রাসূল সা: যখন পবিত্র মক্কা নগরীতে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে গিয়ে মক্কার কাফেরদের অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য করতে হয়ে ছিলো ঠিক তখন মহান আল্লাহ তার হাবীবকে এক মহান সান্তনার বানী দান করলেন । আল্লাহ বলেনঃ
فَاِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا ۙ﴿۵﴾ اِنَّ مَعَ الۡعُسۡرِ یُسۡرًا ؕ﴿۶﴾
সুতরাং কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে,
নিশ্চয় কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে।(সূরা ইনশিরাহ ৫/৬)
অত্র আয়াতে কষ্টের পরে স্বস্তি বলা হয় নি, বরং কষ্টের সাথেই স্বস্তি বলা হয়েছে। তার একটি মহান উদাহরণ হলো রাসূল সাঃ যখন তার সবচেয়ে কাছের মানুষ হযরত খাদীজা (রাঃ) ও চাচা আবু তালেবকে হারালেন, ঠিক এর কিছু দিন পরেই আল্লাহ তার হাবীবকে মীরাজে নিয়ে গেলেন। যেখানে রাসূল সাঃ স্বয়ং আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করলেন। অনেক সময় দেখা যায় অনেক আল্লাহর প্রিয় বান্দা দিনের পর দিন জেল জুলুমের স্বীকার হন। বাহ্যিক চোখে দেখা যায় তারা প্রচুর কষ্টে দিন অতিবাহিত করতেছেন।
কিন্তু অনেক সময় আল্লাহ সেখানেও তাদের স্বস্তি দান করেন। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেখানে প্রিয় নবী সাঃ কে স্বপ্নে দেখেন। প্রিয় নবী স্বপ্নে তাদের সান্তনা দেন, এছাড়াও অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যা অন্তরে প্রশান্তি এনে দেয়।
আবার অনেকের কষ্টের মাত্রা বাড়তে বাড়তে দুনিয়া থেকেই বিদায় নেন।দুনিয়াতে তারা স্বস্তি না পেলেও মহা স্বস্তির ও সুখের জায়গায় তারা চলে যান। যেমনঃ হযরত ইয়াসির (রাঃ) ও সুমাইয়া (রাঃ) সহ যুগের আরো বড় বড় ইমামরা রয়েছেন। যাদের অনেকের লাশ জেল থেকে বের হয়েছে।
এখন একটা প্রশ্ন হলো কষ্টের সাথে স্বস্তি লাভ হয় কিভাবে?
#আল্লাহ পরবর্তী আয়াতে বলেনঃ
فَاِذَا فَرَغۡتَ فَانۡصَبۡ ۙ﴿۷﴾
অতএব আপনি যখনই অবসর পান তখনই কঠোর ইবাদাতে রত হোন।(সূরা ইনশিরাহ ৭)
অত্র আয়াতে আল্লাহ তার হাবীবকে বলতেছেন আপনি যখনই অবসর হবেন তখন কঠোর ইবাদাতে আত্মনিয়োগ করুন।যখনই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ থেকে অবসর হবেন, তখন অন্য কাজের জন্য তৈরী হয়ে যান। আর তা হলো, আল্লাহর যিকির, দোয়া, ইস্তেগফার, নফল ইবাদাত, ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হলো রাসূল সাঃ কি থেকে অবসর হবেন? কেননা অত্র আয়াত মাক্কী জীবনে নাযিল হয়েছে আর তিনিতো সে সময় দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতেন। দাওয়াত ও তাবলীগের কাজও সর্ববৃহৎ ইবাদাত। অথচ উনাকেই বলা হচ্ছে এসব কাজ থেকে অবসর হলে কঠোর ইবাদাতে আত্মনিয়োগ করার জন্যে।
আসলে দাওয়াত, তাবলীগ, মানুষকে সংশোধনের কাজ ছিলো মানুষের মধ্যস্থতায় এবাদাত। আয়াতের উদ্দেশ্য আপনি শুধু এ জাতীয় ইবাদাতে ক্ষান্ত হবেন না, বরং যখনই এসব ইবাদাত থেকে অবসর পাবেন তখন প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করুন। তার কাছেই কাজের সাফল্যের জন্য দোয়া করুন।আর আল্লাহর যিকির ও প্রত্যক্ষ ইবাদাতই তো আসল উদ্দেশ্য। এ জন্যই মানুষের সৃষ্টি। তাবলীগের কাজেরও মূল উদ্দেশ্যও হলো এটি।
