"এসো আমরা নক্ষত্র হই"
হাজার হাজার মানুষ ঘন অন্ধকার মরুভূমিতে আটকে আছে। কোনো দিক নির্ণয় করতে পারছে না, কখনও এদিক আবার কখনও ওদিক যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় আকাশে নক্ষত্র উদিত হলো, ফলে তারা দিক নির্ণয় করতে পারলো এবং গন্তব্যে রওয়ানা হলো। কিন্তু কে হবে সেই নক্ষত্র, যার মাধ্যমে মানুষ পথের দিশা পাবে? মানুষ তার গন্তব্যের দিক নির্ণয় করতে পারবে? আসুন জেনেই নেই সেই নক্ষত্র সম্পর্কে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ مَثَلُ نُوۡرِہٖ کَمِشۡکٰوۃٍ فِیۡہَا مِصۡبَاحٌ ؕ اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّہَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ زَیۡتُوۡنَۃٍ لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّ لَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ یَّکَادُ زَیۡتُہَا یُضِیۡٓءُ وَ لَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡہُ نَارٌ ؕ نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ یَہۡدِی اللّٰہُ لِنُوۡرِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿ۙ۳۵﴾
আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি; তাঁর জ্যোতির উপমা যেন সে তাকের মত; যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ; যা পবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল হতে প্রজ্জ্বলিত হয়, যা প্রাচ্যের নয়, প্রতীচ্যেরও নয়, অগ্নি স্পর্শ না করলেও মনে হয় ওর তৈল যেন উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; জ্যোতির উপর জ্যোতি! আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির দিকে পথনির্দেশ করেন। আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। (সুরা নূরঃ ৩৫)
আল্লাহ প্রথমে বলেছেন তিনি আসমান ও জমিনের আলো। আনাস বিন মালেক রাঃ বলেছেনঃ এই নূর হলো তার হেদায়েত। সুদ্দী রহঃ বলেনঃ তার জ্যোতিতেই আসমান ও জমিন উজ্জ্বল রয়েছে।
( তাফসীর ইবনে কাসীর)
যে ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহ আছেন, অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ইমান, ভয়, ভালোবাসা আছে, তার মাঝেই আছে নুর। কিন্তু যার মাঝে এই নূর নাই, সে হয় দিকভ্রান্ত, পথহারা। কেননা যত সৌন্দর্য আছে সব সৌন্দর্য তখনই দেখা যায় যখন আলো থাকে। আলো থাকলেই সব সৌন্দর্যের থেকে সুখ পাওয়া যায়। কিন্তু যার মাঝে নূর নেই সেতো তার মত, যে কিনা মরুভূমির অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে।
একটা ঘর যতই সুন্দর হোক, তাতে যদি আলো না থাকে তাহলে তার সৌন্দর্যতো দেখা যায় না বরং উল্টো অন্ধকারে একেকবার একেক দেয়ালে আঘাত খেতে হয়।
এরপর আল্লাহ এই নূরের খুব সুন্দর উদাহরন দিলেন।
এসম্পর্কে ইবনে কাসীরে বলা হয়েছেঃ
ইব্ন আব্বাসের (রাঃ) মতে نُوۡرِہٖ এর 'ه' সর্বনামটি আল্লাহর দিকে ফিরেছে।
অর্থাৎ আল্লাহর হিদায়াত যা মু'মিনের অন্তরে রয়েছে ওর উপমা এইরূপ। আবার কারও মতেঃ সর্বনামটি মুমিনের দিকে ফিরেছে। অর্থাৎ মু'মিনের অন্তরের জ্যোতির দৃষ্টান্ত যেন একটি দীপাধার। সুতরাং মু'মিনের অন্তরের পরিচ্ছন্নতাকে প্রদীপের কাঁচের সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। অতঃপর কুরআন ও শারীয়াত দ্বারা যে সাহায্য সে পেয়ে থাকে, ওটার উপমা দেয়া হয়েছে যাইতূনের ঐ তেলের সাথে যা স্বয়ং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চকমকে ও উজ্জ্বল। অতএব দীপাধার এবং দীপাধারের মধ্যে প্রদীপ এবং প্রদীপটিও উজ্জ্বল। (ইবনে কাসীর)
