আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) যে দ্বীনের বানী নিয়ে এসেছিলেন তা পৃথিবীতে নতুন কোন বিষয় নয়; বরং পৃথিবীর শুরু থেকে সকল নবিগণ একই দাওয়াত মানবজাতিকে দিয়ে গেছেন । শেষ নবী মুহাম্মাদ (সঃ) এর মাধ্যমে দ্বীনের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সংস্করন মানবজাতিকে উপহার দেয়া হয়েছে মাত্র । অথবা অলা যায়, সর্বশেষ নবির মাধ্যমে এ দ্বীন চূড়ান্তভাবে পূর্ণতা লাভ করেছে । মানব ইতিহাসে সকল নবিদের একই দাওয়াত ছিল । আর সে দাওয়াত হলো, একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে প্রভু ও ইলাহ হিসেবে মেনে তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করা । এ দাওয়াত ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ । বিক্ষিপ্ত দু’একজন বিকৃত মস্তিষ্কের লোক ব্যতীত সামগ্রিকভাবে মানবজাতি কখনো সৃষ্টিজগতের ওপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে অস্বীকার করেনি । তবে মানবজাতি যুগে যুগে যে অপরাধে লিপ্ত হয়েছে তা হলো ‘শিরক’ । তারা অনেক সময় আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে ভ্রান্ত আকিদা পোষন করেছে, কখনো বা আল্লাহর কাছে পৌছার মাধ্যম হিসেবে অন্য কারো গোলামি করেছে । এসব পদ্ধতির মাধ্যমে হোক কিংবা অন্য কোন পদ্ধতিতে হোক, শিরক যে কোনো ধরনেরই হোক না কেন, তা মানুষেকে আল্লাহর দ্বীন থেকে বের করে দিয়ে দূরতম গোমরাহীতে নিমজ্জিত করে । পৃথিবীতে যতো নবীই এসেছেন তাদের মিশন ছিল আল্লাহর একত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করা । তারা তাদের দায়িত্ব পালনে সর্বাত্নক সংগ্রাম করেছেন । কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, প্রত্যেক নবীর ইন্তেকালের পরেই তাঁর উম্মত কিছুকাল সঠিক পথে থেকে, ধীরে ধীরে শিরকের মাঝে ডুবে গেছে । জাহেলিয়াতের ভয়াল অন্ধকার তাদের আবার তাদের গ্রাস করে ফেলেছে । তবে তারা সবাই একই ধরনের শিরকে লিপ্ত হয় না; বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের শিরকে লিপ্ত হয় । কখনো আকিদা-বিশ্বাসে, কখনো বা গোলামি-আনুগত্যে, পূজা-আর্চনায়, কখনো বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার মাধ্যমে, কখনো বা একই সাথে উপরোক্ত সকল ধরনের শিরকে লিপ্ত হয় । শিরকের দরজা একবার খুলে গেলে তা সামাল দেয়া বড়ো কঠিন । এক দরজা দিয়ে তখন হাজার ধরনের শিরক এসে জীবনকে কালিমাচ্ছন্ন করে ফেলে ।
পৃথিবীর উষালগ্ন থেকে শুরু করে যুগে যুগে দ্বীনের আহ্বান একই । একই পয়গাম নিয়ে সব নবীরা এসেছেন । আর তা হলো ‘ইসলাম’ । তবে ইসলাম বলতে বর্তমান যুগের এক শ্রেনীর মুসলমানরা যা বুঝে নিয়েছে তা ইসলাম নয়; ইসলাম অর্থই হলো ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা । অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছার সর্বাত্নক প্রতিফলন ঘটানো এবং জীবনের সকল স্তর থেকে মানবরচিত জীবনবিধানের ঘৃণ্য পঙ্কিলতা বিতাড়িত করা । এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে মিথ্যা ‘মানবপ্রভু’দের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা । হযরত নূহ (আঃ) থেকে নিয়ে মুহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত সকল নবী একই মিশন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন ।
বিশ্বজগতের প্রতিটি অনু পরমানু তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান মেনেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে । সৃষ্টিজগতের একটি অংশ হওয়ার কারণে মানুষও স্রষ্টার আইন মেনে চলতে বাধ্য । একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, রক্তকণিকা সবকিছুই আল্লাহর হুকুম মেনে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে । হাত কখনো বলে না আমি হাটতে চায়, পা কখনো বলে না আমি লিখতে চায় । এমনিভাবে প্রত্যেকে তাঁর নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে । অথচ মানুষকে এ সামান্য স্বাধীনতা দেয়ার কারণেই সে তাঁর প্রভুর আইন অমান্য করে স্বেচ্ছাচার জীবন যাপন শুরু করে দেয় । এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মানুষের মাঝে সংগতি রক্ষার জন্য আল্লাহর আইনের নিরঙ্কুশ আনুগত্য বাঞ্ছনীয় । মানুষের শারীরিক পুষ্টি-অপুষ্টি, সুস্থতা-অসুস্থতা, বেচে থাকা, মরে যাওয়া সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন । পাপ-পুণ্যের পুরস্কার বা শাস্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও আল্লাহর নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় মানুষের নেই । এ সকল ক্ষেত্রে মানুষ একেবারেই অসহায় । প্রাকৃতিক জগৎ আল্লাহর যে নিয়মানুযায়ী চলে সেখানেও মানুষের সামান্যতম কর্তৃত্ব নেই । একটু ঝড়-বাদল, বৃষ্টি-বন্যা ও ভুমিকম্পের সময়ে মানুষ অসহায়ের মতো আল্লাহকেই ডাকে । সুতরাং আল্লাহ তাআলা জীবনের যে অংশে মানুষকে পরীক্ষার জন স্বাধীনতা দিয়েছেন সে অংশেও মানুষের উচিত আল্লাহর কাছে সর্বাত্নক আত্মসমর্পন করে তাঁর দেয়া আইন-বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপন করা । কতো বড়ো নির্লজ্জ, অকৃতজ্ঞ ও অপরিণামদর্শী হলে মানুষ সামান্য একটু সুযোগ পেয়েই এমন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে, তা নিতান্তই এক আশ্চর্যের বিষয়।
জাহেলিয়াতের অনেক ব্যাপক বিস্তৃত রূপ থাকলেও এর মূল ভিত্তি হলো নফসের কুপ্রবৃত্তি ও মানুষ হয়ে অন্য মানুষের গোলামী করা । এর মাধ্যমে নিজের নফসকে কিংবা অন্য মানুষকে প্রভূর আসনে বসানো হয় । কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতি যেহেতু আল্লাহর হুকুমের অনুগত- তাই এটি প্রাকৃতিক নিয়মের সম্পুর্ন পরিপন্থী । মানুষ তাঁর জীবনের একটি অংশে আল্লাহর আইন মানতে বাধ্য,আর ব্যবহারিক জীবনে সে স্বাধীন । তাই স্বাধীন অংশে যদি মানুষ আল্লাহর আইন মেনে না চলে তাহলে মানুষ তাঁর নিজের সত্তার ভেতরেই একটা সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয় ।
জাহেলিয়াতকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই । কারন, জাহেলিয়াত নিছক কোনো মতবাদ নয়, বরং বর্তমান বিশ্বে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শেকড় গেড়ে বসেছে এবং জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকরা এর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে । এ কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের প্রবর্তিত রীতিনীতি, আইন-বিধান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারনা, মুল্যবোধ সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত করে জেকে বসেছে । জাহেলিয়াতের ধারক বাহকরা সংগঠিত এবং আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত । তারা সকল শক্তি নিয়ে সারাক্ষন তাদের প্রবর্তিত ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানের জন্য তৎপর । শুধু তাই নয়, যাকেই তারা সমস্যা তথা কাটা মনে করে, অর্থাৎ তাদের এ জাহেলিয়াতকে উচ্ছেদের জন্য কেউ যদি উঠে দাঁড়ায় তাহলে সংঘবদ্ধভাবে, একযোগে তাঁর বিরুদ্ধে লেগে যায় এবং প্রয়োজনবোধে তারা তাঁকে হত্যা করতেও কুন্ঠিত হয় না ।
