দ্বীন কায়েমের কাজে সফলতা পেতে হলে যে আমলটি করা বাধ্যতামূলক।
যদি কোন একটা কাফেলাকে জাগ্রত করার জন্য কিংবা পাহারাদারি করার জন্য আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন আপনি কি ঘুমিয়ে রাত কাটাতে পারবেন?আপনাকে রাত জেগে পাহারা দিতে হবে, সবার মত ঘুমিয়ে পড়লে হবে না।
আপনি একজন দ্বীন কায়েমের কর্মী, আপনি উম্মাহকে জাগ্রত করতে চাচ্ছেন, আপনি চাচ্ছেন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত হোক।তাই আপনাকে সবার মত ঘুমালে হবে না, আপনাকে আপনার লক্ষ্যে পৌছাতে হলে, আপনার মিশনে সফল হতে হলে দিনের বেলা কাজের পাশাপাশি রাতের বেলা কিয়ামূল লাইল করতে হবে। আল্লাহ তা'য়ালা তার হাবীবকে যখন নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব অর্পন করলেন, তখন দায়িত্ব দেওয়ার পরই তাহাজ্জুদ নামাজ রাসূল (সাঃ) ও অন্যান্য মুসলমানদের উপর ফরয করে দিলেন।
আল্লাহ তা'য়ালা সর্বশক্তিমান ও মহাজ্ঞানী। তার দেওয়া পথ ও পদ্ধতিও শ্রেষ্ট। আর তিনিই তার হাবীবকে নবুওয়তের মহান দায়িত্ব দেওয়ার পর পরই তাহাজ্জুদ ফরয করে জানিয়ে দিলেন যে, রাসূল সাঃ তার মহান এ দায়িত্ব সফল হতে হলে দিনের বেলা দাওয়াতের পাশাপাশি রাতে তাহাজ্জুদ পড়া ফরয।
আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
یٰۤاَیُّهَا الۡمُزَّمِّلُ ۙ﴿۱﴾ قُمِ الَّیۡلَ اِلَّا قَلِیۡلًا ۙ﴿۲﴾ نِّصۡفَهٗۤ اَوِ انۡقُصۡ مِنۡهُ قَلِیۡلًا ۙ﴿۳﴾ اَوۡ زِدۡ عَلَیۡهِ وَ رَتِّلِ الۡقُرۡاٰنَ تَرۡتِیۡلًا ؕ﴿۴﴾
হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত।অর্ধরাত্রি কিংবা তার চাইতে অল্প।অথবা তার চাইতে বেশী। আর কুরআন আবৃত্তি কর ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। (সূরা মুযাম্মিল ১-৪)
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা রাসূল সাঃ ও অন্যান্য মুসলিমদের উপর রাতের তাহাজ্জুদ ফরয করেন,কমপক্ষে একচতুর্থাংশ পড়া ফরয ছিলো, মূল আদেশ হলো রাতের কিছু অংশবাদে বাকিটা তাহাজ্জুদে ব্যায় করা। সাহাবীরা তখন তাহাজ্জুদ পড়তে পড়তে পা ফুলে যেত। এভাবে এক বছর উনারা তাহাজ্জুদ আদায় করেন, এরপর আস্তে আস্তে তাহাজ্জুদের বিধান শীতল করা হয়। এক পর্যায়ে রাসূল সাঃ ছাড়া অন্যান্য মুসলমানদের জন্য তা নফল হয়ে যায়।
একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখুন,পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ,রোজা, হজ্ব, যাকাত ফরয হওয়ার আগে এই তাহাজ্জুদ নামায ফরয হয়েছিলো। কত মহা মার্যাদাপূর্ন এই নামায। আজও যদি আমরা দ্বীন কায়েমের মিশনে সফল হতে চাই, আমাদের অবশ্যই তাহাজ্জুদ নামায পড়ার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে।
মনে করুন,এই পৃথিবীতে কোন দেশের বাদশাহ তার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে যদি বিশেষ কোন দায়িত্ব অর্পন করে দেয় সে কাজটি কতটা মহান ও মার্যাদাবান হয়।
এই পৃথিবীতে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা রাসূল (সাঃ)। আল্লাহ তা'য়ালা তার সবচেয়ে প্রিয় বান্দার উপর একটি আমল বিশেষভাবে ফরয করেছেন। আর সেটি হলো তাহাজ্জুদ, তাহাজ্জুদে ফরয বিধান সকল মুসলিমের উপর থেকে রহিত হলেও আল্লাহ তা'য়ালা তার হাবীবের উপর ফরয রেখে দেন।
চিন্তা করুন,যেই আমলটি আল্লাহ তা'য়ালা তার সবচেয়ে প্রিয় বান্দার উপর বিশেষভাবে ফরয করেছেন সেই আমলটি কত মহান ফজিলতপূর্ন ও গুরুত্ব পূর্ন।আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
وَ مِنَ الَّیۡلِ فَتَهَجَّدۡ بِهٖ نَافِلَۃً لَّکَ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا ﴿۷۹﴾
আর রাত্রির কিছু অংশে তা দিয়ে তাহাজ্জুদ পড়; এটা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য।আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।(সূরা ইশরা ৭৯)
এজন্য আজও দেখবেন, তাহাজ্জুদ নামাজ তারাই পড়ার তাওফিক পায় যারা আল্লাহর খুব কাছের বান্দা,সাধারন দ্বীনদারাও নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তে পারে না।
হাদিসে বলা হয়েছে
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللّيْلِ فَإِنّهُ دَأَبُ الصّالِحِينَ قَبْلَكُمْ، وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ، وَمَكْفَرَةٌ لِلسّيِّئَاتِ، وَمَنْهَاةٌ لِلإِثْمِ.