অর্থাৎ এখানে মুমিনের নূরকে একটি প্রদীপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। চন্দ্র, সূর্যের সাথে তুলনা করা হয় নি। কেননা প্রদীপতো তখন জ্বলে যখন অন্ধকার থাকে।
আর সূর্য, চন্দ্র আলো দেয়, কিন্তু এক সূর্য থেকে আরেক সূর্য বানানো যায় না। এক চন্দ্র থেকে আরেক চন্দ্র বানানো যায় না। সূর্যের আলো সব জায়গায় একই সময় থাকে না, সব জায়গায় পৌছেও না, বিশেষ করে ঘন জঙ্গলে। সূর্যের কিংবা চন্দ্রের আলোর জন্য জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে না।
অপরদিকে, একটি প্রদীপের আলো থেকে হাজারটা প্রদীপ জ্বালানো যায় বরং সারা পৃথিবীর সব প্রদীপ জ্বালানো যায়। প্রদীপের আলো সব জায়গায় পৌছানো যায়। কেউ যদি অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী থাকে সেখানেও এই আলো পৌছানো যায়। প্রদীপের আলো তখনিই সবচেয়ে বেশি উপকারে আসে যখন অন্ধকার খুব বেশি থাকে। যে অন্ধকারের কারনে মানুষ ভয়ংকর গর্তে বা বিপদ জনক জায়গায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই পৃথিবী পাপ ও ফিতনা, জুলুমের অন্ধকার সব সময় থাকে, আর এই হিদায়েতের নুর,আল্লাহকে ভালোবাসা ও ভয়ের নূর এসেই এই অন্ধকার দূর করে।
আর এরপর অন্তরের স্বচ্ছতাকে কাচের উপমা দ্বারা বুঝানো হয়েছে। যা হলো দেখতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত।
আমরা জানি নক্ষত্র তখনই উদিত হয়, যখন থাকে অন্ধকার। আর নক্ষত্র দিয়েই মানুষ দিক নির্ণয় করে। অন্ধকারে পথের দিশা পায়।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَ ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ النُّجُوۡمَ لِتَہۡتَدُوۡا بِہَا فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ قَدۡ فَصَّلۡنَا الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ﴿۹۷﴾
আর তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তা দিয়ে স্থলে ও সমুদ্রের অন্ধকারে পথ পাও। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছেন। (সুরা আন'আম ৯৭)
এখন প্রশ্ন হলো কে হবে সেই কাচের ভিতরে থাকা প্রদীপ যাকে দেখতে নক্ষত্রের মত?
কে হবে সেই প্রদীপ যার থেকে হাজারটা প্রদীপ আলোকিত হবে?
মনে রাখতে হবে কোন জনপদে যদি প্রদীপের আলো কারো মাঝেই না থাকে, তখন প্রদীপের আলো প্রথম যিনি আনবেন তাকে সবার চেয়ে একটু বেশি কষ্ট করতে হয়। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে প্রদীপ পৌঁছাতে গিয়ে বাতাসের সম্মুখীন হতে পারে। তাই প্রদীপ বহনকারীকে সতর্ক হতে হয়, তার আলো নিবু নিবু হলে চলবে না।
তবে একবার যদি কোন জনপদে ভালোভাবে কিছু প্রদীপ জ্বলে উঠে, সে প্রদীপের আলো কোনভাবেই আর নিভিয়ে দেয়া যায় না।
যার মাঝে এই নূর যত বেশি হবে তার জন্য ফেতনাময় এই সমাজে চলা তত সহজ হবে, কেননা অন্ধকার যত বেশি হয় আলোর প্রয়োজনীয়তা ততবেশি দেখা দেয়। যার মাঝে এই নূর বেশি হবে তার দ্বীন নিয়ে পরিকল্পনা তত উন্নত হবে। কারন যার আলো যত বেশি, সে পথের দূরত্ব ততবেশি দেখবে। কেউ হয়ত তার নূর দ্বারা দশ হাত সামনে পর্যন্ত দেখে, আর কেউ একশ হাত। তাইতো অনেক সময় দেখা যায় যে, একশ হাত দেখা ব্যক্তি যা কিছু বলে কিংবা অনুধাবন করে, তা দশহাত দেখা ব্যক্তি বিশ্বাস করতেও অনেক সময় লেগে যায়।