সুতরাং, একটি সুসংগঠিত, সংঘবদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার জন্য নিছক ওয়াজ-নসিহত, তাত্ত্বিক আলোচনা বা ইসলামি আইনের শ্রেষ্ঠত্বের গুণকীর্তন কখনোই ফলপ্রসূ হতে পারে না । আজকের বস্তুবাদী সমাজের পুরোটাই যখন জাহেলিয়াত নিয়ন্ত্রিত, একটি সুসংগঠিত বিপুল জনগোষ্ঠী, সরকার, সামরিক বাহিনী যেখানে জাহেলিয়াতের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক, সেখানে মৌখিকভাবে ইসলামের আদর্শ প্রচার করে সফলতা পাওয়া তো দূরের কথা বাতিলের মুখোমুখি দাড়ানোটাও সম্ভব নয় । তাই জাহেলিয়াতের উচ্ছেদকল্পে ও আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা অবতীর্ণ হবে তাদেরকে অবশ্যই ইমানের অপ্রতিরোধ্য বলে বলীয়ান ও সুসংগঠিত হয়ে, সর্বাত্নক জিহাদের পরিকল্পনা নিয়ে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে হবে । বস্তুগত দিক থেকে না হলেও তাদেরকে সাংগঠনিক কাঠামো, পারস্পরিক সম্পর্ক, আমীরের আনুগত্য, নৈতিক উৎকর্ষ ও প্রয়জোনীয় সকল দিক থেকে জাহেলি সংগঠনগুলোর চেয়ে আরো বেশি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী হতে হবে । জাহেলিয়াতের স্রোতের মুখে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে তাঁর গতি রোধ করে দিতে হবে ।
কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ – এর বৈপ্লবিক সাক্ষ্যদানই হলো ইসলামি সমাজের সর্বপ্রধান ভিত্তি । সকল নবীরা এ কালেমার ওপর ভিত্তি করেই সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন । সুতরাং আরব অনারব সকলকেই এ কালেমার সঠিক তাৎপর্য জানতে ও বুঝতে হবে । এ কালেমার অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলাই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষক । সুতরাং, তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন একমাত্র শাসক । চিন্তা-চেতনায়, আকিদা- বিশ্বাসে, বাস্তব জীবনের সকল কাজে কর্মে তথা আল্লাহর একত্ববাদের ছাপ রাখতে হবে । ব্যক্তিগত জীবন থেকে নিয়ে রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন-কানুনের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদানের মধ্য দিয়ে এ কালেমার প্রকৃত মর্ম বিকশিত করে তুলতে হবে । এভাবে কালেমার দাবি বাস্তবায়ন না করে নিছক মন্ত্র জপার মতো পড়লে কিছুতেই সঠিক অর্থে কালেমার সাক্ষ্য দেয়া হয় না । এ ধরনের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় । কালেমার দাবি মোতাবেক উল্লিখিত সকল দিকগুলোর বাস্তব প্রতিফলনের মধ্য দিয়েই এ কালেমার সাক্ষ্য কার্যকর হয় এবং এ গুলোকে যারা অস্বীকার করে তারাই কাফির, তাদেরকে নিঃসন্দেহে অমুসলিম বলা যেতে পারে । চিন্তা-চেতনায়, নীতি আদর্শে এ কালেমা তখনই বাস্তব রূপ লাভ করে যখন মানুষ তাঁর পুরো জীবন আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত করে নেয় । এ কালেমার অর্থ হলো মানুষ কোনো ব্যাপারেই মনগড়া সিদ্ধান্ত নেবে না; বরং যে কোন ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ও তার রাসুল (সঃ) নির্দেশনার আলোকেই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে । আর আল্লাহর হুকুম জানার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে আর রাসুল মুহাম্মাদ (সঃ) । কালেমায় শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশে আমরা এ কথারই স্বীকৃতি দান করি- ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ’, অর্থাৎ - আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর রাসুল ।
এ দুটো চেতনায় হলো ইসলামের প্রধান প্রানসত্তা । ইসলামি আদর্শের মূলভিত্তি । এ বিশ্বাস ও মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই ইসলাম মানবজাতির সকল সমস্যার সমাধান দেয় । সে সমস্যা হোক ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের । হোক তা কারো সাথে সন্ধিচুক্তির বা সম্পর্কচ্ছেদের । সকল ক্ষেত্রের সকল আইনের মূলনীতি এ কালেমা ।
এযাবৎ আলোচনায় পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম এমন কোনো অর্থহীন প্রতীকী মতবাদ নয় যে, মন্ত্র জপার মতো দু একটা কালেমা পাঠ করলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে, অথচ ওদিকে তাঁর জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্রগুলো চলবে জাহেলি রীতিনীতি, আইন-কানুন অনুযায়ী । সংখ্যায় তারা যতই হোক মুসলমান দাবিদারদের অবস্থা যদি সত্যিই এমন হয় তাহলে আদৌ মানবসমাজে তাদের দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় । যেসব নামধারি মুসলমানরা প্রতিষ্ঠিত জাহেলি সমাজকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে, যারা এ জাহেলি সমাজের নিয়ন্ত্রকদের সহযোগী শক্তিতে পরিণত পরিণত হয়, তাঁরা ইচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায় হোক জাহেলি সমাজের চাহিদা পুরন করে চলেছে । এ অপরাধদুষ্ট জাহেলি সমাজ ও সমাজের নেতৃত্বকে টিকিয়ে রাখতে নিজেদের অজান্তেই সক্রিয় হয়ে উঠে । জাহেলি নেতৃত্ব যখন কোন সিদ্ধান্ত নেবে তখন ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের স্বার্থে তাঁর সহযোগীরা কাজ করে যায় । এ জন্য যে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেই তাঁর উচিত নয় জাহেলি সমাজের স্রোতে ভেসে যাওয়া জাহেলি নেতৃত্বের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া বা সহযোগীতা করা ।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে জ্ঞানহীনতা । যারা কালেমা পাঠ করেছে তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া কালেমার সঠিক বুঝ কারো ভেতরে আছে বলে মনে হয় না । এর সর্বপ্রধান কারন হলো, তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করে না যে, তারা কী পাঠ করছে । নিছক মন্ত্র জপার মতো করে কালেমা পাঠকারীদের সংখ্যায় যদি পৃথিবী ভরেও যায়, ইউরোপ আমেরিকার সবাই যদি এভাবে কালেমা পাঠ করে নেয় তাতে ইসলামের কিছুই আসে যায় না । কালেমার বিপ্লবী ঘোষণার সঠিক অর্থ বুঝে জীবনের সকল কাজকর্মে তাঁর বাস্তব প্রতিফলন না ঘটলে এ কালেমা পাঠ করে কোনো লাভ নেই । যখন কালেমা পাঠকারীরা এর সঠিক অর্থ বুঝবে, যখন মজবুত ভ্রাতৃত্ববন্ধনের মধ্য দিয়ে সকল শ্রেনীর মানুষকে সংগঠিত করে একটি অখণ্ড ইউনিটে হতে পারবে, যখন তারা জাহেলিয়াতকে রুখে দাড়াবার জন্য ইমানি বল ও প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি লাভ করবে, যখন জাহেলি নেতৃত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকার দ্বীনী নেতৃত্বের অধীনে সংগঠিত হয়ে সংগ্রাম শুরু করবে তখনই তারা অর্পিত মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবে । ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্ব হবে সম্পুর্ন জাহেলি নেতৃত্বের প্রভাবমুক্ত এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত সকল কার্যক্রম হবে আল্লাহমুখী । জাহেলিয়াতের প্রভাব থেকে জীবন, মন ও সমাজকে সম্পুর্ন পবিত্র করে তোলার লক্ষ্যে তারা অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবে । এ সংগ্রাম চলবে নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে ও প্রতিষ্ঠিত জাহেলি বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে।
ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যা খুব ছোট একটি কথা দিয়ে মানুষের গোটা জীবনকে পরিবেষ্টন করে নেয় । এ মৌলিক ছোট বাক্যটি হৃদয়ঙ্গম করার সাথে সাথে তথা এ কালেমাকে গ্রহন করার সাথে সাথে প্রথম যুগের প্রতিটি মানুষের ভেতর জন্ম নিয়েছিলো বলিষ্ঠ আন্দোলন, সক্রিয় বিপ্লব ।
নিছক কোন কাল্পনিক মতবাদ নিয়ে ইসলাম পৃথিবীতে আসেনি । আর যদি ভবিষ্যতে ইসলামের অনুসারীরা ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে তা বাস্তব ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই করতে হবে । নিছক কিছু যিকির- আযকার, নামায-রযার নাম ইসলাম নয় । এ সংগ্রামে প্রথমে যারা শরিক হয়েছিলেন তারা ইসলামকে সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন । তাই তারা নিজেদেরকে জাহেলিয়াত থেকে দূরে সরিয়ে ক্ষান্ত হননি; বরং প্রতিষ্ঠিত জাহেলি সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তা উচ্ছেদকল্পে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন । বর্তমান পৃথিবীকে জাহেলিয়াতের নিকোষ কালো আধার যেভাবে ছেয়ে ফেলেছে, যেভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাহেলিয়াত জেকে বসেছে, তা থেকে এ সমাজ তথা এ বিশ্বকে পবিত্র করতে হলে প্রথম যুগের মুসলমানদের পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে । ইসলামের সঠিক মর্ম যথার্থরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, ইসলামের ইন্সিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভালো করে বুঝে নিতে হবে । তারপর একটি বাস্তব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে । এছাড়া অন্য কোন পদ্ধতিতে সফলতা পাওয়ার আশা করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা ।
মানুষের নীতি-নৈতিকতা, কর্মক্ষমতা তথা মানবসম্পদ উন্নয়নও ইসলামি কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত । তাওহিদের ভিত্তিতে যখন ইসলাম একটি উম্মাহর ভিত্তি রচনা করে তখন পারস্পরিক মজবুত ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সুপ্ত মনুষ্যত্ববোধ, প্রাকৃতিক গুণাবলী ও নীতি-নৈতিকতাঁর বিকাশ ঘটিয়ে তাঁকে বলিষ্ট ও সংগ্রামী করে তোলা নেহাত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । প্রাণী হিসেবে মানুষের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যেগুলো সমভাবে অনেক পশুরও রয়েছে । তবে, সেগুলো মানুষের পরিচয় বহন করে না । মানুষ হিসেবে যে বিশেষ গুণাবলী ও বিশেষ যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন সেগুলোই মানুষের পরিচয়বাহী গুণ । মানুষের মধ্যে বিদ্যমান পশুসুলব বৃত্তিগুলোর উপরে মনুষ্যত্ববোধ ও নৈতিক গুণাবলীর প্রাধান্য বিস্তার করার মতো আধ্যাত্মিক শক্তিই একজন মানুষকে সত্যিকার মানুষ করে তুলে । মানুষের মধ্যে শুধু পশুসুলভি নয়; বরং বিশেষ কিছু দিকের সাথে জড়পদার্থেরও মিল রয়েছে । আর কিছু বিভ্রান্ত, বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক নামধারী এ যুক্তি তুলে মানুষকে জড়পদার্থের পর্যায়ে নামিয়ে আনার অসার কল্পনায় ডুবে আছে । তাদের চিন্তা যে কতোটা ভ্রান্ত ও অমূলক তা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় । ( ধরুন একটি অফিসে একশো জন স্টাফ আছে, তবে তাই বলে সবাই কি ডাইরেক্টর ? না । অথচ এই ডাইরেক্টরের মাঝে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সাধারণ স্টাফদের মধ্যেও রয়েছে । তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য সমভাবে সবার মাঝে বিদ্যমান থাকলেও বিশেষ কিছু যোগ্যতা ও গুনাবলীর কারণেই এ লোকটিকে ডাইরেক্টরের চেয়ারে বসানো হয়েছে । ) ঠিক তেমনি সৃষ্টিজগতের সদস্য হিসেবে কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য সবার মাঝে সমানভাবে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা মানুষকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য, যোগ্যতা ও গুণাবলী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা অন্য কাউকে দেননি । মানুষকে সবচেয়ে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন । মানুষকে তাঁর খিলাফাত দান করে সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে সম্মানিত আসনে সমাসীন করেছেন । অনস্বীকার্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অনেক জাহেলি সমাজের বিজ্ঞানীও একথা স্বীকার কর নিতে বাধ্য হচ্ছে । তবে তারপরও নির্লজ্জের মতো সুস্পষ্ট বক্তব্য না দিয়ে বিভিন্নভাবে বিষোদ্গার করছে ।
এ ধরনের মান-মর্যাদাহীন কথাবার্তাকে ইসলাম মোটেই গুরুত্ব দেয় না । ইসলাম সব সময় মানুষের নৈতিক ও মানবিক গুনাবলীর বিকাশ সাধনের চেষ্টা করে । কেননা, এ নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ ও পশুসুলভ বৃত্তি দমনের মাধ্যমে মানুষকে সত্যিকার মানুষের মর্যাদায় উন্নীত করা ইসলামি সমাজের মহান লক্ষ্য । এ পদ্ধতিতে গড়ে উঠে একটি অতুলনীয় আদর্শসমাজ । এ সমাজের ভিত্তি হলো আল্লাহভীতি, নীতিনৈতিকতা ও আদর্শ । এ সমাজ ভাষা, বর্ণ, জাতীয়তাবাদ ও ভৌগলিক সীমারেখাভিত্তিক দুর্বল বন্ধন ছিড়ে ফেলে ঈমান ও নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে এক ‘মেগা পরিবার’ গড়ে তোলে । সকল বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চলের মানুষের জন্য এ পরিবার বা সমাজের দ্বার থাকে সদা উন্মুক্ত। এ কারণেই ইসলামি সমাজে বৈচিত্র্যময় মেধা ও মননশীলতার সমন্বয় ঘটে । ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানরা ইসলামের এ মহান আদর্শ অনুসরণ করেই বিশ্বের ইতিহাসের সর্বাধিক সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন । ইসলামি আদর্শের এ মহামিলনে মানবসমাজের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-গুনী, মেধাবী ও প্রতিভাবান স্বতঃস্ফুর্ত যোগদান করেছিলেন ।
