বিপদাপদে ধৈর্যধারণ : ফজিলত, অর্জনের উপায় ও করণীয়
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : সবর অর্জনের উপায়
প্রথম পরিচ্ছেদে আমরা সবরের ফজিলত ও গুরুত্ব জানতে পেরেছি। বিবেকবানরা এতটুকুতেই নিজেদের মধ্যে সবরের গুণ পরিপূর্ণভাবে অর্জনে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু এটা যেহেতু অনেক কঠিন একটি বিষয়, শুধু ফজিলতের কথা শুনেই সবার পক্ষে তা অর্জন করা সম্ভব হয়ে ওঠবে না, তাই এ পরিচ্ছেদে আমরা দশটি উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব, যাতে সবাই সবরের গুণটি নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারে।
এক : বিপদে ইন্নালিল্লাহ পড়া্।
ব্যক্তির ওপর যখন কোনো বিপদ আপতিত হয় তখন প্রথমে إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ পড়ে নেওয়া উচিত। বিপদাপদে এই দুআ পাঠ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। এটি অন্তরে প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা এনে দেয় এবং ধৈর্যধারণের জন্য সহায়ক হয়।
উম্মে সালমা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: مَا مِنْ مُسْلِمٍ تُصِيبُهُ مُصِيبَةٌ، فَيَقُولُ مَا أَمَرَهُ اللهُ: إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا، إِلَّا أَخْلَفَ اللهُ لَهُ خَيْرًا مِنْهَا.
‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে মুসলিম কোনো বিপদে আক্রান্ত হয়ে আল্লাহ-নির্দেশিত দুআ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ পড়ে বলবে, اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا তাকে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই ওই বিপদের চেয়ে উত্তম প্রতিদান দান করবেন।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৬৩১, হা. নং ৯১৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
আম্মাজান উম্মে সালামা রা.-এর অবস্থার প্রতি একটু চিন্তা করে দেখুন! তিনি তাঁর স্বামী আবু সালামা রা.-এর ইনতিকালে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন আল্লাহুম্মা’জুরনি ফি মুসিবাতি ওয়া আখলিফ লি খাইরাম মিনহা’ পড়েছিলেন। ফলে আল্লাহ তাআলা ওই বিপদে তাঁকে উত্তম বদলা দিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী আবু সালামা রা.-এর চেয়ে উত্তম ব্যক্তি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন। তবে এই বিকল্প উত্তম প্রতিদান সর্বদাই দুনিয়াতে পাওয়াটা জরুরি নয়; বরং আল্লাহ চাইলে দুনিয়াতেও মিলতে পারে, নয়তো তিনি আখিরাতে দান করবেন। আবার কখনো এমনও হতে পারে যে, সবরে জামিলের দরুন উভয় জগতেই উত্তম প্রতিদান পাবে।
দুই : ধীরস্থিরতা অবলম্বন।
বিপদ আসলে অধিকাংশ মানুষ অস্থির ও পেরেশান হয়ে যায়। অথচ জ্ঞানীদের অজানা নয় যে, এতে বিপদ তো কমেই না; বরং আরও বৃদ্ধি পায়। তাই কোনো বিপদে আক্রান্ত হলে স্থির থাকার চেষ্টা করবে এবং বিষয়টি নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবে। এভাবে ভাবলে তার জন্য ধৈর্যধারণ করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যাবে। আর একবার ধৈর্য সহকারে কোনো বিপদ-মুসিবত নিয়ে চিন্তা করলে আল্লাহ যেকোনো একটা উপায় বের করে দেবেনই। এতে ভুল হওয়ার আশঙ্কাও খুব কম থাকে।
অন্তর যখন শান্ত হবে, মনোবল যখন শক্তিশালী থাকবে এবং অস্থিরতা যখন দূর হবে তখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও সহজ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মাজান আয়িশা রা.-কে সম্মোধন করে বলেছিলেন :
مَهْلًا يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ وَالعُنْفَ وَالفُحْشَ.
‘তুমি নিজের ওপর নম্রতা ও কোমলতাকে আবশ্যক করে নাও এবং কঠোরতা ও অশালীন কথা থেকে দূরে থাকো।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/১৩, হা. নং ৬০৩০, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
তিনি আরও বলেন :
إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ.
