দু'আ কবুলের ১৪টি টিপস
১। আল্লাহর একত্ববাদ
দু'আকারীকে আল্লাহ'র রুবুবিয়্যত, উলুহিয়্যত ও আসমা-সিফাতের প্রতি একত্ববাদী হতে হবে। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক দু'আ কবুল করার শর্ত হচ্ছে- বান্দা কর্তৃক আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে নেক কাজ করা ও গুনাহ পরিত্যাগ করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন, "আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই।"
[সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৬]
২। ইখলাস
একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে দু'আ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: আর "তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহ'র ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।" [সূরা বাইয়্যেনাহ, অয়োত ৫]
'দু'আ হচ্ছে ইবাদত' যেমনটি নবী বলেছেন। তাই ইখলাস দু'আ কবুলের শর্ত।
৩। সিফাত
আল্লাহ'র সুন্দর নাম ও গুণাবলী দিয়ে তাঁকে ডাকা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: "আর আল্লাহ'র জন্যই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক; আর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন কর।" [সূরা আরাফ, আয়াত ১৮০। যেমন: ইয়া গাফুরুর রাহীম, ইয়া আর-রাযযাক, ইয়া গফফার, ইয়া জব্বার ইত্যাদি সিফারের মাধ্যমে ডাকা।
৪। হামদ ও সানা
দু'আ করার পূর্বে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করা। ফাযালা বিন উবায়দ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ বসে ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামায আদায় করল। এরপর দু'আ করল, 'হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ করে দাও, তুমি আমাকে রহম কর'। তখন রাসুলুল্লাহ বললেন, হে! নামাযী! তুমি বেশ তাড়াহুড়া করে ফেললে। তুমি নামায আদায় করে যখন বসবে তখন আগে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করবে, আমার ওপর দরুদ পড়বে। এরপর আল্লাহর কাছে দু'আ করবে।" (সুনানে তিরমিযি ৩৪৭৬) অপর এক রেওয়ায়েতে এসেছে (৩৪৭৭) "যখন তোমাদের কেউ নামায শেষ করবে তখন আল্লাহর প্রশংসা ও হামদ শুরু করবে। এরপর নবী -এর ওপর দরূদ পড়বে। অতঃপর যা ইচ্ছা দু'আ করবে"
বর্ণনাকারী বলেন: এরপর অপর এক লোক নামায আদায় করল। সে ব্যক্তি আল্লাহর প্রশংসা করল, নবী ﷺ এর উপর দরূদ পড়ল। তখন নবী বললেন, "ওহে নামাযী! দু'আ কর, আল্লাহ তোমার দু'আ কবুল করবেন" (আলবানী সহিহৃত তিরমিযি গ্রন্থে (২৭৬৫), (২৭৬৭) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন।
৫। দরূদ ও স্বালাত
নবী -এর ওপর দরূদ পড়া। নবী বলেছেন, "নবী ওপর দরুদ না পড়া পর্যন্ত যে কোন দু'আ আটকে থাকে" {আল মুজাম আল আওসাত (১/২২০), আলবানী সহিহুল জামে' গ্রন্থে (৪৩৯৯) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন}
৬। কিবলা দিকে মুখ
কিবলামুখী হয়ে দু'আ করা। সহিহ মুসলিমে (১৭৬৩) উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ মুশরিকদের দিকে তাকালেন; তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আর তাঁর সাহাবীদের সংখ্যা ছিল তিনশত উনিশ। তখন তিনি কিবলামুখী হয়ে হাত প্রসারিত করলেন, তারপর তাঁর রবকে ডাকতে শুরু করলেন, 'হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছেন সেটা বাস্তবায়ন করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি মুসলমানদের এ দলটিকে ধ্বংস করে দেন তাহলে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত হবে না'। এভাবে দুই হাত প্রসারিত করে কিবলামুখী হয়ে তাঁর রবকে ডাকতে থাকলেন। এমনকি এক পর্যায়ে তাঁর কাঁধ থেকে চাদরটি পড়ে গেল...।
ইমাম নববী (রহঃ) 'শারহুল মুসলিম' গ্রন্থে বলেন; এ হাদিসে দু'আকালে কিবলামুখী হওয়া ও দুই হাত তুলে দু'আ করা মুস্তাহাব হওয়ার পক্ষে প্রমাণ রয়েছে।
৭। হাত উত্তোলন
দুই হাত তোলা। সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (১৪৮৮) সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "নিশ্চয় আপনাদের সুমহান রব হচ্ছেন লজ্জাশীল ও মহান দাতা। বান্দা যখন তাঁর কাছে দু'হাত তোলে তখন তিনি সে হাতদ্বয় শূন্য ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।" {সহিহ আবু দাউদ (১৩২০) আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন}
আর হাতের তালু থাকবে আকাশের দিকে; যেভাবে একজন নতজানু দরিদ্র সাহায্যপ্রার্থী কিছু পাওয়ার আশায় হাত পাতে। সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (১৪৮৬)
মালেক বিন ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ খান বলেন, "যখন তোমরা আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাইবে তখন হাতের তালু দিয়ে চাইবে; হাতের পিঠ দিয়ে নয়" [আলবানী সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (১৩১৮) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]
হাত তোলার সময় দুই হাত কি মিলিয়ে রাখবে; না কি দুই হাতের মাঝে ফাঁক রাখবে?
