ্ট তথা গোটা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন ‘জিহাদে’ লিপ্ত। ১৯৯৮ সালের আগস্টে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা বিষ্ফোরণ তাদের সর্বশেষ বড় ধরণের জিহাদী হামলার দৃষ্টান্ত। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই নব্য র*্যডিকেল ইসলামী এলিটদের আবির্ভাব উন্নয়নশীল বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনা। সধারণত সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র ও বিক্ষুব্ধ অংশ থেকে সন্ত্রাসবাদী ও র*্যডিকেলরা জন্ম নিলেও এই নেতারা এসব শ্রেণী থেকে আসেননি, এসেছেন বিত্তবান ও বিশেষ সুবিধাভোগী অংশ থেকে। এঁরা শুধু উচ্চ শিক্ষিতই নন, পাশ্চাত্যের মননশীলতার দ্বারাও প্রভাবিত। ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদীদের থেকেও তাঁরা আলাদা। ওসামা বিন লাদেন, আইমান আল জাওয়াহিরি এবং তাঁদের সত্তর ও আশির দশকের টালমাটালময় সময়ের ফসল। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে তাদের জিহাদী রাজনীতি র*্যডিকেলিজমকে আলিঙ্গন করার ব্যাপারটা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
    তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলো হলো সত্তরের দশকে তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে একই সঙ্গে আরব জাতির সমৃদ্ধি ও সত্তার সঙ্কট, ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় এবং আশির দশকের আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী সংগ্রাম।
    ওসামা বিন মুহাম্মদ বিন লাদেনের জন্ম সম্ভবত ১৯৫৭ সালে সৌদি আরবের রিয়াদ নগরীতে। বাবা মুহাম্মদ বিন লাদেন তখন ছিলেন ছোটখাটো একজন ঠিকাদার। ভাগ্যের সন্ধানে তিনি ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবে আসেন। মোহাম্মদ বিন লাদেনের স্ত্রী ছিল বেশ কয়েকটি, সন্তান সংখ্যা ৫০-এরও বেশি।
    এদেরই একজন বিন লাদেন। মোহাম্মদ বিন লাদেন শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন বলে সন্তানদের শিক্ষাদানে কার্পণ্য করেননি। ষাটের দশকে তার পরিবার সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে হিজাজে চলে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মদিনায় বসতি স্থাপন করে। ওসামা বিন লাদেন তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বেশিরভাগই পেয়েছিলেন মদিনায় ও পরবর্তীকালে জেদ্দায়।
    সত্তরের দশকে তেল সঙ্কটকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর বিপুল আর্থোপার্জন মোহাম্মদ বিন লাদেনের ভাগ্যের চাকা বদলে দেয়। হিজাজে উন্নয়নের জোয়ার বইতে থাকে এবং সেই সাথে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে লাদেনের নির্মাণ ব্যবসা। এই নির্মাণ ব্যবসার সূত্রেই সৌদি এলিটদের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ ঘটেছিল তার । অচিরেই আল-সৌদ পরিবারের সবচেয়ে উঁচু মহলের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠে। নির্মাণ কাজে তিনি শুধু উৎকর্ষ ও উন্নত রুচিই এনে দেননি, আভিজাত্যও সৃষ্টি করেছিলেন। সেই সঙ্গে আল-সৌদ পরিবারকে গোপন কিছু সার্ভিসও দিতেন তিনি। তার মধ্যে একটি ছিল বিভিন্ন স্থানে অর্থ প্রেরণ। শীর্ষ মহলের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগে মোহাম্মদ বিন লাদেন তার ব্যবসায়কে সম্প্রসারিত করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ নির্মাণ কোম্পানিতে পরিণত করেন এবং তার নাম দেন বিন লাদেন কর্পোরেশন। আল-সৌদ পরিবার লাদেনের কোম্পানিকে মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ নবরূপায়ন ও পুননির্মাণের দায়িত্ব দেন। এতে কোম্পানির মর্যাদা আরও বেড়ে যায়। সত্তরের দশকে বিন লাদেন কোম্পানি উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশ কয়েকটি আরব দেশের রাস্তাঘাট, ভবন, মসজিদ, বিমানবন্দরসহ গোটা অবকাঠামো নির্মাণে জড়িত হয়ে পড়ে।
    ওসামা বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন এ যেন কথাই ছিল। প্রথমে তিনি জেদ্দার হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। পরে সেখানকার কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতির ওপর অধ্যয়ন করেন। বাবা কথা দেন ওসামাকে তার কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব দেবেন। রাজ দরবারের সাথে বিন লাদেনের সরাসরি যোগাযোগ আছে। সেই যোগাযোগের সুযোগে অত্যন্ত আকর্ষণীয় কনট্রাক্টগুলো বাগিয়ে আনতে পারবে তার কোম্পানি। ওসামার সত্তরের দশকটা আর দশটা বিত্তবান ও প্রভাবশালী সন্তানদের মতোই শুরু হয়েছিল। সৌদি আরবের কঠোর ইসলামী জীবনধারার বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে তিনি প্রমোদ ভ্রমণে যেতেন কসমোপলিটন বৈরুতে। হাই স্কুল ও কলেজে পড়তেই তার বৈরুতে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিলর*্য
