আল্লাহর,সালাত ও সালাম শেষ নবীর উপর।
পার্থিব জীবনে মর্যাদা ও প্রসিদ্ধি লাভের বিভিন্ন উপায় রয়েছে, কেউ বংশগত আভিজাত্য থেকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।কেউ ধন সম্পদের পাহাড়ে চড়ে মর্যাদা ছিনিয়ে আনতে চেষ্টা করে।কেউ আবার বিদ্যা-বুদ্ধির জোরে যশ-খ্যাতি অর্জন করে।আর কিছু মানুষ জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জন করে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটায়।ফলে দুনিয়াজোড়া খ্যাত,চোখ ধাঁধানো সম্মান তার পদচুম্বন করে। আর হাতে গোনা দু'চারজন মানুষ আছে, যারা খ্যাতি ও প্রসিদ্ধির পরোয়া করে না। এমনকি ইতিহাস তাদের নাগাল পর্যন্ত* পাই না।কারন তারা ইতিহাস হতে চাই না; বরং তারা ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায়।তবে ঐতিহাসিকদের মত কলমের কালিতে নয়, বুকের লাল রক্ত ঢেলে তারা ইতিহাস রচনা করে যায়।ইজ্জত-সম্মানের নতুন নতুন মানচিত্র এঁকে যায়।গর্ব ও গৌরবের সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করে যায়।সেই মহান ও মহিমান্বিত ব্যাক্তিরা হচ্ছেন আল্লাহর রাস্তায় শহীদগণ।যারা অন্তত সম্মান ও অন্যন্য মর্যাদা লাভ করে রক্তের বিনিময়ে। তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে অনন্ত জীবন লাভ করার জন্য।তারা জনতা থেকে নিরুদ্দেশ হয় নির্জনতায় নিবীড়ভাবে মিশে থাকার জন্য। সেই মহান ব্যক্তিদের অন্যতম হচ্ছেন শহীদ আবু আছেম মুহাম্মদ উসমান। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত টগবগে ওকজন যুবক। তিনি জন্মগ্রহন করেন ধন-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা ও সামাজিক মর্যাদায় মধ্যম স্তরের একটি পরিবারে। তবে তাকে বেড়ে উঠতে হয়েছে ভীষণ বৈরী পরিবেশে,যেখানে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে।ফলে তার তারবিয়াত ও দীক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য কোন সদয় হাত এগিয়ে আসেনি।তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি উন্মেষ ও উৎকর্ষ সাধনের গুরুদায়িত্ব কোন আদর্শ শিক্ষকের হাতে পড়েনি।তা সত্ত্বেও তিনি মানবতার সেই দুর্যোগের মুহূর্তে নিজের ও দ্বীন ইমান রক্ষার্থে কঠিন এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। আর লক্ষ্য যখন বড় হয় এবং গন্তব্য যখন অজানা, তখন পথের প্রতিকূলতা, দুর্গমতা ও বন্ধুরতা শুধু বৃদ্ধি পেতে থাকে। আলোচ্য শহীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘঠেনি।হ্যাঁ.... উদ্দেশ্য যেহেতু ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি ; তাই পদে পদে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন, এবং সঠিক পথে তাকে পরিচালিত করেছেন। প্রথমেই আল্লাহ তার অন্তরে নিজের কালাম কোরআনের আকর্ষণ দান করেছেন। ফলে তিনি কোরআনের কিরাত, তেলাওয়াত,তাজবীদ, তারতীল এবং কোরআনের যাবতীয় আদব শিক্ষা দিয়েছেন। পরবর্তিতে তিনি পূর্ণ কোরআনের হিফজ করেছিলেন। এভাবে তিনি মোজাহিদদের ইমাম ও উস্তাদে পরিণত হয়েছিলেন। তিনিই* সালাতে ইমাম ছিলেন এবং সালাতের পর সবাইকে কোরআন শিক্ষা দিতেন।