আয়াতে فَانۡصَبۡ শব্দটি نصب থেকে উদ্ভুত। এর আসল অর্থ পরিশ্রম ও ক্লান্তি। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এবাদাত ও যিকির এতটুকু করা উচিত যে, তাতে কিছু কষ্ট ও ক্লান্তি অনুভূত হয়।
পাঠক এবার কল্পনা করুন, রাসূল সাঃ তাবলীগের কাজে কত বেশি কষ্ট করতেন, এরপরেও আবার বলা হচ্ছে এসব কাজ থেকে অবসর হওয়ার পর তিনি এতো বেশি দোয়া, যিকির ইস্তেগফার, নফল নামাজ পড়েন যাতে করে কষ্ট ক্লেশ হয়। অথচ আমাদের অবস্থা হলো এমন যে, আমরা বড় একটু কাজ করতে পারলে, একটু কষ্টের কাজ করতে পারলে তখন অন্য ইবাদাতের দিকে আর মনোনিবেশ করি না। আমরা দোয়া, যিকির ইত্যাদিকে হালকা ভাবে দেখি। যার ফলে আমাদের কষ্টের পর স্বস্তি আসে না আর আসলেও সেটা খুব ফলফসূ হয় না।
যখন মূল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যিকির, দোয়া, নফল ইবাদাত, তাহাজ্জুদ আদায় করা হবে তখন কষ্ট ঠিকই হবে।এজন্যই তো প্রিয় নবী সাঃ এর মত শক্তিশালী মানুষ তাহাজ্জুদ পড়তে পড়তে পা ফুলে যেত। কেননা তিনি একদিকে সব দায়িত্ব পালন করতেন আবার এসকল ইবাদাতেও কষ্ট করতেন। কিন্তু আমাদের পা ফুলে না কেন?
প্রিয় নবী সাঃ যখন তায়েফে পাথরের আঘাতো জর্জরিত হয়ে ফিরতেছেন তখনও তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে ভুলেন নি। তিনি সে রাতেও ক্লান্তশ্রান্ত শরীর নিয়ে রবের সামনে দাড়িয়ে কিয়ামূল লাইল করেছেন। অথচ আমরা হলে কি এরকম অবস্থায় আহত শরীর নিয়ে কিয়ামূল লাইল করতাম?
তবে যদি মূল দায়িত্ব ছেড়ে, চেষ্টা প্রচেষ্টা ছেড়ে এমনিই দোয়া, যিকিরে সময় ব্যায় করে তখন এর ফলাফল তেমন ভালো হবে না। এর দ্বারা তেমন কষ্ট ক্লেশও হয় না।
#একজন দ্বীনের কর্মী যখন তার কাজের পাশাপাশি দোয়া, যিকির, বিভিন্ন নফল ইবাদাত করবেন,তাহাজ্জুদ পড়বেন তখন তার তাযকিয়া অর্জন হবে। আর তাযকীয়া যার যত বেশি হবে দ্বীনের কাজ তার দ্বারা ততবেশি হবে।তার কাজ তত ফলফসূ হবে। আল্লাহ বলেনঃ
قَدۡ اَفۡلَحَ مَنۡ زَکّٰىہَا ۪ۙ﴿۹﴾ وَ قَدۡ خَابَ مَنۡ دَسّٰىہَا ﴿ؕ۱۰﴾
. সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে।আর সে-ই ব্যর্থ হয়েছে, যে নিজেকে কলুষিত করেছে।(সূরা আশ শামশ ১০)
মহান আল্লাহ প্রতিটি কথাই সর্বশ্রেষ্ঠ কথা, এরপরেও যখন তিনি কসম করে কিছু বলেন তখন তার দাম আরো বেড়ে যায়। আর আল্লাহ কুরআনে বহু জায়গায় বহুবার কসম করেছেন, কোথায় দুই বার, কোথাও তিন কিংবা চার বার। কিন্তু সূরা আশ শামশে আটবার কসম করে বলেছেন, "সফল সে, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করলো"।
যুগে যুগে যারাই ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে নফসকে পরিশুদ্ধ করে দ্বীনের কাজ করেছেন তাদের দ্বারাই দ্বীনের বিশাল বিশাল কাজ সম্পাদিত হয়েছে।
যেমন মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ হাসান আল বান্না (রহঃ)ছাত্র জীবন থেকে তাযকীয়ার জন্য দীর্ঘ সাধনা করেছেন। তৎকালীন বড় বড় শাইখদের নিকট থেকে তিনি তাযকীয়া লাভ করেছেন।তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য একজন হলেন শাইখ হোছাফী (রহঃ)।
