মুজাহিদের আখলাক: ৫
শাজাআ'ত-বীরত্ব:
"و إن الشجاع منا للذي يحاذي به"
"আমাদের বাহাদুর ব্যক্তিই তার মোকাবেলা করবে"
একজন মুসলিম যখন তাঁর দ্বীনকেই একমাত্র এই দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দামী এবং মূল্যবান জ্ঞান করবে তখন সে তার দ্বীনকে রক্ষার জন্য অত্যন্ত সাহসী বীর, নির্ভীক এবং দৃঢ়পদের অগ্রগামী হবে।
বীরত্ব এবং বাহাদুরি উদ্ভোবিত হয় মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি থেকে। আর জিহাদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিত চর্চা, অনুশীলন এবং রণাঙ্গনের অবতরণ এই স্বভাব-প্রকৃতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক সময় একজন যুবক বীরত্বের এই নৈতিক গুণটির অধিকারী হয়ে উঠে, এবং সে বীরবিক্রম, বীরোত্তম ইত্যাদির সম্মানিত ভূষনের পাত্র হয়। সায়্যিদুনা ওমর (রা বলেনঃ
(والجرأة والجبن غرائز يضعها الله حيث شاء، فالجبان يفر عن أبيه و أمه، و الجريء يقاتل عما لا يؤوب به إلى رحله، و القتل حتف من الحتوف).
"বীরত্ব এবং কাপুরুষতা দুটিই স্বভাবজাত গুণ, আল্লাহ্ তায়ালা যেটাকে যার মধ্যে চান রাখেন। কাপুরুষ তো আপন মা বাবা থেকেই পালায়ন করে, আর বাহাদুর ব্যক্তি সে তো আমরণ লড়াই করে চলে। আর নিহত হয়া সাধারণ নিয়তিরি একটি নিয়তি। (মুআত্ত্বা, কিতাবুল-জিহাদ, হাদীস নং:৩৫)
"নিহত হয়া সাধারণ নিয়তিরি একটি নিয়তি" এই কথার ব্যাখ্যায় ফুআদ আব্দুল বাকী (রহ বলেন:
"قوله: والقتل حتف من الحتوف, اي نوع من أنواع الموت كالموت بمرض أو نحوه، فيجب ألا يرتاع منه ولا يهاب هيبة تورث الجبن"
"-"নিহত হয়া সাধারণ নিয়তিরি একটি নিয়তি" এই কথার অর্থ এবং উদ্যেশ্য হলো: নিহত হয়াটা রোগ-ব্যধির এবং অনুরূপ কোন কারণে মৃত্যুর মতই এক প্রকার মৃত্যু। সুতরাং জরুরি হলো নিহত হয়াকে ভয় না করা, এবং নিহত হয়ার ব্যাপারে এতটা সন্ত্রস্ত হয়া উচিত নয়, যার দরুন কাপুরুষতা জন্ম নেয়।" ( উল্লেখিত হাদীসের উপর ফুআদ আব্দুল বাকী রহ: এর টীকা।)
আহলে হক্বের বীরত্বের দ্বারাই দ্বীন বিজয়ী হবেঃ
মহান আল্লাহ্ তায়ালা ফায়সাল করেছেন যে, তিনি তাঁর দ্বীনে হক্বকে বিজয়ী করবেন এই দ্বীনের অনুসারীদের বীরত্বের মাধ্যমে। এ জন্য আল্লাহ্ তায়ালার নিয়ম হল: হক্বের অনুসারীগণ যখন দুর্বলতা এবং কাপুরুষতা প্রদর্শন করে তখন তাদেরকে পরিবর্তন করে অন্যদেরকে নিয়ে আসেন।
ইবনে তায়মিয়াহ্ রহঃ বলেন:
"ولما كان صلاح بني آدم لا يتم في دينهم و دنياهم إلا بالشجاعة و الكرم ، بين سبحانه أن من تولى عن الجهاد بنفسه أبدله الله به من يقوم بذلك".
"যেহেতু স্বাভাবিক নীতি এই যে, বীরত্ব এবং দয়া-দানশীলতা এ দুটি নৈতিক গুণ ব্যতীত বনী আদমের দ্বীনী এবং দুনিয়াবি কল্যাণ পুর্ণ হয় না, সেহেতু আল্লাহ্ তায়ালা সুস্পষ্ট করেছেন যে, যে ব্যক্তি তার জান (মাল) দ্বারা জিহাদ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে আল্লাহ্ তাকে বাদ দিয়ে এমন কাউকে নিয়ে আসবেন যে এই কাজকে সম্পন্ন করবে।" (ফাতাওয়ায়ে ইবনে তায়মিয়্যাহ্:২৮/১৫৭)
কাপুরুষতা মুনাফিকদের স্বভাবঃ
মুনাফিক এবং সুবিধাবাদী লোকদের উপর আস্থা রাখা যায় না, কেননা তারা নিজেদের চিন্তায় বিভোর, এবং লোভ লালসার পিছে উদ্ভ্রান্ত। উহুদের যুদ্ধে মুনাফিকদের বিবরণ দিতে গিয়ে হযরত আবু ত্বলহা রা: যেমনটি বলেছেনঃ
(و الطائفة الأخرى المنافقون، ليس لهم إلا أنفسهم أجبن قوم و أرعبه، و أخذله ألحق".