‘নিশ্চয় কোমলতা সব জিনিসকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। আর কোনো জিনিসে কোমলতা পরিহার করা হলে তা তাকে কলুষিত করে দেয়।’ (সহিহু মুসলিম : ৪/২০০৪, হা. নং ২৫৯৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
অস্থিরতা ও ক্রোধ কখনো কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। অস্থিরতা ও ক্রোধের শিকার হয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তে অনেক মানুষ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো আরও বড় বিপদে নিপতিত হয়েছে। তাই বিপদ ও মুসিবত যত বড়ই হোক না কেন নিজেকে স্থির রাখতে হবে, এরপর ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এতে অনেক সমস্যা আপনাআপনিই দূর হয়ে যাবে।
তিন : আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ।
বিপদে আক্রান্ত প্রতিটি মুমিনের ওপর আল্লাহ তাআলার প্রতি এ ধারণা পোষণ করা আবশ্যক যে, নিশ্চয় এ পার্থিব বিপদের মাঝেই আমার কোনো কল্যাণ আছে। তিনি যেমন বিপদ দিয়েছেন, ঠিক তিনিই আবার আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। কেননা, কাঠিন্যের সাথেই রয়েছে সহজতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا. إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا.
‘নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। নিশ্চয় কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। (সুরা আল-ইনশিরাহ : ৫-৬)
আল্লাহর ব্যাপারে কখনো বিরূপ ধারণা রাখা যাবে না। পরিস্থিতি কখনো বিরূপ মনে হলেও হয়তো শীঘ্রই এর কল্যাণ উন্মোচিত হয়ে যাবে। তাই ধৈর্যের সাথে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। এভাবে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সুধারণা ঠিক করতে পারলে তার জন্য ধৈর্যধারণ করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
অনেক সময় মানুষ বিপদে বা সমস্যায় আসমান-জমিন এক করে ফেলে। যেন তাদের সামনে দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে আসে এবং ভাবে তাদের সবকিছুই যেন শেষ হয়ে গেছে! মানুষ একটা বিষয়কে অপছন্দ করে; অথচ পরে দেখা যায়, আর আল্লাহ এর মধ্যেই তার জন্য কল্যাণ রেখেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ
‘হয়তো তোমরা কোনো বিষয়কে অপছন্দ করো; অথচ সেটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর!’ (সুরা আল-বাকারা : ২১৬)
একটি ঘটনার প্রতি লক্ষ করুন। উমর রা.-এর কন্যা হাফসা রা. যখন বিধবা হলেন তখন উমর রা. তাঁকে আবু বকর রা.-এর কাছে পেশ করলেন। কিন্তু তিনি তাকে কোনো উত্তরই দিলেন না। এরপর তিনি উসমান রা.-এর নিকট প্রস্তাব পেশ করলে তিনি বললেন, আমার এখন বিবাহ করার ইচ্ছা নেই। উমর রা. তাঁদের জবাবে কষ্ট পেলেন এবং চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি তাঁর এ অবস্থার কথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জানালেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :
يَتَزَوَّجُ حَفْصَةَ مَنْ هُوَ خَيْرٌ مِنْ عُثْمَانَ؛ وَيَتَزَوَّجُ عُثْمَانُ مَنْ هِيَ خَيْرٌ مِنْ حَفْصَةَ
‘উসমান রা.-এর চেয়েও উত্তম ব্যক্তি হাফসা রা.-কে বিবাহ করবে। আর উসমান রা. হাফসা রা. থেকেও উত্তম মেয়ে বিবাহ করবে।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/২২৮, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাফসা রা.-কে নিজে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বিবাহ করেন। আর উসমান রা.-এর সঙ্গে স্বীয় কন্যা রুকাইয়া রা.-এর বিবাহ দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে হাফসা রা.-এর বিবাহের পর আবু বকর রা. উমর রা.-এর সাথে দেখা করলেন এবং অজুহাত পেশ করে বললেন, আপনি মনে কষ্ট রাখবেন না। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বিবাহের ইচ্ছায়) হাফসা রা.-এর কথা আলোচনা করেছিলেন। আর আমি তাঁর গোপন কথা (আপনার কাছে) প্রকাশ করতে পারছিলাম না। তিনি যদি তাঁর ইচ্ছা ত্যাগ করতেন তাহলে আমি তাঁকে অবশ্যই বিবাহ করতাম।’ (সহিহুল বুখারি : ৭/১৩, হা. নং ৫১২২, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