একটা বিষয় দেখুন, আজ কত ইসলামি বই, কত অডিও, ভিডিও, অথচ ইসলামের বিজয় নেই। মানুষ দ্বীনের পথে আসছে না, আসলেও অনেকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু সাহাবীদের সময় এতো বই, ভিডিও অডিও ছিলো না। এতো ওয়াজ মাহফিল ছিলো না, কিন্তু ইসলাম বিজয় ছিলো, মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতো, জিহাদ করতো। কারন তারা ছিলো উজ্জ্বল প্রদীপ। তাদের প্রদীপের নুর ছিলো অনেক বেশি। ফলে তাদের সংস্পর্শে যারাই এসেছে তারাই ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজ থেকে কয়েক শত বছর পূর্বেও এতো বই, অডিও, ভিডিও ছিলো না, অথচ বড় বড় নেককার আলেমদের সামান্য সোহবতে দেখা যেত হাজার হাজার ব্যক্তি ইসলাম গ্রহন করতো। আসলে মুমিনের এই নূর এমন এক নূর, যাহার মাঝে মানুষ শান্তি-সুখের দেখা পায়। যেমন রাসূল সাঃ এর সময় সাহাবীদের অবস্থা এমন ছিলো যে, শত কষ্ট, ক্ষুধা ভুলে যেতেন যখন উনারা রাসূল সাঃ কে দেখতেন। সাহাবীরা উনার মাঝেই সুখ ও প্রশান্তি খুঁজে পেতেন।
সাহাবীদের ইমান দূর্বল হয়ে গেলে যখন উনারা প্রিয় নবীর সোহবতে যেতেন, আবার ইমান তাজা হয়ে যেত। আজকেও যারা নবীর সত্যিকারের খাঁটি ওয়ারিশ তাদের সংস্পর্শে সামান্য কিছুক্ষণ থাকলেই দেখা যায় ইমান তাজা হয়ে যায়, দুঃখ কষ্ট নিমিষেই ভুলে যায়।
এরপরে আল্লাহ বলেছেন সেই প্রদীপ জ্বলে যয়তুনের তেল দ্বারা, যে তেলের বৃক্ষ পূর্বের ও পশ্চিমের নয়। অর্থাৎ সব সময় তাতে সূর্যের আলো পড়ে। ফলে সেই গাছের তেল এতটাই স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল যেন তাতে আগুন দিলেও উজ্জ্বল, না দিলেও উজ্জ্বল মনে হয়। আর সেই যয়তুনের তেল হলো দ্বীনের ইলম। যা সবসময় নিজে নিজে জ্বলে। আর যখন এই উজ্জল যয়তুনের তেল মুমিনের প্রদীপের সাথে একসাথ হয়, তখন হয়ে যায় ''আলোর উপর আলো'', ''নূরুন 'আলা নূর''।
যারা নিজের কলবের নূর বাড়াতে চান, তাদের অবশ্যই এই দ্বীনের ইলম ও আমলের সাথে থাকতে হবে। অনেকে মনে করেন কিছু দিন ইলম অর্জন করলেই হয়। এরপর আর করা লাগে না। তাদের নিকট প্রশ্ন হলো আপনার ঘরে যদি একটি প্রদীপ থাকে সেই প্রদীপে কি আপনি একবার তৈল দিলেই যথেষ্ট হয় নাকি বার বার দেওয়া লাগে? তেল শেষ হলেইতো দেওয়া লাগে। তেমনি আপনার অন্তরের প্রদীপের আলো ঠিক রাখতে হলে সবসময় ইলম ও আমলের সাথে থাকতে হবে। শুধু ইলম অর্জন যথেষ্ট নয়। কেননা আপনার নিকট অনেক তেল আছে কিন্তু আপনি তা প্রদীপে রাখলেন না, তাহলে আপনার প্রদীপের আলো বাড়বে না। বরং আলো ঠিক রাখতে হলে প্রদীপে তেল দিতে হবে। তেমনি আপনি যখন ইলম ও আমল করবেন, তখন আপনার ইমান, তাকওয়া বাড়বে। আর এভাবে হবে "নূরের উপর নূর"। আর আল্লাহ যাকে চান, তার নূরের দিকে হিদায়েত দিবেন।