শাইখ উসাইমিন (রাহিমাহুল্লা-হ) তাঁর 'আল-শারহুল মুমতি' গ্রন্থে (৪/২৫) উল্লেখ করেছেন যে, হাত দুইটি মিলিয়ে রাখবে। তাঁর ভাষায়, "দুই হাতের মাঝখানে ফাঁক রাখা ও এক হাত থেকে অন্য হাত দূরে রাখা সম্পর্কে আমি কোন দলিল পাইনি; না হাদিসে; আর না আলেমদের কথায়।"
৮। ইয়াকীন
আল্লাহর প্রতি এ ইয়াকীন রাখা যে, আল্লাহ দু'আ কবুল করবেন। তাই মনোযোগ দিয়ে দু'আ করা। দলিল হচ্ছে নবী ﷺ এর বাণী, "তোমরা দু'আ কবুল হওয়ার ইয়াকীন নিয়ে দু'আ কর। জেনে রাখ, আল্লাহ তা'আলা অবহেলাকারী ও অমনোযোগী অন্তরের দু'আ কবুল করেন না।" সুনানে তিরমিজি (৩৪৭৯), শাইখ আলবানী সহিহৃত তিরমিজি গ্রন্থে (২৭৬৬) হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)।
৯। সবর
বারবার চাওয়া। বান্দা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর যা ইচ্ছা তা চাইবে, কাকুতি-মিনতি করবে। তবে দু'আর ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া করবে না। কেননা নবী বলেছে, "বান্দার দু'আ ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দু'আ করে। বান্দার দু'আ ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন: বলে যে, আমি দু'আ করেছি, আমি দু'আ করেছি; কিন্তু আমার দু'আ কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দু'আ ছেড়ে দেয়।[সহিব বুখারী (৬৩৪০) ও সহহি মুসলিম (২৭৩৫)]
১০। দৃঢ়তা
দৃঢ়তার সাথে দু'আ করা। কেননা নবী বলেছেন, "তোমাদের কেউ যেন অবশ্যই এভাবে না বলে যে, হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে দয়া করুন। কেননা নিশ্চয় আল্লাহর উপর জবরদস্তি করার কেউ নেই। [সহিহ বুখারী (৬৩৩৯)]
১১। আবেগ
অনুনয়-বিনয়, আশা ও ভয় প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক"। [সুরা আ'রাফ, আয়াত ৫৫] তিনি আরও বলেন: “তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত, আর তারা আমাদেরকে ডাকত আগ্রহ ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমাদের নিকট ভীত-অবনত।" সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৯০) তিনি আরও বলেন: "আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, ভীতচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়।" সূরা আ'রাফ, আয়াত ২০৫]
১২। তিনবার
তিনবার করে দু'আ করা। সহিহ বুখারী (২৪০) ও সহিহ মুসলিমে (১৭৯৪) আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেন: "একবার রাসুল ﷺ বায়তুল্লাহর কাছে সালাত আদায় করছিলেন। সেখানে আবু জাহেল ও তার সঙ্গীরা বসা ছিল। গতদিন উট জবাই করা হয়েছিল। এমন সময় আবু জাহেল বলে উঠল, 'তোমাদের মধ্যে কে অমুক গোত্রের উটনীর নাড়ীভুঁড়ি এনে মুহাম্মদ যখন সিজদা করবে তখন তার পিঠের উপর রাখতে পারবে?' তখন কওমের সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকটি দ্রুত গিয়ে উটনীর নাড়ীভুঁড়ি নিয়ে এলো এবং রাসূল ﷺ যখন সিজদায় গেলেন তখন এগুলো তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে রেখে দিল। বর্ণনাকারী বলেন: তারা নিজেরা হাসতে থাকল; হাসতে হাসতে একে অন্যের ওপর হেলে পড়ল।