অতএব, পেরেশানি বা বিপদ আসলেই অস্থির না হয়ে অপেক্ষা করতে হবে এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে সবরের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে উত্তম বিনিময় দান করবেন।
চার : বিপদের কথা সবার কাছে প্রকাশ না করা।
সাধারণত মানুষ কোনো বিপদে আক্রান্ত হলে তা সবাইকে বলে দেয় এবং নিজের অস্থিরতার কথা প্রকাশ করে। এতে মানুষ তাকে সঠিক সমাধান তো দিতে পারেই না; উল্টো বিভিন্ন রকমের কথা শুনে তার পেরেশানি আরও বেড়ে যায়। আর এতে তার সবর করা কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে সব কথা প্রকাশ করার কারণে সবরের ফজিলত থেকেও বঞ্চিত হতে হয় এবং কোনো সমাধানের পথ বের করতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। বরং কখনো কখনো তো এভাবে নিজের বিপদাপদের কথা সবাইকে বলে বেড়ানোয় উল্টো তার ক্ষতি হয়।
নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি নির্দেশনা হলো :
مِنْ كُنُوزِ الْبِرِّ كِتْمَانُ الْمَصَائِبِ , وَالْأَمْرَاضِ, وَالصَّدَقَةِ
‘বিপদ-মুসিবত, অসুখ-বিসুখ ও সদকার কথা গোপন রাখা পূণ্যের কাজসমূহের মধ্যে অন্যতম।’ (শুআবুল ইমান : ১২/৩৭৭, হা. নং ৯৫৭৪, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ)
উসামা বিন জাইদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
إِنَّ لِلَّهِ مَا أَخَذَ، وَلَهُ مَا أَعْطَى، وَكُلٌّ عِنْدَهُ بِأَجَلٍ مُسَمًّى، فَلْتَصْبِرْ، وَلْتَحْتَسِبْ
‘আল্লাহ যা কেড়ে নেন আর যা দান করেন—সব তাঁরই অধিকারে। তাঁর কাছে সবকিছুরই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। কাজেই সে যেন ধৈর্যধারণ করে এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রাখে।’ (সহিহুল বুখারি : ২/৭৯, হা. নং ১২৮৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
তাই মুসিবতের বিষয়টি যদি গোপন রাখা সম্ভব হয় তাহলে তা গোপন রাখা আল্লাহ তাআলার একটি বড় নিয়ামত। এটা আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টি এবং অস্থিরতা প্রকাশ না করে অটল থাকার গোপন রহস্য। যেহেতু যথাসময়ে বিপদ ঠিকই কেটে যাবে, তাই মানুষের কাছে অভিযোগ প্রকাশ করে নিজের সবরের প্রতিদান নষ্ট করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। এক্ষেত্রে বিপদের কথা গোপন রাখলে তার জন্য সবর করা সহজ হয় এবং সর্বদা আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাস্তবতায় দেখা গেছে, মানুষের বিপদাপদ কেটে গেলে অন্যকে তার বিপদ ও গোপন বিষয়টি জানানোর কারণে সে মনেমনে লজ্জাবোধ করে। বিষয়টি যেহেতু এমনই, তাই শুরুতেই নিজের বিপদাপদের বিষয়টা প্রকাশ না করে গোপন রাখা উচিত।
পাঁচ : ক্রোধ দমন করা।
বিপদে অনেক সময় মানুষ ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। ক্রোধ আসলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান ঠিক থাকে না। তাই সবর করার জন্য ক্রোধ দমন করা খুবই জরুরি। যার ক্রোধ যত বেশি নিয়ন্ত্রিত তার সবরও তত তাড়াতাড়ি অর্জন হবে। ক্রোধ দমনের সাথে সবরের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই যেকোনো বিপদে আমাদের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
এক লোক নবি কারিম সা.-এর নিকট এসে বলল, আমাকে নসিহত করুন। তিনি বললেন :
