আল্লাহ ভীতি সম্পর্কিত একটি ভাষণ :
একদা রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনতাকে সম্বোধন করে বলেন, “ হে মানুষ, যা আমি জানি, তোমরা তা জানলে, খুব কমই হাসতে এবং অনেক বেশি কাঁদতে । অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহকে ভয় করো । (জামি‘ সাগীর, পৃষ্ঠা ৫৮০ )
ব্যাখ্যা : সকল প্রকার হীন আচরণ, ফিতনা-ফাসাদ ও কুকর্ম থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে আল্লাহভীতি একটি মোক্ষম প্রতিষেধক, এটা যাবতীয় পুণ্যকর্ম ও সদিচ্ছার উদ্দিপক এবং জান্নাত লাভের কারণ ও মাধ্যম । আল্লাহ তা’আলা বলেন,
-“ যে আপন প্রতিপালকের সামনে হাযির হওয়ার ভয় রাখে এবং কু-প্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস ।” (৭৯: ৪০-৪১)
যেহেতু আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশাবলীর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আল্লাহ ভীতির উপর নির্ভরশীল, তাই এখানে এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে ।
রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “ আল্লাহ ভীতি হচ্ছে হিকমত ও বিজ্ঞতার মূল ।” (কানযুল উম্মাল , পৃষ্ঠা ২৭২)
তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদবে, তার জাহান্নামে যাওয়াটা সেরূপ, যেরূপ বেরিয়ে আসা দুধের স্তনে ফিরে যাওয়াটা (তিরমিযী) ।
তিনি আরো বলেন, আল্লাহর ভয়ে যে চোখ থেকে একটুখানি অশ্রু ঝরবে, সে চোখের জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায় । (তিবরানী, কানযুল উম্মাল ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭১ )
তিনি আরো বলেন, যখন মুসলমানের অন্তর আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়, তখন তা থেকে পাপরাশি এমনভাবে ঝরে পড়ে, যেমন ঝরে পড়ে গাছপালা থেকে শুকনো পাতা । (মুসনাদে আহমাদ: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭২)
জনৈক সাহাবীর এক প্রশ্নের উত্তরে একদা রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, নাজাতের পথ হচ্ছে এই যে, তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো, ঘরে বসে থাকো এবং আপন ভুল-ত্রুটির উপর কাঁদতে থাকো । (মুসনাদে আহমাদ)
হযরত আয়েশা (রা) একদা রসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার উম্মতের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি কি থাকবে, যে হিসাব-নিকাশ ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে ? রসূলুল্লাহ (সা) উত্তরে বলেন, হ্যাঁ, ঐ ব্যক্তি, যে তার গুণাহসমূহ স্মরণ করে কাঁদে । (জামি‘ সাগীর : আল্লামা সুয়ূতী, পৃষ্ঠা ৪৪৫ )
হুযুর (সা) বলেন, যাবতীয় ফোটার মধ্যে মাত্র দু’টি ফোটাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় । একটি হলো সেই অশ্রুর ফোটা, যা আল্লাহর ভয়ে চোখ থেকে ঝরে পড়েছে এবং অপরটি হলো সেই রক্তের ফোটা, যা আল্লাহর পথে দেহ থেকে প্রবাহিত হয়েছে । (জামি‘তিরমিযী : ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭২ )
বুখারী শরীফে আছে, কিয়ামতের দিন সাতজন লোক আল্লাহর করুণা ও সহানুভূতির ছায়ায় আশ্রয় পাবে । তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে । এ ধরনের বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে । এখানে সংক্ষেপে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করা গেল ।