তিনি শাইখদের সান্নিধ্যে থেকে দীর্ঘ সময় চুপ থাকতেন, যিকির করতেন, খোঁড়া কবরের ভিতরে বসে বসে কবরের চিন্তা করে কান্নাকাটি করতেন।এরপর যখন তিনি দাওয়াতি কাজ শুরু করেন, মাত্র অল্প দিনে তার দাওয়াত গোটা মিশরের আনাচে কানাচে পৌছে যায়। এমনকি তিনি মিশর থেকে একদল দক্ষ সৈনিক জিহাদের জন্য ফিলিস্তিন প্রেরন করেন, যারা বিরাট সফলতাও অর্জন করেছে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন হাসান আল বান্নার ডায়েরি)
উপমহাদেশের বিখ্যাত মুজাহিদ শহীদ আহমদ বেরেলভী (রহঃ) ও বড় বড় শাইখদের থেকে তাযকীয়া লাভ করেছেন, ফলে অল্প দিনে উনি বিরাট সফলতাও লাভ করেন। উনার দাওয়াত দূরদূরান্তে ছড়িয়ে যায়।
শায়েখ ইমাম ইবনে তাইমিয়ার রহঃ জীবনি দেখুন, উনি ছিলেন একাধারে একজন মুজতাহিদ ইমাম,রনাঙ্গনের মুজাহিদ ও মাজলুম।কিন্তু তিনিও এসবের পাশাপাশি দোয়া যিকির,আযকারে, তাযকিয়ায় ব্যাপক সময় দিতেন।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর ছাত্র হাফেজ বাজ্জার রহঃ বলেন,
"শায়েখ রহঃ এর অভ্যাস ছিল যে,তার সাথে ফজরের পরে প্রয়োজন ব্যতীত কেউ কথা বলত না। ফজরের পরে তিনি এমনভাবে যিকির করতেন যে, তিনি শ্রবন করতেন কখনও তার পাশের ব্যক্তিও শুনতে পেত। যিকিরের মাঝে মাঝে তিনি আসমানের দিকে তার দৃষ্টি ঘুরাতেন।সূর্যোদয় এবং নামায আদায়ের নিষিদ্ধ সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি তার আমল ছিল।আমি যখন দামেশকে অবস্থান করছিলাম, সারাদিন এবং রাতের অধিকাংশ তার সাথে অতিবাহিত করতাম। তিনি আমাকে তার নৈকট্য দানে ধন্য করেন, এমনকি তিনি আমাকে পাশে বসাতেন। তিনি কি পড়তেন এবং কি কি যিকির করতেন তা আমি শুনতে পেতাম।আমি দেখলাম যে তিনি বার বার সূরা ফাতেহা পড়েন এবং এর মাঝেই সমস্ত সময় অতিবাহিত করেন অর্থাৎ ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত "
( আল আলামূল আলিয়া ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, আল্লামা বাজ্জার (রহঃ) খ--১, পৃষ্ঠা ৩৮)
ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বর্ননা করতেন "একদা ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ তার নিকট আগমন করেন, তখন সূর্য অনেক উপরে উঠে যাওয়া সত্ত্বেও ইবনে তাইমিয়া রহঃ তার যিকিরের হালতে রয়েছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এতে আশ্চর্য ন্বিত হলেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া বললেন, যিকির হল আমার সকালের নাস্তা, যদি আমি এটি আহার না করি আমার শক্তি চলে যাবে "
[আল ওয়াবিলুস সাইয়্যিব, পৃষ্টা ৫৩, আর -রদ্দুল ওয়াফির, পৃষ্ঠা -৬৯]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ এর আমলও এটি ছিল। তিনিও দীর্ঘ সময় যিকির করতেন, এমনকি দিনের অনেক অংশ অতিবাহিত হয়ে যেত।
[ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযিয়া হায়াতুহু ও আছারুহু, পৃষ্টা ৪৬]
বর্তমানেও যারা দ্বীনের কাজ করেন, যাদের দ্বারা দ্বীনের বড় বড় কাজ হয়, তারা ব্যক্তিগত ভাবে ব্যাপক আমল করেন, পাঠক ডা.জাকির নায়েকের রুটিন যেনে নিন। তিনি দীর্ঘ সময় তাহাজ্জুদ পড়েন আবার ফজরের পর তার চাশতের নামাজও ছুটে না। কল্পনা করুন উনি কত বড় মাপের দায়ী হওয়ার পরেও এসব নফল ইবাদাত উনার ছুটে না। বাংলাদেশেও যাদের দাওয়াতে মানুষ দ্বীনের পথে আসে তাদের ব্যাপারে খবর নিলেও দেখবেন তারা ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি আমল করেন।
