দারসে রমাদান।। দারস-১৯।।
সানা ও দোয়া
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম
==================================================
=====
সানা ও দোয়া
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম
==================================================
=====
সহীহ মুসলিমে এসেছে, এক বেদুইন এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল: “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে এমন একটি দোয়া শিক্ষা দিন, যে দোয়াটি পড়ে আমি আল্লাহর কাছে চাইব”। মানবজাতির আদর্শ শিক্ষক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কী দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন? তিনি বেদুইনকে বললেন,
قُلْ : لا إلهَ إلَّا اللهُ وحدَه لا شريكَ له اللهُ أكبَرُ كبيرًا والحمدُ للهِ كثيرًا وسُبحانَ اللهِ ربِّ العالَمينَ ولا حولَ ولا قوَّةَ إلَّا باللهِ العزيزِ الحكيمِ.
এখানে বেদুইনকে পাঁচটি বাক্য শিক্ষা দিয়েছেন। আগত বেদুইন লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই বাক্যগুলো তো শুধু আল্লাহ তাআলার প্রশংসা বর্ণনা করার মাঝেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবেই এই বাক্যগুলোতে শুধু আল্লাহ তাআলার প্রশংসা, মাহাত্ম্য, বড়ত্ব ও পবিত্রতা বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআন-হাদিসে আল্লাহ তাআলার সানা ও প্রশংসা করার জন্য অনেক চমৎকার চমৎকার বাক্য রয়েছে।
কুরআনের কিছু আয়াত দেখুন,
بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ.
وَإِذَا قَضَى أَمْراً فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ .
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ *اللَّهُ الصَّمَدُ *لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ*وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُواً أَحَدٌ .
اللّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ .
এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলার সানা ও প্রশংসা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা নিজেই আমাদেরকে তাঁর প্রশংসা শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়াও আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যেখানে আল্লাহ তাআলার হামদ-সানা করা হয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে “ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ” প্রদান করা হয়েছে। তিনি জানতেন বেদুইন লোকটি তাঁর কাছে কী চাচ্ছে। কিন্তু তিনি চাইলেন এই বেদুইনকে তরবিয়ত করতে। তাকে এই শিক্ষা দিতে যে, যখনই আল্লাহর কাছে দোয়া করবে তখনই দোয়ার পূর্বে আল্লাহর হামদ-সানা করে নাও। লক্ষ করে দেখুন, এই বাক্যগুলোতে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথম বাক্য:
” لا إلهَ إلَّا اللهُ وحدَه لا شريكَ له” অর্থ: “আল্লাহ তাআলা ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত কোনও ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনও শরীক নেই”। আল্লাহু আকবার! এই বাক্যটিতে “তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ”র প্রমাণ বিদ্যমান। একমাত্র আল্লাহ তাআলা-ই হচ্ছেন ইবাদতের উপযুক্ত।
দ্বিতীয় বাক্য: “الله أكبر كبيرًا” অর্থ: “আল্লাহ সবচে বড়, অনেক বড়”। অর্থাৎ, তিনি সবকিছু থেকে বড়। তাঁর সত্তা, গুণ, কাজ, জ্ঞান ইত্যাদি সবকিছুই বড়।
তৃতীয় বাক্য: “والحمد لله كثيرًا” অর্থ: “সকল প্রশংসা আল্লাহর, অনেক অনেক প্রশংসা”। আল্লাহ তাআলার বেশি বেশি প্রশংসা শিক্ষা দিচ্ছেন।
চতুর্থ বাক্য: “وسبحان الله رب العالمين” অর্থ: “জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলা সকল দোষ-ত্রুটি ও অংশীদারত্ব থেকে পবিত্র”। এখানে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ঘোষণা করা হচ্ছে।
পঞ্চম বাক্য: “ولا حولَ ولا قوَّةَ إلَّا باللهِ العزيزِ الحكيمِ.” অর্থ: “পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তাআলার তাওফীক ছাড়া গুনাহ থেকে বাঁচার ও নেক কাজ করার কোনও শক্তি-সামর্থ্য নেই”। তিনি সানাটি আল্লাহ তাআলার দুটি নাম দিয়ে শেষ করেছেন। “আযীয” বা পরাক্রমশালী এবং “হাকীম” বা প্রজ্ঞাবান। আল্লাহ তাআলার রয়েছে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা। রয়েছে আইন প্রণয়নের প্রজ্ঞা। তাই আল্লাহপ্রদত্ত শরীয়ত পুরোটাই প্রজ্ঞাময়, কল্যাণকর ও সঠিক। আল্লাহর সকল হুকুমই প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ তাআলা যে ফায়সালা করেন তাতেই কল্যাণ নিহিত থাকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সানা শিক্ষা দেওয়ার পর দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ! সুরা ফাতিহার সাথে এই হাদীসের ধারাবাহিকতা তথা প্রথমে সানা তারপর দোয়া করার শিক্ষা প্রদানের কত মিল রয়েছে। সুরা ফাতিহার শুরুতে সানা ও শেষে দোয়া। সুরার প্রথম তিনটি আয়াতে সানা ও প্রশংসা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
الْحَمْدُ للّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ الرَّحْمـنِ الرَّحِيمِ *مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ.
