মুজাহিদের আখলাক:৬
সবর ও অবিচলতা
একজন মুজাহিদ যে নিজের জন্য কুরবানীর রাস্তাকে বেছে নিয়েছে সে কখনো এ পথে টিকে থাকতে পারবে না যতক্ষণ না সে নিজেকে ধৈর্যের দ্বারা সজ্জিত করে। এবং যে দল বিপদ ও মসিবতের কষ্টকীর্ণ বন্ধূর পথ অবলম্বন করবে তাদের পারস্পরিক বন্ধন স্থায়ী হবে না এবং তার ভিত্ মজবুত হবে না, যদি না তারা একেঅপরকে সত্যের এবং সবরের ওসীয়ত করে। আল্লাহ্ তায়ালা সকল মুমিনদের কে সম্বোধন করেছেন এই বলে:
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴾
সূরা আল ইমরান (آل عمران), আয়াত: ২০০
অর্থঃ হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার।
সবর দুই প্রকার: ১/ সবরে এখতিয়ারি, ২/ সবরে গায়রে এখতিয়ারি।
১/ এখতিয়ারি সবর, (অর্থাৎ: যা ধারন করতে বান্দার ইচ্ছা এবং প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন) উলামায়ে কেরাম তার সংজ্ঞা ও পরিচয় বিভিন্নভাবে দিয়েছেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো:
ক) ইমাম তবারী রহঃ বলেন:
الصبر منع النفس محابها، و كفها عن هواها.
অর্থাৎ: সবর হলো; নফসকে তার পছন্দের জিনিস থেকে বিরত রাখা এবং তার তাড়ণা থেকে তাকে বাধা প্রদান করা। (ফাতহুল বারী ৩/১৭২, কিতাবুল জানায়েয অধ্যায়: ৪২, হাদীস নং ১৩০২ এর ব্যাখ্যায়।)
খ) ইবনুল জাওযী রহ: সবরে এখতিয়ারির বর্ণনা এভাবে দিয়েছেনঃ
(حبس النفس عن فعل ما تحبه، و الزامها بفعل ما تكره في العاجل، مما لو فعله أو تركه لتأذى به في الآجل.)
অর্থাৎ: নফসকে এমন কাজ থেকে বারন করা যা সে করতে পছন্দ করে এবং তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যায় সে অপছন্দ করে, আর বিষয়গুলো হলো এমন যে যদি সেই কাজটি করা হয় অথবা ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে পরবর্তীকালে এর কারণে কষ্ট এবং শাস্তি পাবে। (ফাতহুল বারী ১১/৩০৪, কিতাবুর-রিকাক— অধ্যায়:২০,এর ব্যাখ্যা থেকে।)
গ) আল্লামা ইবরাহীম খাও্যয়াছ বলেন:
(الصبر: هو الثبات على الكتاب والسنة)
অর্থাৎ: সবর হলো আল্লাহ্ তায়ালার কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর উপর স্থীর এবং দৃঢ় থাকা। (শরহুন-নববী সহীহ মুসলিম ২/১০৪)
২/ সবরে গায়রে এখতিয়ারি, (অর্থাৎ এমন সব বিষয়ের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা যে সব বিষয়ে বান্দার কোন ইচ্ছা, এখতিয়ার কিংবা ক্ষমতা নেই যেমন তাকদীর নির্ধারিত বালা-মুসিবত এবং আপতিত বিপদ-আপদ) তার ব্যাখ্যায় ইবনে আত্বা' রহ: বলেন:
(الصبر: الوقوف مع البلاء مع حسن الادب)
অর্থাৎ: সবর হলো; সুন্দর ও উত্তম আদবের সঙ্গে বালা-মসিবতের সাথে স্থির থাকা ।
এবং আবু আলী আদ্-দাক্কাক রহঃ বলেন:
(حقيقة الصبر أن لايعترض على المقدور ...)