"অপর দলটি হল মুনাফিকদের, তাদের নিজেদের ছাড়া অন্য কোন চিন্তা নেই, তারা হলো লোকদের মধ্যে সবচেয়ে কাপুরুষ এবং অধিক ভীতু, এবং হক্বকে অধিক লাঞ্ছিত কারী।" ( সহীহ সুনানে তিরমীজী (আলবানী কর্তৃক) তাফসীর অধ্যায়, সূরা আলে ইমরান, হাদীস নং:২৪০৬/৩২০৮, সহীহ।)
কাপুরুষতা সর্বকালেই নিন্দনীয়ঃ
জাহিলী সমাজের মর্যাদাসম্পন্ন লোকেরা পরস্পরকে কাপুরুষতার কারণে তিরস্কার করতো আর বীরত্ব সাহসিকতা নিয়ে গর্ব করতো। বদরের যুদ্ধে কুরাইশ নেতা আবু জাহেল এবং উতবা বিন রবিআহর মধ্যকার তর্কবিতর্ক এই বিষয়টির স্পষ্ট নমূনা।
বদরের দিন উতবা বললঃ
"يا قوم! إني أرى قوما مستميتين لا تصلون إليهم و فيكم خير، يا قوم! اعصبوها اليوم برأسي، و قولوا جبن عتبة بن ربيعة و قد علمتم أني لست بأجبنكم".
"হে কওম! আমি এক মরণপণ যুদ্ধা জাতিকে দেখছি, তাদের কাছে না যাওয়ার মাঝেই তোমাদের কল্যাণ রয়েছে। হে কওম! তোমরা এটাকে আমার উপর চাপিয়ে দিবে এবং বলবে: উতবা বিন রবিআহ কাপুরুষ হয়েগেছে, অথচ তোমরা জানো আমি তোমাদের মধ্যে কাপুরুষ নই।"
একথা শুনে আবু জাহেল বলল:
"انت تقول هذا؟! والله لو غيرك يقول هذا لأعضضته، قد ملأت رئتك جوفك رعبا".
"তুমিই এ কথা বললে?! আল্লাহর কসম! যদি তুমি ছাড়া অন্য কেউ একথা বলতো তাহলে অবশ্যই আমি তাকে লাঞ্ছিত করতাম! তোমার ফুসফুস তোমার উদরটাকে ভয়ভীতি দ্বারা পুর্ণ করে দিয়েছে।
উত্তরে উতবা বললঃ
"إياي تعير يا مصغر استه، ستعلم اليوم أينا الجبان!؟!"
"আমাকে অপমানিত করলে?! (হে পাছা হলদে কারী!!) আজ শীঘ্রই জানতে পারবে আমাদের মধ্যে কে কাপুরুষ!!(মুসনাদে আহমাদ ১/১১৭, বুলূগুল আমানী ২০/৩২)
কাপুরুষতা একটি নিন্দনীয় এবং একটি নিকৃষ্টতম চরিত্র, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিন্দা করে বলেনঃ
"شر ما في الرجل شح هالع، و جبن خالع.."
"একজন ব্যক্তির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট স্বভাব হলো লালসাপুর্ণ কৃপণতা, এবং ভয়ভীতিপুর্ণ কাপুরুষতা। (আলবানী কর্তৃক সহীহ সুনানে আবী দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়:২২, হাদীস নং ২১৯২/২৫১১)
এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে পানাহ চেয়ে এই দুআ' করতেন:
*" اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ*مِنَ الْجُبْنِ،*وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ*الْهَرَمِ*، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ ".(صحيح البخاري)
সায়া'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রাঃ তাঁর সন্তানদেরকে এই কালেমাগুলোর তা'লীম দিতেন যেভাবে একজন শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে হাতের লেখার তা'লীম দেন, এবং তিনি বলতেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সালাতের পরে এই দুআ' পড়তেন:
" اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ*مِنَ الْجُبْنِ،*وَأَعُوذُ بِكَ أَنْ أُرَدَّ إِلَى*أَرْذَلِ الْعُمُرِ*، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ ". (صحيح البخاري)
ব্যাক্তির মধ্যে কাপুরুষতা কিভাবে জন্ম নেয়?