মোটকথা, যার তাযকীয়া যত বেশি হবে তার দ্বারা দ্বীনের কাজ তত নিখুঁত ও ফলদায়ক হবে।যখন একজন দ্বীনের কর্মী তার কাজের পাশাপাশি দোয়া, যিকির, ইস্তেগফার, নফল ইবাদাতে আত্মনিয়োগ করবেন তখন তার মাঝে দেখা যাবে বিশেষ বিশেষ যোগ্যতা চলে আসে। ফলে তার মাধ্যমে দ্বীনের ব্যাপক খেদমত লাভ হয়।
দ্বীন কায়েমের যে কর্মী যত বড় হন তার উচিত নিজের প্রতিটি আমলের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া।কেউ যদি ১০/১৫ জনের দায়িত্ব শীল হন তাহলে তার উচিত নিজের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া।কেননা অধীনস্ত কর্মীরা তার নেতাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে আর হাদীসে আছেঃ
عن أبي هريرة رضي الله عنه أَن النبيَّ -صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم- قَالَ: «الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ، فَلْيَنْظُر أَحَدُكُم مَنْ يُخَالِل».
[حسن] - [رواه أبوداود والترمذي وأحمد]
আবু হুরাইরাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক মারফু হিসেবে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর হয়। অতএব তোমাদের প্রত্যেককে দেখা উচিত কাকে বন্ধু বানাবে।”
সুতরাং যিনি যত বড় নেতা হবেন তার উচিত বিশেষ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাহাজ্জুদ থেকে শুরু করে সব আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া। কেননা তার মতই দ্বীন পালন করবে তার অধীনস্তরা।
#হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন জিব্রাইল (আ.)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাসো। রাবি বলেন, অতঃপর জিব্রাইল (আ.)-ও তাকে ভালোবাসতে থাকেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তাআলা অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন আকাশের অধিবাসীরাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। অতঃপর সেই বান্দার জন্য জমিনেও স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়। আর যখন আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন জিব্রাইল (আ.)-কে ডেকে বলেন যে, আমি অমুককে ঘৃণা করি, তুমিও তাকে ঘৃণা করো। রাবি বলেন, অতঃপর জিব্রাইল (আ.)-ও তাকে ঘৃণা করেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তাআলা অমুক ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন, তোমরাও তাকে ঘৃণা করো এবং আকাশবাসীরাও তার প্রতি ঘৃণাপোষণ করেন। অতঃপর তার জন্য জমিনেও ঘৃণা স্থাপন করা হয়।’(মেশকাত: ৫০০৫; মুসলিম ১৫৭-(২৬৩৭৮), সহিহুল জামে: ২৫৮৫; আহমদ; ৮৫০০)
একজন দ্বীন কায়েমের কর্মী যখন সত্যিকারেই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারবেন, মানুষের জনপ্রিয়তার আশা না করে রবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় কাজ করে যাবেন। তখন মহান আল্লাহ জমিনেই তার গ্রহনযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিবেন। সকল মুসলমানরা তাকে ভালোবাসবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবে কিভাবে?
