বিপদাপদে ধৈর্যধারণ : ফজিলত, অর্জনের উপায় ও করণীয়
প্রবন্ধটি বেশ দীর্ঘ। তবে যারা ফিতনার এ জমানায় সঠিকভাবে দ্বীনের ওপর চলতে গিয়ে কিংবা জীবনের বাঁকে বাঁকে নানারকম সমস্যা ও বিপদের সম্মুখীন হয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন, হিম্মত ও সাহস সব হারিয়ে বসেছেন, তাদের জন্য বক্ষ্যমাণ এ লেখাটি সবিশেষ উপকারে আসবে। বিপদাপদ ও তাতে ধৈর্যধারণ নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখা এ প্রবন্ধটি তাদের জীবনে নতুন করে প্রাণের ছোঁয়া নিয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ। অবশ্য আলোচ্য বিষয়ের মতো এ লেখাটি পড়তেও হবে ধৈর্য সহকারে ও বেশ সময় নিয়ে। তবেই আশা করা যায় এর কাঙ্ক্ষিত ফল। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।
পৃথিবী হলো দারুল ইবতিলা বা পরীক্ষাগৃহ। পার্থিব এ জীবন বান্দার জন্য এক মহাপরীক্ষা। প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি অবস্থায় তাকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হয়। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই শয়তান এসে পদস্খলন ঘটাতে চেষ্টা করে। বিশেষ করে বিপদের নাজুক মুহূর্তে এসে বান্দাকে অস্থির ও অধৈর্য করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালায়। কারণ, সে জানে, এ সময়ে বান্দাকে বিভ্রান্ত করা অনেক সহজ। আর তাই মুমিন বান্দাকে এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে; যেন শয়তান এসে আমাকে ধোঁকায় না ফেলে দেয়। শত বিপদ-মুসিবত আসুক না কেন, সবই মাথা পেতে নিলে গায়ে সয়ে যাবে। অধৈর্য হলে পেরেশানি বাড়বে বৈ কমবে না।
বস্তুত পার্থিব জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য, আখিরাতের পরীক্ষায় পাশ করার জন্য সবরের কোনো বিকল্প নেই। সবর আমাকে অর্জন করতেই হবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সবরকে সাথে নিয়ে চলতে হবে। দ্বীনের পথে যে যত বড়, তার সবরের পরিমাণও তত বেশি। এজন্যই দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি কষ্ট-মুসিবতের শিকার হন আম্বিয়ায়ে কিরাম। এরপর সিদ্দিকিন, শুহাদা ও সালিহিন। এভাবেই পর্যায়ক্রমে দ্বীনের পথে তাঁরা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। দাওয়াতের মেহনত নিয়ে আগমনকারী প্রথম নবি নুহ আ. থেকে নিয়ে সর্বশেষ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত এমন কোনো নবি নেই, যাঁকে আল্লাহর পথে অভাবনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়নি। তাঁরা সব বাধা পেরিয়ে তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন।
পার্থিব জীবনে বিপদ যেহেতু অবশ্যম্ভাবী একটি বিষয়, বিধায় এটাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। এরপর ধৈর্য ও সবরের প্রশিক্ষণ নিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে সব ধরনের বিপদে স্থির থাকার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এজন্য ইসলামে সবরের ব্যাপারে অসংখ্যবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেননা, সকল বিপদাপদের একমাত্র সহজ ও উত্তম উপশম হলো সবর। এ প্রবন্ধে আমরা আজ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা বিপদ-মুসিবত ও সবর নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এসংক্রান্ত আলোচনা আমরা দুটি অধ্যায়ে দালিলিকভাবে তুলে ধরছি। প্রথম অধ্যায়ে বান্দাদের পরীক্ষা করার ব্যাপারে কুরআন-হাদিসের বিভিন্ন নির্দেশনা তুলে ধরা হবে। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে থাকবে বান্দা কীভাবে এসব বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করবে, তার বিশদ আলোচনা। তিনিই তাওফিকদাতা ও সাহায্যকারী।
প্রথম অধ্যায় : ইবতিলা (বিপদ-মুসিবত)
বান্দার ওপর বিপদ-মুসিবত আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এতে ভেঙে পড়া বা অস্থির হয়ে যাওয়া মুমিন বান্দার জন্য শোভা পায় না। পৃথিবীতে যতদিন হায়াত থাকবে ততদিন বিপদ আসতেই থাকবে। তাই এটাকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মেনে নিতে হবে। পূর্বেই বলে এসেছি যে, তুলনামূলক যারা আল্লাহর অধিক প্রিয় তারাই অধিক বিপদের সম্মুখীন হয়। হাদিসেও এমনটাই বলা হয়েছে।
সাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً؟ قَالَ: الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ، فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلاَؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَمَا يَبْرَحُ البَلاَءُ بِالعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ.