ইসলামের এ ‘মেগা পরিবার’-এর গর্বিত সদস্য হয়েছিলো আরব, পারস্য, সিরিয়া, মিশর, মরক্কো, তুরস্ক, চীন, ভারত, রোম, গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বর্ণ গোত্রের মানুষ । তাদের মাঝে বিদ্যমান বিভিন্ন গুণাবলী, বৈচিত্র্যময় আঞ্চলিক চালচিত্র, সবই ইসলামি আদর্শের অভিন্ন সুতায় গেথে গিয়েছিলো । পারস্পরিক মজবুত ভ্রাতৃত্ববন্ধন, সহযোগিতামূলক মনোভাব ও মেধার মুল্যায়নের মাধ্যমে তারা গড়ে তুলেছিলেন এক অবিস্মরণীয় সভ্যতা । আজকাল কিছু সংখ্যক বিকৃত মস্তিষ্কের ও সংকীর্ণ জ্ঞানের বুদ্ধিজীবীরা সেই সভ্যতাকে নিছক আরবসভ্যতা বলে চালিয়ে দিয়ে মহান ইসলামি আদর্শের ওমর কৃতিত্বকে ম্লান করে দিতে চায় । আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চায়, সে সভ্যতা কখনোই আরবসভ্যতা ছিল না; বরং সেটা ছিলো সার্বজনিন এবং একটি নির্ভেজাল ইসলামি সভ্যতা । এ সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিলো ঈমান ও ইসলামের মূলনীতির ওপর ।
বর্ণ, ভাষা, গোত্র, জাতীয়তা, অঞ্চল নির্বিশেষে ইসলামের গভীর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সকলেই এ সমাজ তথা সভ্যতা নির্মাণে যথাসাধ্য ভুমিকা রাখেন । প্রত্যেকেই নিজের সবটুকু সামর্থ্য, যোগ্যতা ও মেধা উজাড় করে দিয়ে এ সভ্যতার ভিত্তি মজবুত করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন । এ কাজ কেউ তাদেরকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে করায় নি, বরং ইসলামি সমাজের সম্মানিত সদস্য হওয়ায় প্রত্যেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র । তাই প্রত্যেকেরই যোগ্যতা, মেধা, প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ছিল এ সমাজের স্বাভাবিক দৃশ্য । যে কারণে, তাদের মধ্যে এমন ধরনের উন্নত মানবিক গুনাবলি আমরা দেখতে পাই, যা পৃথিবীর কোনো জাতির ইতিহাসই আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারে নি ।
এমন আদর্শ সমাজের কোনো চিত্র ইতিহাসে নেই । তবে ঐতিহাসিকরা রোমান সভ্যতাকে একটা সামগ্রিক ও সার্বজনীন সভ্যতা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন । কারন বিভিন্ন গোত্র, বর্ণ, অঞ্চলের লোক এ সমাজে একত্রিত হয়েছিলো । যে যাই বলুক না কেন, বাস্তবতার দৃষ্টিতে এ ধরনের আদর্শহীন সামষ্টিক সমাজের কোনো মুল্য নেই । কারন, সে সমাজ কোনো আদর্শভিত্তিক সমাজ ছিল না । সে সমাজ কোনো মানবিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি । কোনো নীতি-নৈতিকতার যোগসূত্রে তারা একত্রিত হয়নি; বরং শ্রেনি বিভাগই ছিলো সেই সমাজের মূল ভিত্তি । একদিকে ছিলো মুষ্টিমেয় সংখ্যক বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত শাসকশ্রেণী, অপর দিকে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের দাস শ্রেনী । তাছাড়া গোত্রীয় বিভেদও তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল । রোমীয় গোত্রের লোকদেরকে সমাজের শাসক হিসেবে সর্বত্রই অন্যরা আনুগত্য প্রদানে বাধ্য থাকতো । যে কারণে ইসলামি সমাজের মতো স্বাধীনতা সেই সমাজ কখনোই দিতে পারে নি, কখনোই তারা ইসলামি সমাজের মতো কোনো সার্বজনীন কল্যাণ ধর্মী সমাজ গড়ে তুলতে পারে নি ।
এরপরের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বৃটিশ সম্রাজ্যের ঘৃণ্য অধ্যায় । এরা একদিক থেকে রোমান সম্রাজ্যেরই উত্তরাধিকারী । নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষাই ছিলো এ সম্রাজ্যের মূলনীতি । স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তারা তাদের উপনিবেশগুলোতে চরম শোষণ চালিয়েছে । সেসব অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ভাবে লুটতরাজ করে নিজেদের ভোগ বিলাস নিশ্চিত করেছে । জাতীয় স্বার্থের ঘৃণ্য লোভই এ সম্রাজ্যের মূল লক্ষ্য এবং বৃটিশরাই এর হর্তাকর্তা । এছাড়াও অতিতের স্পেন, পর্তুগীজ এবং আধুনিক কালের ফ্রান্সসহ ইউরোপিয় সম্রাজ্যগুলোর ইতিহাস একই স্বার্থবাদী সূত্রে গাঁথা ।
এরপর কমুনিজম এসে বিশ্ববাসীকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলো । তাদের গোত্র, বর্ন, ভাষা ও আঞ্চলিকতাঁর জাতীয়তাবাদমুক্ত সমাজ দেখে অনেকে অভিভূত হয়ে পড়েছিলো । কিন্তু এরা কেউ লক্ষ্য করেনি, এ সমাজও সকল মানবিক ভিত্তি পরিত্যাগ করে নিছক শ্রেনি বিভাগের ওপর দাঁড়ানো এক ঠুনকো সমাজ । এদিক থেকে প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যের মূলনীতির সাথে এ সমারাজ্যের তেমন কোনো পার্থক্য নেই ।
রোমান সম্রাজ্যের প্রাধান্য ছিলো বিত্তশালী সম্ভ্রান্তদের, আর কখনো প্রলেটারিয়েটদের । প্রতিটি সমাজই এক শ্রেনী অপর শ্রেনীর বিরুদ্ধে চরম হিংসা বিদ্বেষ পোষন করে । এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা মানবজাতির জন্য চরম অপমানজনক পরিণতি বয়ে আনে । কাতণ, এদের মূলনীতিটাই এমন যে, এর দ্বারা মানবীয় সৎ গুণাবলী ও নীতি-নৈতিকতাকে গলা টিপে হত্যা করা হয় এবং পশুবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলা হয় । পশুবৃত্তিকে জাগ্রত করে তোলাই যেন এদের মূল কর্মসূচি । এ কথা আমরা নিছক আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে নয়; বরং সু-নির্ধারিত তথ্যের ভিত্তিতেই বলছি । দেখুন, পশুর মতো দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে কি শুধু ‘খাদ্য, বাসস্থান এবং যৌনক্ষুধা নিবারণ’-এগুলোকেই মানুষ তার মৌলিক প্রয়োজন নির্ধারন করতে পারে ? এ কারণে মানবসভ্যতার ইতিহাসকে কম্যুনিস্টরা নিছক খাদ্যশস্য সংগ্রহের ইতিহাস বলেই আখ্যায়িত করে ।
এসব বাস্তবধর্মী ও সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষনের মাধ্যমে আমরা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইসলাম মানুষের জন্য একমাত্র জীবনবিধান । কারন, এ জীবনবিধান এসেছে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, প্রতিপালক, মহাজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে । দ্বিতীয়ত, এ জীবনব্যবস্থা মানুষকে মানুষ বলেই বিবেচনা করে । এ কারণে সে মানুষের মাঝে সুপ্ত গুনাবলী, নীতি-নৈতিকতা ও সুকুমার বৃত্তিগুলোর বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয় । মানবিক গুণাবলী বিকাশের জন্য উপযুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে সে হয় বদ্ধপরিকর । এ জীবনব্যবস্থা যে নজির স্থাপন করেছে, ইতিহাসে তাঁর কোন উপমা নেই । মানবতা বিবর্জিত মানব দুশমনেরাই এ সব মানবীয় গুন-বৈশিষ্ট্যগুলোকে উপেক্ষা করে গোত্র, বর্ন, শ্রেনী কিংবা আঞ্চলিকতাঁর ভিত্তিতে সমাজ গড়ার চেষ্টা করে । তারা মানুষের প্রাকৃতিক মানবিক গুনাবলীর বিকাশ চায় না । ইসলাম চায় সকল ধরনের জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ এমন একটি সামগ্রিক ও সার্বজনিন সমাজ গড়ে তুলুক যেখানে মেধা, যোগ্যতা ও গুনাবলী দ্বারা সবাই কল্যাণ লাভ করতে পারে, সবাই উপকৃত হতে পারে । এসব প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন-