অর্থাৎ: সবরের হাকীকত ও বাস্তবতা হলো তাকদীর এবং নিয়তির উপর কোন রকম অভিযোগ আপত্তি না তোলা। (উক্তি দুটি শরহুন-নববী সহীহ মুসলিম ২/১০৪ দ্রষ্টব্য।)
জীবন হলো হক ও বাতিলের মধ্যকার সংঘাতের নাম। এ সংঘাতে তাঁরাই বিজয়ী এবং সফল হবে যারা সুউচ্চ মনোবল এবং অধিক ধৈর্যশীল হবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
﴿وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً أَتَصْبِرُونَ وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيرًا .﴾
সূরা আল ফুরকান (الفرقان), আয়াত: ২০
অর্থঃ "আমি তোমাদের এককে অপরের জন্যে পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। দেখি, তোমরা সবর কর কিনা। আপনার পালনকর্তা সব কিছু দেখেন।"
যদি আহলে বাতিল তারা বাতিলের উপর ধৈর্যের এবং আঁকড়ে থাকার জন্য একেঅপরকে উপদেশ করতে পারে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা যেমন বলেছেনঃ ১/
وَانْطَلَقَ الْمَلَأُ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوا وَاصْبِرُوا عَلَى آَلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ
সূরা ছোয়াদ (ص), আয়াত: ৬
অর্থঃ তাদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি একথা বলে প্রস্থান করে যে, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের পূজায় দৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই এ বক্তব্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত।
২/
إِنْ كَادَ لَيُضِلُّنَا عَنْ آَلِهَتِنَا لَوْلَا أَنْ صَبَرْنَا عَلَيْهَا وَسَوْفَ يَعْلَمُونَ حِينَ يَرَوْنَ الْعَذَابَ مَنْ أَضَلُّ سَبِيلًا
সূরা আল ফুরকান (الفرقان), আয়াত: ৪২
অর্থঃ সে তো আমাদেরকে আমাদের উপাস্যগণের কাছ থেকে সরিয়েই দিত, যদি আমরা তাদেরকে আঁকড়ে ধরে না থাকতাম। তারা যখন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন জানতে পারবে কে অধিক পথভ্রষ্ট।
তবে আহলে হক আহলে বাতিলকে কেন একথা বলতে পারে না;
وَمَا لَنَا أَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَى اللَّهِ وَقَدْ هَدَانَا سُبُلَنَا وَلَنَصْبِرَنَّ عَلَى مَا آَذَيْتُمُونَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ
সূরা ইব্রাহীম (إبراهيم), আয়াত: ১২
অর্থঃ আমাদের আল্লাহর উপর ভরসা না করার কি কারণ থাকতে পারে, অথচ তিনি আমাদেরকে আমাদের পথ বলে দিয়েছেন। তোমরা আমাদেরকে যে পীড়ন করেছ, তজ্জন্যে আমরা সবর করব। ভরসাকারিগণের আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত।
যদি সত্যবাদীগণ মিথ্যাবাদীদেরকে দৃঢ়তার সাথে আয়াত আলোচিত কথা বলতে পারে তবে তাদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার নুসরাত এবং তামকীনের ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। যেমনটি পুর্বের বনী ইসরাইলের জন্য ঘটেছিল। তাদের প্রসঙ্গে কালামে পাকে এরশাদ হয়েছে:
১/
وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ الْحُسْنَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ بِمَا صَبَرُوا وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُوا يَعْرِشُونَ
সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ১৩৭
অর্থঃ"এবং পরিপূর্ণ হয়ে গেছে তোমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত কল্যাণ বনী-ইসরাঈলদের জন্য তাদের ধৈর্য্যধারণের দরুন। আর ধ্বংস করে দিয়েছে সে সবকিছু যা তৈরী করেছিল ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় এবং ধ্বংস করেছি যা কিছু তারা সুউচ্চ নির্মাণ করেছিল।
২/
وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يُوقِنُونَ
সূরা আস সেজদাহ্ (السّجدة), আয়াত: ২৪।
অর্থঃ তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।
অনেকেই আপত্তি করে থাকে যে তারা নিজেদের স্বভাব প্রকৃতির কাছে পরাজিত, তাদের ধৈর্য-সহ্যের ক্ষমতা নেই!
কিন্তু বাস্তবতা হলো যদি কেউ নফসের সাথে মুজাহাদাহ করে,। ক্রোধ-গোশ্শা নিবারণ করে, হারাম থেকে বেচে থাকে, নিজের মনকে প্রসস্থ করে, এবং আল্লাহ্ তায়ালা তাকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকে এবং আল্লাহ তাআলার দেয়া বালা-মসিবতের উপর নিজেকে স্টীল করে তবে সে অবশ্যই ধৈর্য এবং সহনশীলতার গুণ অর্জন করতে পারবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
وَمَنْ*يَسْتَعْفِفْ يُعِفَّهُ اللَّهُ،*وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللَّهُ، وَمَنْ يَصْبِرْ يُصَبِّرْهُ اللَّهُ، وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ مِنْ عَطَاءٍ خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ*الصبر.