‘আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন, নবিদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা নেককার তাদের, এরপর যারা নেককার তাদের বিপদের পরীক্ষা। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের অনুপাত অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশি ধার্মিক তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে। আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে তাহলে তাকে সে মুতাবিক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, বান্দার ওপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে জমিনে চলাফেরা করে; অথচ তার কোনো গুনাহই বাকি থাকে না। (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৭৯, হা. নং ২৩৯৮, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
তাই বিপদাপদে নিপতিত হওয়াকে খারাপ ভাবা যাবে না; বরং এটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কতা, পরীক্ষা বা গুনাহ মাফের অসিলা মনে করে ধৈর্যধারণ করতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহয় মুমিনদের বিপদাপদ দ্বারা পরীক্ষা করার ব্যাপারে অনেক নস এসেছে। আমরা এখানে সেসব হতে কতিপয় নস উল্লেখ করছি।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ
‘আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। আর সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৫৫)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি বিভিন্নভাবে বান্দাদের পরীক্ষা করবেন। কখনো শত্রুদের ভীতির মাধ্যমে, কখনো অভাব-অনটনের মাধ্যমে, কখনো সম্পদ ও ফল-ফসল বিনষ্ট করার মাধ্যমে আর কখনো বান্দার প্রিয় কারও জান নেওয়ার মাধ্যমে। আর মুমিনদের ওপর এ ধরনের সব পরীক্ষাই এসে থাকে। তাই পরীক্ষা আসা এটা চিরন্তন। এটা কখনো প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। এ অবস্থা আসলে হা-হুতাশ না করে সবর করতে হবে, যা আয়াতটির শেষে বিবৃত হয়েছে এ বলে “আর সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” অর্থাৎ বিপদ আসলে যারা সবর করতে পারবে, তাদের জন্যই এ বিপদ রহমত ও কল্যাণের কারণ হবে। নচেৎ এ বিপদে অধৈর্য হয়ে শিকায়াত করলে উল্টো বিপদ আরও বাড়ল বৈ কমল না। তাই বুদ্ধিমানরা এতে কখনো অধৈর্য হয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে বসে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
الم. أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ. وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
‘আলিফ লাম মিম। মানুষ কি মনে করে যে, “আমরা ইমান এনেছি” একথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেওয়া হবে? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম। আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন—কারা সত্যবাদী এবং কারা মিথ্যাবাদী।’ (সুরা আল-আনকাবুত : ১-৩)
এ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে, ইমান আনলে তাদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতেই হবে। এরপর এর নজির পেশ করেছেন যে, পূর্ববর্তী উম্মতদের যেভাবে বিভিন্ন বিপদাপদ ও মুসিবতের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়েছে, তোমাদেরও তেমনই পরীক্ষা করা হবে। অর্থাৎ ইমানদার হলে পরীক্ষার সম্মুখীন হতেই হবে। আর এ পরীক্ষার মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কারা ইমানের ব্যাপারে সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
‘তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে; অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করোনি, যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের ওপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর তাদের এমনই শিহরিত হতে হয়েছে, যাতে নবি ও তাঁর প্রতি যারা ইমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য! তোমরা শুনে নাও, আল্লাহর সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী।’ (সুরা আল-বাকারা : ২১৪)