* কোরআনের ভালোবাসা তার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছিল। তাই দেখা যেত সবাই একসাথে কথাবার্তা বলছে,গল্প-গুজব করছে,মাঝখান থেকে আস্তে করে উঠে পাশের কামরায় গিয়ে তিলাওয়াতে মশগুল হয়েছেন। সম্মান করে সবাই তাকে ক্বারী সাহেব বলে ডাকত।রামাদ্বান শুরু হওয়ার পর তার তিলাওয়াতে মুগ্ধ হয়ে সবাই তার পিছনে তারাবিহ পড়ার জন্য সমেবেত হল।তার তিলাওয়াত এত মধুর ছিল যে,শুনে মনে হত কোরআন বুঝি এই মাত্র নাযিল হচ্ছে। একবার সে আমার কাছে কোরআনের অন্য কিরাতগুলোও শেখার আরজি জানাল।আমি বললাম, তোমার জন্য আবু হাফসের কিতাবটিই যথেষ্ট।এখন কিরাতের চেয়ে জিহাদের প্রয়োজন বেশী। এরই ফাকে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বিবাহের জন্য অব্যাহত চাপ আসছিল।একবার তো তার হবু স্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপ পর্যন্ত করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার একটায় কথা, আমি অন্য কোথায় বিবাহ বসব না। তুমি এসে বিবাহ করে আবার চলে যাও।সেও নিজের বক্তব্যে অনড় ছিল। আমি আসব না, তুমি অন্য কোথাও বিবাহ বসো।
যাহোক, দেখতে দেখতে রামাদ্বানের নতুন চাঁদ পূর্ণিমায় রুপান্তরিত হলো।অভিযানের ক্ষেত্রও পরিবর্তন হল।মুজাহিদ বাহিনী পেশওয়ার ছেড়ে পাঞ্চশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।আবু আছেমও পেশওয়ারকে চিরবিদায় জানিয়ে রওয়ানা হলেন এবং পাঞ্চদেশে পৌঁছে সেখানকার বীর বাহাদুর সিপাহসালার* শায়খ আহমাদ শাহ-এর শরণাপন্ন হলেন। এবং তাকে করজোড় অনুরোধ করলেন, আবাসে-প্রবাসে, অভিযানে-অবসরে সর্বাবস্থায় আমি আপনার খেদমতে থাকতে চাই।আর কোরআনের ইলম ও আরবি ভাষা শিখতে চাই।শায়েখ আহমাদ শাহ মাসউদ রামাদ্বানের বাকী দিনগুলোতে আবু আছেমের হেফজের দাওর করার জন্য কয়েকজন হাফেজ মুজাহিদকে নিযুক্ত করে দিলেন। শায়েখ আহমদ অবশ্য একজন সিপাহসালার হওয়ার পাশাপাশি আদর্শ একজন শিক্ষকও। মাত্র এক বছরে তিনি প্রায় দুইশজন মুজাহিদকে জিহাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সাথে সাথে তাজবীদসহ সহীহ শুদ্ধভাবে তারতীলের সাথে কোরআন তিলাওয়াত শিখিয়েছিলেন।সপ্তাহের সোম-বৃহস্পতিবার দুটি সুন্নাত সিয়াম এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নিয়মিত আমলে তিনি তাদেরকে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন। রামাদ্বান বিদায় নিল। ঈদের চাঁদ শাওয়ালও ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিদায় শেষ হলো,কিন্তু অভিযান সমাপ্ত হলো না। একে একে এগার মাস কেটে গেল। বছর ঘুরে আবার শাবানের চাঁদ দেখা গেল। রামাদ্বানের আর ক'দিন বাকী? আবু আছেম হিসাব করে আর আফসোস করে, আহা! রামাদ্বান তো এসে গেল, গতবারের লাইলাতুল কদর কি আমার শাহাদাত সৌভাগ্য লিপিবদ্ধ করেছে। এবারের কদর কি সেই তাকদীর নিয়ে হাযির হবে! রামাদ্বানের শাহাদাত যে ভিন্ন মর্যাদার! অনন্য মরতবার!!!