لاَ تَغْضَبْ فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ: لاَ تَغْضَبْ
‘ক্রোধান্নিত হবে না। এরপর আরও কয়েকবার বললেন, ক্রোধান্নিত হবে না।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/২৮, হা. নং ৬১১৬, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
তিনি আরও বলেন :
لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ، إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الغَضَبِ
‘প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়; বরং সে-ই হলো আসল বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/২৮, হা. নং ৬১১৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
রাগ সঠিক ও সুস্থ চিন্তার জন্য অন্তরায়। রাগ মানুষকে বিক্ষিপ্ত ও অস্থির চিন্তার দিকে ঠেলে দেয়। আর তখন মানুষ আবেগী হয়ে যায়। আবেগের বসে সে অনাকাঙ্খিত কিছু করে ফেলে। সুতরাং প্রথমে ভালোভাবে স্থির ও শান্ত হতে হবে। এরপর উত্তম পদ্ধতিতে সমস্যার মুকাবেলা করতে হবে। অনেক জ্ঞানী মহিলা তাদের রাগী ও কর্কশ স্বামীর সাথে দয়া ও নম্রতার আচরণ করে। ফলে কিছু সময় পরেই আবার তার স্বামী তার কাছে ফিরে আসে। এসংক্রান্ত মানুষের অসংখ্য ঘটনা আছে। আর এ কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তাঁর নবি সা.-কে এর আদেশ দিয়ে বলেন :
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ۚ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
‘ভালো ও মন্দ সমান নয়। (তাদের কথার) জবাবে তাই বলুন, যা উৎকৃষ্ট; তখন দেখবেন আপনার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হা-মিম সাজদা : ৩৪)
অতএব রাগের ব্যাপারে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সবর অর্জন করা কখনো সম্ভব হবে না। রাগের ক্ষতিকর দিক ও এর খারাপ পরিণামের কথা চিন্তা করলে আশা করা যায় ধীরে ধীরে রাগ কন্ট্রোলে চলে আসবে ইনশাআল্লাহ। আর এটা কন্ট্রোলে চলে আসলে দ্রুতই সবর অর্জন হয়ে যাবে।
ছয় : বেশি বেশি ইসতিগফার পড়া।
বিপদের সময় সবরের সাথে অটল থাকার জন্য বেশি বেশি ইসতিগফার ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। কেননা, অধিকাংশ বিপদ আমাদের নিজেদের হাতের কামাই ও গুনাহের কারণে এসে থাকে। তাই ইসতিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলে আশা করা যায়, তিনি সবরের তাওফিক দেবেন এবং বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। হাদিসে এসেছে, রালুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَنِ أكْثَرَ مِنَ الاسْتِغْفَارِ، جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا، وَمِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا، وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
‘যে ব্যক্তি বেশি পরিমাণে ইসতিগফার পড়বে আল্লাহ তাআলা তাকে সকল পেরেশানি থেকে মুক্ত করবেন এবং সকল সংকীর্ণতা থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি করে দেবেন। আর তাকে তার ধারণাতীত রিজিক দান করবেন।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৪/১০৪, হা. নং ২২৩৪, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
আমাদের ওপর আল্লাহ তাআলার অনেক বড় একটি নিয়ামত এই যে, তিনি আমাদের জিহ্বাকে অনেক হালকা বানিয়েছেন এবং কোনো ধরনের কষ্ট ছাড়াই তার নড়াচড়ার ব্যবস্থা করেছেন। তাই বেশি বেশি করে ইসতিগফার পড়তে অলসতা ও কার্পণ্য না করা।
সাত : আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল করা।
