ময়দানের পাঞ্জলতা যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেতো! ১ম পর্ব
প্রিয় যুবক ভাই!
মহান সত্তা মানবকে এমন কিছু নেয়ামত দান করেছেন যার তুলনা অন্য কোনো তুলনা দিয়ে হয় না। শুকরিয়ার সবগুলো বাক্য ব্যবহার করলেও তার ধারে কাছে যাওয়া যায় না। আর সে নেয়ামত গুলোই হলো পঞ্চইন্দ্রিয়। যার যান্ত্রিক কাজগুলো সত্তার আদেশে নিপুণতার সাথে হয়ে থাকে। এগুলো এমন বিশেষ নেয়ামত যার সঠিক ব্যবহার মানবকে উচ্চ শীখড়ে পৌঁছাতে পূর্ণ সহযোগিতা করে। কিন্তু আবার এই পঞ্চইন্দ্রিয় গুলোই কিছু জায়গায় তার যান্ত্রিকতার নিপুণতা হারিয়ে ফেলে।
সেটা তাহলে কখন? এমন প্রশ্ন অবশ্যই চলে আসে। উত্তরটা সহজ হলেও তার গভীরতা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। মানুষ কত কিছুই না ভাষায় ফুটিয়ে তুলে, তার কোনো ইয়াত্তা নেই। মানুষ কত কিছুর গভীরতাই না মেপে ফেলে, তার কোনো হিসাব নেই। সবুজ পাহাড়ের সজিবতা, নীলাভূমির নীলাদ্রতা, সমূদ্রের জলোচ্ছ্বাসতা, সুনামির ধরন, পানি এত মিটার উঁচু হওয়ার কারণ, আবহাওয়া পরিবর্তনের সন্নিক্ষণ, আরো কত কিছু, ভাবা যায়! মানুষ এসব কিছুর একটা তৃভূজকোণ একে ফেলে হৃদয়ের করিডরে।
@কিন্তু ভাই আপনাকে যদি বলি- ময়দানে একজন অশ্বারোহীর ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তুলতে! একজন বীর মুজাহিদের ভাবনাকে নিজের করে প্রকাশ করতে! একজন রণাঙ্গন লড়াকু সৈনিকের পাঞ্জলতা কিঞ্চিৎ ভাষায় প্রকাশ করতে তখন আপনি কিভাবে শুরু করবেন? ময়দানী অভিজ্ঞতা যার মাঝে নেই কি করে মুখে কথা বলার চেষ্টা করবে? আর যে ময়দানে লড়াই করে সেইবা কতটুকু নিজ ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে পারবে? তবে হাদিসের ভাষ্য বলে দেয়- ভাষাহীন আনন্দ বয়ে বেড়ায় প্রত্যেকজন অশ্বারোহী। স্বরহীন দৃশ্যপট নিয়ে ঘুরে বেড়ায় প্রতিজন বীরসেনানী। অফুরন্ত রহমতের শিশির ছোঁয়া তাঁকে ঢেকে ফেলে চতুর্দিক থেকে। যার পরায়ণ সে উন্মাদ থাকে দীদারে এলাহির সর্বোচ্চ ফলের। যার আশা অগণিত, যার প্রত্যাশা সীমাহীন, সে কি করে পাঞ্জলতা ভাষায় প্রকাশ করবে?
প্রিয় যুবক ভাই!
প্রাণ-পঙ্কিলতা, রণ-বীরতা, সাঁজ-সজিবতা এসব কিছু যদি উত্তম কিছুতে প্রয়োগ হয় তাহলে সে বস্তুর পুরষ্কার কতইনা শানদার হতে পারে! সামান্য ফিকিরে তার গভীরতার সূত্র বের করা সম্ভব না। কারী তৈয়্যাব রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন-[১]অনুগত ব্যক্তিকে সবকিছু দেয়া হয় আর দাবীদার কিছুই পায়না, অতএব সহজে সাফল্যের যোগ্যব্যক্তি হতে হলে আল্লাহপাকের অনুগত হয়ে যাও। তাঁর প্রিয় জিনিসের তরে নিজ তনুমন সপে দাও। জান-মাল কুরবান করে সর্বোচ্চ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নাও। তবেই অনুগত শব্দের ব্যবহার যথার্থ হবে। প্রয়োগ শব্দের ব্যবহারে স্বার্থকতা পূর্ণতা পাবে।
@সত্তিকার্থে শয়তানও চায় আমরা রবের অনুগত হয়ে যাই, তবে তার চাওয়ার ধরণটা ভিন্নরকম, সে আবার কেমন কথা! সেটাই তার মনের চাহদ! যা আমরা বাস্তবয়নে বদ্ধপরিকর, ব্যক্তি, দল, সমাজ, ও রাষ্ট্রীয় মানুষগুলোও । শুদ্ধতার আদতে নয় বরং ভ্রষ্টতার আদলে। সহজ সমাধানে নয়, বরং ছিটকে পড়ার কঠিন কৌশলে। কারণ সে আল্লাহর কাছে আবদার রেখে এসেছে-
وَلاُضِلَنَّهُمْ
এবং আমি তাদের অবশ্যই পথভ্রষ্ট করব।
প্রিয় যুবক ভাই!