এ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তবেই জান্নাতে যাওয়ার আশা করার কখা বলেছেন। পরীক্ষা তা-ও যেই সেই নয়, পরীক্ষার ধরণ এতটাই কঠিন ছিল যে, নবি ও তাঁর উম্মত সবাই পেরেশান হয়ে গেছেন এই ভেবে যে, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে। মূলত আল্লাহর সাহায্য চূড়ান্ত ও শেষ মুহূর্তেই আসে। কিন্তু সে পর্যন্ত অপেক্ষার ধৈর্য খুব কম মানুষেরই থাকে। এজন্যই এটাকে অনেক বড় ও কঠিন পরীক্ষা বলা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
‘অবশ্যই তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও লোকবলের ব্যাপারে পরীক্ষিত হবে এবং নিশ্চয়ই তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার।’ (সুরা আলি ইমরান : ১৮৬)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রথমে মুমিনদের ধনসম্পদ ও লোকবলের ব্যাপারে পরীক্ষা করবেন জানিয়েছেন। এভাবে যে, ধনসম্পদ ছেড়ে অন্যত্র হিজরত করতে হবে বা ধনসম্পদ কাফিররা দখল করে নেবে বা আসমানি বা দুনিয়াবি কোনো দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে যাবে। লোকবলের ক্ষেত্রে পরীক্ষা এভাবে যে, হয়তো কাউকে শহিদ করে দেওয়া হবে, কাউকে আটকে রাখা হবে, কাউকে নির্যাতন করা হবে, কাউকে দাস-দাসী বানানো হবে ইত্যাদি। এছাড়াও কাফির, মুশরিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কটুক্তিমূলক গালিগালাজ ও সমালোচনা তো থাকবেই। এগুলো বলার উদ্দেশ্য, যেন মুমিনরা জেনে নেয় যে, ইমান আনলেই কাজ শেষ নয়; বরং কাজ সবে শুরুমাত্র। দুনিয়ার জীবনে বিভিন্ন চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে, বিভিন্ন জুলুম-নির্যাতন ও মুসিবত সহ্য করে তবেই সফলতার আশা করা যায়। মুমিনরা যেন আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারে, এজন্য আল্লাহ তাআলা আগেই সব জানিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব; যে পর্যন্ত না জেনে নিই তোমাদের জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদের এবং তোমাদের কর্মকাণ্ড পরীক্ষা করি।’ (সুরা মুহাম্মাদ : ৩১)
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা জিহাদ ও জিহাদের পথে পাওয়া কষ্ট সহ্য করার মাধ্যমে পরীক্ষা করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ জিহাদের মাধ্যমেও পরীক্ষা করা হবে যে, কারা এ পথে ধৈর্যধারণ করে লড়াই করে আর কারা এ থেকে পিছে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়েও এ জিহাদের মাধ্যমেই মুনাফিকরা চিহ্নিত হয়ে যেত। কারণ, জিহাদের ডাক আসলেই তারা বিভিন্ন তাল-বাহানা দেখিয়ে জিহাদ থেকে নিবৃত্ত থাকতে চাইত এবং শরয়ি কোনো ওজর ছাড়াই ঘরে বসে থাকত। বুঝা যায়, মুমিন ও মুনাফিকদের চেনার একটি উপায় হলো জিহাদ। মুনাফিকরা কখনও জিহাদ পছন্দ করে না এবং যেকোনোভাবে এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু খাঁটি মুমিনদের কাছে জিহাদ পরম সাধনার জিনিস। এর মাধ্যমেই তো শাহাদাতের পেয়ালা পান করা যায় আর আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়।
হাদিসেও মুমিনদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। জানানো হয়েছে যে, মুমিনদের পরীক্ষা করা ছাড়া কেউ উত্তীর্ণ হতে পারবে না। ব্যক্তির অবস্থান হিসেবে পরীক্ষার ধরনে কমবেশ হবে। একেক জনের জন্য একেক রকমের পরীক্ষা। পরীক্ষার মানের দিক থেকেও অনেক প্রকারের পরীক্ষা করা হয়। ব্যক্তির মান ও অবস্থান যদি সুউচ্চ হয় তাহলে তার পরীক্ষাও হয় অত্যন্ত কঠিন। আর যদি মাঝারি হয়, তাহলে পরীক্ষার মানও মাঝারি হয়ে থাকে। দুর্বল হলে পরীক্ষাও দুর্বলভাবেই নেওয়া হয়।
সাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً؟ قَالَ: الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ، فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلاَؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ، فَمَا يَبْرَحُ البَلاَءُ بِالعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ.