এবার শুনুন, অনুরূপ পরিস্থিতিতে হুজুরে আকরাম (সা) সাহাবা-ই কিরাম (রা) ও অলী-আউলিয়াদের কি অবস্থা হত ।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, বৃষ্টিবাদলা, ঘনঘটা ও ঝড়-তুফানের সময় রসূলুল্লাহ (সা)- এর চেহারায় এক ভীতিকর অবস্থা ফুটে উঠত । তিনি কখনো ঘরের বাইরে যেতেন, আবার কখনো ভিতরে আসতেন । তিনি বললেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রসূল, মানুষ তো পানি(মেঘ) দেখে খুশি হয়, কিন্তু আপনাকে ভয়ার্ত দেখা যাচ্ছে ? হুজুর (সা) উত্তরে বলেন, আমার ভয় হচ্ছে, না জানি মেঘের মধ্যে সেই আযাবই লুকিয়ে রয়েছে, যা ‘আদ জাতির উপর আপতিত হয়েছিল । তারা তো মেঘ দেখে সেটাকে পানিই মনে করেছিল, অথচ তাতে লুকিয়ে রয়েছিল আল্লাহর আযাব । (আবু দাঊদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭১)
হযরত আনাস (রা)-এর জীবিতাবস্থায় একদা আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল । তখন কেউ একজন তাকে জিজ্ঞাসা করলো, রসুলুল্লাহ (সা)-এর যুগেও কি এরূপ অবস্থা কখনো হয়েছিল ? তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহর পানাহ ! হুযূর (সা)-এর যুগে বায়ু একটু প্রবল বেগে বইতে থাকলে আমরা কিয়ামত আগমনের আশঙ্ক্ষা করতাম এবং মসজিদ অভিমুখে দৌড়ে যেতাম । (তাবাকাত)
হুযূর (সা) সম্পর্কে এই মর্মে অনেকগুলো রিওয়ায়েত আছে যে, তিনি সারা রাত কাঁদতে থাকতেন ।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাতের বেলা তাঁর (সা) এই অভ্যাস ছিল যে, তিনি কিছুক্ষণ নামায পড়ে আবার শুয়ে পড়তেন । অত:পর উঠে পুনরায় নামায পড়তেন এবং নামাযের মধ্যে এমনভাবে কাঁদতেন যে, মনে হত, চুলার উপর হাড়িতে কিছু রান্না হচ্ছে । (সুনানে কুবরা, পৃষ্ঠা ৩৯)
(সাহাবীদের অবস্থা : হযরত আবু বকর (রা) যার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, তিনি জান্নাতীদের নেতা এবং আমার উম্মতের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম জান্নাতে যাবেন’ (সেই আবু বকর) প্রায়ই বলতেন, হায় ! আমি যদি সেই বৃক্ষ হতাম, যা কেটে ফেলা হত কিংবা সেই ঘাস হতাম, যা জন্তু-জানোয়ার খেয়ে ফেলত । (তারীখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা ৯৯)
হযরত উমর ফারূক (রা), যার সম্পর্কে হুযূর (সা) বলেন, ‘যদি আমার পরে কোন নবী হত, তাহলে তিনি হতেন এই উমর’, তিনি (সা) আরো বলেন, ‘জান্নাতে উমর আমার সাথী হবে,’ হে আল্লাহ, উমরের মুখ দিয়ে হক জারী কর- সেই(উমর) প্রায়ই বলতেন, হায় ! আমি যদি তুচ্ছ খড়কুটা হতাম এবং হিসাব নিকাশের কোন ভয় আমার না থাকত ! তিনি কখনো কখনো এও বলতেন, হায়, আমার মা যদি আমাকে জন্মই না দিতেন । (তাবাকাতে ইবনে সা‘দ, পৃষ্ঠা ৫৪৪)
হযরত উসমান গনি (রা) সম্পর্কে হুযূর (সা) বলেন, ‘হায়া(লজ্জা) ও ঈমানের ক্ষেত্রেউসমান একজন পরিপূর্ণ মানুষ’,‘উসমান জান্নাতী’,উসমান যাই করুক, আল্লাহ তার অগ্রপশ্চাৎ সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন ।
একদা উসমান(রা) কোন একটি ভুলের কারণে তার একটি কৃতদাসের কান মলে দিলে সে বলে উঠে, ‘মনে হচ্ছে, আপনি আল্লাহকে ভয় করেন না ।’ একথা শুনামাত্র উসমান(রা) কাঁপতে থাকেন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত স্বস্তি পাননি,যতক্ষণ না ঐ কৃতদাসের হাত দিয়ে নিজের কানটি মলিয়ে নেন । হযরত উসমান (রা) কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত রাত কাটিয়ে দিতেন এবং রাতের নামাযের মধ্যেই সমগ্র কুরআন শরীফ একবার খতম করতেন । (তারীখ-ই-ইসলাম :কামিল)