কাপুরুষতা একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। এর দ্বারা শুধু ব্যাক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং একটি সমাজ এমনকি পুরা একটি জাতি ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। তাই এধরণের ব্যাধি কেন এবং কিভাবে জন্ম নেয় এবং কী তার প্রতিকার? তা জেনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ব্যক্তির মনোবলকে ভেঙে দেয়, এধরণের ভয়ভীতি এবং কাপুরুষতা জন্ম নেয় তার বাল্যকাল থেকেই, তার লালন পালনের ধরণ, এবং বেড়ে উঠার পরিবেশ ও সমাজের প্রভাবের কারণে। পরিবার-সমাজ এবং পরিবেশ যদি হয় আরাম প্রিয়, অসহিষ্ণু এবং জাগতিক মুখী, তবে এমন মহলে বেড়ে উঠলে স্বাভাবিক ভাবেই একজন ব্যক্তির মধ্যে কাপুরুষতা জন্ম নেবে। মূলত দুনিয়ার মুহব্বত ও আকর্ষণ এবং মৃত্যুর ভয় ও অনিহার মানসিকতা থেকেই মানুষ অতিমাত্রার আরাম এবং বিলাস প্রিয় হয়ে উঠে আর একারণে সে ভয়ভীতি, মানসিক দুর্বলতা নানা ধরনের দুঃশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়, আর এসবের কারণে এক সময় সে বীরত্ব, সাহসিকতা, শৌর্যবীর্য এর মত উন্নত মানবিক গুণাবলী থেকে শুন্য হয়ে পড়ে।
দুনিয়া এবং দুনিয়ার চাকচিক্যের সাথে মাত্রাতিরিক্ত সম্পর্কের অশুভ ফল এটাই যে, এর কারণে ব্যক্তি নিজের ইহকালীন এবং পরকালীন কল্যাণ রক্ষার ক্ষেত্রে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, এবং ফরজ যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে কাপুরুষতা প্রদর্শন করে।
দুনিয়ার বস্তুসমূহের মধ্যে মানুষকে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি আকর্ষণ করে তা হলো সন্তানাদি। সন্তানাদির মুহব্বত এবং তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তার কারণেই মানুষ নিজের পরকালের কথা ভুলে গিয়ে সম্পদ আহরণ এবং গুচ্ছিত করে, এবং এসব করতে গিয়ে একপর্যায়ে সে নিজেই দুনিয়ার মোহজালে আটকে পড়ে। আর এর কারণে তার মধ্যে ধিরে ধিরে লোভ-লালসা, ভয়ভীতি, কৃপণতা এবং কাপুরুষতার মত মারাত্মক মানসিক ব্যাধিসমূহ বাসা বাঁধতে থাকে। এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
"إن الولد مبخلة مجبنة"
"নিশ্চয়ই সন্তানাদি কার্পন্যতা এবং কাপুরুষতার কারণ।"(আলবানী কর্তৃক সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল-আদব, অধ্যায়:৩, হাদীস নং:২৯৫৭/৩৬৬৬.)
এজন্য একজন বীর-বাহাদুর ব্যক্তিত্বের মাঝে এবং একজন কাপুরুষ ব্যক্তির মাঝে পার্থক্য লক্ষনীয় এবং অত্যন্ত স্পষ্ট। এপ্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়্যিম রহ: বলেন:
"فإن الشجاع منشرح الصدر ... والجبان أضيق الناس صدرا، وأحصرهم قلبا، لا فرحة له و لا سرور، و لا لذة له و لا نعيم؛ إلا من جنس ما للحيوان البهيمي".
"কেননা নিশ্চয়ই বীর-সাহসী ব্যক্তি প্রসশ্ত হৃদয়ের অধিকারী হয়, আর কাপুরুষ-ভীরু ব্যক্তি হয় সংকীর্ণমনা, ছোট দিলের, তার জীবনে না আছে কোন খুশি, না আছে কোন আনন্দ-সুখ, এবং না আছে কোন স্বাদ-স্বাচ্ছন্দ! হ্যাঁ তার জীবনে ভোগ বলতে যা কিছু আছে তা ঐরকম, যেরকম একটি চতুষ্পদ জন্তুর জীবনে রয়েছে।"( যাদুল-মাআ'দ:১/১৮৭)
আমাদের সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বীর-সাহসী করে গড়ে তোলার জন্য বাল্যকাল থেকেই তাদের হৃদয়ে বীরত্বের বীজ বপন করতে হবে, যাতে তারা নিজেদেরকে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। এর জন্য পরিবারের মধ্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রা: এবং সালাফদের বীরত্বগাঁথা যুদ্ধজীবনের এবং দ্বীনের জন্য তাঁদের অসীম ত্যাগ ও কুরবানীর ঘটনাসমুহের নিয়মিত তা'লীম করতে হবে।
নেতৃত্বের জন্য বীরত্ব ও সাহসীকতার প্রয়োজন:
যে ব্যক্তি উম্মাহকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দাঁড়াবে তাকে অবশ্যই বীরত্বের মধ্যে আদর্শ হতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনি ছিলেন, তিনি ছিলেন লোকদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বড় বাহাদুর, এবং সর্বাধিক দানশীল। (সহীহ বুখারী,কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়: ২৪, হাদীস নং ২৮২০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ
"لَوْ كَانَ لِي عَدَدُ هَذِهِ العِضَاة نَعَمًالَقَسَمْتُهُ بَيْنَكُمْ، ثُمَّ لَا تَجِدُونِي بَخِيلًا، وَلَا كَذُوبًا،*وَلَا جَبَانًا*".