যদি আপনি আপনার অন্তরে এই প্রদীপ জ্বালাতে পারেন, তাহলে এই প্রদীপ থেকে একদিন হাজারো লাখো প্রদীপ জ্বলবে। যেটা দেখতে হবে নক্ষত্রের মত। হাজারটা নক্ষত্রের আলোতে এক সময় আকাশ এতটাই সুন্দর দেখাবে যে, কারো চোখ সে আকাশ থেকে সরাতে মন চাইবে না। তাই চেষ্টা করুন আপনি আপনার দেশে কিংবা জেলায়, বা গ্রামে সর্বপ্রথম সেই প্রদীপ হবেন, যেই প্রদীপের নূরে গোটা সমাজ আলোকিত হবে। আপনি যদি আপনার গ্রামের, কিংবা শহরের সর্বপ্রথম প্রদীপ হতে পারেন, তাহলে আপনার দ্বারা যতজন হিদায়েত পাবে প্রত্যেকের নেকের সওয়াব আপনি পাবেন। রাসূল সাঃ একজন মাত্র সাহাবী মদীনাতে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন, ফলে মদীনার ঘরে ঘরে ইসলাম প্রবেশ করেছে। সেই সাহাবীর নাম হলো মুসয়াব বিন ওমায়ের (রাঃ)। মদীনাতে যারা ইসলাম গ্রহন করেছে সবার জীবনে যত নেক আমল হয়েছে তার সমপরিমাণ নেকের সওয়াব তিনি পেয়েছেন। কল্পনা করুন, তিনি আমার বা আপনার মতই যুবক, তরুন ছিলেন। কিন্তু এমন এক প্রদীপ ছিলেন যে প্রদীপের নূরে মদীনার ঘর গুলো নূরান্বিত হয়ে গেছে।
আল্লাহ আমাদের দ্বীনের একেকটা প্রদীপ হওয়ার তাওফিক দান করুন, যে প্রদীপ দেখতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত।
হাজার হাজার মানুষ ঘন অন্ধকার মরুভূমিতে আটকে আছে। কোনো দিক নির্ণয় করতে পারছে না, কখনও এদিক আবার কখনও ওদিক যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় আকাশে নক্ষত্র উদিত হলো, ফলে তারা দিক নির্ণয় করতে পারলো এবং গন্তব্যে রওয়ানা হলো। কিন্তু কে হবে সেই নক্ষত্র, যার মাধ্যমে মানুষ পথের দিশা পাবে? মানুষ তার গন্তব্যের দিক নির্ণয় করতে পারবে? আসুন জেনেই নেই সেই নক্ষত্র সম্পর্কে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ مَثَلُ نُوۡرِہٖ کَمِشۡکٰوۃٍ فِیۡہَا مِصۡبَاحٌ ؕ اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّہَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ زَیۡتُوۡنَۃٍ لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّ لَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ یَّکَادُ زَیۡتُہَا یُضِیۡٓءُ وَ لَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡہُ نَارٌ ؕ نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ یَہۡدِی اللّٰہُ لِنُوۡرِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿ۙ۳۵﴾
আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি; তাঁর জ্যোতির উপমা যেন সে তাকের মত; যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ; যা পবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল হতে প্রজ্জ্বলিত হয়, যা প্রাচ্যের নয়, প্রতীচ্যেরও নয়, অগ্নি স্পর্শ না করলেও মনে হয় ওর তৈল যেন উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; জ্যোতির উপর জ্যোতি! আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির দিকে পথনির্দেশ করেন। আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। (সুরা নূরঃ ৩৫)
আল্লাহ প্রথমে বলেছেন তিনি আসমান ও জমিনের আলো। আনাস বিন মালেক রাঃ বলেছেনঃ এই নূর হলো তার হেদায়েত। সুদ্দী রহঃ বলেনঃ তার জ্যোতিতেই আসমান ও জমিন উজ্জ্বল রয়েছে।
( তাফসীর ইবনে কাসীর)
যে ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহ আছেন, অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ইমান, ভয়, ভালোবাসা আছে, তার মাঝেই আছে নুর। কিন্তু যার মাঝে এই নূর নাই, সে হয় দিকভ্রান্ত, পথহারা। কেননা যত সৌন্দর্য আছে সব সৌন্দর্য তখনই দেখা যায় যখন আলো থাকে। আলো থাকলেই সব সৌন্দর্যের থেকে সুখ পাওয়া যায়। কিন্তু যার মাঝে নূর নেই সেতো তার মত, যে কিনা মরুভূমির অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে।