অর্থ: সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। যিনি আতিশয় দয়ালু পরম করুণাময়। যিনি বিচার দিবসের মালিক।
সুরার শেষের তিনটি আয়াতে দোয়া শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
اهدِنَـا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ *صِرَاطَ الَّذِينَ أَنعَمتَ عَلَيهِمْ غَيرِ المَغضُوبِ عَلَيهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ.
অর্থ: আমাদেরকে সুদৃঢ় পথের হেদায়াত দান করুন। সেই ব্যক্তিদের পথ যাদের উপর আপনি নেয়ামত বর্ষণ করেছেন। সেই ব্যক্তিদের পথ নয় যাদের উপর আপনার গজব পতিত হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট।
সুরা ফাতিহায় যেমন শুরুতে সানা ও শেষে দোয়া, ঠিক এই হাদীসেও শুরুতে সানা শেষে দোয়া রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সানা শিক্ষা দেওয়ার পর দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন।
প্রিয় ভাই, এই হাদীসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের উচিত সিজদায় প্রথমে সানা অতঃপর দোয়া পড়া। ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি “আল-আযকার” কিতাবে বলেন, এটি এমন এক দোয়া যেটি মানুষের সবসময় পড়া উচিত।
এই যিকর ও দোয়া সবসময় পড়বেন। আপনার সিজদায়, আসা-যাওয়ায়, দিনে-রাতে পড়বেন। প্রথমে আল্লাহ তাআলার সানা ও প্রশংসা করার পর নিজের জন্য দোয়া করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই শিক্ষা দিয়েছেন।
দোয়ার প্রথম বাক্যগুলোতে আল্লাহ তাআলার হামদ, সানা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। বেদুইন লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি নিজের জন্য দোয়া করতে চাচ্ছি। নিজের জন্য প্রার্থনা করতে চাচ্ছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
” اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي، وَارْحَمْنِي، وَاهْدِنِي، وَارْزُقْنِي “, في بعض الروايات ” وَعَافِنِي “.