আর হযরত আলী (রা) সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘আমি যার বন্ধু, আলীও তার বন্ধু’, ‘ হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধু জ্ঞান কর, যে আলীকে বন্ধু জ্ঞান করে এবং তাকে শত্রু জ্ঞান কর, যে আলীকে শত্রু জ্ঞান করে।’ তিনি (সা) আরো বলেন, ‘আলী আমার এবং আমি আলীর । (মুসনাদে আহমাদ)
অথচ হযরত উসমান ও আলী (রা)-এর অবস্থা ছিল এই যে, আজানের আওয়াজ শুনলে ভয়ে তাদের চেহারার রং বদলে যেত । তারা বলতেন, এটা যে মহান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে অধম বান্দার হাযিরা দেওয়ার সময় । (তারিখে খামীস,পৃষ্ঠা ৩১১)
তারা আল্লাহর ভয়ে সারা রাতকাঁদতে থাকতেন, এমনকি তাদের দাড়ি অশ্রুতে ভিজে জবজবে হয়ে উঠত । (যাদুল মা‘আদ: ইবনে কাইয়্যিম, পৃষ্ঠা ৭১১)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা), যিনি রসূলুল্লাহ (সা)- এর একজন অতি প্রিয় চাচাতো ভাই ছিলেন এবং খোদ রসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট থেকে ‘ এই উম্মতের বিরাট আলিম’ উপাধি পেয়েছিলেন- একদা তার চোখে রোগ দেখা দেয় । তখন চিকিৎসক বলেন, এই রোগের ততক্ষণ পর্যন্ত কোন চিকিৎসা হবে না, যতক্ষণ না তিনি (ইবনে আব্বাস) কান্না বন্ধ করেন । তখন তিনি বলে উঠেন, আল্লাহর ভয়ে যে চোখ থেকে অশ্রু নির্গত না হয়, সে চোখ চোখই নয় । শেষ পর্যন্ত তিনি অন্ধ হওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেন, কিন্তু রাতের বেলা আল্লাহর স্মরণে ও আল্লাহর ভয়ে কান্না বন্ধ করেননি । (তাবাকাতে ইবনে সা‘দ)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা), যিনি অতি মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী ছিলেন, আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যান । একদা লোকে তাঁকে এত বেশি কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তোমরা আমার কান্না দেখে বিস্মিত হও, অথচ আল্লাহর ভয়ে সূর্যও কাঁদে ।(ইসাবা: ১ম খণ্ড, পৃ: ৫১১)
হযরত ইমাম আ‘যম (রহ) একদা সারা রাত এই আয়াত তিলাওয়াত করতে থাকেন-
“হে অপরাধীগণ, তোমরা আজ কিয়ামতের দিন পৃথক হয়ে যাও ।” (৩৬:৫৯)
তাঁর এ চিরাচরিত অভ্যাস ছিল যে, তিনি অর্ধেক রাত ঘুমাতেন এবং অর্ধেক রাত আল্লাহর স্মরণে কান্নাকাটি করতেন । (মানাকিবে ইমাম আ‘যম : পৃ :৩৬৬)
মোটকথা, হুযূর আকরাম (সা), খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবা-ই-কিরাম (রা) এবং অলী-আল্লাহগণ এত মর্যাদাসম্পন্ন থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর ভয়ে সব সময় কাঁপতে থাকতেন, তারা প্রতিটি মুহূর্তে পুণ্যকর্মে নিয়োজিত থাকলেও আল্লাহর ভয়ে ছিলেন সদা কম্পমান । এর কারণ কি ? এর কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ ভীতির মধ্যে যে স্বাদ ও মজা রয়েছে, তা অন্য কোন জিনিসের মধ্যেই নেই । স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি আমার বান্দার মধ্যে দু’টি ভয় এবং দু’টি দুশ্চিন্তা একত্রিত করবো না । যে আমাকে এখানে ভয় করতে থাকে, তাকে আমি আখিরাতের ভয় থেকে নাজাত দেব । আর যে এখানে আমার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকে আমি আখিরাতে দুশ্চিন্তার সম্মুখিন করবো । (তিবরানী: ৭ম খণ্ড, পৃ ১৭১)
অতএব প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকা উন্নতি ও পরিপূর্ণতা লাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্ববৃহৎ উপায় ।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এর তাওফীক দান করুন । আমীন !
