বোন তোমার নারীত্বের আঁচল এত সুন্দর কেন?
{৮ম পর্ব }
প্রিয় বোন আমার!
মানব ইতিহাসে চার চারজন নারী ঈমানের শীর্ষ চূড়ায় আরােহণ করেছেন। তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনাে নারী নেই। তাদের মধ্যে গুণের কোন কমতি নেই। যেমন ছিলেন চারিত্রিক দিক থেকে তেমন হলেন কর্মগত দিক থেকে। রবের সাথে তাঁদের যোগসূত্র ছিলো একেবারে নিকটতম। রব তাঁদেরকে কাছে টেনে নিয়েছেন তাঁদের ইমান আমলের মাপকাঠি দেখে।
দ্বীনের পথে তাঁদের অবিচলতা ছিলো একরুখা। ইমান এনেছে তো এনেছিই। কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাবো। রক্তের বন্যায় সাময়িক ভেসে যাবো তবুও কিঞ্চিৎ পরিমাণ ইমানের মোহনায় নাপাক মিশতে দিবো না। শরীরের জুড়াগুলো নড়বড় করে দিলেও ইমানের বেলায় পুরাই তার উল্টো। এতই মজবুত তার ভিত, জীবন বিসর্জন দিলেও আফসোস হয় না বরং অর্জন বেড়ে যায়। সফলতা তত দ্রুত হাতছানি দেখায়।
এ সমস্ত চিন্তা যে নারীদের মাথায় সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে, তারা কি রবের কাছের মানুষ না হয়ে পারে? তারা কি মুহাম্মাদের দ্বীনের সঠিক ও পাকাপোক্ত অনুস্বারী না হয়ে বেঁচে থাকতে পারে? না বোন আমার! কক্ষনোই না। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো ইমানের তরে ইসলামের সাঁজে।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে- আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সৃষ্টিজগতের মধ্যে চারজন নারী শ্রেষ্ঠ। তাঁরা হলেন, মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ও ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ।[১]
© মারয়াম বিনতে ইমরান। যিনি ঈসা আলাইহিস সালামের মা। তিনি একমাত্র নারী। যার নাম কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছে। এমনকি তাঁর নামে একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সে সূরাটির নাম হলো সূরাতুল মারয়াম। অসম্ভব সুন্দর মনোমুগ্ধতার আদলে ঘটনাটি সাঁজানো হয়েছে। চরিত্রের বাস্তবরুপ অন্তর চক্ষুওয়ালা ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারবে।
© আসিয়া বিনতে মুযাহিম। যিনি ছিলেন ফিরআউনের স্ত্রী। তিনি মূসা আলাইহিস সালামকে প্রতিপালন করেছিলেন। তাঁর ঘটনাও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। নির্যাতনের কাঁটাতার তাকে কিভাবে ঘিরে রেখেছিলো তা ইতিহাস থেকে না জানলে নিজেকে অথর্ব মনে করতে হবে। এর ভিতর থেকেও সে একজন পাক্কা মুমিনা। আল্লাহ তাঁকে পছন্দ করে নিয়েছেন তার ভিতরের গুণাবলি দেখে।
© খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ। আম্মাজান খাদিজা রা. আমাদের মমতাময়ী মা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় সহধর্মিণী। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একমাত্র স্ত্রী। যিনি তাঁর সন্তান জন্মদানের গৌরব অর্জন করেছেন। তিনি প্রথম ঈমান এনেছেন। প্রথম অজু করেছেন। প্রথম সালাত আদায় করেছেন। প্রথম তিনিই দান করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমর্থন করেছেন যখন সবাই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। উম্মতে মুহাম্মাদিয়্যার মধ্যে তিনিই প্রথম যাকে দুনিয়াতে বেহেশতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। তিনি সাহাবিদের মধ্যে প্রথম যাকে আল্লাহ তাআলা জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সালাম পাঠিয়েছেন।
© ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ। যার বাবা প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মা হলেন আম্মাজান খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ। সাহাবী হযরত আলি রা. এর সহধর্মিণী। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাতি হাসান হুসাইন রা. এর সম্মানিত মাতা।
বোন আমার! মানব ইতিহাসে এই চারজন নারী হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নারী। যারা দুনিয়ার সকল নারীদের আদর্শ। পবিত্র কুরআন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। সময় সুযোগ বুঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণ মোযাকারা করবো ইনশা-আল্লাহ তবে আপনারা তাঁদের চরিত্রের আসল স্বাধ আস্বাদন করতে, তাদের জীবন কর্মের নীতিনৈতিকতার দিকগুলো উপভোগ করতে পবিত্র কুরআনে চোখ রাখুন। হাদীসের পাতায় নিমজ্জিত হোন। সবচেয়ে তেজদীপ্ত একটি কাজের কাজ হবে।
বোন! আজ ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ জেগেছে। তাই আমাদের এ সম্মানিত বোনটিকে দিয়েই আলোচনাদ্বার উন্মুক্ত করি। হয়তো খুঁটিনাটি বিষয় আমার মনে নাও থাকতে পারে তুমি কিন্তু সজাগ থেকো! ভুল হলে কোন ক্ষমা নেই। সরাসরি পবিত্র কুরআনে চোখ রাখবো। আর আমাদের সাথে আল্লাহ তো আছেনই!
আসিয়া বিনতে মুযাহিম একজন দৃঢ়চেতা ঈমান দীপ্তওয়ালী সম্রাজ্ঞী। প্রখর বুদ্ধিমত্তা, আভিজাত্য ও অর্থ-সম্পদে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস সালাম-এর লালন-পালনের মূল দায়িত্বে ছিলেন তিনি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-ফেরাউনের স্ত্রী বললো- এ বাচ্চাটি [মুসা আ.] আমার ও তোমার চক্ষুশীতলকারী হবে।তোমরা তাকে হত্যা করো না, হয়তো সে আমাদের উপকার করবে কিংবা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করবো। তারা তা অনুধাবন করতে পারেনি। [০]
ফেরাউনের ঘরে থেকেও নিজের বুদ্ধি-জ্ঞানকে স্বাধীন চিন্তার জন্য উন্মুক্ত করেন। রাজপ্রাসাদের সব রকম বিলাসিতা ত্যাগ করে স্বামীর ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন। এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কথা জানতে পেরে আসিয়ার প্রতি ফেরাউন ক্রোধান্বিত হয়। মূসার প্রতি ঈমান আনায় ফেরাউন আসিয়ার সঙ্গীদের হত্যা করে।
অতঃপর ঈমান থেকে ফিরে আসতে আসিয়াকে নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে থাকে। কিন্তু নিরাশ হয়ে বনি ইসরাঈলের মুমিনদের মতো নিজের জীবনসঙ্গী আসিয়াকেও কঠিন শাস্তি দেওয়া শুরু করে ফেরাউন। বরং আসিয়াকে অন্যদের চেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। হাতে ও পায়ে লোহার পেরেক লাগিয়ে অদম্য প্রহারের নির্দেশ দেয় ফেরাউন। কঠিন নির্যাতনেও ধৈর্যহারা হননি আসিয়া। পুরো দেহ ক্ষতবিক্ষত হলেও নিজের ঈমানকে রক্ষা করেন তিনি।
পাহাড়ের চেয়েও কঠিন ঈমান ধারণ করেন নিজের মধ্যে। ঈমানের ওপর দৃঢ়তার জন্য বিরল সম্মাননা পান তিনি। আল্লাহ তাআলা আসিয়াকে সৃষ্টজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নারীদের তালিকাভুক্ত করে চিরকালের জন্য সম্মানিত করেন। নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে আসিয়ার। মৃত্যুকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করেন। আল্লাহর কাছে আবদার করেন, যেন জান্নাতে তাঁর জন্য একটি ঘর তৈরি করা হয়। এই*মহীয়সী নারীর জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ তাআলার বেশ পছন্দ হয়। তাই তিনি আসিয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেন।