হাদিসে এসেছেঃ
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : «إنَّ اللهَ قال: مَن عادى لي وليًّا فقد آذنتُه بالحرب، وما تقرَّب إليَّ عبدي بشيء أحب إليَّ مما افترضتُ عليه، وما يزال عبدي يتقرَّب إليَّ بالنوافل حتى أحبَّه، فإذا أحببتُه: كنتُ سمعَه الذي يسمع به، وبصرَه الذي يُبصر به، ويدَه التي يبطش بها، ورجلَه التي يمشي بها، وإن سألني لأعطينَّه، ولئن استعاذني لأُعيذنَّه، وما تردَّدتُ عن شيء أنا فاعلُه تردُّدي عن نفس المؤمن، يكره الموتَ وأنا أكره مساءتَه».
[صحيح] - [رواه البخاري]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু‘ হিসেবে বর্ণিত, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: যে আমার কোনো অলীর সাথে শত্রুতা করবে, আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছি। আর আমি বান্দার উপর যা ফরয করেছি তার চেয়ে প্রিয় কোনো জিনিস নেই যার দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করবে, আর বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, এক সময় আমি তাকে মহব্বত করি। আর আমি যখন তাকে মহব্বত করি, আমি তার কানে পরিণত হই, যার দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং তার চোখে পরিণত হই, যার দ্বারা সে দেখে এবং তার হাতে পরিণত হই যার দ্বারা সে স্পর্শ করে এবং তার পায়ে পরিণত হই, যার দ্বারা সে হাঁটে, আর যদি সে আমার নিকট প্রশ্ন করে, আমি অবশ্যই তাকে দিব, আর যদি আমার নিকট পানাহ চায়, আমি অবশ্যই তাকে পানাহ দিব, আমি যা করতে চাই সেটা করতে কোনো দ্বিধা করি না, যেরূপ দ্বিধা করি মুমিনের নফসকে গ্রহণ করতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তাকে কষ্ট দিতে অপছন্দ করি।”
সহীহ - এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন।
বান্দা ফরজ ইবাদাতের মাধ্যমেই আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্য লাভ করে। তাই একজন দ্বীন কায়েমের কর্মীকে ফরযের ব্যাপারে সর্বাধিক নজর দিতে হবে। এরপর শুধু ফরয ইবাদাত করেই ক্ষান্ত হবে না। সাথে সাথে অধিক পরিমানে নফল ইবাদাত করতে হবে, ফলে এক পর্যায়ে আল্লাহ বান্দাকে সীমাহীন ভালোবাসেন। দেখুন এখানে শুধু ফরযের কথা বলা হয় নি। এর পাশাপাশি নফল ইবাদাত করতে বলা হয়েছে। আর এভাবে রবের প্রিয় বান্দা হওয়া যায়। একটা সময় যখন আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবে তখন আল্লাহ তা'য়ালা সবার মাঝে গ্রহনযোগ্যতা দিয়ে দেন৷
#যারা দ্বীনের কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা অনেক সময় বাহ্যিক শত্রুকে নিয়ে যতটা সতর্ক থাকেন, অভ্যন্তরিন শত্রু নিয়ে ততটা সতর্ক থাকেন না। অভ্যন্তরিন শত্রুর কথা তারা বেমালুম ভুলে যান। আর সে শত্রু হলো শয়তান ও নফস। অনেক সময় দেখা যায় শয়তান যখন কোন ভাবেই কোন দ্বীনদারের ক্ষতি করতে না পারে, দ্বীন কায়েমের কাজ বন্ধ করতে না পারে তখন সে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। সে দ্বীনের সৈনিক, দায়ী, আলিম দ্বারা এমন অনেক কাজ করান যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখা যায় অনেক ভালো, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে দেখা যায় সে কাজ দ্বারা দ্বীন কায়েমের ক্ষতি হয়। আল্লাহর সাহায্য থেকে মাহরুম হতে হয়। কিন্তু শয়তানের এই ধোকা থেকে বাচবেন কিভাবে? ডাল তলোয়ার, অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে বাহ্যিক শত্রুর মোকাবিলা করা গেলেও অভ্যন্তরিন শত্রুর মোকাবিলাতো সম্ভব নয়। নিজের পর্যাপ্ত জ্ঞান দিয়েও এই মোকাবিলা সম্ভব নয়, কেননা আপনার বয়সও কম, অভিজ্ঞতাও কম।