"যদি এই বৃক্ষরাজির সংখ্যায় আমার উট হত তবে আমি তা তোমাদের মাঝে বিলিয়ে দিতাম, তোমরা আমাকে একটুও কৃপণ, মিথ্যুক এবং কাপুরুষ পেতে না।(সহীহ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায় ২৪, হাদীস নং ২৮২১)
ফায়েদাঃ
ইবনে হাজার রহ: বলেনঃ উক্ত হাদীসের মধ্যে কৃপণতা, মিথ্যা, এবং কাপুরুষতা এই তিনটি স্বভাবের কুৎসা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একথার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইমামুল মুসলিমীনের মধ্যে উল্লেখিত স্বভাব গুলোর কোন একটি স্বভাব বিদ্যমান থাকা উপযুক্ত নয়।"(ফাতহুল বারী ৬/২৫৪, কিতাব:ফরজুল-খুমুস, অধ্যায়:১৯, হাদীস নং ৩১৪৮ এর ব্যাখ্যায়।)
সুতরাং মুসলিমদের ইমাম থেকে শুরু করে সর্বস্তরের আমীর এবং উলামাদের বীর-সাহসী হয়া অপরিহার্য। বিশেষত যিনি আমীরুল-জাঈশ হবেন তাঁকে আরোও সাহসী বীর হতে হবে, এতে করে তার অধিনস্ত সাধারণ সৈনিকগণ তার সাহসীকতা এবং বীরত্ব নিয়ে গর্ব করবে এবং তারা আরোও বেশি অগ্রগামী এবং তৎপর হবে। বারা' রা: হুনাঈন যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:
"كنا و الله إذا احمر البأس نتقي به، و إن الشجاع منا للذي يحاذي به".(صحيح مسلم، كتاب الجهاد، الحديث:٧٩)
"আল্লাহর কসম! যখন যুদ্ধ প্রকট আকার ধারণ করল আমরা নিজেদের রক্ষা করতে লাগলাম, আর আমাদের মধ্যে যে সাহসী বাহাদুর সে মোকাবেলা করতে থাকল।"
এর কারণ ছিল যে, তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীম সাহসীকতার সাথে লড়াই করা প্রত্যক্ষ করছিলেন।
মুমিনের শান নয় যে, শত্রু তাঁর মধ্যে দুর্বলতা এবং ভীরুতা প্রত্যক্ষ করবে। কাফের মুশরিকদের সামনে মুমিন ব্যক্তির মনোবল কেমন হয়া চাই, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে সাহাবী খুবাইব রা: এর শাহাদাতের ঘটনা। তাঁকে যখন মুশরিকরা শহীদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন তিনি শাহাদাতের পুর্বমুহুর্তে দু রাকা'ত সালাত আদায় করেন। সালাত শেষে তিনি কাফেরদের কে লক্ষ্য করে বলেন:
"والله لو لا أن تحسبوا أن ما بي جزع لزدت"
"আল্লাহর কসম! যদি তোরা আমার ব্যাপারে এই ধরণা করবি বলে আশংকা না হত যে, আমার মধ্যে কোন ভয় কাজ করছে!! তাহলে আমি (সালাতকে) আরোও বৃদ্ধি করতাম!! ( সহীহ বুখারী, আলমাগাযী, অধ্যায়:১০, হাদীস নং ৩৯৮৯, ফাতহুল বারী ৭/৩০৯)
মুমিনের বীরত্ব প্রকাশ পাবে দ্বীন ও উম্মাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে, এবং তাঁর অপর মুসলিম ভাই বোনদের কল্যাণ কামনায় আবৃত্তির মাধ্যমে, সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ করতে। আর যখন সে মুসলিম ভাই-বন্ধু এবং দুর্বল অসহায় ও মজলুমদের সাহায্য করতে অগ্রসর হবে সে ক্ষেত্রে তার বীরত্ব এবং সাহসীকতা নিজ ইচ্ছাসীমা থেকে বের হয়ে যাবে।
"উম্মাতুশ-শাহাদাত" তথা যে উম্মতকে আল্লাহ্ তায়ালা মানবজাতির উপর সাক্ষী বানিয়েছেন, দ্বীনে হক্বের সাহায্য এবং প্রতিরোধ-প্রতিরক্ষার জন্য তার প্রয়োজন একদল নির্ভীক সাহসী বীর সেনানীর। সেই সঙ্গে প্রয়োজন দ্বীনে হকের দাওয়াত এবং প্রচার প্রসারের জন্য বলিষ্ঠ সাহসী কন্ঠ।
اللهم اجعلنا من الذين يجاهدون في سبيلك باموالهم و أنفسهم ولا يخافون لومة لائم و يقولون: رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ. امين يارب العالمين
কেমন হবে মুজাহিদের আখলাক? ১-৪ পর্বের লিংক:
কেমন হবে মুজাহিদদের আখলাক
4.
1.
2.
3.