অর্থ: বল, হে আল্লাহ, আমাকে মাফ করুন, রহম করুন, হেদায়াত ও রিযক দান করুন। অপর এক বর্ণনায় আরও এসেছে,
আমাকে নিরাপত্তা দিন।
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-২৬৯৬)
আমাকে নিরাপত্তা দিন।
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-২৬৯৬)
প্রিয় ভাই, এই হাদিসের সামারা ও ফলাফল কী দাঁড়াল? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি বা পাঁচটি শব্দে এর ফলাফল স্পষ্ট করেছেন। শব্দগুলো সবসময় আমাদের পড়া উচিত।
প্রথমে সানা পড়ে তারপর বলবেন, ” اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي، وَارْحَمْنِي، وَاهْدِنِي، وَارْزُقْنِي”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট করেছেন, যে এই শব্দগুলো সর্বদা পড়ল সে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ জমা করল। এটি এই দোয়ার ফলাফল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, “সে তার হাত দুটি কল্যাণে পূর্ণ করে নিল”। বেদুইন লোকটি সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “সে তার হাত দুটি কল্যাণে পূর্ণ করে নিল”।
সুতরাং, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর সানা পড়ার পর এই দোয়া বারবার পড়বে, আল্লাহর ইচ্ছায় “সে তার হাত দুটি কল্যাণে পূর্ণ করে নেবে”। নিজের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ জমা করে নেবে। এই দোয়াটি “জামে” ও “শামেল” দোয়ার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, দোয়াটি অনেক বিষয়কে একসাথে যুক্ত করেছে।
হাদীসটিতে সানার জন্য পাঁচটি বাক্য ও দোয়ার জন্য পাঁচটি বাক্য রয়েছে।
দোয়ার প্রথম বাক্য হচ্ছে, “اللهم اغفر لي” “হে আল্লাহ, আমাকে মাফ করুন”। মাগফিরাত বলা হয় গোপন করা ও এড়িয়ে যাওয়াকে। আপনি আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছেন যেন তিনি আপনার গুনাহ গোপন রাখেন এবং আপনার গুনাহ এড়িয়ে যান। এর জন্য দুনিয়াতে, কবরে বা আখেরাতে পাকড়াও না করেন।
দোয়ার দ্বিতীয় বাক্য “واهدني” “আমাকে হেদায়াত দিন”। আমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয়ে হেদায়াত দিন। আমাকে রায়, ফিকর, অবস্থান, লেনদেন ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে হেদায়াত দিন।
তৃতীয় বাক্য “وارحمني” “আমাকে দয়া করুন”। দুনিয়া আখেরাতে আমাকে দয়া করুন। আল্লাহ তাআলা যাকে দুনিয়া-আখেরাতে দয়া করেন সে মহাসফল।
চতুর্থ বাক্য “وارزقني” “আমাকে রিযক দিন”। রিযক দুই প্রকার। এক প্রকার রিযক মুমিন-কাফের, মানুষ-অমানুষ ইত্যাদি সকল মাখলুকের জন্য। এটি হচ্ছে পানাহার, স্ত্রী ইত্যাদির রিযক লাভ করা।
আরেক প্রকার রিযক আছে, “اللهم ارزقني” দোয়া করার সময় এই দ্বিতীয় প্রকার রিযকের কথা খুব কম মানুষই অনুভব করে। আমাকে প্রকৃত ঈমানের রিযক, প্রকৃত বিনয়ের রিযক, প্রকৃত সততা, প্রকৃত ইখলাস, প্রকৃত তাওয়াক্কুল ইত্যাদির রিযক দান করুন। যখন রিযক চাইবেন তখন এই দ্বিতীয় প্রকারের রিযকও চাইবেন।
অন্য হাদিসে দোয়ায় পঞ্চম আরেকটি বাক্যের উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চম বাক্য “وعافني”. “আমাকে নিরাপত্তা দিন”। এখানে দুনিয়ার যাবতীয় বিপদাপদ ও পরকালের সকল আযাব-গজব থেকে আমাকে নিরাপত্তা প্রার্থনা করার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
প্রিয় ভাই, আমাদের উচিত হাদিসে বর্ণিত এই সানা ও দোয়া মুখস্থ করা। এই হাদিসটি “হিসনুল মুসলিম” কিতাবের শেষে আছে। এই সানা ও দোয়া কিতাবটির শেষে পাবেন। যেহেতু এই কিতাবটি অনেকের কাছে আছে তাই এর রেফারেন্স দিয়েছি। হাদিসটি মূলত মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদিসটি মুখস্থ করুন এবং সিজদায়, আসা-যাওয়ায়, দিনে-রাতে বারবার পড়ুন। “জামে” ও “শামেল” এই সানা ও দোয়ার উপকার অনেক। এই সানা ও দোয়ার মাঝে নিহিত আছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও বরকত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই সানা ও দোয়াটি মুখস্থ করে আমল করার তাওফীক দান করুন। প্রথমে সানা তারপর দোয়া করার নববী তালীম গ্রহণের তাওফীক দান করুন, আমীন।
আরও পড়ুন
১৮ তম দারস--------------------------------------------------------------------------------------২০ তম দারস
Comment