একটা ঘর যতই সুন্দর হোক, তাতে যদি আলো না থাকে তাহলে তার সৌন্দর্যতো দেখা যায় না বরং উল্টো অন্ধকারে একেকবার একেক দেয়ালে আঘাত খেতে হয়।
এরপর আল্লাহ এই নূরের খুব সুন্দর উদাহরন দিলেন।
এসম্পর্কে ইবনে কাসীরে বলা হয়েছেঃ
ইব্ন আব্বাসের (রাঃ) মতে نُوۡرِہٖ এর 'ه' সর্বনামটি আল্লাহর দিকে ফিরেছে।
অর্থাৎ আল্লাহর হিদায়াত যা মু'মিনের অন্তরে রয়েছে ওর উপমা এইরূপ। আবার কারও মতেঃ সর্বনামটি মুমিনের দিকে ফিরেছে। অর্থাৎ মু'মিনের অন্তরের জ্যোতির দৃষ্টান্ত যেন একটি দীপাধার। সুতরাং মু'মিনের অন্তরের পরিচ্ছন্নতাকে প্রদীপের কাঁচের সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। অতঃপর কুরআন ও শারীয়াত দ্বারা যে সাহায্য সে পেয়ে থাকে, ওটার উপমা দেয়া হয়েছে যাইতূনের ঐ তেলের সাথে যা স্বয়ং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চকমকে ও উজ্জ্বল। অতএব দীপাধার এবং দীপাধারের মধ্যে প্রদীপ এবং প্রদীপটিও উজ্জ্বল। (ইবনে কাসীর)
অর্থাৎ এখানে মুমিনের নূরকে একটি প্রদীপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। চন্দ্র, সূর্যের সাথে তুলনা করা হয় নি। কেননা প্রদীপতো তখন জ্বলে যখন অন্ধকার থাকে।
আর সূর্য, চন্দ্র আলো দেয়, কিন্তু এক সূর্য থেকে আরেক সূর্য বানানো যায় না। এক চন্দ্র থেকে আরেক চন্দ্র বানানো যায় না। সূর্যের আলো সব জায়গায় একই সময় থাকে না, সব জায়গায় পৌছেও না, বিশেষ করে ঘন জঙ্গলে। সূর্যের কিংবা চন্দ্রের আলোর জন্য জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে না।
অপরদিকে, একটি প্রদীপের আলো থেকে হাজারটা প্রদীপ জ্বালানো যায় বরং সারা পৃথিবীর সব প্রদীপ জ্বালানো যায়। প্রদীপের আলো সব জায়গায় পৌছানো যায়। কেউ যদি অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী থাকে সেখানেও এই আলো পৌছানো যায়। প্রদীপের আলো তখনিই সবচেয়ে বেশি উপকারে আসে যখন অন্ধকার খুব বেশি থাকে। যে অন্ধকারের কারনে মানুষ ভয়ংকর গর্তে বা বিপদ জনক জায়গায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই পৃথিবী পাপ ও ফিতনা, জুলুমের অন্ধকার সব সময় থাকে, আর এই হিদায়েতের নুর,আল্লাহকে ভালোবাসা ও ভয়ের নূর এসেই এই অন্ধকার দূর করে।
আর এরপর অন্তরের স্বচ্ছতাকে কাচের উপমা দ্বারা বুঝানো হয়েছে। যা হলো দেখতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত।
আমরা জানি নক্ষত্র তখনই উদিত হয়, যখন থাকে অন্ধকার। আর নক্ষত্র দিয়েই মানুষ দিক নির্ণয় করে। অন্ধকারে পথের দিশা পায়।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَ ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ النُّجُوۡمَ لِتَہۡتَدُوۡا بِہَا فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ قَدۡ فَصَّلۡنَا الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ﴿۹۷﴾
আর তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তা দিয়ে স্থলে ও সমুদ্রের অন্ধকারে পথ পাও। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছেন। (সুরা আন'আম ৯৭)
এখন প্রশ্ন হলো কে হবে সেই কাচের ভিতরে থাকা প্রদীপ যাকে দেখতে নক্ষত্রের মত?