“(হে নবী, এদের) বলো, আমি কি তোমাদের এ লোকদের কথা বলবো যারা আমলের দিক থেকে সম্পুর্ন ক্ষতিগ্রস্থ (হয়ে পড়েছে)? (এরা হচ্ছে) সেসব লোক যাদের সমুদয় প্রচেষ্টা এ দুনিয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে মনে ভাবছে তারা (বুঝি) ভালো কাজই করে যাচ্ছে । এরাই হচ্ছে সে সব লোক, যারা তাদের মালিকের আয়াতের সাথে কুফরি করে এবং (অস্বীকার করে) তাঁর সাথে ওদের সাক্ষাতের বিষয়টিও । ফলে এদের সব কর্মই নিস্ফল হয়ে যায়; তাই কিয়ামাতের দিন আমি তাদের জন্য অজনের কোনো মানদণ্ডই স্থাপন করবো না । জাহান্নাম হলো তাদের যথার্থ পাওনা । কেননা, তারা কুফরি করেছে, (উপরন্তু) তারা আমার আয়াতসমূহ ও (তাঁর বাহক) রাসুলদেরকে বিদ্রূপের বিষয় হিসেবে গ্রহন করেছে ।”
(সূরা কাহাফ= ১০৩-১০৬)
[[সংগৃহীত]]
পৃথিবীর উষালগ্ন থেকে শুরু করে যুগে যুগে দ্বীনের আহ্বান একই । একই পয়গাম নিয়ে সব নবীরা এসেছেন । আর তা হলো ‘ইসলাম’ । তবে ইসলাম বলতে বর্তমান যুগের এক শ্রেনীর মুসলমানরা যা বুঝে নিয়েছে তা ইসলাম নয়; ইসলাম অর্থই হলো ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা । অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছার সর্বাত্নক প্রতিফলন ঘটানো এবং জীবনের সকল স্তর থেকে মানবরচিত জীবনবিধানের ঘৃণ্য পঙ্কিলতা বিতাড়িত করা । এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে মিথ্যা ‘মানবপ্রভু’দের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা । হযরত নূহ (আঃ) থেকে নিয়ে মুহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত সকল নবী একই মিশন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন ।
বিশ্বজগতের প্রতিটি অনু পরমানু তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান মেনেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে । সৃষ্টিজগতের একটি অংশ হওয়ার কারণে মানুষও স্রষ্টার আইন মেনে চলতে বাধ্য । একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, রক্তকণিকা সবকিছুই আল্লাহর হুকুম মেনে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে । হাত কখনো বলে না আমি হাটতে চায়, পা কখনো বলে না আমি লিখতে চায় । এমনিভাবে প্রত্যেকে তাঁর নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে । অথচ মানুষকে এ সামান্য স্বাধীনতা দেয়ার কারণেই সে তাঁর প্রভুর আইন অমান্য করে স্বেচ্ছাচার জীবন যাপন শুরু করে দেয় । এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মানুষের মাঝে সংগতি রক্ষার জন্য আল্লাহর আইনের নিরঙ্কুশ আনুগত্য বাঞ্ছনীয় । মানুষের শারীরিক পুষ্টি-অপুষ্টি, সুস্থতা-অসুস্থতা, বেচে থাকা, মরে যাওয়া সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন । পাপ-পুণ্যের পুরস্কার বা শাস্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও আল্লাহর নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় মানুষের নেই । এ সকল ক্ষেত্রে মানুষ একেবারেই অসহায় । প্রাকৃতিক জগৎ আল্লাহর যে নিয়মানুযায়ী চলে সেখানেও মানুষের সামান্যতম কর্তৃত্ব নেই । একটু ঝড়-বাদল, বৃষ্টি-বন্যা ও ভুমিকম্পের সময়ে মানুষ অসহায়ের মতো আল্লাহকেই ডাকে । সুতরাং আল্লাহ তাআলা জীবনের যে অংশে মানুষকে পরীক্ষার জন স্বাধীনতা দিয়েছেন সে অংশেও মানুষের উচিত আল্লাহর কাছে সর্বাত্নক আত্মসমর্পন করে তাঁর দেয়া আইন-বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপন করা । কতো বড়ো নির্লজ্জ, অকৃতজ্ঞ ও অপরিণামদর্শী হলে মানুষ সামান্য একটু সুযোগ পেয়েই এমন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে, তা নিতান্তই এক আশ্চর্যের বিষয়।
জাহেলিয়াতের অনেক ব্যাপক বিস্তৃত রূপ থাকলেও এর মূল ভিত্তি হলো নফসের কুপ্রবৃত্তি ও মানুষ হয়ে অন্য মানুষের গোলামী করা । এর মাধ্যমে নিজের নফসকে কিংবা অন্য মানুষকে প্রভূর আসনে বসানো হয় । কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতি যেহেতু আল্লাহর হুকুমের অনুগত- তাই এটি প্রাকৃতিক নিয়মের সম্পুর্ন পরিপন্থী । মানুষ তাঁর জীবনের একটি অংশে আল্লাহর আইন মানতে বাধ্য,আর ব্যবহারিক জীবনে সে স্বাধীন । তাই স্বাধীন অংশে যদি মানুষ আল্লাহর আইন মেনে না চলে তাহলে মানুষ তাঁর নিজের সত্তার ভেতরেই একটা সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয় ।
জাহেলিয়াতকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই । কারন, জাহেলিয়াত নিছক কোনো মতবাদ নয়, বরং বর্তমান বিশ্বে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শেকড় গেড়ে বসেছে এবং জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকরা এর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে । এ কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের প্রবর্তিত রীতিনীতি, আইন-বিধান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারনা, মুল্যবোধ সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত করে জেকে বসেছে । জাহেলিয়াতের ধারক বাহকরা সংগঠিত এবং আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত । তারা সকল শক্তি নিয়ে সারাক্ষন তাদের প্রবর্তিত ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানের জন্য তৎপর । শুধু তাই নয়, যাকেই তারা সমস্যা তথা কাটা মনে করে, অর্থাৎ তাদের এ জাহেলিয়াতকে উচ্ছেদের জন্য কেউ যদি উঠে দাঁড়ায় তাহলে সংঘবদ্ধভাবে, একযোগে তাঁর বিরুদ্ধে লেগে যায় এবং প্রয়োজনবোধে তারা তাঁকে হত্যা করতেও কুন্ঠিত হয় না ।
সুতরাং, একটি সুসংগঠিত, সংঘবদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করার জন্য নিছক ওয়াজ-নসিহত, তাত্ত্বিক আলোচনা বা ইসলামি আইনের শ্রেষ্ঠত্বের গুণকীর্তন কখনোই ফলপ্রসূ হতে পারে না । আজকের বস্তুবাদী সমাজের পুরোটাই যখন জাহেলিয়াত নিয়ন্ত্রিত, একটি সুসংগঠিত বিপুল জনগোষ্ঠী, সরকার, সামরিক বাহিনী যেখানে জাহেলিয়াতের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক, সেখানে মৌখিকভাবে ইসলামের আদর্শ প্রচার করে সফলতা পাওয়া তো দূরের কথা বাতিলের মুখোমুখি দাড়ানোটাও সম্ভব নয় । তাই জাহেলিয়াতের উচ্ছেদকল্পে ও আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা অবতীর্ণ হবে তাদেরকে অবশ্যই ইমানের অপ্রতিরোধ্য বলে বলীয়ান ও সুসংগঠিত হয়ে, সর্বাত্নক জিহাদের পরিকল্পনা নিয়ে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে হবে । বস্তুগত দিক থেকে না হলেও তাদেরকে সাংগঠনিক কাঠামো, পারস্পরিক সম্পর্ক, আমীরের আনুগত্য, নৈতিক উৎকর্ষ ও প্রয়জোনীয় সকল দিক থেকে জাহেলি সংগঠনগুলোর চেয়ে আরো বেশি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী হতে হবে । জাহেলিয়াতের স্রোতের মুখে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে তাঁর গতি রোধ করে দিতে হবে ।
কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ – এর বৈপ্লবিক সাক্ষ্যদানই হলো ইসলামি সমাজের সর্বপ্রধান ভিত্তি । সকল নবীরা এ কালেমার ওপর ভিত্তি করেই সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন । সুতরাং আরব অনারব সকলকেই এ কালেমার সঠিক তাৎপর্য জানতে ও বুঝতে হবে । এ কালেমার অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলাই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষক । সুতরাং, তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন একমাত্র শাসক । চিন্তা-চেতনায়, আকিদা- বিশ্বাসে, বাস্তব জীবনের সকল কাজে কর্মে তথা আল্লাহর একত্ববাদের ছাপ রাখতে হবে । ব্যক্তিগত জীবন থেকে নিয়ে রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন-কানুনের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদানের মধ্য দিয়ে এ কালেমার প্রকৃত মর্ম বিকশিত করে তুলতে হবে । এভাবে কালেমার দাবি বাস্তবায়ন না করে নিছক মন্ত্র জপার মতো পড়লে কিছুতেই সঠিক অর্থে কালেমার সাক্ষ্য দেয়া হয় না । এ ধরনের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় । কালেমার দাবি মোতাবেক উল্লিখিত সকল দিকগুলোর বাস্তব প্রতিফলনের মধ্য দিয়েই এ কালেমার সাক্ষ্য কার্যকর হয় এবং এ গুলোকে যারা অস্বীকার করে তারাই কাফির, তাদেরকে নিঃসন্দেহে অমুসলিম বলা যেতে পারে । চিন্তা-চেতনায়, নীতি আদর্শে এ কালেমা তখনই বাস্তব রূপ লাভ করে যখন মানুষ তাঁর পুরো জীবন আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত করে নেয় । এ কালেমার অর্থ হলো মানুষ কোনো ব্যাপারেই মনগড়া সিদ্ধান্ত নেবে না; বরং যে কোন ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা ও তার রাসুল (সঃ) নির্দেশনার আলোকেই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে । আর আল্লাহর হুকুম জানার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে আর রাসুল মুহাম্মাদ (সঃ) । কালেমায় শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশে আমরা এ কথারই স্বীকৃতি দান করি- ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ’, অর্থাৎ - আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর রাসুল ।
এ দুটো চেতনায় হলো ইসলামের প্রধান প্রানসত্তা । ইসলামি আদর্শের মূলভিত্তি । এ বিশ্বাস ও মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই ইসলাম মানবজাতির সকল সমস্যার সমাধান দেয় । সে সমস্যা হোক ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের । হোক তা কারো সাথে সন্ধিচুক্তির বা সম্পর্কচ্ছেদের । সকল ক্ষেত্রের সকল আইনের মূলনীতি এ কালেমা ।
এযাবৎ আলোচনায় পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম এমন কোনো অর্থহীন প্রতীকী মতবাদ নয় যে, মন্ত্র জপার মতো দু একটা কালেমা পাঠ করলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে, অথচ ওদিকে তাঁর জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্রগুলো চলবে জাহেলি রীতিনীতি, আইন-কানুন অনুযায়ী । সংখ্যায় তারা যতই হোক মুসলমান দাবিদারদের অবস্থা যদি সত্যিই এমন হয় তাহলে আদৌ মানবসমাজে তাদের দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয় । যেসব নামধারি মুসলমানরা প্রতিষ্ঠিত জাহেলি সমাজকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে, যারা এ জাহেলি সমাজের নিয়ন্ত্রকদের সহযোগী শক্তিতে পরিণত পরিণত হয়, তাঁরা ইচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায় হোক জাহেলি সমাজের চাহিদা পুরন করে চলেছে । এ অপরাধদুষ্ট জাহেলি সমাজ ও সমাজের নেতৃত্বকে টিকিয়ে রাখতে নিজেদের অজান্তেই সক্রিয় হয়ে উঠে । জাহেলি নেতৃত্ব যখন কোন সিদ্ধান্ত নেবে তখন ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের স্বার্থে তাঁর সহযোগীরা কাজ করে যায় । এ জন্য যে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেই তাঁর উচিত নয় জাহেলি সমাজের স্রোতে ভেসে যাওয়া জাহেলি নেতৃত্বের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া বা সহযোগীতা করা ।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে জ্ঞানহীনতা । যারা কালেমা পাঠ করেছে তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া কালেমার সঠিক বুঝ কারো ভেতরে আছে বলে মনে হয় না । এর সর্বপ্রধান কারন হলো, তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করে না যে, তারা কী পাঠ করছে । নিছক মন্ত্র জপার মতো করে কালেমা পাঠকারীদের সংখ্যায় যদি পৃথিবী ভরেও যায়, ইউরোপ আমেরিকার সবাই যদি এভাবে কালেমা পাঠ করে নেয় তাতে ইসলামের কিছুই আসে যায় না । কালেমার বিপ্লবী ঘোষণার সঠিক অর্থ বুঝে জীবনের সকল কাজকর্মে তাঁর বাস্তব প্রতিফলন না ঘটলে এ কালেমা পাঠ করে কোনো লাভ নেই । যখন কালেমা পাঠকারীরা এর সঠিক অর্থ বুঝবে, যখন মজবুত ভ্রাতৃত্ববন্ধনের মধ্য দিয়ে সকল শ্রেনীর মানুষকে সংগঠিত করে একটি অখণ্ড ইউনিটে হতে পারবে, যখন তারা জাহেলিয়াতকে রুখে দাড়াবার জন্য ইমানি বল ও প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি লাভ করবে, যখন জাহেলি নেতৃত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকার দ্বীনী নেতৃত্বের অধীনে সংগঠিত হয়ে সংগ্রাম শুরু করবে তখনই তারা অর্পিত মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবে । ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্ব হবে সম্পুর্ন জাহেলি নেতৃত্বের প্রভাবমুক্ত এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত সকল কার্যক্রম হবে আল্লাহমুখী । জাহেলিয়াতের প্রভাব থেকে জীবন, মন ও সমাজকে সম্পুর্ন পবিত্র করে তোলার লক্ষ্যে তারা অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবে । এ সংগ্রাম চলবে নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে ও প্রতিষ্ঠিত জাহেলি বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে।
ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা, যা খুব ছোট একটি কথা দিয়ে মানুষের গোটা জীবনকে পরিবেষ্টন করে নেয় । এ মৌলিক ছোট বাক্যটি হৃদয়ঙ্গম করার সাথে সাথে তথা এ কালেমাকে গ্রহন করার সাথে সাথে প্রথম যুগের প্রতিটি মানুষের ভেতর জন্ম নিয়েছিলো বলিষ্ঠ আন্দোলন, সক্রিয় বিপ্লব ।