শাজাআ'ত-বীরত্ব:
"و إن الشجاع منا للذي يحاذي به"
"আমাদের বাহাদুর ব্যক্তিই তার মোকাবেলা করবে"
একজন মুসলিম যখন তাঁর দ্বীনকেই একমাত্র এই দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দামী এবং মূল্যবান জ্ঞান করবে তখন সে তার দ্বীনকে রক্ষার জন্য অত্যন্ত সাহসী বীর, নির্ভীক এবং দৃঢ়পদের অগ্রগামী হবে।
বীরত্ব এবং বাহাদুরি উদ্ভোবিত হয় মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতি থেকে। আর জিহাদের প্রশিক্ষণ, নিয়মিত চর্চা, অনুশীলন এবং রণাঙ্গনের অবতরণ এই স্বভাব-প্রকৃতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক সময় একজন যুবক বীরত্বের এই নৈতিক গুণটির অধিকারী হয়ে উঠে, এবং সে বীরবিক্রম, বীরোত্তম ইত্যাদির সম্মানিত ভূষনের পাত্র হয়। সায়্যিদুনা ওমর (রা বলেনঃ
(والجرأة والجبن غرائز يضعها الله حيث شاء، فالجبان يفر عن أبيه و أمه، و الجريء يقاتل عما لا يؤوب به إلى رحله، و القتل حتف من الحتوف).
"বীরত্ব এবং কাপুরুষতা দুটিই স্বভাবজাত গুণ, আল্লাহ্ তায়ালা যেটাকে যার মধ্যে চান রাখেন। কাপুরুষ তো আপন মা বাবা থেকেই পালায়ন করে, আর বাহাদুর ব্যক্তি সে তো আমরণ লড়াই করে চলে। আর নিহত হয়া সাধারণ নিয়তিরি একটি নিয়তি। (মুআত্ত্বা, কিতাবুল-জিহাদ, হাদীস নং:৩৫)
"নিহত হয়া সাধারণ নিয়তিরি একটি নিয়তি" এই কথার ব্যাখ্যায় ফুআদ আব্দুল বাকী (রহ বলেন:
"قوله: والقتل حتف من الحتوف, اي نوع من أنواع الموت كالموت بمرض أو نحوه، فيجب ألا يرتاع منه ولا يهاب هيبة تورث الجبن"
"-"নিহত হয়া সাধারণ নিয়তিরি একটি নিয়তি" এই কথার অর্থ এবং উদ্যেশ্য হলো: নিহত হয়াটা রোগ-ব্যধির এবং অনুরূপ কোন কারণে মৃত্যুর মতই এক প্রকার মৃত্যু। সুতরাং জরুরি হলো নিহত হয়াকে ভয় না করা, এবং নিহত হয়ার ব্যাপারে এতটা সন্ত্রস্ত হয়া উচিত নয়, যার দরুন কাপুরুষতা জন্ম নেয়।" ( উল্লেখিত হাদীসের উপর ফুআদ আব্দুল বাকী রহ: এর টীকা।)
আহলে হক্বের বীরত্বের দ্বারাই দ্বীন বিজয়ী হবেঃ
মহান আল্লাহ্ তায়ালা ফায়সাল করেছেন যে, তিনি তাঁর দ্বীনে হক্বকে বিজয়ী করবেন এই দ্বীনের অনুসারীদের বীরত্বের মাধ্যমে। এ জন্য আল্লাহ্ তায়ালার নিয়ম হল: হক্বের অনুসারীগণ যখন দুর্বলতা এবং কাপুরুষতা প্রদর্শন করে তখন তাদেরকে পরিবর্তন করে অন্যদেরকে নিয়ে আসেন।
ইবনে তায়মিয়াহ্ রহঃ বলেন:
"ولما كان صلاح بني آدم لا يتم في دينهم و دنياهم إلا بالشجاعة و الكرم ، بين سبحانه أن من تولى عن الجهاد بنفسه أبدله الله به من يقوم بذلك".
"যেহেতু স্বাভাবিক নীতি এই যে, বীরত্ব এবং দয়া-দানশীলতা এ দুটি নৈতিক গুণ ব্যতীত বনী আদমের দ্বীনী এবং দুনিয়াবি কল্যাণ পুর্ণ হয় না, সেহেতু আল্লাহ্ তায়ালা সুস্পষ্ট করেছেন যে, যে ব্যক্তি তার জান (মাল) দ্বারা জিহাদ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে আল্লাহ্ তাকে বাদ দিয়ে এমন কাউকে নিয়ে আসবেন যে এই কাজকে সম্পন্ন করবে।" (ফাতাওয়ায়ে ইবনে তায়মিয়্যাহ্:২৮/১৫৭)
কাপুরুষতা মুনাফিকদের স্বভাবঃ
মুনাফিক এবং সুবিধাবাদী লোকদের উপর আস্থা রাখা যায় না, কেননা তারা নিজেদের চিন্তায় বিভোর, এবং লোভ লালসার পিছে উদ্ভ্রান্ত। উহুদের যুদ্ধে মুনাফিকদের বিবরণ দিতে গিয়ে হযরত আবু ত্বলহা রা: যেমনটি বলেছেনঃ
(و الطائفة الأخرى المنافقون، ليس لهم إلا أنفسهم أجبن قوم و أرعبه، و أخذله ألحق".