অবশেষে ১৪ই রামাদ্বান ১৪০৬ হিজরী সেই দিনটি এসে গেল। অভিযানে অংশগ্রহণকারী সকল মুজাহিদের নাম লিপিবদ্ধ করা হল,কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ১১০ জন মুজাহিদের নাম তালিকাভুক্ত করা হল। কারো নামের সঙ্গে শহীদ*লেখা হল না,অথচ আবু আছেমের নামের সঙ্গে লেখা হল "শহীদ"।তখন আব্দুল্লাহ আনাস নামে আরেক আরব যোদ্ধা তালিকা প্রস্তুতকারীকে লক্ষ্য করে বলল,* কী ভাই ছফিউল্লাহ! আমরা মোটে দু'জন মাত্র আরব।* তার মধ্যে তুমি আবার একজনকে আল্লাহর দরবারে পাঠিয়ে দিচ্ছো!* ছফিউল্লাহ বলল,* আল্লাহর কসম,* সে আর ফিরে আসবে না।* তার চেহারার দিকে একবার তাকাও,* শাহাদাতের নূর কেমন জ্বলজ্বল করছে তার ললাটে! আল্লাহর কসম, সে এই যুদ্ধেই শহীদ হয়ে যাবে!* আসলে একেই বলে মুমিনের কিয়ামত। "
অভিযানের গুরুত্বতা চিন্তা করে পরদিন সবাই সিয়াম ভাঙ্গার রুখছুত গ্রহণ করল কেবল দু'জন ছাড়া।* আবু আছেম ও শাহ কালান্দর।* মুজাহিদরা শত্রুবাহিনীর দূর্গের নিকট পৌছে গেল। তখন উপর থেকে বৃষ্টির মতো বুলেট ছুটে আসতে লাগল। এদিকে আবু আসিমের দায়িত্বটাই ছিল এমন যে তাকে এই বুলেট - বৃষ্টির মধ্যেই নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে হবে কারণ শত্রু দূর্গের লৌহদারে মাইন পুঁততে না পারলে কোনো প্রকার প্রতিরোধ করাই সম্ভব না।* আর এও গুরু দায়িত্বটা আবু আছেমের উপর। তাই তিনি কালবিলম্ব না করে সিংহের সাহস নিয়ে, চিতার ক্ষিপ্ততায় পৌছে গেলেম কাঙ্ক্ষিত স্থানে।* শত্রুর প্রতিরোধের প্রথম ও চুড়ান্ত স্তর দূর্গের দরজার নিচে।* মহূর্তের মধ্যে সেখানে মাইন (বিস্ফোরক)রেখে ফিরে গেলেন সতর্ক অবস্থানে।* বিস্ফোরন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল লৌহদার ও অনতিক্রম্য দেয়াল ধ্বসে পড়ল চোখের পলকে। মুজাহিদরা আল্লাহু আকবার তাকবির বলে সদর্পেএগিয়ে চলল।* কাফির- মুশরিকরা তখন জান বাঁচাতে ব্যস্ত। এমন সময় অজ্ঞাত দিক থেকে দুটি বুলেট এসে আঘাত হানল।* আল্লাহু আকবার!* কাফিররা অগ্রভাগে থাকা দুই সিয়াম পালনকারী মুজাহীদ আবু আছেম ও শাহ কালান্দারের বুকে।* সঙ্গে সঙ্গে তারা চলে গেলেন মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে। অল্পক্ষনের মধ্যেই মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত হল। যেন তাদের সাথে করা আল্লাহর পূর্ণ ওয়াদা পূরনের জন্যই শুধু তাদেরকে শাহাদাহ দান করলেন। কারণ এছাড়া আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি মুসলিমদের হয়নি।
আবু আছেমের শাহাদাহর সংবাদ সবার উপর বজ্রের মতো আপতিত হলো।* মুজাহিদরা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে তাদের ইমাম ও শিক্ষক তাদেরকে ফেলে চলে গেলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে। তার শোকে সবাই যেন কাতর হয়ে গেল। নিস্তব্ধতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।* নিস্তব্ধতা সবাইকে গ্রাস করে ফেলল। পরিচয় ভুলে অন্তরঙ্গতা হারিয়ে সবাই যেন নি:সঙ্গ হয়ে গেল। সবাই আছে, কিন্তু কেউ নেই,* সবই আছে,* কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুই নেই।* ফজরের আজান হলো,* সালাতের সময় হলো কিন্তু ইমামের দাঁড়াবে কে?* সালাত শেষে হালাকাতো বসল কিন্তু শিক্ষকের মসনত খালিই পড়ে থাকল। শোক সন্তপ্ত আবহে এই কবিতা - পঙক্তিটিই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল----