নিছক কোন কাল্পনিক মতবাদ নিয়ে ইসলাম পৃথিবীতে আসেনি । আর যদি ভবিষ্যতে ইসলামের অনুসারীরা ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে তা বাস্তব ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই করতে হবে । নিছক কিছু যিকির- আযকার, নামায-রযার নাম ইসলাম নয় । এ সংগ্রামে প্রথমে যারা শরিক হয়েছিলেন তারা ইসলামকে সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন । তাই তারা নিজেদেরকে জাহেলিয়াত থেকে দূরে সরিয়ে ক্ষান্ত হননি; বরং প্রতিষ্ঠিত জাহেলি সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তা উচ্ছেদকল্পে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন । বর্তমান পৃথিবীকে জাহেলিয়াতের নিকোষ কালো আধার যেভাবে ছেয়ে ফেলেছে, যেভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাহেলিয়াত জেকে বসেছে, তা থেকে এ সমাজ তথা এ বিশ্বকে পবিত্র করতে হলে প্রথম যুগের মুসলমানদের পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে । ইসলামের সঠিক মর্ম যথার্থরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, ইসলামের ইন্সিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভালো করে বুঝে নিতে হবে । তারপর একটি বাস্তব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে । এছাড়া অন্য কোন পদ্ধতিতে সফলতা পাওয়ার আশা করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা ।
মানুষের নীতি-নৈতিকতা, কর্মক্ষমতা তথা মানবসম্পদ উন্নয়নও ইসলামি কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত । তাওহিদের ভিত্তিতে যখন ইসলাম একটি উম্মাহর ভিত্তি রচনা করে তখন পারস্পরিক মজবুত ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সুপ্ত মনুষ্যত্ববোধ, প্রাকৃতিক গুণাবলী ও নীতি-নৈতিকতাঁর বিকাশ ঘটিয়ে তাঁকে বলিষ্ট ও সংগ্রামী করে তোলা নেহাত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । প্রাণী হিসেবে মানুষের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যেগুলো সমভাবে অনেক পশুরও রয়েছে । তবে, সেগুলো মানুষের পরিচয় বহন করে না । মানুষ হিসেবে যে বিশেষ গুণাবলী ও বিশেষ যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন সেগুলোই মানুষের পরিচয়বাহী গুণ । মানুষের মধ্যে বিদ্যমান পশুসুলব বৃত্তিগুলোর উপরে মনুষ্যত্ববোধ ও নৈতিক গুণাবলীর প্রাধান্য বিস্তার করার মতো আধ্যাত্মিক শক্তিই একজন মানুষকে সত্যিকার মানুষ করে তুলে । মানুষের মধ্যে শুধু পশুসুলভি নয়; বরং বিশেষ কিছু দিকের সাথে জড়পদার্থেরও মিল রয়েছে । আর কিছু বিভ্রান্ত, বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক নামধারী এ যুক্তি তুলে মানুষকে জড়পদার্থের পর্যায়ে নামিয়ে আনার অসার কল্পনায় ডুবে আছে । তাদের চিন্তা যে কতোটা ভ্রান্ত ও অমূলক তা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় । ( ধরুন একটি অফিসে একশো জন স্টাফ আছে, তবে তাই বলে সবাই কি ডাইরেক্টর ? না । অথচ এই ডাইরেক্টরের মাঝে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সাধারণ স্টাফদের মধ্যেও রয়েছে । তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য সমভাবে সবার মাঝে বিদ্যমান থাকলেও বিশেষ কিছু যোগ্যতা ও গুনাবলীর কারণেই এ লোকটিকে ডাইরেক্টরের চেয়ারে বসানো হয়েছে । ) ঠিক তেমনি সৃষ্টিজগতের সদস্য হিসেবে কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য সবার মাঝে সমানভাবে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা মানুষকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য, যোগ্যতা ও গুণাবলী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা অন্য কাউকে দেননি । মানুষকে সবচেয়ে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন । মানুষকে তাঁর খিলাফাত দান করে সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে সম্মানিত আসনে সমাসীন করেছেন । অনস্বীকার্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অনেক জাহেলি সমাজের বিজ্ঞানীও একথা স্বীকার কর নিতে বাধ্য হচ্ছে । তবে তারপরও নির্লজ্জের মতো সুস্পষ্ট বক্তব্য না দিয়ে বিভিন্নভাবে বিষোদ্গার করছে ।
এ ধরনের মান-মর্যাদাহীন কথাবার্তাকে ইসলাম মোটেই গুরুত্ব দেয় না । ইসলাম সব সময় মানুষের নৈতিক ও মানবিক গুনাবলীর বিকাশ সাধনের চেষ্টা করে । কেননা, এ নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ ও পশুসুলভ বৃত্তি দমনের মাধ্যমে মানুষকে সত্যিকার মানুষের মর্যাদায় উন্নীত করা ইসলামি সমাজের মহান লক্ষ্য । এ পদ্ধতিতে গড়ে উঠে একটি অতুলনীয় আদর্শসমাজ । এ সমাজের ভিত্তি হলো আল্লাহভীতি, নীতিনৈতিকতা ও আদর্শ । এ সমাজ ভাষা, বর্ণ, জাতীয়তাবাদ ও ভৌগলিক সীমারেখাভিত্তিক দুর্বল বন্ধন ছিড়ে ফেলে ঈমান ও নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে এক ‘মেগা পরিবার’ গড়ে তোলে । সকল বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চলের মানুষের জন্য এ পরিবার বা সমাজের দ্বার থাকে সদা উন্মুক্ত। এ কারণেই ইসলামি সমাজে বৈচিত্র্যময় মেধা ও মননশীলতার সমন্বয় ঘটে । ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানরা ইসলামের এ মহান আদর্শ অনুসরণ করেই বিশ্বের ইতিহাসের সর্বাধিক সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন । ইসলামি আদর্শের এ মহামিলনে মানবসমাজের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-গুনী, মেধাবী ও প্রতিভাবান স্বতঃস্ফুর্ত যোগদান করেছিলেন ।
ইসলামের এ ‘মেগা পরিবার’-এর গর্বিত সদস্য হয়েছিলো আরব, পারস্য, সিরিয়া, মিশর, মরক্কো, তুরস্ক, চীন, ভারত, রোম, গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বর্ণ গোত্রের মানুষ । তাদের মাঝে বিদ্যমান বিভিন্ন গুণাবলী, বৈচিত্র্যময় আঞ্চলিক চালচিত্র, সবই ইসলামি আদর্শের অভিন্ন সুতায় গেথে গিয়েছিলো । পারস্পরিক মজবুত ভ্রাতৃত্ববন্ধন, সহযোগিতামূলক মনোভাব ও মেধার মুল্যায়নের মাধ্যমে তারা গড়ে তুলেছিলেন এক অবিস্মরণীয় সভ্যতা । আজকাল কিছু সংখ্যক বিকৃত মস্তিষ্কের ও সংকীর্ণ জ্ঞানের বুদ্ধিজীবীরা সেই সভ্যতাকে নিছক আরবসভ্যতা বলে চালিয়ে দিয়ে মহান ইসলামি আদর্শের ওমর কৃতিত্বকে ম্লান করে দিতে চায় । আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চায়, সে সভ্যতা কখনোই আরবসভ্যতা ছিল না; বরং সেটা ছিলো সার্বজনিন এবং একটি নির্ভেজাল ইসলামি সভ্যতা । এ সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিলো ঈমান ও ইসলামের মূলনীতির ওপর ।