মানুষ যখন শয়তানের ফাঁদে পড়ে আল্লাহকে ভুলে যায়, তখন তার কাছে দুনিয়াটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। পরকালের জীবনের কথা তার হৃদয়ের মানসপট থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই স্থান দখল করে নেয় দুনিয়ার চাকচিক্য। সেখানে ভালােমন্দ বিচারের বদলে আরাম-আয়েশ হয়ে ওঠে প্রধান বিবেচনার বিষয়। এভাবেই শয়তান তার কৃত ওয়াদা পূরণে বিজয়ী হয়। সাফল্যের প্রতিযোগিতায় আরো একটি সিঁড়ি অতিক্রম করে ফেলে। কিন্তু ইনসান তার আসল মারযার দিকে ফিরে যায়, ভুলে যাওয়া। এ মুহূর্তের জন্যই ইরশাদ হয়েছে-
ومن يتق الله يجعل له مخرجا ويرزقه من حيث لا يحتسب ومن يتوكل على الله فهو حسبه
যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য {সমস্যা থেকে উত্তরণের} রাস্তা বের করে দেন। আর তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক প্রদান করেন। যা সে কল্পনাও করতে পারে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট [৩]
প্রিয় যুবক ভাই!
সবুজের স্নিগ্ধতা। প্রকৃতির প্রীতিলতা। নির্মলতার আতিথেয়তা। পাখিদের মুখরতা। বাতাসের হিমবায়তা। ঝর্ণার কল্লোলে তোমরা ক্ষণিকের জন্য মুগ্ধমুখী হলেও অশ্বারোহীর পাঞ্জলতা তুমি কক্ষণোই অনুভব করতে পারবে না। যদি না তুমি রণাঙ্গনের নওজোয়ান না সাঁজো! যদি না তুমি চড়াই-উতরাই পথের পথিক না হও! আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন খুব ছােট। মাত্রই ১৩ বছরের বালক। তিনি বলছেন-একদিন আমি ঘােড়ায় চেপে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছন পেছন যাচ্ছিলাম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু উপদেশ দিচ্ছিলেন।[৪]
@ঐতিহাসিকগণ বলেন-তাঁর কথা শুনে মনে হয়েছে, যতক্ষণ তিনি ঘোড়ায় আরোহণরত ছিলেন ততক্ষণ ভূস্বর্গে দিনাতিপাত করার স্বাধ আস্বাদন করছিলেন। সুবহানাল্লাহ! হে প্রিয়! তুমি কি জানো না? শেকড় ভুলে গেলেও শেকড়ের কিছু চিহ্ন মানুষ অজান্তে বুকের ভিতর ধারণ করে রাখে। আমরাই হলাম সেই শেকড় ভুলে যাওয়া ব্যক্তিগুলো কিন্তু মনের গহীনে আঁটসাঁট করে বেঁধে রেখেছি
বদরীওয়ালাদের স্মৃতি। কারণ তাঁদের বক্ষথিত অন্তরে ছিলোনা কোনো ধোঁয়াশা। তাই দলবল, অস্ত্রসস্র আর হাতিয়ার কম থাকাতেও বিন্দুমাত্র দমে যায়নি। ঐযে বললাম, পাঞ্জলতা তাঁদের হৃদয়তন্ত্রকে শশীর মাত্রায় তুলে রেখেছে।
অথচ আমরা, কতইনা ব্যতিক্রম! দ্বীনে-দানে। তাঁরা দৃষ্টান্তহীন তুলনা, শুধুই আমাদের ইসলাহের জন্য। সুস্থ চর্মচক্ষু যেখানে ঘাের অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখে না, অন্তর্চক্ষু সেখানে দেখতে পায় ঝলমলে আলাে। সাহাবি উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথাই বলছিলাম- তাঁর চর্মচক্ষুতে আলাে ছিলো না, তবে তাঁর বক্ষস্থিত চোখের জ্যোতি তাঁকে সত্যিকার অন্ধ হতে দেয়নি। সেই জ্যোতি ঠিক ঠিক খুঁজে নিয়েছিলো শুদ্ধতার পথ। খুঁজে নিয়েছিলো পরম পবিত্র সত্যটিকে। তাহলে বুঝা গেলো সত্য সঠিক বেছে নিতে চোখের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন একটি বক্ষথিত অন্তর। যেই বক্ষথিত অন্তরে স্থান পাবে রবের সন্তুষ্টির আ'লা তবকার ইবাদাহগুলো।
@ঠিক তখন থেকেই মনের ভেতর শেকড় গেড়ে বসা লালসার পাহাড় আর শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কলুষিত হওয়া অন্তর পরিশুদ্ধতার উপায় খোঁজবে। খোদায়ী দান স্পর্শকাতরতার রশি ধরে ঝুলে থাকার ইচ্ছে জাগবে। দুধের শ্বরের মত ভারী মানদার বস্তু হওয়ার সদিচ্ছে তৈয়্যার হবে। এমন অগণন, অঘটন, কিছু আশা মনের দরজায় উঁকিঝুঁকি মারবে। যা ভাষায় ব্যক্ত করার মত না। যা মাথায় কল্পনা করার মতও না। তুমি কি দেখেছো! শহীদ তাঁর চেহারায় ফুটন্ত, মায়াবী, মৃদুময় হাসিখানা, কি অপূর্ব দৃশ্য! সুবহানাল্লাহ!!