"অপর দলটি হল মুনাফিকদের, তাদের নিজেদের ছাড়া অন্য কোন চিন্তা নেই, তারা হলো লোকদের মধ্যে সবচেয়ে কাপুরুষ এবং অধিক ভীতু, এবং হক্বকে অধিক লাঞ্ছিত কারী।" ( সহীহ সুনানে তিরমীজী (আলবানী কর্তৃক) তাফসীর অধ্যায়, সূরা আলে ইমরান, হাদীস নং:২৪০৬/৩২০৮, সহীহ।)
কাপুরুষতা সর্বকালেই নিন্দনীয়ঃ
জাহিলী সমাজের মর্যাদাসম্পন্ন লোকেরা পরস্পরকে কাপুরুষতার কারণে তিরস্কার করতো আর বীরত্ব সাহসিকতা নিয়ে গর্ব করতো। বদরের যুদ্ধে কুরাইশ নেতা আবু জাহেল এবং উতবা বিন রবিআহর মধ্যকার তর্কবিতর্ক এই বিষয়টির স্পষ্ট নমূনা।
বদরের দিন উতবা বললঃ
"يا قوم! إني أرى قوما مستميتين لا تصلون إليهم و فيكم خير، يا قوم! اعصبوها اليوم برأسي، و قولوا جبن عتبة بن ربيعة و قد علمتم أني لست بأجبنكم".
"হে কওম! আমি এক মরণপণ যুদ্ধা জাতিকে দেখছি, তাদের কাছে না যাওয়ার মাঝেই তোমাদের কল্যাণ রয়েছে। হে কওম! তোমরা এটাকে আমার উপর চাপিয়ে দিবে এবং বলবে: উতবা বিন রবিআহ কাপুরুষ হয়েগেছে, অথচ তোমরা জানো আমি তোমাদের মধ্যে কাপুরুষ নই।"
একথা শুনে আবু জাহেল বলল:
"انت تقول هذا؟! والله لو غيرك يقول هذا لأعضضته، قد ملأت رئتك جوفك رعبا".
"তুমিই এ কথা বললে?! আল্লাহর কসম! যদি তুমি ছাড়া অন্য কেউ একথা বলতো তাহলে অবশ্যই আমি তাকে লাঞ্ছিত করতাম! তোমার ফুসফুস তোমার উদরটাকে ভয়ভীতি দ্বারা পুর্ণ করে দিয়েছে।
উত্তরে উতবা বললঃ
"إياي تعير يا مصغر استه، ستعلم اليوم أينا الجبان!؟!"
"আমাকে অপমানিত করলে?! (হে পাছা হলদে কারী!!) আজ শীঘ্রই জানতে পারবে আমাদের মধ্যে কে কাপুরুষ!!(মুসনাদে আহমাদ ১/১১৭, বুলূগুল আমানী ২০/৩২)
কাপুরুষতা একটি নিন্দনীয় এবং একটি নিকৃষ্টতম চরিত্র, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিন্দা করে বলেনঃ
"شر ما في الرجل شح هالع، و جبن خالع.."
"একজন ব্যক্তির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট স্বভাব হলো লালসাপুর্ণ কৃপণতা, এবং ভয়ভীতিপুর্ণ কাপুরুষতা। (আলবানী কর্তৃক সহীহ সুনানে আবী দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়:২২, হাদীস নং ২১৯২/২৫১১)
এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে পানাহ চেয়ে এই দুআ' করতেন:
*" اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ*مِنَ الْجُبْنِ،*وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ*الْهَرَمِ*، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ ".(صحيح البخاري)
সায়া'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রাঃ তাঁর সন্তানদেরকে এই কালেমাগুলোর তা'লীম দিতেন যেভাবে একজন শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে হাতের লেখার তা'লীম দেন, এবং তিনি বলতেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সালাতের পরে এই দুআ' পড়তেন:
" اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ*مِنَ الْجُبْنِ،*وَأَعُوذُ بِكَ أَنْ أُرَدَّ إِلَى*أَرْذَلِ الْعُمُرِ*، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ ". (صحيح البخاري)
ব্যাক্তির মধ্যে কাপুরুষতা কিভাবে জন্ম নেয়?