বর্ণ, ভাষা, গোত্র, জাতীয়তা, অঞ্চল নির্বিশেষে ইসলামের গভীর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সকলেই এ সমাজ তথা সভ্যতা নির্মাণে যথাসাধ্য ভুমিকা রাখেন । প্রত্যেকেই নিজের সবটুকু সামর্থ্য, যোগ্যতা ও মেধা উজাড় করে দিয়ে এ সভ্যতার ভিত্তি মজবুত করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন । এ কাজ কেউ তাদেরকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে করায় নি, বরং ইসলামি সমাজের সম্মানিত সদস্য হওয়ায় প্রত্যেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র । তাই প্রত্যেকেরই যোগ্যতা, মেধা, প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ছিল এ সমাজের স্বাভাবিক দৃশ্য । যে কারণে, তাদের মধ্যে এমন ধরনের উন্নত মানবিক গুনাবলি আমরা দেখতে পাই, যা পৃথিবীর কোনো জাতির ইতিহাসই আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারে নি ।
এমন আদর্শ সমাজের কোনো চিত্র ইতিহাসে নেই । তবে ঐতিহাসিকরা রোমান সভ্যতাকে একটা সামগ্রিক ও সার্বজনীন সভ্যতা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন । কারন বিভিন্ন গোত্র, বর্ণ, অঞ্চলের লোক এ সমাজে একত্রিত হয়েছিলো । যে যাই বলুক না কেন, বাস্তবতার দৃষ্টিতে এ ধরনের আদর্শহীন সামষ্টিক সমাজের কোনো মুল্য নেই । কারন, সে সমাজ কোনো আদর্শভিত্তিক সমাজ ছিল না । সে সমাজ কোনো মানবিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি । কোনো নীতি-নৈতিকতার যোগসূত্রে তারা একত্রিত হয়নি; বরং শ্রেনি বিভাগই ছিলো সেই সমাজের মূল ভিত্তি । একদিকে ছিলো মুষ্টিমেয় সংখ্যক বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত শাসকশ্রেণী, অপর দিকে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের দাস শ্রেনী । তাছাড়া গোত্রীয় বিভেদও তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল । রোমীয় গোত্রের লোকদেরকে সমাজের শাসক হিসেবে সর্বত্রই অন্যরা আনুগত্য প্রদানে বাধ্য থাকতো । যে কারণে ইসলামি সমাজের মতো স্বাধীনতা সেই সমাজ কখনোই দিতে পারে নি, কখনোই তারা ইসলামি সমাজের মতো কোনো সার্বজনীন কল্যাণ ধর্মী সমাজ গড়ে তুলতে পারে নি ।
এরপরের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বৃটিশ সম্রাজ্যের ঘৃণ্য অধ্যায় । এরা একদিক থেকে রোমান সম্রাজ্যেরই উত্তরাধিকারী । নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষাই ছিলো এ সম্রাজ্যের মূলনীতি । স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তারা তাদের উপনিবেশগুলোতে চরম শোষণ চালিয়েছে । সেসব অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ভাবে লুটতরাজ করে নিজেদের ভোগ বিলাস নিশ্চিত করেছে । জাতীয় স্বার্থের ঘৃণ্য লোভই এ সম্রাজ্যের মূল লক্ষ্য এবং বৃটিশরাই এর হর্তাকর্তা । এছাড়াও অতিতের স্পেন, পর্তুগীজ এবং আধুনিক কালের ফ্রান্সসহ ইউরোপিয় সম্রাজ্যগুলোর ইতিহাস একই স্বার্থবাদী সূত্রে গাঁথা ।
এরপর কমুনিজম এসে বিশ্ববাসীকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলো । তাদের গোত্র, বর্ন, ভাষা ও আঞ্চলিকতাঁর জাতীয়তাবাদমুক্ত সমাজ দেখে অনেকে অভিভূত হয়ে পড়েছিলো । কিন্তু এরা কেউ লক্ষ্য করেনি, এ সমাজও সকল মানবিক ভিত্তি পরিত্যাগ করে নিছক শ্রেনি বিভাগের ওপর দাঁড়ানো এক ঠুনকো সমাজ । এদিক থেকে প্রাচীন রোমান সম্রাজ্যের মূলনীতির সাথে এ সমারাজ্যের তেমন কোনো পার্থক্য নেই ।
রোমান সম্রাজ্যের প্রাধান্য ছিলো বিত্তশালী সম্ভ্রান্তদের, আর কখনো প্রলেটারিয়েটদের । প্রতিটি সমাজই এক শ্রেনী অপর শ্রেনীর বিরুদ্ধে চরম হিংসা বিদ্বেষ পোষন করে । এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা মানবজাতির জন্য চরম অপমানজনক পরিণতি বয়ে আনে । কাতণ, এদের মূলনীতিটাই এমন যে, এর দ্বারা মানবীয় সৎ গুণাবলী ও নীতি-নৈতিকতাকে গলা টিপে হত্যা করা হয় এবং পশুবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলা হয় । পশুবৃত্তিকে জাগ্রত করে তোলাই যেন এদের মূল কর্মসূচি । এ কথা আমরা নিছক আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে নয়; বরং সু-নির্ধারিত তথ্যের ভিত্তিতেই বলছি । দেখুন, পশুর মতো দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে কি শুধু ‘খাদ্য, বাসস্থান এবং যৌনক্ষুধা নিবারণ’-এগুলোকেই মানুষ তার মৌলিক প্রয়োজন নির্ধারন করতে পারে ? এ কারণে মানবসভ্যতার ইতিহাসকে কম্যুনিস্টরা নিছক খাদ্যশস্য সংগ্রহের ইতিহাস বলেই আখ্যায়িত করে ।
এসব বাস্তবধর্মী ও সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষনের মাধ্যমে আমরা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইসলাম মানুষের জন্য একমাত্র জীবনবিধান । কারন, এ জীবনবিধান এসেছে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, প্রতিপালক, মহাজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে । দ্বিতীয়ত, এ জীবনব্যবস্থা মানুষকে মানুষ বলেই বিবেচনা করে । এ কারণে সে মানুষের মাঝে সুপ্ত গুনাবলী, নীতি-নৈতিকতা ও সুকুমার বৃত্তিগুলোর বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয় । মানবিক গুণাবলী বিকাশের জন্য উপযুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে সে হয় বদ্ধপরিকর । এ জীবনব্যবস্থা যে নজির স্থাপন করেছে, ইতিহাসে তাঁর কোন উপমা নেই । মানবতা বিবর্জিত মানব দুশমনেরাই এ সব মানবীয় গুন-বৈশিষ্ট্যগুলোকে উপেক্ষা করে গোত্র, বর্ন, শ্রেনী কিংবা আঞ্চলিকতাঁর ভিত্তিতে সমাজ গড়ার চেষ্টা করে । তারা মানুষের প্রাকৃতিক মানবিক গুনাবলীর বিকাশ চায় না । ইসলাম চায় সকল ধরনের জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ এমন একটি সামগ্রিক ও সার্বজনিন সমাজ গড়ে তুলুক যেখানে মেধা, যোগ্যতা ও গুনাবলী দ্বারা সবাই কল্যাণ লাভ করতে পারে, সবাই উপকৃত হতে পারে । এসব প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন-
“(হে নবী, এদের) বলো, আমি কি তোমাদের এ লোকদের কথা বলবো যারা আমলের দিক থেকে সম্পুর্ন ক্ষতিগ্রস্থ (হয়ে পড়েছে)? (এরা হচ্ছে) সেসব লোক যাদের সমুদয় প্রচেষ্টা এ দুনিয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে মনে ভাবছে তারা (বুঝি) ভালো কাজই করে যাচ্ছে । এরাই হচ্ছে সে সব লোক, যারা তাদের মালিকের আয়াতের সাথে কুফরি করে এবং (অস্বীকার করে) তাঁর সাথে ওদের সাক্ষাতের বিষয়টিও । ফলে এদের সব কর্মই নিস্ফল হয়ে যায়; তাই কিয়ামাতের দিন আমি তাদের জন্য অজনের কোনো মানদণ্ডই স্থাপন করবো না । জাহান্নাম হলো তাদের যথার্থ পাওনা । কেননা, তারা কুফরি করেছে, (উপরন্তু) তারা আমার আয়াতসমূহ ও (তাঁর বাহক) রাসুলদেরকে বিদ্রূপের বিষয় হিসেবে গ্রহন করেছে ।”
(সূরা কাহাফ= ১০৩-১০৬)
[[সংগৃহীত]]
Comment