-" শব্দ তো বেসে আসছে কানে,
কিন্তু বেলালের রুহ নেই এ আযানের টানে। "
সবাই যেন সান্ত্বনার ভাষাটাও হারিয়ে ফেলেছে।* তাই চোখের অশ্রুকেই সান্ত্বনার উপায় বানিয়ে এখন সবাই শুধু অশ্রু বিনিময় করছে।* দস্তরখানে বাসন আছে,* আবু আছেম নেই।* গাছের তলে বিছানাটা আছে,* কিন্তু মালিক তো বিদায় নিয়েছে। তার শোকে কেউ কেউ স্বাভাবিকতা হারিয়ে প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। কিন্তু এমন কেন হলো? এরা সবাই তো রণাঙ্গের লড়াকু সৈনিক।* জীবন-মৃত্যু নিয়েই যাদের খেলা।** চোখের সামনে নিজের সহযোদ্ধার জীবন* যেতে দেখেছে।* পিতা-পুত্র ও আত্মীয়-স্বজনের লাশের সারি দেখেছে।* তার পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা সৈনিকের বুকে গুলি লেগে ছটফট করে শহীদ হতে দেখেছে। তারপরও এদের মধ্যে এত শোক ঢুকল কোথেকে?** পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শায়খ আহমাদ শাহ মুজাহিদদেরকে বহু দূরে এক অঞ্চলে ঘুরিয়ে এনেছিলেন, যাতে সবাই তার কথা ভুলে যেতে পারে।*
শহীদ আবু আছেমের শেষ ঠিকানা তৈরি করা হল আফগানিস্তানের সুউচ্চ একটি পাহাড়ের চূড়ায়। কবর খনন করলেন স্বয়ং* শায়খ আহমাদ নিজের হাতে।* আরব হওয়া সত্ত্বেও আফগানিস্তানের পাহাড়ে তার শেষ শয্যা হওয়া, একথাই প্রমণ করে যে, ইসলাম বিশ্বজনীন শাশ্বত একটি ধর্ম,* যা মানচিত্রের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। হে আল্লাহ, আবু আছেম সবকিছু বিসর্জন শুধু তোমার সন্তুষ্টির জন্য। অতএব, তুমিও তাকে খুশি করে দাও। জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করো।--আমিন
[ইয়া রাব্বাল 'আলামীন ]
(উৎস- কারা জান্নাতি কুমারীদের ভালোবাসে,* ড. আব্দুল্লাহ আযযাম রাহিমাহুল্লাহ)
পার্থিব জীবনে মর্যাদা ও প্রসিদ্ধি লাভের বিভিন্ন উপায় রয়েছে, কেউ বংশগত আভিজাত্য থেকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।কেউ ধন সম্পদের পাহাড়ে চড়ে মর্যাদা ছিনিয়ে আনতে চেষ্টা করে।কেউ আবার বিদ্যা-বুদ্ধির জোরে যশ-খ্যাতি অর্জন করে।আর কিছু মানুষ জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জন করে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটায়।ফলে দুনিয়াজোড়া খ্যাত,চোখ ধাঁধানো সম্মান তার পদচুম্বন করে। আর হাতে গোনা দু'চারজন মানুষ আছে, যারা খ্যাতি ও প্রসিদ্ধির পরোয়া করে না। এমনকি ইতিহাস তাদের নাগাল পর্যন্ত* পাই না।কারন তারা ইতিহাস হতে চাই না; বরং তারা ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায়।তবে ঐতিহাসিকদের মত কলমের কালিতে নয়, বুকের লাল রক্ত ঢেলে তারা ইতিহাস রচনা করে যায়।ইজ্জত-সম্মানের নতুন নতুন মানচিত্র এঁকে যায়।গর্ব ও গৌরবের সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করে যায়।সেই মহান ও মহিমান্বিত ব্যাক্তিরা হচ্ছেন আল্লাহর রাস্তায় শহীদগণ।যারা অন্তত সম্মান ও অন্যন্য মর্যাদা লাভ করে রক্তের বিনিময়ে। তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে অনন্ত জীবন লাভ করার জন্য।তারা জনতা থেকে নিরুদ্দেশ হয় নির্জনতায় নিবীড়ভাবে মিশে থাকার জন্য। সেই মহান ব্যক্তিদের অন্যতম হচ্ছেন শহীদ আবু আছেম মুহাম্মদ উসমান। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত টগবগে ওকজন যুবক। তিনি জন্মগ্রহন করেন ধন-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা ও সামাজিক মর্যাদায় মধ্যম স্তরের একটি পরিবারে। তবে তাকে বেড়ে উঠতে হয়েছে ভীষণ বৈরী পরিবেশে,যেখানে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে।ফলে তার তারবিয়াত ও দীক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য কোন সদয় হাত এগিয়ে আসেনি।তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি উন্মেষ ও উৎকর্ষ সাধনের গুরুদায়িত্ব কোন আদর্শ শিক্ষকের হাতে পড়েনি।তা সত্ত্বেও তিনি মানবতার সেই দুর্যোগের মুহূর্তে নিজের ও দ্বীন ইমান রক্ষার্থে কঠিন এক অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। আর লক্ষ্য যখন বড় হয় এবং গন্তব্য যখন অজানা, তখন পথের প্রতিকূলতা, দুর্গমতা ও বন্ধুরতা শুধু বৃদ্ধি পেতে থাকে। আলোচ্য শহীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘঠেনি।হ্যাঁ.... উদ্দেশ্য যেহেতু ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি ; তাই পদে পদে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন, এবং সঠিক পথে তাকে পরিচালিত করেছেন। প্রথমেই আল্লাহ তার অন্তরে নিজের কালাম কোরআনের আকর্ষণ দান করেছেন। ফলে তিনি কোরআনের কিরাত, তেলাওয়াত,তাজবীদ, তারতীল এবং কোরআনের যাবতীয় আদব শিক্ষা দিয়েছেন। পরবর্তিতে তিনি পূর্ণ কোরআনের হিফজ করেছিলেন। এভাবে তিনি মোজাহিদদের ইমাম ও উস্তাদে পরিণত হয়েছিলেন। তিনিই* সালাতে ইমাম ছিলেন এবং সালাতের পর সবাইকে কোরআন শিক্ষা দিতেন।* কোরআনের ভালোবাসা তার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছিল। তাই দেখা যেত সবাই একসাথে কথাবার্তা বলছে,গল্প-গুজব করছে,মাঝখান থেকে আস্তে করে উঠে পাশের কামরায় গিয়ে তিলাওয়াতে মশগুল হয়েছেন। সম্মান করে সবাই তাকে ক্বারী সাহেব বলে ডাকত।রামাদ্বান শুরু হওয়ার পর তার তিলাওয়াতে মুগ্ধ হয়ে সবাই তার পিছনে তারাবিহ পড়ার জন্য সমেবেত হল।তার তিলাওয়াত এত মধুর ছিল যে,শুনে মনে হত কোরআন বুঝি এই মাত্র নাযিল হচ্ছে। একবার সে আমার কাছে কোরআনের অন্য কিরাতগুলোও শেখার আরজি জানাল।আমি বললাম, তোমার জন্য আবু হাফসের কিতাবটিই যথেষ্ট।এখন কিরাতের চেয়ে জিহাদের প্রয়োজন বেশী। এরই ফাকে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বিবাহের জন্য অব্যাহত চাপ আসছিল।একবার তো তার হবু স্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপ পর্যন্ত করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার একটায় কথা, আমি অন্য কোথায় বিবাহ বসব না। তুমি এসে বিবাহ করে আবার চলে যাও।সেও নিজের বক্তব্যে অনড় ছিল। আমি আসব না, তুমি অন্য কোথাও বিবাহ বসো।