তোমরা কিয়ামুল লাইলের প্রতি যত্নবান
হও। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহীনের অভ্যাস এবং রবের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। আর তা পাপরাশী মোচনকারী এবং গোনাহ থেকে বাধা প্রদানকারী। -জামে তিরমিযি, হাদীস ৩৫৪৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১১৫৬
হাদীসে কিয়ামূল লাইল বা তাহাজ্জুদকে পূর্ববর্তী সালেহীনদের অভ্যাস বলা হয়েছে।কোন সাধারন ব্যক্তির অভ্যাস বলা হয় নি। এরপরে বলা হয়েছে তাহাজ্জুদ রবের নৈকট্য লাভের মাধ্যম।
দুনিয়াতে দেখা যায় কেউ যদি কোন ক্ষমতাধর, সম্পদশালী ব্যক্তির কাছের লোক হয় তখন তার সাহস, শক্তি বেড়ে যায়। এমনকি ভীতু, কাপুরষ হওয়ার পরেও ক্ষমতাধর ব্যক্তির নৈকট্য লাভের কারনে সাহস বেড়ে যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়,দুনিয়াতে কোন বড় আলিম বা নেতার নৈকট্য লাভের দ্বারা মানুষ এতটাই প্রভাবিত হয় যে, কথা বার্তা ধরন , চালচলন, উঠাবসাও তার মত করার চেষ্টা করে।
যখন আপনি সর্বশক্তিমান ও মহা প্রতাপশালী আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবেন তখন দেখা যাবে আপনিও আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে যাবেন,আপনিও রবের নৈকট্য লাভের মাধ্যমে সাহসী, শক্তিশালী হয়ে উঠবেন।আপনার সবকিছুতেই পরিবর্তন চলে আসবে ইনশাআল্লাহ,আপনার ইমানী শক্তি বেড়ে যাবে।যেহেতু হাদীসে বলা হয়েছে তাহাজ্জুদ রবের নৈকট্য লাভের মাধ্যম, সেহেতু আমাদের অবশ্যই তাহাজ্জুদ নামায পড়ার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে।
হাদিসে আরও বলা হয়েছে, তাহাজ্জুদ পাপ থেকে বাঁধা দিবে। সাধারণত দ্বীনের পথে যিনি যত অগ্রসর হন তাকে তত বেশি শয়তান ধোঁকা দেয়।
তাকে ততবেশি পাপে জড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যদি কেউ নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস করে, তাকে এই তাহাজ্জুদ পাপ থেকে বিরত রাখবে।
রাসূল সাঃ বলেনঃ
يَنْزِلُ رَبّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلّ لَيْلَةٍ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي، فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.
আমাদের রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছো, দুআ করবে আমি তার দুআ কবুল করব। কে আছো, আমার কাছে (তার প্রয়োজন) চাইবে আমি তাকে দান করব। কে আছো, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮
এই হাদিসখানায় বলা হয়েছে রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ ডেকে ডেকে বলেন, কেউ কিছু চাইলে তিনি দিবেন,কেউ দুআ করলে তিনি কবুল করবেন।আমরা যখন শেষ রাতে উঠতে পারি না, যখন শেষ রাতে উঠার গুরুত্ব আমাদের নিকট কমে যায় তখন আমাদের বুজতে হবে যে, আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার গুরুত্ব আমাদের কমে গেছে।ভেবে দেখুন যিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা ও সম্মান পাওয়ার হক্বদার তার ডাকে সাড়া দিতে না পারাটা কত বড় আপসোসের ব্যাপার।
আমরা যদি ওই সময় আল্লাহর দরবারে আমাদের দূর্বলতা, অক্ষমতা, সমস্যা দূর হওয়ার জন্য দোয়া করতে পারতাম তাহলে আমরা অনেক বড় সফলতা পেতাম।আমরা অনেকেই দোয়া কে ছোট করে দেখি। অথচ দোয়া অনেক বড় শক্তিশালী অস্র।হযরত সুলাইমান আঃ কত বিরাট বাদশাহ ছিলেন, জ্বীনদের উপরেও উনার রাজত্ব ছিলো। কিন্তু এত বিরাট রাজত্ব তিনি দোয়া করার কারনেই লাভ করেছেন। হযরত ওমর (রাঃ) এর মত মহান সাহাবী ইমান এনেছের রাসূল সাঃ এর দোয়ার বরকতেই৷আমরাও যদি দ্বীনের একজন যোগ্য, বিচক্ষণ, সাহসী সেনিক হওয়ার জন্য দোয়া করতে পারতাম, আল্লার নিকট দ্বীন কায়েমের কাজ বেশি বেশি করবার তাওফিক চাইতে পারতাম তাহলে আমরা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য অনেক বড় অবদান রাখতে পারবো ইনশাআল্লাহ। তাহাজ্জুদ পড়ার উপায়ঃ তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য প্রথমত আমরা গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে। এরপর রাতে শোয়ার পূর্বে দুই চার রাকাত নফল নামাজ পড়ে দোয়া করবো যেন আল্লাহ তাহাজ্জুদের সময় জাগ্রত করে দেন। যদি কোন রাত তাহাজ্জুদ নামাজ মিস হয়, আমরা দিনের বেলা বেশি বেশি নফল পড়ে কাকুতি মিনতি করে দোয়া করবো যেন নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তে পারি, যেন শেষ রাতে রবের ডাকে সাড়া দিতে পারি। আল্লাহ আমাদের নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায পড়ার তাওফিক দান করুন, আমিন।
Comment