বিপদ-মুসিবতে আল্লাহ তাআলার ওপর তাওয়াক্কুল করতে পারাটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় একটি নিয়ামত। দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবতের সময় সবর করার জন্য তাওয়াক্কুলের ভূমিকা অপরিসীম। আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করে তার ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থেকে সমস্যার সমাধানের জন্য দুআ করার মধ্যে অন্তরের প্রশান্তি রয়েছে। ইবাদত ও নৈকট্যের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে সবচে বড় মর্যাদা হলো আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করা এবং সকল বিষয় তাঁর ওপর ন্যস্ত করা।
তাওয়াক্কুলের মধ্যে মনের স্থিরতা, দিলের প্রশান্তি ও অন্তরের নিশ্চিন্ততা রয়েছে। যারা এই মহান গুণের অধিকারী, আল্লাহ তাআলা তাদের ভালবাসেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুল অবলম্বনকারীদের ভালবাসেন।’ (সুরা আলি ইমরান : ১৫৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করবে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন।’ (সুরা আত-তালাক : ৩)
প্রত্যেকেরই এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, সমস্যা সমাধানে যে চেষ্টা-মুজাহাদা ও কষ্ট-ক্লেশ সে করে, এগুলো আসবাব গ্রহণ ও মাধ্যম অবলম্বন ব্যতীত আর কিছুই না। সমস্যার সমাধান এবং সকল কিছুর পরিচালনা তো একমাত্র আল্লাহ তাআলাই করে থাকেন। তিনি যা চান তা-ই হয় এবং যা চান না তা হয় না।
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ، وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ، رُفِعَتِ الأَقْلاَمُ وَجَفَّتْ الصُّحُفُ.
‘আর জেনে রাখো, যদি সমগ্র জাতি তোমার কোনো উপকার করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে তারা তোমার ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর তারা যদি তারা সবাই তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তারা তোমার ততটুকু ক্ষতিই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তাআলা তোমার তাকদিরে লিখে রেখেছেন। কলমসমূহ তুলে নেওয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/২৪৮, হা. নং ২৫১৬, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
আট : পরামর্শ করা।
মানুষ যখন কোনো বিষয়ে সমস্যায় পতিত হয় তখন তা থেকে উদ্ধারের জন্য তার একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ও উত্তম ফিকিরের প্রয়োজন হয়। যোগ্য লোকের সাথে পরামর্শ করে সঠিক সিদ্ধান্ত পেলে তার জন্য সবর করা অনেক সহজ হয়ে যায়। সে বিপদের হাকিকত অনুভব করতে পারে এবং বাস্তবসম্মত চিন্তা করার পথ খুলে যায়। আল্লাহর অনুগ্রহে এটা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। এটা অভিযোগের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা, এখানে ব্যাপকভাবে সবাইকে নিজের কষ্টের কথা বলা উদ্দেশ্য হয় না; বরং জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়, যা শরিয়া-অনুমোদিত। তবে পরামর্শ করার জন্য মুত্তাকি ও আহলে ইলম লোক বাছাই করবে। যার তার কাছে পরামর্শের জন্য গেলে কল্যাণের পরিবর্তে উল্টো আরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
কুরআন-সুন্নাহয় পরামর্শের অনেক গুরুত্ব ও উপকারিতার কথা বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করতেন। সাধারণ বিষয় হলে সাধারণভাবে আর বিশেষ বিষয় হলে বিশেষ সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করতে বসতেন। গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতার বিবেচনায় কখনো শুধু একজন বা দুজনকে নিয়েই বসতেন। কুরআনেও আল্লাহ তাআলা পরামর্শ করার আদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ
‘আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।’ (সুরা আলি ইমরান : ১৫৯)
আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণাগুণের বর্ণনা দিয়ে বলেন :