ইরশাদ হয়েছে- আল্লাহ মুমিনদের জন্য ফেরাউনের স্ত্রীর উপমা পেশ করছেন, তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমার জন্য জান্নাতে আপনার কাছে একটি ঘর নির্মাণ করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কার্যাবলি থেকে রক্ষা করুন এবং আমাকে জালেম জনগোষ্ঠী থেকে রক্ষা করুন।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। জান্নাতে নিজের বাড়িও দেখতে পান। নিজ চোখে বাড়ি দেখে হেসে দেন। এদিকে চরম নির্যাতনের মধ্যে আসিয়ার মুখে হাসি দেখে ফেরাউনের ক্রোধ আরো বেড়ে যায়। ফেরাউন প্রলাপ বকছে- দেখছো! কী উন্মাদ হয়ে গেছে? আমরা তাঁকে চরম শাস্তি দিচ্ছি আর সে হাসছে। ফেরাউন রাগে ক্ষোভে এক প্রকাণ্ড প্রস্তর নিক্ষেপ করে। এর পর পরই আসিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
অবিশ্বাসী মহলের একজন সম্রাজ্ঞী হয়েও পৃথিবীবাসীর জন্য রেখে যান ঈমানি দৃঢ়তার চির আদর্শ। পার্থিব জীবনের সব বিলাসিতা পরিত্যাগ করে পাড়ি জমান অনন্তের পথে। পৃথিবীর পূণ্যবতী নারীদের একজন আসিয়া। আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- পুরুষদের মধ্যে অনেকে পুণ্য*অর্জন করেছেন। তবে নারীদের মধ্যে পুণ্য অর্জন করেছেন শুধু মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া। আর সব খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি সব নারীদের মধ্যে আয়েশা শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। [২]
ঈমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন আসিয়া। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমিনে চারটি রেখা টেনে বলেন, তোমরা কি জানো এটা কী? সাহাবীরা বললেন- আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ও আমার সাহাবারা! জান্নাতবাসীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী হলেন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম।[৩]
প্রিয় বোন! ফেরাউনের স্ত্রী হয়েও আসিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে অবিচলতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা, নিজ মনোবলের উপর দৃঢ়প্রত্যয় তাকে সফলতা শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। সাময়িক কষ্ট বিষাদে পরিণত না হয়ে চির মুক্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? এরচেয়ে সুখকর সুসংবাদ আর কিছু ঘটতে পারে? আর কিছুই না।
বোন! সবকিছুই আমাদের অনূকূলে, তারপরও কেন তোমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে? পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের তাড়া করছে না তারপরও কেন দ্বীনের মালা গলায় দিতে অসহ্য লাগে? তারা কষ্টের হাড়ি মাথায় নিয়ে ইমানকে অগ্রাধিকার দিয়েছে আর তোমরা সুখের হাড়ি মাথায় নিয়ে প্রভুর সেচ্ছাচারীতাকে প্রাধান্য দিচ্ছো? তারা নিজেকে মেপেছে ইমানের পাল্লা দিয়ে, আমি আর তুমি সবকিছুই মাপি মডারেটের পাল্লা দিয়ে।
এখন তুমিই বলো! সফলতার শীর্ষ চূড়া কি মডারেটের সাথে সম্পৃক্ত না ইমানের সাথে? তাঁরা কোনটা প্রাধান্য দিয়েছেন আর আমরা কোনটা প্রাধান্য দিচ্ছি? তাঁরা কিসের আশায় এত বড় বিসর্জন দিয়েছেন সে জিনিসটাই আজ পর্যন্ত আমাদের মাথা কিয়াস করতে পারলো না। নারী তুমি যদি সোনায় সোহাগা হতে চাও তাহলে তাঁদেরকেই নিজ মনুষ্যত্বের আদর্শ বানাও।
তথ্যাদিঃ
_______________________________
১.জামে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৮৭৪
মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১২৪১৪
০.সূরা কাসাস. আয়াত নং ৯
০.সূরা তাহরিম. আয়াত নং ১১
২ সহীহ বুখারী.হাদিস নং ৩৪১১
সহীহ মুসলিম. হাদিস নং ২৪৩১
৩.মুসনাদে আহমাদ. হাদিস নং ২৯০৩
{৮ম পর্ব }
প্রিয় বোন আমার!
