আমিত্ব থেকে দূরে থাকুন
ভূমিকাঃ
আত্মপ্রশংসাকেই আমিত্ব বলা হয় । এটি মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। সুযোগ পেলেই আমরা আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাই। নিজের অর্জন, গুণাগুণ, কর্মতৎপরতা নিয়ে আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলি। সাধারণ মানুষ তো বটেই অনেক দ্বীনদার-পরহেযগার বা দাঈ ইলাল্লাহর মাঝেও ইখলাছ বিনষ্টকারী ও আমল বিধ্বংসী এই রোগ ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান।
বস্ত্ততঃ আমাদের সকলেরই জানা, মানুষের কাছে নিজের বড়ত্ব যাহির করা বা আত্মপ্রচারে লিপ্ত হওয়া নিঃসন্দেহে কোন গ্রহণযোগ্য আচরণ নয়। কোন সচেতন মানুষ তা ভালো চোখে দেখে না। এমনকি স্বয়ং আত্মপ্রশংসাকারী ব্যক্তিও অন্যের আত্মপ্রশংসাকে নিন্দনীয় দৃষ্টিতেই দেখেন। অতএব একজন আল্লাহভীরু ও ব্যক্তিত্ববান মানুষকে অবশ্যই এই অপসন্দনীয় আচরণের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, যা একাধারে নিজের ব্যক্তিত্বকে নষ্ট করে অপরদিকে সৎআমলকেও ধ্বংস করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى، ‘তোমরা আত্মপ্রশংসায় লিপ্ত হয়ো না। কারণ তিনি সর্বাধিক অবগত কে আল্লাহকে ভয় করে’ (নাজম ৫৩/৩২)।
আত্মপ্রশংসার হুকুমঃ
আত্মপ্রশংসা কবিরা গোনাহ । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَخَشِيتُ عَلَيْكُمْ مَا هُوَ أَكْبَرُ مِنْهُ العُجْب، ‘যদিও তোমরা পাপ না করো, তথাপি আমি তোমাদের জন্য এর চেয়ে বড় পাপের আশংকা করি। আর তা হ’ল আত্ম-অহমিকা’।[1] হাদীছটির ব্যাখ্যায় মানাবী (রহঃ) বলেন, পাপী ব্যক্তি নিজের ত্রুটি স্বীকার করে। ফলে তার পক্ষ থেকে তওবার আশা করা যায়। কিন্তু আত্মগর্বী নিজের আমলের দ্বারা প্রতারিত হয়। ফলে তার তওবার সুযোগ সুদূর পরাহত হয়ে যায়।[2]
একটি উদাহারনঃ
মুহাম্মাদ ইবনে আমর (রহঃ) থেকে বর্ণিত, যয়নব বিনতে আবী সালামা (রাঃ) তাঁকে প্রশ্ন করেন, তোমার মেয়ের কী নাম রেখেছ? তিনি বললেন, বাররাহ (পুণ্যবতী)। তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের নাম রাখতে নিষেধ করেছেন। আমার নামও বাররাহ রাখা হয়েছিল। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বললেন, তোমরা নিজেদের পরিশুদ্ধ দাবী করো না। কেননা আল্লাহই ভালো জানেন, তোমাদের মধ্যে কে পুণ্যবান। অতঃপর তিনি বললেন, আমি এর কী নাম রাখব? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এর নাম রাখো যয়নাব।[3]
আত্মপ্রশংসার ক্ষতিঃ
প্রশংসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের নেক আমলগুলোকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন একজন যে দুনিয়াতে শহীদ হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তার আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, আমি তোমার পথেই যুদ্ধ করেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি বরং এ জন্যেই যুদ্ধ করেছিলে যাতে লোকেরা তোমাকে ‘বীর’ বলে আখ্যায়িত করে। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। অতঃপর তাকে উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[4]
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কাছে এসে বলল, ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনি কি বলেন, যে জিহাদ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সুনাম-সুখ্যাতি উভয়টিই কামনা করে। তার জন্য কি প্রতিদান রয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তার জন্য কিছুই নেই। এই প্রশ্ন তাঁকে তিনবার করা হ’লেও তিনি একই জবাব দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ، ‘আল্লাহ তা‘আলা এমন আমলই গ্রহণ করে থাকেন যা নিষ্কলুষভাবে কেবল তাঁর জন্যই করা হয় এবং যার মাধ্যমে শুধুমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করা হয়’।[5]
আত্মপ্রশংসার উৎপত্তিস্থল
প্রিয় পাঠক! আত্মপ্রশংসার প্রবণতা মানুষের মধ্যে আসে আত্ম অহংকার থেকে, যা অত্যন্ত ঘৃণিত আচরণ। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি অহংকারবশে মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালবাসেন না’।[6]
অহংকারের কারণে মানুষের আমল সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই সে জান্নাতের পথ থেকে দূরে সরে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।[7] তিনি বলেন, তিনটি বিষয় ধ্বংসকারী (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম-অহংকারী হওয়া। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক।[8]
নিজের প্রতি অতঃপর সকল ভাইদের প্রতি আহ্বান
অতএব আসুন! সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে আত্মপ্রশংসা ও আত্মপ্রসাদ থেকে বাঁচার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করি। বরং নিজেদের নেক আমলগুলো পারতপক্ষে গোপন রাখার চেষ্টা করি, যাতে তা শেষবিচারের দিনে আল্লাহর খাতায় লেখা থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, مَنِ استطاعَ منكم أنْ يكونَ لَهُ خَبْءٌ مِنْ عمَلٍ صالِحٍ فلْيَفْعَلْ، ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কিছু গোপন নেক আমল সঞ্চয় করে রাখতে পারলে সে যেন তা করে’।[9] আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!
গ্রন্থপুঞ্জিঃ
[1]. বাযযার হা/২৯২১, ছহীহুত তারগীব হা/২৯২১।
[2]. মানাবী, ফায়যুল ক্বাদীর শারহু জামেঈছ ছাগীর ৫/৩৩১।
[3]. আবুদাঊদ হা/৪৯৫৩।
[4]. মুসলিম হা/১৯০৫।
[5]. নাসাঈ হা/৩১৪০, সনদ হাসান ছহীহ।
[6]. লোকমান ৩১/১৮।
[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৭।
[8]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫১২২।
[9]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৩১৩।
Comment