আখলাকে হামিদা ও আখলাকে রাজিলা
তাজকিয়াতুন নাফসের গুরুত্ব অনুধাবন করতঃ প্রথমে নিজের পরে উম্মাহর উপকারের কথা ভেবে আখলাকে হামিদা ও আখলাকে রাজিলার উপর ধারাবাহিক কিছু আলোচনা করার সুযোগ খুজছিলাম । দীর্ঘ ব্যস্ততা ও শূন্য যোগ্যতার দরুন সুযোগ হচ্ছিল না । আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আবারো ইলমি খেদমত ও লেখালেখির জগতে প্রবেশ করলাম । গত পর্বে আমরা গীবত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুজাকারা করেছিলাম । আজকে সেই ধারাবাহিকতায় আত্মশুদ্ধির ২য় পর্ব নিয়ে কিছু মুজাকারা পেশ করলাম ।
শুরুর কথা : ঈমান, ইসলাম ও শরীয়তের সর্ম্পক হল, জাহের ও বাতেন তথা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে। যেমন জাহেরী শরীয়তের বিধি-বিধান জাহেরী ও বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত। যথা নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ফরজ বিধানসমূহ। তাই এ আমলসমূহ যদি শুধু জাহেরী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আদায় করা হয় তাহলে এগুলো আদায় করা হয়েছে বলা হবে। পক্ষান্তরে বাতেনী শরীয়তের বিধি-বিধানসমূহ বাতেনী ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত যথা কুচরিত্রসমূহ দূর করে সুচরিত্রসমূহ গ্রহণ করার বিধানসমূহ। তাই সে সব আমলসমূহ বাতেনী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা কলব ও রুহসহ ছয় লতীফার মাধ্যমে আমল করে তা হাসিল করতে হয়। সেই বাতেনী ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহ দুই ভাগে বিভক্ত।প্রথমত : উত্তম চরিত্রসমূহ যা কলবের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে। তাকে আখলাকে হামীদা (উত্তম চরিত্র), আখলাকে হাসানা (সুন্দর চরিত্র), মালাকাতে ফাযেলা (উত্তম জ্ঞান) ও মাকামাত (আধ্যাত্বিক উত্তম স্তর) বলা হয়ে থাকে। যেমন (১) তাওহীদ, আল্লাহ তা'আলার একত্ববাদ (২) ইখলাস, নিষ্টাচার ও আন্তরিকতা (৩) তাওবা, পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া (৪) হুব্বে ইলাহী, খোদাপ্রেম (৫) যুহুদ (৬) তাওয়াক্কুল, আল্লাহর প্রতি ভরসা করা (৭) কানায়াত, অল্পেতুষ্টি (৮) হিল্ম, সহিষ্ণুতা, ভারী চরিত্রের হওয়া (৯) সবর, ধৈর্যধারণ করা (১০) শোকর, কৃতজ্ঞ হওয়া (১১) সিদক, আল্লাহর সাথে সততা (১২) তাফবীজ (تفويض), সকল বিষয় আল্লাহর কাছে ন্যাস্ত করা (১৩) তাসলীম, (নিজেকে আল্লাহর কাছে অর্পন করা, তাঁর সকল ফায়সালা মেনে নেওয়া (১৪) রিদ্বা বিল কাদা , (আল্লাহর সকল সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা (১৫) ফানা, আল্লাহর ওয়াস্তে বিলীন হওয়া (১৬) ফানাউল ফানা, একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়া।
দ্বিতীয়ত : খারাপ চরিত্রসমূহ যা নফসের ব্যবহার বা নফসের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে, তাকে আখলাকে রাজিলা (বদ চরিত্র), আখলাকে খবিছা (কুচরিত্র ও খারাপ চরিত্র) বলা হয়।