মানব ইতিহাসে চার চারজন নারী ঈমানের শীর্ষ চূড়ায় আরােহণ করেছেন। তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনাে নারী নেই। তাদের মধ্যে গুণের কোন কমতি নেই। যেমন ছিলেন চারিত্রিক দিক থেকে তেমন হলেন কর্মগত দিক থেকে। রবের সাথে তাঁদের যোগসূত্র ছিলো একেবারে নিকটতম। রব তাঁদেরকে কাছে টেনে নিয়েছেন তাঁদের ইমান আমলের মাপকাঠি দেখে।
দ্বীনের পথে তাঁদের অবিচলতা ছিলো একরুখা। ইমান এনেছে তো এনেছিই। কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাবো। রক্তের বন্যায় সাময়িক ভেসে যাবো তবুও কিঞ্চিৎ পরিমাণ ইমানের মোহনায় নাপাক মিশতে দিবো না। শরীরের জুড়াগুলো নড়বড় করে দিলেও ইমানের বেলায় পুরাই তার উল্টো। এতই মজবুত তার ভিত, জীবন বিসর্জন দিলেও আফসোস হয় না বরং অর্জন বেড়ে যায়। সফলতা তত দ্রুত হাতছানি দেখায়।
এ সমস্ত চিন্তা যে নারীদের মাথায় সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে, তারা কি রবের কাছের মানুষ না হয়ে পারে? তারা কি মুহাম্মাদের দ্বীনের সঠিক ও পাকাপোক্ত অনুস্বারী না হয়ে বেঁচে থাকতে পারে? না বোন আমার! কক্ষনোই না। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো ইমানের তরে ইসলামের সাঁজে।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে- আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সৃষ্টিজগতের মধ্যে চারজন নারী শ্রেষ্ঠ। তাঁরা হলেন, মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ও ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ।[১]
© মারয়াম বিনতে ইমরান। যিনি ঈসা আলাইহিস সালামের মা। তিনি একমাত্র নারী। যার নাম কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছে। এমনকি তাঁর নামে একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সে সূরাটির নাম হলো সূরাতুল মারয়াম। অসম্ভব সুন্দর মনোমুগ্ধতার আদলে ঘটনাটি সাঁজানো হয়েছে। চরিত্রের বাস্তবরুপ অন্তর চক্ষুওয়ালা ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারবে।
© আসিয়া বিনতে মুযাহিম। যিনি ছিলেন ফিরআউনের স্ত্রী। তিনি মূসা আলাইহিস সালামকে প্রতিপালন করেছিলেন। তাঁর ঘটনাও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। নির্যাতনের কাঁটাতার তাকে কিভাবে ঘিরে রেখেছিলো তা ইতিহাস থেকে না জানলে নিজেকে অথর্ব মনে করতে হবে। এর ভিতর থেকেও সে একজন পাক্কা মুমিনা। আল্লাহ তাঁকে পছন্দ করে নিয়েছেন তার ভিতরের গুণাবলি দেখে।
© খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ। আম্মাজান খাদিজা রা. আমাদের মমতাময়ী মা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় সহধর্মিণী। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একমাত্র স্ত্রী। যিনি তাঁর সন্তান জন্মদানের গৌরব অর্জন করেছেন। তিনি প্রথম ঈমান এনেছেন। প্রথম অজু করেছেন। প্রথম সালাত আদায় করেছেন। প্রথম তিনিই দান করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমর্থন করেছেন যখন সবাই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। উম্মতে মুহাম্মাদিয়্যার মধ্যে তিনিই প্রথম যাকে দুনিয়াতে বেহেশতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। তিনি সাহাবিদের মধ্যে প্রথম যাকে আল্লাহ তাআলা জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সালাম পাঠিয়েছেন।
© ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ। যার বাবা প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মা হলেন আম্মাজান খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ। সাহাবী হযরত আলি রা. এর সহধর্মিণী। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাতি হাসান হুসাইন রা. এর সম্মানিত মাতা।
বোন আমার! মানব ইতিহাসে এই চারজন নারী হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নারী। যারা দুনিয়ার সকল নারীদের আদর্শ। পবিত্র কুরআন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। সময় সুযোগ বুঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণ মোযাকারা করবো ইনশা-আল্লাহ তবে আপনারা তাঁদের চরিত্রের আসল স্বাধ আস্বাদন করতে, তাদের জীবন কর্মের নীতিনৈতিকতার দিকগুলো উপভোগ করতে পবিত্র কুরআনে চোখ রাখুন। হাদীসের পাতায় নিমজ্জিত হোন। সবচেয়ে তেজদীপ্ত একটি কাজের কাজ হবে।
বোন! আজ ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ জেগেছে। তাই আমাদের এ সম্মানিত বোনটিকে দিয়েই আলোচনাদ্বার উন্মুক্ত করি। হয়তো খুঁটিনাটি বিষয় আমার মনে নাও থাকতে পারে তুমি কিন্তু সজাগ থেকো! ভুল হলে কোন ক্ষমা নেই। সরাসরি পবিত্র কুরআনে চোখ রাখবো। আর আমাদের সাথে আল্লাহ তো আছেনই!