একদা রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনতাকে সম্বোধন করে বলেন, “ হে মানুষ, যা আমি জানি, তোমরা তা জানলে, খুব কমই হাসতে এবং অনেক বেশি কাঁদতে । অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহকে ভয় করো । (জামি‘ সাগীর, পৃষ্ঠা ৫৮০ )
ব্যাখ্যা : সকল প্রকার হীন আচরণ, ফিতনা-ফাসাদ ও কুকর্ম থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে আল্লাহভীতি একটি মোক্ষম প্রতিষেধক, এটা যাবতীয় পুণ্যকর্ম ও সদিচ্ছার উদ্দিপক এবং জান্নাত লাভের কারণ ও মাধ্যম । আল্লাহ তা’আলা বলেন,
-“ যে আপন প্রতিপালকের সামনে হাযির হওয়ার ভয় রাখে এবং কু-প্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস ।” (৭৯: ৪০-৪১)
যেহেতু আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশাবলীর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আল্লাহ ভীতির উপর নির্ভরশীল, তাই এখানে এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে ।
রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “ আল্লাহ ভীতি হচ্ছে হিকমত ও বিজ্ঞতার মূল ।” (কানযুল উম্মাল , পৃষ্ঠা ২৭২)
তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদবে, তার জাহান্নামে যাওয়াটা সেরূপ, যেরূপ বেরিয়ে আসা দুধের স্তনে ফিরে যাওয়াটা (তিরমিযী) ।
তিনি আরো বলেন, আল্লাহর ভয়ে যে চোখ থেকে একটুখানি অশ্রু ঝরবে, সে চোখের জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায় । (তিবরানী, কানযুল উম্মাল ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭১ )
তিনি আরো বলেন, যখন মুসলমানের অন্তর আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়, তখন তা থেকে পাপরাশি এমনভাবে ঝরে পড়ে, যেমন ঝরে পড়ে গাছপালা থেকে শুকনো পাতা । (মুসনাদে আহমাদ: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭২)
জনৈক সাহাবীর এক প্রশ্নের উত্তরে একদা রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, নাজাতের পথ হচ্ছে এই যে, তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো, ঘরে বসে থাকো এবং আপন ভুল-ত্রুটির উপর কাঁদতে থাকো । (মুসনাদে আহমাদ)
হযরত আয়েশা (রা) একদা রসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার উম্মতের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি কি থাকবে, যে হিসাব-নিকাশ ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে ? রসূলুল্লাহ (সা) উত্তরে বলেন, হ্যাঁ, ঐ ব্যক্তি, যে তার গুণাহসমূহ স্মরণ করে কাঁদে । (জামি‘ সাগীর : আল্লামা সুয়ূতী, পৃষ্ঠা ৪৪৫ )
হুযুর (সা) বলেন, যাবতীয় ফোটার মধ্যে মাত্র দু’টি ফোটাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় । একটি হলো সেই অশ্রুর ফোটা, যা আল্লাহর ভয়ে চোখ থেকে ঝরে পড়েছে এবং অপরটি হলো সেই রক্তের ফোটা, যা আল্লাহর পথে দেহ থেকে প্রবাহিত হয়েছে । (জামি‘তিরমিযী : ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭২ )
বুখারী শরীফে আছে, কিয়ামতের দিন সাতজন লোক আল্লাহর করুণা ও সহানুভূতির ছায়ায় আশ্রয় পাবে । তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে । এ ধরনের বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে । এখানে সংক্ষেপে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করা গেল ।