কাপুরুষতা একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। এর দ্বারা শুধু ব্যাক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং একটি সমাজ এমনকি পুরা একটি জাতি ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। তাই এধরণের ব্যাধি কেন এবং কিভাবে জন্ম নেয় এবং কী তার প্রতিকার? তা জেনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ব্যক্তির মনোবলকে ভেঙে দেয়, এধরণের ভয়ভীতি এবং কাপুরুষতা জন্ম নেয় তার বাল্যকাল থেকেই, তার লালন পালনের ধরণ, এবং বেড়ে উঠার পরিবেশ ও সমাজের প্রভাবের কারণে। পরিবার-সমাজ এবং পরিবেশ যদি হয় আরাম প্রিয়, অসহিষ্ণু এবং জাগতিক মুখী, তবে এমন মহলে বেড়ে উঠলে স্বাভাবিক ভাবেই একজন ব্যক্তির মধ্যে কাপুরুষতা জন্ম নেবে। মূলত দুনিয়ার মুহব্বত ও আকর্ষণ এবং মৃত্যুর ভয় ও অনিহার মানসিকতা থেকেই মানুষ অতিমাত্রার আরাম এবং বিলাস প্রিয় হয়ে উঠে আর একারণে সে ভয়ভীতি, মানসিক দুর্বলতা নানা ধরনের দুঃশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়, আর এসবের কারণে এক সময় সে বীরত্ব, সাহসিকতা, শৌর্যবীর্য এর মত উন্নত মানবিক গুণাবলী থেকে শুন্য হয়ে পড়ে।
দুনিয়া এবং দুনিয়ার চাকচিক্যের সাথে মাত্রাতিরিক্ত সম্পর্কের অশুভ ফল এটাই যে, এর কারণে ব্যক্তি নিজের ইহকালীন এবং পরকালীন কল্যাণ রক্ষার ক্ষেত্রে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, এবং ফরজ যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে কাপুরুষতা প্রদর্শন করে।
দুনিয়ার বস্তুসমূহের মধ্যে মানুষকে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি আকর্ষণ করে তা হলো সন্তানাদি। সন্তানাদির মুহব্বত এবং তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তার কারণেই মানুষ নিজের পরকালের কথা ভুলে গিয়ে সম্পদ আহরণ এবং গুচ্ছিত করে, এবং এসব করতে গিয়ে একপর্যায়ে সে নিজেই দুনিয়ার মোহজালে আটকে পড়ে। আর এর কারণে তার মধ্যে ধিরে ধিরে লোভ-লালসা, ভয়ভীতি, কৃপণতা এবং কাপুরুষতার মত মারাত্মক মানসিক ব্যাধিসমূহ বাসা বাঁধতে থাকে। এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
"إن الولد مبخلة مجبنة"
"নিশ্চয়ই সন্তানাদি কার্পন্যতা এবং কাপুরুষতার কারণ।"(আলবানী কর্তৃক সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল-আদব, অধ্যায়:৩, হাদীস নং:২৯৫৭/৩৬৬৬.)
এজন্য একজন বীর-বাহাদুর ব্যক্তিত্বের মাঝে এবং একজন কাপুরুষ ব্যক্তির মাঝে পার্থক্য লক্ষনীয় এবং অত্যন্ত স্পষ্ট। এপ্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়্যিম রহ: বলেন:
"فإن الشجاع منشرح الصدر ... والجبان أضيق الناس صدرا، وأحصرهم قلبا، لا فرحة له و لا سرور، و لا لذة له و لا نعيم؛ إلا من جنس ما للحيوان البهيمي".
"কেননা নিশ্চয়ই বীর-সাহসী ব্যক্তি প্রসশ্ত হৃদয়ের অধিকারী হয়, আর কাপুরুষ-ভীরু ব্যক্তি হয় সংকীর্ণমনা, ছোট দিলের, তার জীবনে না আছে কোন খুশি, না আছে কোন আনন্দ-সুখ, এবং না আছে কোন স্বাদ-স্বাচ্ছন্দ! হ্যাঁ তার জীবনে ভোগ বলতে যা কিছু আছে তা ঐরকম, যেরকম একটি চতুষ্পদ জন্তুর জীবনে রয়েছে।"( যাদুল-মাআ'দ:১/১৮৭)
আমাদের সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বীর-সাহসী করে গড়ে তোলার জন্য বাল্যকাল থেকেই তাদের হৃদয়ে বীরত্বের বীজ বপন করতে হবে, যাতে তারা নিজেদেরকে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। এর জন্য পরিবারের মধ্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রা: এবং সালাফদের বীরত্বগাঁথা যুদ্ধজীবনের এবং দ্বীনের জন্য তাঁদের অসীম ত্যাগ ও কুরবানীর ঘটনাসমুহের নিয়মিত তা'লীম করতে হবে।
নেতৃত্বের জন্য বীরত্ব ও সাহসীকতার প্রয়োজন:
যে ব্যক্তি উম্মাহকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দাঁড়াবে তাকে অবশ্যই বীরত্বের মধ্যে আদর্শ হতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনি ছিলেন, তিনি ছিলেন লোকদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বড় বাহাদুর, এবং সর্বাধিক দানশীল। (সহীহ বুখারী,কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়: ২৪, হাদীস নং ২৮২০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ
"لَوْ كَانَ لِي عَدَدُ هَذِهِ العِضَاة نَعَمًالَقَسَمْتُهُ بَيْنَكُمْ، ثُمَّ لَا تَجِدُونِي بَخِيلًا، وَلَا كَذُوبًا،*وَلَا جَبَانًا*".