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
‘নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে তারা নিজেদের কাজ সম্পাদন করে।’ (সুরা আশ-শুরা : ৩৮)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَنْ أَرَادَ أَمْرًا فَشَاوَرَ فِيهِ امْرَأً مُسْلِمًا وَفَّقَهُ اللَّهُ لِأَرْشَدِ أُمُورِهِ
‘যে ব্যক্তি কোনো কাজের ইচ্ছা করে তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে, আল্লাহ তাকে সবচে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাওফিক দান করেন।’ (আল-মুজামুল আওসাত, তাবারানি : ৮/১৮১, হা. নং ৮৩৩৩, প্রকাশনী : দারুল হারামাইন, কায়রো)
উমর রা. বলেন, তুমি অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না। তোমার শত্রু চিনো এবং বন্ধু থেকে সতর্ক থাকো, তবে বিশ্বস্ত হলে ভিন্ন কথা। আর আল্লাহকে ভয়কারী ব্যতীত কোনো বিশ্বস্ত লোক নেই। তুমি কোনো পাপাচারী লোকের সাথে হাঁটাচলা করবে না, তাহলে সে তোমাকে তার পাপাচারিতা শিক্ষা দিবে। তার নিকট তোমার গোপন বিষয় প্রকাশ করবে না এবং তার সাথে তোমার কোনো বিষয় নিয়ে পরামর্শ করবে না। তবে যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, তার কথা ভিন্ন।
পরামর্শের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। প্রথমত, এমন লোকের সাথে পরামর্শ করবে, যার অবস্থান অনেক দূরে এবং সে নিজেও প্রচারমাধ্যম থেকে অনেক দূরে থাকে। যাতে করে সে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার গোপন বিষয়টা প্রকাশ না করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আহলে ইলমদের সাথে পরামর্শ করবে। তাদের সাথে পরামর্শ করলে দুইটি বিষয় একসাথে অর্জন হবে। এক. তাদের সাথে পরামর্শ করলে বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার তেমন ভয় থাকবে না। কারণ, তাদের কাছে এত মানুষ যাওয়া-আসা করে যে, কোনটা কার বিষয় সেটা তারা ভুলেই যান। তাই তা প্রকাশের বিষয়টিও আর সামনে আসবে না। দুই. তারা হলেন আহলে ইলম, পাশাপাশি মুত্তাকি ও পরহেজগার। তাই আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের পরামর্শের মধ্যে ইলম ও নুর উভয়টাই থাকবে।
নয় : সবরের ফজিলত ও পুরস্কার স্মরণ করা।
বিপদে পড়লে সবর করা কষ্টকর হলেও সবরের যে ফজিলত ও বিনিময় রয়েছে, তা স্মরণ করলে সবর করা অনেক সহজ হয়ে যায়। কেননা, মানুষের অন্তর কোনো কিছুর প্রাপ্তিতে অন্য কষ্টের কথা ভুলে যায়। তাই সবরের প্রতিদানের কথা চিন্তা করলে বর্তমান বিপদ ও কষ্ট অনেক তুচ্ছ মনে হবে এবং এর ওপর সবর করা সহজ হবে।
কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আমরা জানতে পারি, যারা বিপদ-মুসিবতে ও দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয় তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা অফুরন্ত সওয়াব, প্রতিদান, উঁচু মর্যাদা ও পাপমোচন লিখে রেখেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ
‘নিশ্চয় যারা সবরকারী তাদেরকে অগণিত পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (সুরা আজ-জুমার : ১০)
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
مَا يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ مِنْ وَصَبٍ، وَلَا نَصَبٍ، وَلَا سَقَمٍ، وَلَا حَزَنٍ حَتَّى الْهَمِّ يُهَمُّهُ، إِلَّا كُفِّرَ بِهِ مِنْ سَيِّئَاتِهِ
‘মুমিন বান্দার যখন কোনো রোগ-ব্যধি, কষ্ট-মুসিবত, চিন্তা-পেরেশানি এবং তার কোনো ক্ষতিসাধন হয়; এমনকি তার যদি কোনো কাঁটাও বিঁধে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার ত্রুটিবিচ্যুতি ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহু মুসলিম : ৪/১৯৯২, হা. নং ২৫৭৩, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