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। হায়! আমার যদি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ - এর পিঠ থেকে এগুলো ফেলে দিতাম। রাসূল সিজদায় পড়ে থাকলেন; মাথা উঠালেন না। এক পর্যায়ে এক লোক গিয়ে ফাতিমা (রাঃ) কে খবর দিল। খবর শুনে তিনি ছুটে এলেন। সে সময় ফাতেমা (রাঃ) ছিলেন ছোট বালিকা। তিনি এসে উটের নাড়ীভুঁড়ি তাঁর পিঠ থেকে ফেলে দিলেন। এরপর লোকদের দিকে মুখ করে তাদেরকে গালমন্দ করলেন। অতঃপর রাসূল ﷺ যখন তাঁর সলাত শেষ করলেন তখন তিনি কণ্ঠস্বর উঁচু করলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে বদ দু'আ করলেন। তিনি যখন দু'আ করতেন তখন তিনবার করতেন এবং যখন প্রার্থনা করতেন তখন তিনবার করতেন- এরপর বললেন, ইয়া আল্লাহ্! আপনি কুরাইশকে ধ্বংস করুন (এভাবে তিনবার বললেন)। তারা যখন তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল তাদের হাসি মিলিয়ে গেল এবং তারা তাঁর বদ দু'আকে ভয় পেল। এরপর তিনি বললেন, ইয়া আল্লাহ্! আবু জাহেল ইবনে হিশাম, 'উতবা ইবনে রাবীআ, শায়বা ইব্রান রবী'আ, ওয়ালীদ ইবনে 'উকবা, উমাইয়্যা ইবনে খালাফ ও 'উকবা ইবনে আবু মু'আইতকে ধ্বংস করুন। (রাবী বলেন, তিনি সপ্তম ব্যক্তির নামও বলেছিলেন কিন্তু আমি স্মরণ রাখতে পারিনি।) সেই সত্তার কসম! যিনি মুহাম্মদ ﷺ -কে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, রাসূল ﷺ যাদের নাম উচ্চারণ করেছিলেন, আমি বদর যুদ্ধের দিন তাদেরকে নিহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। পরবর্তীতে তাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে বদরের কূপের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়।"
১৩। হালাল জীবন-যাপন
হালাল খাবার ও হালাল পোশাক গ্রহণ করা। সহিহ মুসলিমে (১০১৫) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ বলেছেন: "হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র নয় এমন কিছু গ্রহণ করেন না। তিনি রাসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন একই নির্দেশ মুমিনদের প্রতিও জারী করেছেন। তিনি (আল্লাহ) বলেন: “হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র (হালাল) খাবার গ্রহণ করুন এবং নেক আমল করুন। নিশ্চয় আপনারা যা কিছু আমল করেন সে সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত" সূরা মুমিনুন, আয়াত: ৫১) তিনি আরও বলেন: "হে ঈমানদারেরা! তোমাদেরকে যেসব ভাল রিজিক দিয়েছি সেগুলো থেকে খাও।" (সুরা বাকারা, আয়াত ১৭২]
এরপর তিনি (রাসূল ﷺ ) উল্লেখ করেন যে, জনৈক ব্যক্তি লম্বা সফর করে উস্কখুষ্ক চুল নিয়ে ধূলিমলিন অবস্থায় দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দু'আ করে, ইয়া রব্ব, ইয়া রব্ব! অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, সে পরিপুষ্ট হয়েছে হারাম খেয়ে তাহলে তার দু'আ কিভাবে কবুল হবে?"
ইবনে রজব (রহঃ) বলেন: "হালাল খাওয়া, হালাল পান করা, হালাল পরিধান করা ও হালাল খেয়ে পরিপুষ্ট হওয়া দু'আ কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত।
১৪। নীরবতা
গোপনে দু'আ করা। শব্দ না করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: "তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক" (সূরা আ'রাফ, আয়াত ৫৫] আল্লাহ তাআলা যাকারিয়া (আলাইহি সালাম) এর প্রশংসা করে বলেন: "যখন তিনি তার রবকে ডেকেছিলেন নিভৃতে" [সূরা মারিয়াম, আয়াত: ০৩]
- লেখা: সংগৃহীত
Comment