"যদি এই বৃক্ষরাজির সংখ্যায় আমার উট হত তবে আমি তা তোমাদের মাঝে বিলিয়ে দিতাম, তোমরা আমাকে একটুও কৃপণ, মিথ্যুক এবং কাপুরুষ পেতে না।(সহীহ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায় ২৪, হাদীস নং ২৮২১)
ফায়েদাঃ
ইবনে হাজার রহ: বলেনঃ উক্ত হাদীসের মধ্যে কৃপণতা, মিথ্যা, এবং কাপুরুষতা এই তিনটি স্বভাবের কুৎসা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একথার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইমামুল মুসলিমীনের মধ্যে উল্লেখিত স্বভাব গুলোর কোন একটি স্বভাব বিদ্যমান থাকা উপযুক্ত নয়।"(ফাতহুল বারী ৬/২৫৪, কিতাব:ফরজুল-খুমুস, অধ্যায়:১৯, হাদীস নং ৩১৪৮ এর ব্যাখ্যায়।)
সুতরাং মুসলিমদের ইমাম থেকে শুরু করে সর্বস্তরের আমীর এবং উলামাদের বীর-সাহসী হয়া অপরিহার্য। বিশেষত যিনি আমীরুল-জাঈশ হবেন তাঁকে আরোও সাহসী বীর হতে হবে, এতে করে তার অধিনস্ত সাধারণ সৈনিকগণ তার সাহসীকতা এবং বীরত্ব নিয়ে গর্ব করবে এবং তারা আরোও বেশি অগ্রগামী এবং তৎপর হবে। বারা' রা: হুনাঈন যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:
"كنا و الله إذا احمر البأس نتقي به، و إن الشجاع منا للذي يحاذي به".(صحيح مسلم، كتاب الجهاد، الحديث:٧٩)
"আল্লাহর কসম! যখন যুদ্ধ প্রকট আকার ধারণ করল আমরা নিজেদের রক্ষা করতে লাগলাম, আর আমাদের মধ্যে যে সাহসী বাহাদুর সে মোকাবেলা করতে থাকল।"
এর কারণ ছিল যে, তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসীম সাহসীকতার সাথে লড়াই করা প্রত্যক্ষ করছিলেন।
মুমিনের শান নয় যে, শত্রু তাঁর মধ্যে দুর্বলতা এবং ভীরুতা প্রত্যক্ষ করবে। কাফের মুশরিকদের সামনে মুমিন ব্যক্তির মনোবল কেমন হয়া চাই, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে সাহাবী খুবাইব রা: এর শাহাদাতের ঘটনা। তাঁকে যখন মুশরিকরা শহীদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন তিনি শাহাদাতের পুর্বমুহুর্তে দু রাকা'ত সালাত আদায় করেন। সালাত শেষে তিনি কাফেরদের কে লক্ষ্য করে বলেন:
"والله لو لا أن تحسبوا أن ما بي جزع لزدت"
"আল্লাহর কসম! যদি তোরা আমার ব্যাপারে এই ধরণা করবি বলে আশংকা না হত যে, আমার মধ্যে কোন ভয় কাজ করছে!! তাহলে আমি (সালাতকে) আরোও বৃদ্ধি করতাম!! ( সহীহ বুখারী, আলমাগাযী, অধ্যায়:১০, হাদীস নং ৩৯৮৯, ফাতহুল বারী ৭/৩০৯)
মুমিনের বীরত্ব প্রকাশ পাবে দ্বীন ও উম্মাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে, এবং তাঁর অপর মুসলিম ভাই বোনদের কল্যাণ কামনায় আবৃত্তির মাধ্যমে, সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ করতে। আর যখন সে মুসলিম ভাই-বন্ধু এবং দুর্বল অসহায় ও মজলুমদের সাহায্য করতে অগ্রসর হবে সে ক্ষেত্রে তার বীরত্ব এবং সাহসীকতা নিজ ইচ্ছাসীমা থেকে বের হয়ে যাবে।
"উম্মাতুশ-শাহাদাত" তথা যে উম্মতকে আল্লাহ্ তায়ালা মানবজাতির উপর সাক্ষী বানিয়েছেন, দ্বীনে হক্বের সাহায্য এবং প্রতিরোধ-প্রতিরক্ষার জন্য তার প্রয়োজন একদল নির্ভীক সাহসী বীর সেনানীর। সেই সঙ্গে প্রয়োজন দ্বীনে হকের দাওয়াত এবং প্রচার প্রসারের জন্য বলিষ্ঠ সাহসী কন্ঠ।
اللهم اجعلنا من الذين يجاهدون في سبيلك باموالهم و أنفسهم ولا يخافون لومة لائم و يقولون: رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ. امين يارب العالمين
কেমন হবে মুজাহিদের আখলাক? ১-৪ পর্বের লিংক:
কেমন হবে মুজাহিদদের আখলাক
4.
1.
2.
3.
Comment