কে হবে সেই প্রদীপ যার থেকে হাজারটা প্রদীপ আলোকিত হবে?
মনে রাখতে হবে কোন জনপদে যদি প্রদীপের আলো কারো মাঝেই না থাকে, তখন প্রদীপের আলো প্রথম যিনি আনবেন তাকে সবার চেয়ে একটু বেশি কষ্ট করতে হয়। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে প্রদীপ পৌঁছাতে গিয়ে বাতাসের সম্মুখীন হতে পারে। তাই প্রদীপ বহনকারীকে সতর্ক হতে হয়, তার আলো নিবু নিবু হলে চলবে না।
তবে একবার যদি কোন জনপদে ভালোভাবে কিছু প্রদীপ জ্বলে উঠে, সে প্রদীপের আলো কোনভাবেই আর নিভিয়ে দেয়া যায় না।
যার মাঝে এই নূর যত বেশি হবে তার জন্য ফেতনাময় এই সমাজে চলা তত সহজ হবে, কেননা অন্ধকার যত বেশি হয় আলোর প্রয়োজনীয়তা ততবেশি দেখা দেয়। যার মাঝে এই নূর বেশি হবে তার দ্বীন নিয়ে পরিকল্পনা তত উন্নত হবে। কারন যার আলো যত বেশি, সে পথের দূরত্ব ততবেশি দেখবে। কেউ হয়ত তার নূর দ্বারা দশ হাত সামনে পর্যন্ত দেখে, আর কেউ একশ হাত। তাইতো অনেক সময় দেখা যায় যে, একশ হাত দেখা ব্যক্তি যা কিছু বলে কিংবা অনুধাবন করে, তা দশহাত দেখা ব্যক্তি বিশ্বাস করতেও অনেক সময় লেগে যায়।
একটা বিষয় দেখুন, আজ কত ইসলামি বই, কত অডিও, ভিডিও, অথচ ইসলামের বিজয় নেই। মানুষ দ্বীনের পথে আসছে না, আসলেও অনেকে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু সাহাবীদের সময় এতো বই, ভিডিও অডিও ছিলো না। এতো ওয়াজ মাহফিল ছিলো না, কিন্তু ইসলাম বিজয় ছিলো, মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতো, জিহাদ করতো। কারন তারা ছিলো উজ্জ্বল প্রদীপ। তাদের প্রদীপের নুর ছিলো অনেক বেশি। ফলে তাদের সংস্পর্শে যারাই এসেছে তারাই ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজ থেকে কয়েক শত বছর পূর্বেও এতো বই, অডিও, ভিডিও ছিলো না, অথচ বড় বড় নেককার আলেমদের সামান্য সোহবতে দেখা যেত হাজার হাজার ব্যক্তি ইসলাম গ্রহন করতো। আসলে মুমিনের এই নূর এমন এক নূর, যাহার মাঝে মানুষ শান্তি-সুখের দেখা পায়। যেমন রাসূল সাঃ এর সময় সাহাবীদের অবস্থা এমন ছিলো যে, শত কষ্ট, ক্ষুধা ভুলে যেতেন যখন উনারা রাসূল সাঃ কে দেখতেন। সাহাবীরা উনার মাঝেই সুখ ও প্রশান্তি খুঁজে পেতেন।
সাহাবীদের ইমান দূর্বল হয়ে গেলে যখন উনারা প্রিয় নবীর সোহবতে যেতেন, আবার ইমান তাজা হয়ে যেত। আজকেও যারা নবীর সত্যিকারের খাঁটি ওয়ারিশ তাদের সংস্পর্শে সামান্য কিছুক্ষণ থাকলেই দেখা যায় ইমান তাজা হয়ে যায়, দুঃখ কষ্ট নিমিষেই ভুলে যায়।