আসিয়া বিনতে মুযাহিম একজন দৃঢ়চেতা ঈমান দীপ্তওয়ালী সম্রাজ্ঞী। প্রখর বুদ্ধিমত্তা, আভিজাত্য ও অর্থ-সম্পদে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস সালাম-এর লালন-পালনের মূল দায়িত্বে ছিলেন তিনি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-ফেরাউনের স্ত্রী বললো- এ বাচ্চাটি [মুসা আ.] আমার ও তোমার চক্ষুশীতলকারী হবে।তোমরা তাকে হত্যা করো না, হয়তো সে আমাদের উপকার করবে কিংবা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করবো। তারা তা অনুধাবন করতে পারেনি। [০]
ফেরাউনের ঘরে থেকেও নিজের বুদ্ধি-জ্ঞানকে স্বাধীন চিন্তার জন্য উন্মুক্ত করেন। রাজপ্রাসাদের সব রকম বিলাসিতা ত্যাগ করে স্বামীর ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন। এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কথা জানতে পেরে আসিয়ার প্রতি ফেরাউন ক্রোধান্বিত হয়। মূসার প্রতি ঈমান আনায় ফেরাউন আসিয়ার সঙ্গীদের হত্যা করে।
অতঃপর ঈমান থেকে ফিরে আসতে আসিয়াকে নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে থাকে। কিন্তু নিরাশ হয়ে বনি ইসরাঈলের মুমিনদের মতো নিজের জীবনসঙ্গী আসিয়াকেও কঠিন শাস্তি দেওয়া শুরু করে ফেরাউন। বরং আসিয়াকে অন্যদের চেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। হাতে ও পায়ে লোহার পেরেক লাগিয়ে অদম্য প্রহারের নির্দেশ দেয় ফেরাউন। কঠিন নির্যাতনেও ধৈর্যহারা হননি আসিয়া। পুরো দেহ ক্ষতবিক্ষত হলেও নিজের ঈমানকে রক্ষা করেন তিনি।
পাহাড়ের চেয়েও কঠিন ঈমান ধারণ করেন নিজের মধ্যে। ঈমানের ওপর দৃঢ়তার জন্য বিরল সম্মাননা পান তিনি। আল্লাহ তাআলা আসিয়াকে সৃষ্টজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নারীদের তালিকাভুক্ত করে চিরকালের জন্য সম্মানিত করেন। নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে আসিয়ার। মৃত্যুকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করেন। আল্লাহর কাছে আবদার করেন, যেন জান্নাতে তাঁর জন্য একটি ঘর তৈরি করা হয়। এই*মহীয়সী নারীর জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ তাআলার বেশ পছন্দ হয়। তাই তিনি আসিয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেন।
ইরশাদ হয়েছে- আল্লাহ মুমিনদের জন্য ফেরাউনের স্ত্রীর উপমা পেশ করছেন, তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমার জন্য জান্নাতে আপনার কাছে একটি ঘর নির্মাণ করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কার্যাবলি থেকে রক্ষা করুন এবং আমাকে জালেম জনগোষ্ঠী থেকে রক্ষা করুন।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ. বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। জান্নাতে নিজের বাড়িও দেখতে পান। নিজ চোখে বাড়ি দেখে হেসে দেন। এদিকে চরম নির্যাতনের মধ্যে আসিয়ার মুখে হাসি দেখে ফেরাউনের ক্রোধ আরো বেড়ে যায়। ফেরাউন প্রলাপ বকছে- দেখছো! কী উন্মাদ হয়ে গেছে? আমরা তাঁকে চরম শাস্তি দিচ্ছি আর সে হাসছে। ফেরাউন রাগে ক্ষোভে এক প্রকাণ্ড প্রস্তর নিক্ষেপ করে। এর পর পরই আসিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