যখন ইবরাহিম রহ.-এর ইবাদগুজার মায়ের পা পশুর পায়ের আঘাতে ভেঙে গেল, অতঃপর লোকেরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আসল, তখন তিনি বললেন, দুনিয়ার মুসিবত না আসলে আমরা তো নিঃস্ব হয়ে আখিরাতে পুনরুত্থিত হব। উমর রা.-এর জুতার ফিতা ছিড়ে গেলে তিনি ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ে বললেন, কোনোভাবে তোমার কষ্ট হলে সেটাই তোমার জন্য মুসিবত। ইবনে আবিদ্দুনিয়া রহ. বলেন, সালাফে সালিহিন রাতের জ্বর কামনা করতেন, যাতে এর মাধ্যমে তাদের পূর্বের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُشَاكُ شَوْكَةً، فَمَا فَوْقَهَا إِلَّا كُتِبَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ
‘কোনো মুমিন বান্দার যদি কাঁটা বিঁধে বা অন্য কিছুর দ্বারা কষ্ট পায়, এর বিনিময়ে তার জন্য একটি মর্যাদা লিখে দেওয়া হয় এবং তার একটি ভুল মার্জনা করা হয়।’ (সহিহু মুসলিম : ৪/১৯৯১, হা. নং ২৫৭২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
ইমাম নববি রহ. এ হাদিসের ব্যখ্যায় বলেন, ‘এই হাদিসে মুসলমানদের জন্য এক মহাসুসংবাদ রয়েছে। কারণ, মানুষ খুব কম সময়ই এ সকল পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আর এতে তার রোগ-ব্যধি ও দুনিয়াবি কষ্ট-মুসিবতের মাধ্যমে তার গুনাহ ও ভুল-ত্রুটিগুলোরও কাফফারা হয়ে যাচ্ছে।’ (শারহু মুসলিম, নববি : ১৬/১২৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এসংক্রান্ত আরও অনেক আয়াত ও হাদিস প্রথম পরিচ্ছেদে গত হয়েছে। এসব ফজিলতের কথা অন্তরে থাকলে সবর করা তেমন কোনো কষ্টকরই হবে না। তাই সবরের আয়াত ও হাদিসগুলো আমাদের ইয়াদ করে সর্বদা মনে রাখা কর্তব্য, যেন বিপদের সময় এগুলো সবর অবলম্বনের জন্য সহায়ক হয়।
দশ : অধিক পরিমাণে মাসনুন দুআসমূহ আদায় করা।
মানুষ বিপদে পড়লে প্রথমেই মানুষের কাছে দৌড়ায়; অথচ বিপদে পড়লে কখন কী করতে হবে, তার সব নির্দেশনা শরিয়তে রয়েছে। তাই বিপদে আক্রান্ত হলে আমাদের প্রথমে দেখতে হবে, এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিস কী বলে। এতে যেসব দুআ ও জিকির শেখানো হয়েছে, তা যথাযথভাবে আদায় করলে দিল অনেক শান্ত হবে এবং বিপদের কাঠিন্যের ওপর সবর করা সহজ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বিপদ-মুসিবতের সময় অস্থিরতা ও পেরেশানি দূর করার দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি যখন কোনো বিষয়ে কষ্ট পেতেন তখন তিনি বলতেন :
يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ.
‘হে চিরঞ্জীব, হে অবিনশ্বর সত্তা, আমি আপনার রহমতের অসিলায় সাহায্য প্রার্থনা করছি।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৫/৪২৫, হা. নং ৩৫২৪, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
অন্য একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেরেশানি ও বিপদের সময় এই দুআ শিক্ষা দিয়েছেন :
اللهُ رَبِّي لَا أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا
‘আল্লাহ আমার রব। তাঁর সাথে আমি কোনো কিছুকে শরিক করি না।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৪৫/১৬, হা. নং ২৭০৮২, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
চিন্তা ও পেরেশানি থেকে মুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দুআ :
اللهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ، وَابْنُ عَبْدِكَ، ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ صَدْرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي
‘হে আল্লাহ, আমি আপনার এক দাস। আমি আপনার এক দাস ও দাসীর সন্তান। আমার সকল ফয়সালা আপনার হাতে। আপনার সকল হুকুম কার্যকর হয় এবং আপনার সকল ফয়সালাই ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ। আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি আপনার সকল নামের অসিলায়, যা আপনি নিজের জন্য রেখেছেন অথবা যা আপনি আপনার কিতাবে নাজিল করেছেন অথবা যা আপনি আপনার সৃষ্টির কাউকে শিক্ষা দিয়েছেন অথবা যা আপনার ইলমে গাইবের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আপনি কুরআনকে আমার কলবের বসন্ত বানান, আমার বক্ষের নুর বানান, আমার দুঃখ মোচনকারী বানান এবং আমার পেরেশানি দূরকারী বানান।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৭/৩৪১, হা. নং ৪৩১৮, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
হাদিসে আরও একটি দুআ পড়ার কথা এসেছে, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَالعَجْزِ وَالكَسَلِ، وَالجُبْنِ وَالبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট দুঃখ, পেরেশানি, অপারগতা, অলসতা, কৃপণতা, ভীরুতা, ঋণের গ্রাস ও মানুষের আধিপত্য থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।’ (সহিহুল বুখারি : ৮/৭৯, হা. নং ৬৩৬৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)
কোনো বিষয় কঠিন ও কষ্টকর হলে এই দুআ পড়বে :
اللَّهُمَّ لَا سَهْلَ إِلَّا مَا جَعَلْتَهُ سَهْلًا، وَأَنْتَ تَجْعَلُ الْحَزَنَ إِذَا شِئْتَ سَهْلًا
‘হে আল্লাহ, আপনি যা কিছু সহজ করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু সহজ নেই এবং আপনি চাইলে দুঃখকে সহজ করে দেন।’ (আ’মালুল ইয়াউমি ওয়াল লাইলা : পৃ. নং ৩১১, হা. নং ৩৫১, প্রকাশনী : দারুল কিবলা, জিদ্দা)
দুআর মাধ্যমে সব কিছুই অর্জন করা সম্ভব। এমনকি দুআর মাধ্যমে তাকদিরও পরিবর্তন হয়। হাদিস শরিফে এসেছে :
لاَ يَرُدُّ القَضَاءَ إِلاَّ الدُّعَاءُ
‘একমাত্র দুআই তাকদিরকে পরিবর্তন করতে পারে।’ (সুনানুত তিরমিজি : ৪/১৬, হা. নং ২১৩৯, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)
সুন্নাহর ভাণ্ডারে এ ধরনের দুআ ও জিকিরের সংখ্যা অগণিত। সব উল্লেখ করলে আলাদা একটি গ্রন্থ হয়ে যাবে। মূলত কেউ যদি এসব দুআ একিন ও বিশ্বাসের সাথে পড়ে তাহলে আল্লাহ তাআলা তার বিপদ থেকে তাকে মুক্তি দান করবেন এবং আরও উত্তম কিছুর ব্যবস্থা করে দেবেন। এসব দুআ মানুষের অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি আনয়ন করে, অন্তরের অস্থিরতা দূর এবং বিপদকে তুচ্ছ করতে শেখায়। এমন হলে তার জন্য সবর করা সহজ হয়ে যায় এবং সবরের বিনিময়ে সে উত্তম বিকল্প পায়। এতে সে দুনিয়া ও আখিরাত―উভয় জাহানে সফলতা লাভ করে। তাই বিপদাপদে আমাদের এসব মাসনুন দুআর প্রতি খুব মনোযোগী হওয়া দরকার। বেশিরভাগ মানুষ বিপদে পড়লে স্থির থাকতে পারে না। ধৈর্য হারিয়ে হা-হুতাশ করতে থাকে। অনেকে তো স্বাভাবিক করণীয় বিষয়গুলো পর্যন্ত ভুলে যায়। অথচ এগুলো কোনোটিই মুমিনের সিফাত নয়। বিপদ-আপদে একজন মুমিনকে হতে হবে স্থির ও ধৈর্যশীল। ধীরতা, স্থিরতা ও উত্তম পরিকল্পনার মাধ্যমে সে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। এরপর সুন্নাহসম্মত পন্থা ও সঠিক তদবিরের মাধ্যমে সে অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করবে। সর্বদা ভরসা রাখবে আল্লাহর ওপর এবং বিশ্বাস রাখবে তাকদিরের ভালো-মন্দ সব আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। এভাবে চিন্তা ও কাজ করলে পার্থিব জীবনে একজন মুমিনের বিপদ বলতে কোনো জিনিসই থাকবে না। ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মপদ্ধতিগুলো এভাবেই সংশোধন করে নেওয়া উচিত। তাহলে আমাদের সবকিছুই হবে সুন্দর ও সুসংহত। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
**************
Collected
Collected
Comment