যাহোক, দেখতে দেখতে রামাদ্বানের নতুন চাঁদ পূর্ণিমায় রুপান্তরিত হলো।অভিযানের ক্ষেত্রও পরিবর্তন হল।মুজাহিদ বাহিনী পেশওয়ার ছেড়ে পাঞ্চশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।আবু আছেমও পেশওয়ারকে চিরবিদায় জানিয়ে রওয়ানা হলেন এবং পাঞ্চদেশে পৌঁছে সেখানকার বীর বাহাদুর সিপাহসালার* শায়খ আহমাদ শাহ-এর শরণাপন্ন হলেন। এবং তাকে করজোড় অনুরোধ করলেন, আবাসে-প্রবাসে, অভিযানে-অবসরে সর্বাবস্থায় আমি আপনার খেদমতে থাকতে চাই।আর কোরআনের ইলম ও আরবি ভাষা শিখতে চাই।শায়েখ আহমাদ শাহ মাসউদ রামাদ্বানের বাকী দিনগুলোতে আবু আছেমের হেফজের দাওর করার জন্য কয়েকজন হাফেজ মুজাহিদকে নিযুক্ত করে দিলেন। শায়েখ আহমদ অবশ্য একজন সিপাহসালার হওয়ার পাশাপাশি আদর্শ একজন শিক্ষকও। মাত্র এক বছরে তিনি প্রায় দুইশজন মুজাহিদকে জিহাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সাথে সাথে তাজবীদসহ সহীহ শুদ্ধভাবে তারতীলের সাথে কোরআন তিলাওয়াত শিখিয়েছিলেন।সপ্তাহের সোম-বৃহস্পতিবার দুটি সুন্নাত সিয়াম এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নিয়মিত আমলে তিনি তাদেরকে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন। রামাদ্বান বিদায় নিল। ঈদের চাঁদ শাওয়ালও ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিদায় শেষ হলো,কিন্তু অভিযান সমাপ্ত হলো না। একে একে এগার মাস কেটে গেল। বছর ঘুরে আবার শাবানের চাঁদ দেখা গেল। রামাদ্বানের আর ক'দিন বাকী? আবু আছেম হিসাব করে আর আফসোস করে, আহা! রামাদ্বান তো এসে গেল, গতবারের লাইলাতুল কদর কি আমার শাহাদাত সৌভাগ্য লিপিবদ্ধ করেছে। এবারের কদর কি সেই তাকদীর নিয়ে হাযির হবে! রামাদ্বানের শাহাদাত যে ভিন্ন মর্যাদার! অনন্য মরতবার!!!
অবশেষে ১৪ই রামাদ্বান ১৪০৬ হিজরী সেই দিনটি এসে গেল। অভিযানে অংশগ্রহণকারী সকল মুজাহিদের নাম লিপিবদ্ধ করা হল,কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ১১০ জন মুজাহিদের নাম তালিকাভুক্ত করা হল। কারো নামের সঙ্গে শহীদ*লেখা হল না,অথচ আবু আছেমের নামের সঙ্গে লেখা হল "শহীদ"।তখন আব্দুল্লাহ আনাস নামে আরেক আরব যোদ্ধা তালিকা প্রস্তুতকারীকে লক্ষ্য করে বলল,* কী ভাই ছফিউল্লাহ! আমরা মোটে দু'জন মাত্র আরব।* তার মধ্যে তুমি আবার একজনকে আল্লাহর দরবারে পাঠিয়ে দিচ্ছো!* ছফিউল্লাহ বলল,* আল্লাহর কসম,* সে আর ফিরে আসবে না।* তার চেহারার দিকে একবার তাকাও,* শাহাদাতের নূর কেমন জ্বলজ্বল করছে তার ললাটে! আল্লাহর কসম, সে এই যুদ্ধেই শহীদ হয়ে যাবে!* আসলে একেই বলে মুমিনের কিয়ামত। "
অভিযানের গুরুত্বতা চিন্তা করে পরদিন সবাই সিয়াম ভাঙ্গার রুখছুত গ্রহণ করল কেবল দু'জন ছাড়া।* আবু আছেম ও শাহ কালান্দর।* মুজাহিদরা শত্রুবাহিনীর দূর্গের নিকট পৌছে গেল। তখন উপর থেকে বৃষ্টির মতো বুলেট ছুটে আসতে লাগল। এদিকে আবু আসিমের দায়িত্বটাই ছিল এমন যে তাকে এই বুলেট - বৃষ্টির মধ্যেই নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে হবে কারণ শত্রু দূর্গের লৌহদারে মাইন পুঁততে না পারলে কোনো প্রকার প্রতিরোধ করাই সম্ভব না।* আর এও গুরু দায়িত্বটা আবু আছেমের উপর। তাই তিনি কালবিলম্ব না করে সিংহের সাহস নিয়ে, চিতার ক্ষিপ্ততায় পৌছে গেলেম কাঙ্ক্ষিত স্থানে।* শত্রুর প্রতিরোধের প্রথম ও চুড়ান্ত স্তর দূর্গের দরজার নিচে।* মহূর্তের মধ্যে সেখানে মাইন (বিস্ফোরক)রেখে ফিরে গেলেন সতর্ক অবস্থানে।* বিস্ফোরন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল লৌহদার ও অনতিক্রম্য দেয়াল ধ্বসে পড়ল চোখের পলকে। মুজাহিদরা আল্লাহু আকবার তাকবির বলে সদর্পেএগিয়ে চলল।