    বিন লাদেনের ভাব পুরুষ
    ভোগ বিলাসের উপকরণ বেশি আকর্ষণ করতে পারেনি বিন লাদেনকে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইলী যুদ্ধের পর থেকে তাঁর মধ্যে একটা পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা যায়। তখনও মাঝে মধ্যে প্রমোদ ভ্রমণে বৈরুত যেতেন বটে, তবে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামাতে থাকেন। ইসলামী বইপত্র পড়া তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। এবং আলেম ওলামাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। ওসামার জীবনে এই পরিবর্তনটা আসলে ছিল সত্তরের দশকের আরব ও মধ্য প্রাচ্যের অস্থির সময়ের প্রতিফলন। এই অস্থির সময়ের একটি ফসল ছিল র*্যডিকেল ইসলামী চিন্তাধারা।
    সে সময় র*্যডিকেল ভাবধারার অন্যতম পাঠ্যস্থান ছিল জেদ্দা নগরী। জেদ্দা বন্দর দিয়ে সৌদি আরবে পণ্য আনা নেয়ার পাশাপাশি মিসর ও অন্যান্য দেশ থেকে র*্যডিকেল ইসলামী প্রচার পুস্তিকা ঢালাওভাবে চলে আসত। তা ছাড়া জেদ্দার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুল র*্র*্যডিকেল ইসলামী বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের কর্মকান্ডে মুখর হয়ে উঠেছিল। বিন লাদেনসহ জেদ্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র এই র*্যডিকেল ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ডের সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তী পর্যায়ে মিশর র*্যডিকেল আন্দোলনের জোয়ার, ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানের শাহের বিরুদ্ধে ইসলামী শক্তির বিজয় এবং খোদ সৌদি আরবে র*্যডিকেল শক্তির অভ্যুত্থান চেষ্টা (কাবার মসজিদুল হারাম দখলের ঘটনা) বিন লাদেনের মতো তরুণদের প্রবলভাবে আলোড়িত করে। এরপর ঘটে আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন। আগ্রাসনের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই রুশ দখলদারীর বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় মুজাহিদ বাহিনীর তৎপরতা। আমেরিকা ও সৌদি আরব পাকিস্তানের মাধ্যমে মুজাহিদদের অস্ত্র, রসদ, অর্থসহ যাবতীয় সাহায্য যোগাতে থাকে। সোভিয়েত হামলার পর মুজাহিদদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়বার জন্য প্রথম যে ক’জন আরব আফগানিস্তানের গিয়েছিল ওসামা বিন লাদেন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বলা যেতে পারে যে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত হামলা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
    বিন লাদেন আফগানিস্তানের পথে প্রথমে পাকিস্তানে যান। সেখানে পৌঁছে আফগান মুজাহিদদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখে হতবাক হয়ে যান। অবশেষে নিজেই রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করে আফগান যুদ্ধের জন্য লোক সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়েন। বিন লাদেন এ কাজের জন্য যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন পরবর্তী কয়েক বছরে তাঁর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলোর হাজার হাজার আরব যোদ্ধা আফগানিস্তানে পৌঁছে।
    আফগানিস্তানে অবস্থানের প্রথমদিকে শেখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিয়ন অব ইসলাম’ নামে আন্তর্জাতিক ইসলামী জিহাদের অতি দক্ষ ও জানবায একটি হার্টকোর বাহিনী প্রতিষ্ঠায় আযযাম ছিলেন আসল ব্যক্তি। আযযাম প্রসঙ্গে এখানে দুটো কথা না বললেই নয়। কারণ প্রকৃত অর্থে এই মানুষটি ছিলেন বিন লাদেনের ভাব পুরুষ।
    আযযামের জন্ম ১৯৪১ সালে সামাবিয়ার জেনিন শহরের কাছে এক গ্রামে। ১৯৭৩ সালে তিনি মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী আইনশাস্ত্রের ওপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। মধ্যবর্তী সময়টিতে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। কায়রোয় থাকাকালে তিনি ইসলামী জিহাদীদের সংস্পর্শে আসেন। এ সময় বেশকিছু ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে যাঁরা পরবর্তীকালে আফগানিস্তানে বড় ধরনের প্রভাব রেখেছিলেন।
    —-চলমান।
    (collected)

    Comment


    • #3
      জাযাকাল্লাহু খায়ের, ভাই লিখতে থাকেন।

      Comment


      • #4
        জাঝাকাল্লাহ ভাই। আল্লাহ আপনাদেরকে আরো সুন্দর সুন্দর পোস্ট করার তাওফিক দান করুন, আমিন।
        আমি হতে চাই খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা এর মত রণকৌশল ও ওমর (রা এর মত কাফেরদের প্রতি কঠোর।

        Comment

        Working...
        X