খাদিজাতুল কুবরা: এক মহিয়সী নারীর গল্প - ১ম পর্ব ┇ শাইখ তামিম আল আদনানি হাফিজাহুল্লাহ্ (Transcript)
নাহমাদুহু ওয়ানুসল্লি আ'লা রসূলিহিল কারীম আম্মাবাদ
‘উম্মুল মু'মীনিন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ’ রদ্বীয়াল্লহু আনহা! ইসলামের ইতিহাসে এক মহিমান্বিত নারীর নাম। আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হন। অনুপম চরিত্রের কারণেই তিনি ত্বহিরহ্ বা পুতঃপবিত্র উপাধিতে ভূষিত হন।
ইসলাম পূর্ব যুগেই প্রিয় নবী ﷺ- এর চারিত্রিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে চিরদিনের জন্য নিজের করে পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় তাঁর এই মোবারক তামান্না পূর্ণ হয়। প্রিয় নবীর প্রিয়তমা জীবন সাথীর মর্যাদা লাভ করে - খাদিজা ত্বহিরাহ্ হয়ে উঠেন ‘উম্মুল মু'মিনীন’। কিয়ামত পর্যন্ত যত মু'মিন দুনিয়াতে আসবে তিনি সবার মহিমান্বিত আম্মাজান।
প্রিয় নবী ﷺ এর হৃদয় জুড়ে ছিল প্রিয়তমা খাদিজার ভালোবাসা। পুণ্যবতী-গুণবতী খাদিজা - প্রিয়তম স্বামীর হৃদয়ের সবটুকু দখল করে নিতে পেরেছিলেন। প্রিয় নবীর সুখে-দুঃখে তিনি ছিলেন অকৃত্রিম সঙ্গী।
সহীহ্ বুখারীতে এসেছে হেরা গুহায় জিবরাঈল আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার পর রাসূল ﷺ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রদ্বীয়াল্লহু আনহার কাছে ফিরে এলেন, তখন তিনি তাকে বললেন,
أي خدیجة ما لي لقد خشيت على نفسي »
"খাদিজা! আমার কি হয়ে গেল! আমি নিজের জীবনের ব্যাপারে আশঙ্কা করছি।"
তারপর তিনি হেরা গুহায় ঘটে যাওয়া সব ঘটনা শুনালেন। তখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা - প্রিয়তম স্বামীকে শান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “কক্ষনো না; আপনার জন্য সুসংবাদ। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়দের খোঁজখবর নেন, সত্য কথা বলেন, সহায়হীনদের বোঝা লাঘব করেন, নিঃস্ব লোকদের উপার্জনের ব্যবস্থা করেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন, এবং হকের পথে আসা বিপদ-আপদে লোকদের সাহায্য করে থাকেন।’’
সুবহানআল্লাহ! কত বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন খাদিজা ত্বহিরাহ্ রদ্বীয়াল্লহু আনহা! কত সুন্দর ভাষায়, কত নিখুঁতভাবে তিনি প্রিয়তম স্বামীকে সান্ত্বনা দিলেন!