অবিশ্বাসী মহলের একজন সম্রাজ্ঞী হয়েও পৃথিবীবাসীর জন্য রেখে যান ঈমানি দৃঢ়তার চির আদর্শ। পার্থিব জীবনের সব বিলাসিতা পরিত্যাগ করে পাড়ি জমান অনন্তের পথে। পৃথিবীর পূণ্যবতী নারীদের একজন আসিয়া। আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- পুরুষদের মধ্যে অনেকে পুণ্য*অর্জন করেছেন। তবে নারীদের মধ্যে পুণ্য অর্জন করেছেন শুধু মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া। আর সব খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি সব নারীদের মধ্যে আয়েশা শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। [২]
ঈমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন আসিয়া। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমিনে চারটি রেখা টেনে বলেন, তোমরা কি জানো এটা কী? সাহাবীরা বললেন- আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ও আমার সাহাবারা! জান্নাতবাসীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নারী হলেন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম।[৩]
প্রিয় বোন! ফেরাউনের স্ত্রী হয়েও আসিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে অবিচলতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা, নিজ মনোবলের উপর দৃঢ়প্রত্যয় তাকে সফলতা শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। সাময়িক কষ্ট বিষাদে পরিণত না হয়ে চির মুক্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? এরচেয়ে সুখকর সুসংবাদ আর কিছু ঘটতে পারে? আর কিছুই না।
বোন! সবকিছুই আমাদের অনূকূলে, তারপরও কেন তোমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে? পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের তাড়া করছে না তারপরও কেন দ্বীনের মালা গলায় দিতে অসহ্য লাগে? তারা কষ্টের হাড়ি মাথায় নিয়ে ইমানকে অগ্রাধিকার দিয়েছে আর তোমরা সুখের হাড়ি মাথায় নিয়ে প্রভুর সেচ্ছাচারীতাকে প্রাধান্য দিচ্ছো? তারা নিজেকে মেপেছে ইমানের পাল্লা দিয়ে, আমি আর তুমি সবকিছুই মাপি মডারেটের পাল্লা দিয়ে।
এখন তুমিই বলো! সফলতার শীর্ষ চূড়া কি মডারেটের সাথে সম্পৃক্ত না ইমানের সাথে? তাঁরা কোনটা প্রাধান্য দিয়েছেন আর আমরা কোনটা প্রাধান্য দিচ্ছি? তাঁরা কিসের আশায় এত বড় বিসর্জন দিয়েছেন সে জিনিসটাই আজ পর্যন্ত আমাদের মাথা কিয়াস করতে পারলো না। নারী তুমি যদি সোনায় সোহাগা হতে চাও তাহলে তাঁদেরকেই নিজ মনুষ্যত্বের আদর্শ বানাও।
তথ্যাদিঃ
_______________________________
১.জামে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৮৭৪
মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১২৪১৪
০.সূরা কাসাস. আয়াত নং ৯
০.সূরা তাহরিম. আয়াত নং ১১
২ সহীহ বুখারী.হাদিস নং ৩৪১১
সহীহ মুসলিম. হাদিস নং ২৪৩১
৩.মুসনাদে আহমাদ. হাদিস নং ২৯০৩
Comment