এবার শুনুন, অনুরূপ পরিস্থিতিতে হুজুরে আকরাম (সা) সাহাবা-ই কিরাম (রা) ও অলী-আউলিয়াদের কি অবস্থা হত ।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, বৃষ্টিবাদলা, ঘনঘটা ও ঝড়-তুফানের সময় রসূলুল্লাহ (সা)- এর চেহারায় এক ভীতিকর অবস্থা ফুটে উঠত । তিনি কখনো ঘরের বাইরে যেতেন, আবার কখনো ভিতরে আসতেন । তিনি বললেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রসূল, মানুষ তো পানি(মেঘ) দেখে খুশি হয়, কিন্তু আপনাকে ভয়ার্ত দেখা যাচ্ছে ? হুজুর (সা) উত্তরে বলেন, আমার ভয় হচ্ছে, না জানি মেঘের মধ্যে সেই আযাবই লুকিয়ে রয়েছে, যা ‘আদ জাতির উপর আপতিত হয়েছিল । তারা তো মেঘ দেখে সেটাকে পানিই মনে করেছিল, অথচ তাতে লুকিয়ে রয়েছিল আল্লাহর আযাব । (আবু দাঊদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭১)
হযরত আনাস (রা)-এর জীবিতাবস্থায় একদা আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল । তখন কেউ একজন তাকে জিজ্ঞাসা করলো, রসুলুল্লাহ (সা)-এর যুগেও কি এরূপ অবস্থা কখনো হয়েছিল ? তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহর পানাহ ! হুযূর (সা)-এর যুগে বায়ু একটু প্রবল বেগে বইতে থাকলে আমরা কিয়ামত আগমনের আশঙ্ক্ষা করতাম এবং মসজিদ অভিমুখে দৌড়ে যেতাম । (তাবাকাত)
হুযূর (সা) সম্পর্কে এই মর্মে অনেকগুলো রিওয়ায়েত আছে যে, তিনি সারা রাত কাঁদতে থাকতেন ।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাতের বেলা তাঁর (সা) এই অভ্যাস ছিল যে, তিনি কিছুক্ষণ নামায পড়ে আবার শুয়ে পড়তেন । অত:পর উঠে পুনরায় নামায পড়তেন এবং নামাযের মধ্যে এমনভাবে কাঁদতেন যে, মনে হত, চুলার উপর হাড়িতে কিছু রান্না হচ্ছে । (সুনানে কুবরা, পৃষ্ঠা ৩৯)
(সাহাবীদের অবস্থা : হযরত আবু বকর (রা) যার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, তিনি জান্নাতীদের নেতা এবং আমার উম্মতের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম জান্নাতে যাবেন’ (সেই আবু বকর) প্রায়ই বলতেন, হায় ! আমি যদি সেই বৃক্ষ হতাম, যা কেটে ফেলা হত কিংবা সেই ঘাস হতাম, যা জন্তু-জানোয়ার খেয়ে ফেলত । (তারীখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা ৯৯)
হযরত উমর ফারূক (রা), যার সম্পর্কে হুযূর (সা) বলেন, ‘যদি আমার পরে কোন নবী হত, তাহলে তিনি হতেন এই উমর’, তিনি (সা) আরো বলেন, ‘জান্নাতে উমর আমার সাথী হবে,’ হে আল্লাহ, উমরের মুখ দিয়ে হক জারী কর- সেই(উমর) প্রায়ই বলতেন, হায় ! আমি যদি তুচ্ছ খড়কুটা হতাম এবং হিসাব নিকাশের কোন ভয় আমার না থাকত ! তিনি কখনো কখনো এও বলতেন, হায়, আমার মা যদি আমাকে জন্মই না দিতেন । (তাবাকাতে ইবনে সা‘দ, পৃষ্ঠা ৫৪৪)
হযরত উসমান গনি (রা) সম্পর্কে হুযূর (সা) বলেন, ‘হায়া(লজ্জা) ও ঈমানের ক্ষেত্রেউসমান একজন পরিপূর্ণ মানুষ’,‘উসমান জান্নাতী’,উসমান যাই করুক, আল্লাহ তার অগ্রপশ্চাৎ সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন ।
একদা উসমান(রা) কোন একটি ভুলের কারণে তার একটি কৃতদাসের কান মলে দিলে সে বলে উঠে, ‘মনে হচ্ছে, আপনি আল্লাহকে ভয় করেন না ।’ একথা শুনামাত্র উসমান(রা) কাঁপতে থাকেন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত স্বস্তি পাননি,যতক্ষণ না ঐ কৃতদাসের হাত দিয়ে নিজের কানটি মলিয়ে নেন । হযরত উসমান (রা) কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত রাত কাটিয়ে দিতেন এবং রাতের নামাযের মধ্যেই সমগ্র কুরআন শরীফ একবার খতম করতেন । (তারীখ-ই-ইসলাম :কামিল)