অপরদিকে শয়তানের রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে বড় বড় জ্ঞানী, আমলদ্বার লোকদের ধোঁকা দেওয়ার অভিজ্ঞতা। তাই তার ধোকা থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে হবে, তার নিকট দোয়া করতে হবে। নতুবা আপনি শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচতে পারবেন না। মহান আল্লাহ বলেনঃ
,وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِ إِنَّهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ-
‘শয়তানের কুমন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহ’লে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ কর। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আ‘রাফ ৭/২০০; সূরা ফুসসিলাত ৪১/৩৬)
এছাড়াও শয়তান অনেক সময় দেখা যায় যখন একজন ব্যক্তিকে কোন ভাবেই আর দ্বীন থেকে ফিরাতে পারে না, তখন সে তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে বসে। যাতে ওই দ্বীনদারের দ্বারা অন্য কেউ উপকৃত না হয়, হিদায়েত না পায়। আর তাই আপনাকে দ্বীনকায়েমের কাজের পাশাপাশি অনেক বেশি দোয়া, যিকির, ইস্তেগফার করতে হবে। যাতে শয়তানের এই ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারেন।
#আমরা অনেকেই নিজেদের যোগ্যতা, চেষ্টা প্রচেষ্টাকেই সফলতার মাধ্যম মনে করে থাকি। আমরা ভুলে যাই যে, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন নেক কাজই সম্ভব নয়। ফলে আমরা দোয়া করি না, রবের নিকট সাহায্য কামনা করি না। অথচ দোয়া দ্বারা বিশাল বিশাল কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়।যেমনঃ হযরত সুলাইমান আঃ এতো বিরাট রাজত্বের বাদশাহ কিভাবে হয়েছেন? তিনিতো দোয়ার মাধ্যমেই পেয়েছেন।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَّا يَنبَغِي لِأَحَدٍ مِّن بَعْدِي ۖ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
তিনি বলেন, ‘হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে এমন এক রাজ্য দান করুন, যার অধিকারী আমি ছাড়া আর কেউ যেন না হয়। আপনি তো পরম দাতা।’ (সুরা : সাদ, আয়াত : ৩৫)
হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম এর দোয়ার ফলে আল্লাহ উনাকে এমন বাদশাই দান করলেন যে, তার পর এতো বড় বাদশাহ আর কেউ হয় নি।
এরপরে হযরত মূসা আঃ দিকে খেয়াল করুন, তিনি যখন নবুওয়ত পেলেন, ফেরাউনকে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব পেলেন তখন তিনি নিজের যোগ্যতার উপর ভর করে কাজ শুরু করেন নি, বরং তিনি দোয়া করেছেন।
رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ وَ يَسِّرْلِيْ أَمْرِيْ وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِيْ يَفْقَهُوْا قَوْلِيْ
অর্থ : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার
বক্ষ প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কাজ সহজ করে দাও। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সুরা ত্বাহা : আয়াত ২৫-২৮)
কল্পনা করুন, একজন নবী হয়েও তিনি প্রথমে তার কাজ সহজতার জন্য দোয়া করেছেন। আবার নিজের দূর্বলতার কথা তুলে ধরেছেন।তিনি আরো দোয়া করেছেনঃ
-وَ اجْعَلْ لِيْ وَزِيْراً مِنْ أَهْلِيْ هَارُوْنَ أَخِيْ اشْدُدْ بِهِ أَزْرِيْ وَ أَشْرِكْهُ فِيْ أَمْرِيْ :
অর্থ : ‘আমার জন্য আমার স্বজনদের মধ্য থেকে একজন সাহায্যকারী করে দাও আমার ভাই হারূনকে, তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় কর ও তাকে আমার কাজে অংশী কর।’ (সুরা ত্বাহা : আয়াত ২৯-৩২)
মূসা আঃ দোয়ার ফলে আল্লাহ উনার ভাই হারুন আঃ কে সাধারন মানুষ থেকে নবী বানিয়ে দিলেন। চিন্তা করুন দোয়ার কত শক্তি।
অথচ আমরা নিজেদের চেষ্টা,পরিশ্রম, যোগ্যতাকেই সব মনে করি। দোয়াকে প্রাধান্য দিয় না।
নবী ইউনূস আঃ মাছের পেট থেকে কিভাবে উদ্বার হয়েছেন? তিনিও তো দোয়ার ফলে সেখান থেকে উদ্বার হয়েছেন। তাইতো যারা দ্বীন কায়েমের কাজ করেন তাদের অনেক বেশি পরিমানে দোয়া, ইস্তেগফার করা উচিত। কেননা তাদের কাজ অনেক বড় কাজ, এই কাজে প্রতিবন্ধকতাও অনেক বেশি,ধোকাও অনেক বেশি। তাই তাদের উচিত কাজের পাশাপাশি প্রচুর নফল ইবাদাত ও দোয়া, যিকির করা।
#আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡ کَبَدٍ ؕ﴿۴﴾
নিঃসন্দেহে আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে।(সূরা বালাদ ৪)
মানুষ এই পৃথিবীতে কষ্ট করতেই হয়, কষ্ট ছাড়া কেউ জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। যে মা সন্তান জন্ম দেয় তাকে সন্তান জন্ম দেওয়ার কষ্ট সহ্য করতে হয়। আর যে মহিলা জন্ম দেয় না তাকে নিসন্তান থাকার কষ্ট করতে হয়।
যিনি তাহাজ্জুদ, দোয়া, ইস্তেগফারে কষ্ট স্বীকার করবেন তার জন্য দ্বীনের অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে। যেমন রাসূল সাঃ হযরত ওমর রাঃ কে সরাসরি গিয়ে দাওয়াত দিতে হয় নি। শুধু মাত্র দোয়ার ফলেই হযরত ওমর রাঃ ইমান এনেছেন।
তাই আমাদের প্রতিটি ভাইকে দ্বীন কায়েমের সর্বাত্মক চেষ্টার পাশাপাশি যদি দোয়া, যিকির, নফল ইবাদাতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে ইনশাআল্লাহ একদিন বিজয়ের মুকুট মাথায় এসে ধরা দিবে।
#প্রতিটি ভাইয়ের বিশেষ কিছু ওজিফা থাকা চাই। যে ওজিফা কখনই ছাড়বে না। যেমনঃসকালে বা রাতে কিছু নফল নামায, কিছু বিশেষ যিকির, ইস্তেগফার। বিশেষ করে সপ্তাহে কমপক্ষে একটি রোজা রাখার চেষ্টা করা উচিত। কেননা রোজা তাকওয়া বাড়ায়। আর আল্লাহ তাকওয়া সম্পর্কে বলেছেনঃ
وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰہَ یَجۡعَلۡ لَّہٗ مَخۡرَجًا ۙ﴿۲﴾ وَّ یَرۡزُقۡہُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ
আর যে কেউ আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তার জন্য (উত্তরণের) পথ করে দেবেন। এবং তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযিক।(সূরা তালাক ২/৩)
এছাড়াও রোজার মাধ্যমে আধ্যাত্বিকতার চরম উন্নতি হয়।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন।
Comment