এরপরে আল্লাহ বলেছেন সেই প্রদীপ জ্বলে যয়তুনের তেল দ্বারা, যে তেলের বৃক্ষ পূর্বের ও পশ্চিমের নয়। অর্থাৎ সব সময় তাতে সূর্যের আলো পড়ে। ফলে সেই গাছের তেল এতটাই স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল যেন তাতে আগুন দিলেও উজ্জ্বল, না দিলেও উজ্জ্বল মনে হয়। আর সেই যয়তুনের তেল হলো দ্বীনের ইলম। যা সবসময় নিজে নিজে জ্বলে। আর যখন এই উজ্জল যয়তুনের তেল মুমিনের প্রদীপের সাথে একসাথ হয়, তখন হয়ে যায় ''আলোর উপর আলো'', ''নূরুন 'আলা নূর''।
যারা নিজের কলবের নূর বাড়াতে চান, তাদের অবশ্যই এই দ্বীনের ইলম ও আমলের সাথে থাকতে হবে। অনেকে মনে করেন কিছু দিন ইলম অর্জন করলেই হয়। এরপর আর করা লাগে না। তাদের নিকট প্রশ্ন হলো আপনার ঘরে যদি একটি প্রদীপ থাকে সেই প্রদীপে কি আপনি একবার তৈল দিলেই যথেষ্ট হয় নাকি বার বার দেওয়া লাগে? তেল শেষ হলেইতো দেওয়া লাগে। তেমনি আপনার অন্তরের প্রদীপের আলো ঠিক রাখতে হলে সবসময় ইলম ও আমলের সাথে থাকতে হবে। শুধু ইলম অর্জন যথেষ্ট নয়। কেননা আপনার নিকট অনেক তেল আছে কিন্তু আপনি তা প্রদীপে রাখলেন না, তাহলে আপনার প্রদীপের আলো বাড়বে না। বরং আলো ঠিক রাখতে হলে প্রদীপে তেল দিতে হবে। তেমনি আপনি যখন ইলম ও আমল করবেন, তখন আপনার ইমান, তাকওয়া বাড়বে। আর এভাবে হবে "নূরের উপর নূর"। আর আল্লাহ যাকে চান, তার নূরের দিকে হিদায়েত দিবেন।
যদি আপনি আপনার অন্তরে এই প্রদীপ জ্বালাতে পারেন, তাহলে এই প্রদীপ থেকে একদিন হাজারো লাখো প্রদীপ জ্বলবে। যেটা দেখতে হবে নক্ষত্রের মত। হাজারটা নক্ষত্রের আলোতে এক সময় আকাশ এতটাই সুন্দর দেখাবে যে, কারো চোখ সে আকাশ থেকে সরাতে মন চাইবে না। তাই চেষ্টা করুন আপনি আপনার দেশে কিংবা জেলায়, বা গ্রামে সর্বপ্রথম সেই প্রদীপ হবেন, যেই প্রদীপের নূরে গোটা সমাজ আলোকিত হবে। আপনি যদি আপনার গ্রামের, কিংবা শহরের সর্বপ্রথম প্রদীপ হতে পারেন, তাহলে আপনার দ্বারা যতজন হিদায়েত পাবে প্রত্যেকের নেকের সওয়াব আপনি পাবেন। রাসূল সাঃ একজন মাত্র সাহাবী মদীনাতে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন, ফলে মদীনার ঘরে ঘরে ইসলাম প্রবেশ করেছে। সেই সাহাবীর নাম হলো মুসয়াব বিন ওমায়ের (রাঃ)। মদীনাতে যারা ইসলাম গ্রহন করেছে সবার জীবনে যত নেক আমল হয়েছে তার সমপরিমাণ নেকের সওয়াব তিনি পেয়েছেন। কল্পনা করুন, তিনি আমার বা আপনার মতই যুবক, তরুন ছিলেন। কিন্তু এমন এক প্রদীপ ছিলেন যে প্রদীপের নূরে মদীনার ঘর গুলো নূরান্বিত হয়ে গেছে।
আল্লাহ আমাদের দ্বীনের একেকটা প্রদীপ হওয়ার তাওফিক দান করুন, যে প্রদীপ দেখতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত।
Comment