যেমন (১) তামা (طمع), লোভ লালসা করা (২) তুলে আমাল, অতি লোভ, বেশী আশা করা (৩) রাগ ও ক্রোধ করা (৪) দুরুগ, মিথ্যা বলা (৫) গীবত, পরনিন্দা করা (৬) হাসাদ, হিংসা বিদ্বেষ করা (৭) বুখল, কৃপনতা করা (৮) রিয়া, লোক দেখানো (৯) উজব, খুদরায়ি বা নিজ পছন্দের অগ্রাধিকার (১০) কিবর, অহংকার করা (১১) হিকদ, পরশ্রীকাতরতা (১২) হুব্বে মাল, সম্পদের ভালবাসা (১৩) হুব্বে জাহ, সম্মানের ভালবাসা (১৪) হুব্বে দুনিয়া, দুনিয়ার ভালবাসা।
সুতরাং জাহেরী শরীয়তের আমলের ইসলাহ করা ফরজ, তা যেমন সকলে সহজে বুঝতে পারেন, তদ্রুপ বাতেনী শরীয়তের বাতেনী আমলের ইসলাহ করাও ফরজ এবং তার প্রয়োজনীয়তা ও এর গুরুত্ব সকলের বুঝা আবশ্যক। কুরআন ও হাদীসে জাহেরী বিধান পালনের ব্যাপারে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বাতেনী বিধান পালনের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বরং বাতেনী বিধান পালনের ব্যাপরে আরো বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
যেমন কুরআনের বর্ণনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার নিয়ম হল, সাধারণ কোন কথা স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করে থাকেন। কোন ধরণের কসম বা তাকীদের শব্দ ব্যবহার করেন না। কিন্তু আলোচ্যবিষয় যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তখন একটা কসম বা দুটো কসম ব্যবহার করে বিষয়টি মানুষের নিকট গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। যথা একটি জিনিসের কসম করে আল্লাহ তা'আলা বলেন, والعصر যুগের কসম। আবার কখনো দুটো জিনিসের কসম করে বলেন, والتين والزيتون ত্বীন ও জয়তুনের কসম। কখনো তিনটা জিনিসের কসম করে বলেন, ن والقلم ومايسطرون 'নূন ও কলম এবং তাঁরা (ফেরেস্তারা) যা লিখে তার কসম। কিন্তু 'তাযকিয়ায়ে নফস' তথা 'ইহসান' ও আত্মশুদ্ধি হাসিল করার ব্যাপারে সূরা 'শামসে' একটি নয়, দুটি নয়, তিনটিও নয় বরং এগারোটি কসম করে আল্লাহ পাক বলেন,
والشمس وضحاها، والقمر إذا تلاها، والنهار إذا جلاها، واليل إذا يغشاها، والسماء ومابناها، والارض وماطحاها، ونفس وماسواها، فالهمها فجورها وتقواها، قد أفلح من زكاها، وقد خاب من دساها*
(১) সূর্য (২) ও সূর্যের কিরণের কসম (৩) চন্দ্র যখন সূর্যের পরে আসে তার কসম (৪) দিন যখন সূর্যকে উজালা করে তার কসম (৫) রাত যখন সূর্যকে ঢেকে নেয় তার কসম (৬) আকাশের কসম (৭) ও আকাশকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর কসম (৮) পৃথিবীর কসম (৯) ও পৃথিবীকে যিনি বিছিয়েছেন তাঁর কসম (১০) নফসের কসম (১১) ও নফসকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর কসম। তিনি নফসকে গোনাহ ও তাকওয়ার অনুভূতি ও জ্ঞান দান করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের নফসকে তাযকিয়া ও পবিত্র করবেন তিনি সার্বিক সফলতা পাবেন। আর যে ব্যক্তি গোনাহে লিপ্ত হয়ে তার নফসকে অপবিত্র করবে সে কোন ধরণের সফলতা পাবে না। বরং সফলতা পাওয়া থেকে ব্যর্থ ও মাহরুম হবে। (সূরা শামস আয়াত ১ থেকে ১১ পর্যন্ত)
আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে এর উপর আমল করার তাউফিক দান করুন । আমীন ।
Comment