* কাফির- মুশরিকরা তখন জান বাঁচাতে ব্যস্ত। এমন সময় অজ্ঞাত দিক থেকে দুটি বুলেট এসে আঘাত হানল।* আল্লাহু আকবার!* কাফিররা অগ্রভাগে থাকা দুই সিয়াম পালনকারী মুজাহীদ আবু আছেম ও শাহ কালান্দারের বুকে।* সঙ্গে সঙ্গে তারা চলে গেলেন মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে। অল্পক্ষনের মধ্যেই মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত হল। যেন তাদের সাথে করা আল্লাহর পূর্ণ ওয়াদা পূরনের জন্যই শুধু তাদেরকে শাহাদাহ দান করলেন। কারণ এছাড়া আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি মুসলিমদের হয়নি।
আবু আছেমের শাহাদাহর সংবাদ সবার উপর বজ্রের মতো আপতিত হলো।* মুজাহিদরা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে তাদের ইমাম ও শিক্ষক তাদেরকে ফেলে চলে গেলেন আল্লাহর সান্নিধ্যে। তার শোকে সবাই যেন কাতর হয়ে গেল। নিস্তব্ধতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।* নিস্তব্ধতা সবাইকে গ্রাস করে ফেলল। পরিচয় ভুলে অন্তরঙ্গতা হারিয়ে সবাই যেন নি:সঙ্গ হয়ে গেল। সবাই আছে, কিন্তু কেউ নেই,* সবই আছে,* কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুই নেই।* ফজরের আজান হলো,* সালাতের সময় হলো কিন্তু ইমামের দাঁড়াবে কে?* সালাত শেষে হালাকাতো বসল কিন্তু শিক্ষকের মসনত খালিই পড়ে থাকল। শোক সন্তপ্ত আবহে এই কবিতা - পঙক্তিটিই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল----
-" শব্দ তো বেসে আসছে কানে,
কিন্তু বেলালের রুহ নেই এ আযানের টানে। "
সবাই যেন সান্ত্বনার ভাষাটাও হারিয়ে ফেলেছে।* তাই চোখের অশ্রুকেই সান্ত্বনার উপায় বানিয়ে এখন সবাই শুধু অশ্রু বিনিময় করছে।* দস্তরখানে বাসন আছে,* আবু আছেম নেই।* গাছের তলে বিছানাটা আছে,* কিন্তু মালিক তো বিদায় নিয়েছে। তার শোকে কেউ কেউ স্বাভাবিকতা হারিয়ে প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। কিন্তু এমন কেন হলো? এরা সবাই তো রণাঙ্গের লড়াকু সৈনিক।* জীবন-মৃত্যু নিয়েই যাদের খেলা।** চোখের সামনে নিজের সহযোদ্ধার জীবন* যেতে দেখেছে।* পিতা-পুত্র ও আত্মীয়-স্বজনের লাশের সারি দেখেছে।* তার পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা সৈনিকের বুকে গুলি লেগে ছটফট করে শহীদ হতে দেখেছে। তারপরও এদের মধ্যে এত শোক ঢুকল কোথেকে?** পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শায়খ আহমাদ শাহ মুজাহিদদেরকে বহু দূরে এক অঞ্চলে ঘুরিয়ে এনেছিলেন, যাতে সবাই তার কথা ভুলে যেতে পারে।*
শহীদ আবু আছেমের শেষ ঠিকানা তৈরি করা হল আফগানিস্তানের সুউচ্চ একটি পাহাড়ের চূড়ায়। কবর খনন করলেন স্বয়ং* শায়খ আহমাদ নিজের হাতে।* আরব হওয়া সত্ত্বেও আফগানিস্তানের পাহাড়ে তার শেষ শয্যা হওয়া, একথাই প্রমণ করে যে, ইসলাম বিশ্বজনীন শাশ্বত একটি ধর্ম,* যা মানচিত্রের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। হে আল্লাহ, আবু আছেম সবকিছু বিসর্জন শুধু তোমার সন্তুষ্টির জন্য। অতএব, তুমিও তাকে খুশি করে দাও। জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করো।--আমিন
[ইয়া রাব্বাল 'আলামীন ]
(উৎস- কারা জান্নাতি কুমারীদের ভালোবাসে,* ড. আব্দুল্লাহ আযযাম রাহিমাহুল্লাহ)
Comment