প্রিয় বোন! উম্মুল মু'মিনীন খাদিজাতুল কুবরা রদ্বীয়াল্লহু তাআলা আনহা এর এই ঘটনা থেকে আপনাদের অনেক কিছু শেখার আছে। খাদিজা ত্বহিরার মতো আপনাদেরও হতে হবে ত্বহিরহ্। আপনাদেরও হতে হবে পুতঃপবিত্রা। তবেই আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ ( ﷺ) এর মত শ্রেষ্ঠ পবিত্র স্বামী আপনাদের দান করবেন।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
ٱلْخَبِيثَٰتُ لِلْخَبِيثِينَ وَٱلْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَٰتِۖ وَٱلطَّيِّبَٰتُ لِلطَّيِّبِينَ وَٱلطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَٰت
দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষ এর জন্য আর দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্য। চরিত্রবতী নারী চরিত্রবান পুরুষ এর জন্য আর চরিত্রবান পুরুষ চরিত্রবতী নারীর জন্য। [সূরা নূর ২৪: ২৬]
বোন আমার! একজন পবিত্র স্বামী যদি চান, একটি সুখময় জান্নাতি জীবনের স্বপ্ন যদি হৃদয়ে লালন করেন তাহলে নিজের জীবন - নিজের যৌবনকে পুতঃপবিত্র রাখুন। আপনার চিন্তা, আপনার আবেগ, আপনার ভালোবাসাকে হেফাজত করুন আপনার স্বপ্নের রাজকুমারের জন্য।
পাশ্চাত্য ভোগবাদী সভ্যতার অনুসরণে অবৈধ প্রেম ও ভালোবাসার নামে যদি আপনি বিয়ের আগেই এসবের নির্মম অপচয় করেন, নিজের জীবন ও যৌবনের পবিত্রতা যদি নষ্ট করেন, তাহলে একজন পবিত্র স্বামীর আসা আপনি কখনোই করতে পারেন না। একটি সুখময় দাম্পত্য জীবন আপনার কপালে কখনোই জুটবেনা। আপনি যেমন - নিজের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ও যৌবনকে কলুষিত করেছেন; তেমনি আপনার জীবনে এমন এক পুরুষ আসবে যে আপনার মতোই তার আবেগ, অনুভূতি ও যৌবনের পবিত্রতা নষ্ট করে বসে আছে।সুতরাং সাবধান হে বোন! নিজের জীবনকে নিজের হাতে বরবাদ করবেন না।
প্রিয় বোন! আপনারও কি মন চায় না, মুহাম্মাদুর রাসুল (ﷺ) ও খাদিজা ত্বহিরার মতো একটি সুখময় জান্নাতি জীবন লাভ করতে! বোন! আপনি কি জানেন! প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজাকে কত ভালোবাসতেন!
প্রিয়তমার মৃত্যুর পর বহু বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু তিনি কখনো প্রিয়তমা খাদিজা ত্বহিরাকে ভুলতে পারেননি। মুসনাদে আহমাদ ও আল-মু'জামুল কাবীরে সহীহ্ সনদে বর্ণিত হয়েছে: হযরত আইশা রা. বলেন, একবার খাদিজার বোন হা'লা রাসূলের ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইল; রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো যেন খাদিজাই অনুমতি চাচ্ছেন। দু'বোনের কন্ঠস্বর একই রকম হওয়ার কারনে রাসূল ﷺ এর মনে খাদিজার কথা উদিত হলো। তিনি বলে উঠলেন, ইয়া আল্লাহ! এ যেনো হা'লা হয়।
আইশা রদ্বীয়াল্লহু আনহা বলেন তখন আমার ঈর্ষা জেগে উঠলো। আমি বললাম, "কুরাইশের দাঁত পরা এক বৃদ্ধ মহিলা - সময়ের আবর্তে যে হাড়িয়ে গেছে, তার স্বরণে আপনি এখনো পরে আছেন! আল্লাহ তো আপনাকে তার চেয়ে উত্তম বদলা দিয়েছেন!"
এ কথা শুনে রাসূলের চেহারার রং পরিবর্তিত হয়ে গেলো, তার এমন চেহারা আমি কেবল দেখেছি তার উপর যখন ওহী নাজিল হতো কিংবা আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যেতো। তিনি বললেন , “আল্লাহ তাআলা খাদিজার চাইতে উত্তম কাউকে দেন নি আমায়। যখম মানুষ আমার সাথে কুফরি করেছে তখন খাদিজা-ই আমার প্রতি ঈমান এনেছিলো। যখন মানুষ আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তখন খাদিজাই আমাকে সত্যায়ন করেছে, মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে, তখন খাদিজাই আমাকে তাঁর সম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছে। অন্য সব স্ত্রীর মাধ্যমে যেখানে সন্তান পাওয়া থেকে আমি বঞ্চিত, আল্লাহ খাদিজার মাধ্যমে আমাকে সন্তান দান করেছেন।
এরপর আইশা রদ্বীয়াল্লহু আনহা বললেন সেই সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন আমি আর কখনো তাঁর সম্পর্কে মন্দ কিছু বলবো না, সব সময় তার প্রশংসাই করবো।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল বোনকে খাদিজা ত্বহিরার মতো পবিত্র জীবন দান করুন আমীন ইয়া রব্বাল আ'লামীন।
Comment