পিআর ফার্ম এবং বট আইডি: মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ডিজিটাল যুদ্ধ এবং এর মোকাবিলা
" পর্ব - ২ "
" পর্ব - ২ "
বট আইডি: কী এবং কীভাবে কাজ করে?
বট আইডি হলো স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার প্রোগ্রাম যা সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ডিজাইন করা হয়। এই আইডিগুলো মানব ব্যবহারকারীদের মতো আচরণ করে, তবে মূলত এগুলো প্রোগ্রাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এগুলোর ব্যবহার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া সমর্থন দেখানো, জনমত প্রভাবিত করা, ট্রেন্ড তৈরি করা, এবং বিরোধীদের আক্রমণ করার মতো কার্যক্রমে দেখা যায়। বট আইডি ব্যবহার করে একই মেসেজ হাজারো আইডি থেকে শেয়ার করা হয়, যার ফলে একটি মিথ্যা প্রচারণা সত্যে পরিণত হয়। এছাড়া জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ তৈরি করা, বিরোধী হ্যাশট্যাগ চাপিয়ে দেওয়া, বা জনমতের দিক পরিবর্তন করাও এর উদ্দেশ্য।
বট আইডি মূলত বিভিন্ন অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) মাধ্যমে কাজ করে। এগুলো নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রোগ্রাম করা হয় এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করা হয়। বট আইডিগুলোর কাজের ধাপগুলো নিম্নরূপ:
- স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হাজারো ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়, যেগুলো বিভিন্ন নাম, ছবি, এবং ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে মানুষের মতো দেখানো হয়।
- নির্দিষ্ট বিষয় বা বার্তা একযোগে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে তা দ্রুত ভাইরাল হয়। এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড তৈরি করার জন্য কার্যকর।
- জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ তৈরি করার জন্য বট আইডিগুলো একসঙ্গে পোস্ট করে, অথবা বিরোধী হ্যাশট্যাগকে আড়াল করতে বিপুল পরিমাণ পোস্ট করে তা দমিয়ে ফেলে।
- বট আইডিগুলো একই সময়ে হাজার হাজার শেয়ার এবং কমেন্ট দিয়ে কোনো কন্টেন্টকে প্রভাবিত করে।
- যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভিন্ন মতামত দেয়, তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক মন্তব্য ছড়ানো হয়।
বাস্তব উদাহরণ এবং পিআর ফার্মের সংশ্লিষ্টতা
১. রাশিয়ান ট্রোল ফার্ম এবং ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি (Internet Research Agency):
রাশিয়ার এই পিআর ফার্মটি বট আইডি ব্যবহার করে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তারা ফেসবুক, টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে ভুয়া খবর, বিভ্রান্তিকর তথ্য, এবং প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে জনমত প্রভাবিত করেছিল। প্রায় ৫০,০০০ বট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ পোস্ট শেয়ার করা হয়, যার ফলে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে বলে অভিযোগ উঠে।
২. ভারতের নির্বাচনী প্রচারণা:
ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সোশ্যাল মিডিয়ায় বট আইডি ব্যবহার করে জনমত প্রভাবিত করার জন্য কাজ করে। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বেশ কয়েকটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, টুইটারে এবং ফেসবুকে বট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভুয়া সমর্থন দেখানো এবং বিরোধীদের আক্রমণ করা হয়েছিল। বিশেষ করে বিজেপি'র আইটি সেল এই কাজের জন্য কুখ্যাত।
৩. সৌদি আরব এবং খাশোগি হত্যাকাণ্ড:
সৌদি আরব সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালিত বট নেটওয়ার্কগুলো সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। "যুদ্ধ শুরু" বা "মিথ্যা প্রচারণা" দাবি করে বট আইডি ব্যবহার করে সৌদি সরকারের বিরোধী ন্যারেটিভকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
৪. বর্তমানে আওয়ামী লীগের সোশ্যাল মিডিয়া কৌশল:
সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ সোশ্যাল মিডিয়ায় ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে এক বিশাল প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে ইউনূস সরকারের সমালোচনামূলক কনটেন্ট তৈরি ও ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব কনটেন্ট মূলত তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া, আওয়ামী লীগের নেতারা ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন এবং এসব বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। তারা ইউনূস সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান ও নীতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে, যা বিভ্রান্তি এবং জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই প্রচারণার জন্য আওয়ামী লীগ প্রচুর পরিমাণে পেইড বট আইডি ব্যবহার করছে। এসব বট আইডি আওয়ামী লীগের পক্ষের অখ্যাত পেজ এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে ধারাবাহিকভাবে পোস্ট, মন্তব্য এবং শেয়ারের মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছে। পোস্টগুলোর গঠন এবং সমন্বিত প্রচারণা দেখলেই বোঝা যায়, এটি একটি সুসংগঠিত এবং পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
৫. পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়া কৌশল:
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং সরকার দীর্ঘদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বট অ্যাকাউন্ট এবং সংগঠিত প্রচারণা ব্যবহার করে জনমত প্রভাবিত করার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) এবং ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) এর ভূমিকা। আইএসআই মূলত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাব বিস্তারে সক্রিয়। অন্যদিকে, আইএসপিআর সামরিক বাহিনীর মিডিয়া এবং জনসংযোগ শাখা হিসেবে কাজ করে, যা সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষা এবং তাদের বার্তা প্রচারের জন্য কাজ করে।
পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সামরিক বাহিনীও প্রায়ই বট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রচারণা চালায়। এক্স (সাবেক টুইটার) হলো পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম, যেখানে প্রতিদিনই বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিংয়ে উঠে আসে। এই হ্যাশট্যাগগুলো প্রায়শই সামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক দল বা সরকারের সমর্থনে অথবা বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
বেশ কয়েকটি ঘটনার মধ্যে দেখা গেছে, সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করার পরপরই কিছু নির্দিষ্ট এক্স হ্যান্ডেলের মাধ্যমে সমালোচকদের লক্ষ্য করে ট্রোলিং এবং কটূক্তি চালানো হয়। এই অ্যাকাউন্টগুলো প্রায়ই সামরিক বাহিনীর পক্ষে সংগঠিত প্রচারণায় জড়িত। এমনকি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় সামরিক বাহিনী তাদের স্বার্থে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রিত তথ্য ছড়ানোর জন্য বট এবং ট্রোল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর প্রচারণা এবং তার সমর্থকদের লক্ষ্য করে চালানো প্রচারণা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সমালোচনা দমন করতে এবং সরকারের পক্ষে জনমত তৈরি করতে বিশাল পরিমাণে বট অ্যাকাউন্ট সক্রিয় ছিল।
বট আইডি ব্যবহারের উদ্দেশ্য:
- নির্বাচনের সময় ভুয়া সমর্থন বা নেতিবাচক প্রচারণা চালানোর জন্য বট আইডি ব্যবহার হয়। উদাহরণস্বরূপ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৬ সালের প্রচারণার সময় রাশিয়ান বট নেটওয়ার্কের ভূমিকা।
- সামাজিক বিভাজন তৈরির জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় বা জাতিগত ইস্যুতে বট ব্যবহার করে উত্তেজনা ছড়ানো হয়। যেমন ভারতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে তাদের ক্ষতি করার জন্য বট ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগীদের দুর্বল করতে এমন প্রচারণায় অর্থ ব্যয় করে।
- একই মেসেজ বারবার শেয়ার করে একটি মিথ্যাকে সত্য মনে করানো হয়।
- যেসব ইস্যু প্রচার করা প্রয়োজন, সেগুলোকে শীর্ষ ট্রেন্ডে নিয়ে আসা হয়।
- বিরোধীদের আক্রমণ করে তাদের মতামতকে চাপা দেওয়া হয়।
বট আইডি মূলত জনমত প্রভাবিত করতে এবং ইচ্ছামতো ন্যারেটিভ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি শুধু রাজনীতিতে নয়, কর্পোরেট যুদ্ধ, সামাজিক ইস্যু, এমনকি যুদ্ধকালীন প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বট আইডি এবং পিআর ফার্মের ভূমিকা এতটাই জটিল এবং সুসংগঠিত যে এটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে।
.
.
চলমান...
.
পিআর ফার্ম এবং বট আইডি: মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ডিজিটাল যুদ্ধ এবং এর মোকাবিলা
Comment