তাহলে শোনো! পাঞ্জলতা শব্দটি এখানেই পূর্ণতা পায়। সূর্য তার শেষ সূর্যাস্তটা যার জন্য। চন্দ্র তার শেষ সমাধিটা যার হাতে। আদম তার সর্বশেষ সাক্ষাৎ যার সামনে। সেই মহামহিম স্রষ্টার দিদার লাভে। জীবনে পাওয়া না পাওয়ার প্রাপ্তিটাই রাব্বে কারীমের এ সাক্ষাতে। যাপিত জীবনের সকল অনুষঙ্গ ধন্যই হবে মাওলা পাকের এ অনুগ্রহটিতে। শহীদ তার চাঁদমাখা হাসিখানাই বলে দেয় পাঞ্জলতা তাকে কতটা সুখের তীরে পৌঁছে দিয়েছে। আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার কাবিরা![৫]
প্রিয় যুবক ভাই!
ময়দানে বয়ে চলা বসন্ত বাতাসের স্নিগ্ধতার কাছে দুনিয়াবী সমস্ত সংকট নিতান্তই তুচ্ছ। হৃদয়ের হসন্ত থেকে অনিরূদ্ধ জিঘাংসার পাহাড়কে দূরে ঠেলে দিয়ে ময়দানে পাঞ্জলতা খোঁজে নিতে পারাটা মুমিনের জন্য একান্তই সচ্ছতার লক্ষ্মণ। বিভীষিকাময় মৃত্যু কাতরতায় না পড়ে ময়দানের পাঞ্জলতায় হারিয়ে যাওয়া শতকোটিগুণে উত্তম। কারণ তাতে মৃত্যু নেই আছে শুধু নুসরতের শিশির। কারণ তাতে হিসাব নেই আছে শুধু অফুরন্ত নায-নেয়ামত। বেলা শেষে বিনা-হিসাবে জান্নাত। আর তাতে আয়োজন উপলক্ষ্য হবে রব ও তাঁর বন্ধুর মধুর সাক্ষাৎ। সুবহানাল্লাহ!
@এত সুন্দর মহতি মজলিস থেকে তুমি বঞ্চিত হবে? না ভাই আমার! এটা কখনো হতে পারে না। তোমার হৃদয় দুনিয়াবী বিষন্নতার বিষবাষ্পে ছেয়ে যাবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখবো! তোমার যুগল নয়ন পাপের কালো দাগে ঝাপসা হয়ে যাবে আর আমরা চোখ বুঝে থাকবো! না ভাই আমার। জিহাদের ঝান্ডা ধরতে না পেরে তুমি ভেতরে ভেতরে খুঁড়িয়ে যাবে! এটা তো খোদায়ী বিধান না। কোনটা তাহলে- সেটা হলো কাতরতার সবগুলো জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাবে ময়দান পানে। আয়েশতার সবগুলো দিক দূরে ঠেলে দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিবে সবার আগে। অন্তরাত্মা থেকে বিস্তৃত প্রগাঢ় প্রলেপ মুছে দিতে জারি করবে আল্লাহু আকবর তাকবীরের ধ্বনি।
তথ্যসূত্র________________
১.মনীষিদদের অমূল্য বাণী
২.সূরাতুত তালাক' আয়াত নং ২-৩
৩.নির্মল জীবন, পৃষ্ঠা ২২
৪.আত্মার আকুতি' ১ম খন্ড
Comment