‘আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন, নবিদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা নেককার তাদের, এরপর যারা নেককার তাদের বিপদের পরীক্ষা। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের অনুপাত অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশি ধার্মিক তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে। আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে তাহলে তাকে সে মুতাবিক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, বান্দার ওপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে জমিনে চলাফেরা করে; অথচ তার কোনো গুনাহই বাকি থাকে না।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৭৯, হা. নং ২৩৯৮, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
এ হাদিসে মুমিনের স্তরভেদে পরীক্ষা কঠিন ও হালকা হয়, তার বিবরণ রয়েছে। যে বেশি দ্বীন পালন করে তাকে পরীক্ষাও দিতে হয় কঠিন করে। আর যে পরিমিত আকারে দ্বীন পালন করে তার পরীক্ষাও হয়ে থাকে পরিমিত আকারে। মোটকথা, মুমিনদের পরীক্ষা না দিয়ে উপায় নেই। আল্লাহ কোনো কোনো বান্দাকে এত বেশি মুসিবতে নিপতিত করেন যে, এর কারণে ধীরে ধীরে তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। অতএব মুমিনের ওপর আপতিত বালা-মুসিবতকে সে কল্যাণের কারণ মনে করবে। এতে হতাশ বা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহর কিছু বান্দা এমনও আছেন, যাদেরকে মুসিবত চারদিক থেকে ঘিরে রাখে। সে বিপদাপদের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে, তবুও সে দ্বীনের ওপর অটল থাকে।
আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
أَتَى رَجُلٌ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: وَاللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي لَأُحِبُّكَ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: "إِنَّ الْبَلَايَا أَسْرَعُ إِلَى مَنْ يُحِبُّنِي مِنَ السَّيْلِ إِلَى منتهاه
‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, আমাকে যে ভালোবাসে তার দিকে সকল মুসিবত ও বিপদাপদ বন্যার পানির চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটে আসবে।’ (সহিহু ইবনি হিব্বান : ৭/১৮৫, হা. নং ২৯২২, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এ হাদিসটি আরও স্পষ্ট নির্দেশক যে, মুমিন বান্দাকে মুসিবত এসে কখনো ঘিরে ফেলে। চতুর্মুখী বিপদে দুর্বলরা ভেঙে পড়লেও সবলরা ঠিকই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং সবরের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এভাবেই কুরআন ও সুন্নাহয় আরও অনেক নস পাওয়া যায়, যা থেকে প্রমাণ হয় যে, মুমিনদের ওপর নানা মুসিবত ও বিপদাপদ আসবে। এক্ষেত্রে তাদের করণীয় হলো, এতে ভেঙে না গিয়ে ধৈর্যধারণ করবে। এভাবে বারবার অনুশীলন করলে তার জন্য কঠিন থেকে কঠিন সমস্যায়ও ধৈর্যধারণ করা সহজ হয়ে যাবে।
চলবে...
**************
Collected
Collected
Comment