আর হযরত আলী (রা) সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘আমি যার বন্ধু, আলীও তার বন্ধু’, ‘ হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধু জ্ঞান কর, যে আলীকে বন্ধু জ্ঞান করে এবং তাকে শত্রু জ্ঞান কর, যে আলীকে শত্রু জ্ঞান করে।’ তিনি (সা) আরো বলেন, ‘আলী আমার এবং আমি আলীর । (মুসনাদে আহমাদ)
অথচ হযরত উসমান ও আলী (রা)-এর অবস্থা ছিল এই যে, আজানের আওয়াজ শুনলে ভয়ে তাদের চেহারার রং বদলে যেত । তারা বলতেন, এটা যে মহান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে অধম বান্দার হাযিরা দেওয়ার সময় । (তারিখে খামীস,পৃষ্ঠা ৩১১)
তারা আল্লাহর ভয়ে সারা রাতকাঁদতে থাকতেন, এমনকি তাদের দাড়ি অশ্রুতে ভিজে জবজবে হয়ে উঠত । (যাদুল মা‘আদ: ইবনে কাইয়্যিম, পৃষ্ঠা ৭১১)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা), যিনি রসূলুল্লাহ (সা)- এর একজন অতি প্রিয় চাচাতো ভাই ছিলেন এবং খোদ রসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট থেকে ‘ এই উম্মতের বিরাট আলিম’ উপাধি পেয়েছিলেন- একদা তার চোখে রোগ দেখা দেয় । তখন চিকিৎসক বলেন, এই রোগের ততক্ষণ পর্যন্ত কোন চিকিৎসা হবে না, যতক্ষণ না তিনি (ইবনে আব্বাস) কান্না বন্ধ করেন । তখন তিনি বলে উঠেন, আল্লাহর ভয়ে যে চোখ থেকে অশ্রু নির্গত না হয়, সে চোখ চোখই নয় । শেষ পর্যন্ত তিনি অন্ধ হওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেন, কিন্তু রাতের বেলা আল্লাহর স্মরণে ও আল্লাহর ভয়ে কান্না বন্ধ করেননি । (তাবাকাতে ইবনে সা‘দ)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা), যিনি অতি মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী ছিলেন, আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যান । একদা লোকে তাঁকে এত বেশি কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তোমরা আমার কান্না দেখে বিস্মিত হও, অথচ আল্লাহর ভয়ে সূর্যও কাঁদে ।(ইসাবা: ১ম খণ্ড, পৃ: ৫১১)
হযরত ইমাম আ‘যম (রহ) একদা সারা রাত এই আয়াত তিলাওয়াত করতে থাকেন-
“হে অপরাধীগণ, তোমরা আজ কিয়ামতের দিন পৃথক হয়ে যাও ।” (৩৬:৫৯)
তাঁর এ চিরাচরিত অভ্যাস ছিল যে, তিনি অর্ধেক রাত ঘুমাতেন এবং অর্ধেক রাত আল্লাহর স্মরণে কান্নাকাটি করতেন । (মানাকিবে ইমাম আ‘যম : পৃ :৩৬৬)
মোটকথা, হুযূর আকরাম (সা), খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবা-ই-কিরাম (রা) এবং অলী-আল্লাহগণ এত মর্যাদাসম্পন্ন থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর ভয়ে সব সময় কাঁপতে থাকতেন, তারা প্রতিটি মুহূর্তে পুণ্যকর্মে নিয়োজিত থাকলেও আল্লাহর ভয়ে ছিলেন সদা কম্পমান । এর কারণ কি ? এর কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ ভীতির মধ্যে যে স্বাদ ও মজা রয়েছে, তা অন্য কোন জিনিসের মধ্যেই নেই । স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি আমার বান্দার মধ্যে দু’টি ভয় এবং দু’টি দুশ্চিন্তা একত্রিত করবো না । যে আমাকে এখানে ভয় করতে থাকে, তাকে আমি আখিরাতের ভয় থেকে নাজাত দেব । আর যে এখানে আমার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকে আমি আখিরাতে দুশ্চিন্তার সম্মুখিন করবো । (তিবরানী: ৭ম খণ্ড, পৃ ১৭১)
অতএব প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকা উন্নতি ও পরিপূর্ণতা লাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্ববৃহৎ উপায় ।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এর তাওফীক দান করুন । আমীন !
Comment