(صحيح مسلم، كتاب الزكاة، باب فضل التعفف)
"যে ইফ্ফত এবং পবিত্রতা গ্রহণ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ইফ্ফত দান করবেন, আর যে মাখলূক থেকে নিজেকে মুখাপেক্ষী হীন করবে আল্লাহ্ তাকে বে নিয়াজ করে দিবেন, এবং যে ধৈর্য গ্রহণ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ধৈর্যশীল করে দিবেন। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুয্-যাকাত, তায়াফ্ফুফ অধ্যায়)
ইবনে হাজার রহ হাদীস শরীফের শব্দ
"يَصْبِرْ يُصَبِّرْهُ اللَّهُ"
এর বিশ্লেষণ করে বলেন: "আল্লাহ্ তায়ালা তাকে ধৈর্যশীল করে দিবেন" অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাকে শক্তিশালী করবেন তার নফসকে তার নিয়ন্ত্রণ করে দিবেন যে কারণে নফস তার অনুগত হয়ে যাবে, এবং সে দুঃখ কষ্ট সহনের জন্য নিজের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠবে, আর তখনি আল্লাহ্ তায়ালা তার সঙ্গী হবেন এবং সে নিজ লক্ষ্যে উদ্দেশ্যে সফল হবে।(ফাতহুল বারী ১১/৩০৪, কিতাবুর-রিকাক, অধ্যায় ২০, হাদীস ৬৪৭০ এর ব্যাখ্যায়।)
উত্তম এবং প্রশংসনীয় সবর হলো যা কোন ধরনের হা হুতাশ, নৈরাশ্য, এবং অভিযোগ আপত্তি ব্যতিরেকে হয়। এ অর্থেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: " যখন কোন শহরে মহামারী আসে আর সেখানে কোন ব্যক্তি ধৈর্য এবং সাওয়াবের আশায় এই বিশ্বাস নিয়ে অবস্থান করে যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা ছাড়া তাকে কোন কিছুই স্পর্শ করবে না, তাহলে তার জন্য একজন শহীদের সাওয়াব লেখা হবে।"(সহীহ বুখারী, কিতাবুল আন্বা– অধ্যায়: ৫৪– হাদীস নং ৩৪৭৪)
ইবনে হাজার রহ বলেনঃ ধৈর্যের সাথে অবস্থান করার অর্থ হলো, অস্থিরতা, বিরক্তি এবং হা হুতাশ থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহ তাআলার আদেশ এবং সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্পিত হয়ে অবস্থান করা।" (ফাতহুল বারী ১০/১৯৩, কিতাবুত-ত্বিব্ব, অধ্যায়:৩১, হাদীস নং ৫৭৩৪ এর ব্যাখ্যায়)
দাওয়াহ ইলা-ল্লাহর প্রারম্ভিক কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবরে জামীল এখতিয়ার করতে আদেশ করা হয়। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
فَاصۡبِرۡ صَبۡرًا جَمِیۡلًا
সূরা আল-মাআরিজ (المعارج), আয়াত: ৫
অর্থঃ অতএব, আপনি উত্তম সবর করুন।
ইমাম কুরতুবী রহ: বলেনঃ সবরে জামীল হলো যার মধ্যে গায়রুল্লাহর কাছে কোন হাহুতাশ এবং অভিযোগ আপত্তির বহিঃপ্রকাশ থাকবে না।" (তাফসীরে কুরতুবী ১৮/১৮৪)
উত্তম সবর হলো যার মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালার উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল এবং তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ য়াক্বীন এবং আস্থা রাখা হয়। আর এই য়াক্বীনই মুজাহিদকে রণাঙ্গনে সামনে অগ্রসর হতে তৎপর বানাবে এবং ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল: "হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি আল্লাহ্ তায়ালার রাস্তায় নিহত হয়ে যাই তাহলে কি আমার গুনাহগুলোকে মার্জনা করা হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যদি তুমি আল্লাহ তাআলার রাস্তায় নিহত এই অবস্থায় যে, তুমি ধৈর্যশীল এবং সাওয়াবের প্রত্যাশী ছিলে পশ্চাৎপশারণকারী ছিলে না। (আলবানী কর্তৃক সহীহ সুনানে তিরমিজী, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়:৩২–হাদীস সহীহ)
মসীবতের সময় ধৈর্য এবং য়াক্বীন তখনি যথার্থ বলে গণ্য হবে যখন ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবে না এবং মুখে প্রলাপ বকবে না।
হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
"হে ইবনে আদম! যদি তুমি (বিপদ ও মুসিবতের) প্রথম চোটেই ধৈর্য ধারণ এবং এহতিসাব(সাওয়াব লাভের এবং গুনাহ মাফের আশা) করতে তবে আমি তোমার পুরুস্কার হিসেবে তোমাকে জান্নাত দেয়া ছাড়া অন্য কিছুতে রাজি হতাম না।" (সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল জানায়েয, অধ্যায়:৫৫, হাদীস নং ১৫৯৭)
আল্লামা খাত্ত্বাবী রহ: বলেন:"অর্থাৎ: যে সবরের কারণে সবরকারী ব্যক্তির প্রশংসা করা হবে তা হলো যখন সে মুসিবত আসা মাত্রই সবর করবে কারণ পরে যে সবর করা হয় সেটা তো স্বাভাবিক ভাবে হয়েই থাকে।"(ফাতহুল বারী ৩/১৫০, কিতাবুল জানায়েয অধ্যায়:৩১, হাদীস নং ১২৮৩ এর ব্যাখ্যায়।)
নিশ্চয়ই যারা ধৈর্যের জিন্দেগী যাপন করে তারা জীবনের স্বাদ আস্বাদন করে এবং তার সুফল ভোগ করে, আর ধৈর্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক প্রভাব তাদের পরবর্তী জীবনে থেকেই যায়। হযরত ওমর ফারুক রা: বলেনঃ"ধৈর্যের মাধ্যমেই আমরা উত্তম জীবন পেয়েছি।"(সহীহ বুখারী, কিতাবুর-রিকাক, ২০ অধ্যায়ের মূল শিরোনামে।)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সবর থেকে অধিক উত্তম এবং সুপ্রসস্ত কল্যাণ কাউকে দেয়া হয়নি।"( সহীহ বুখারী, কিতাবুয্-যাকাত, অধ্যায়:৫০, হাদীস নং ১৪৬৯)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবেরর প্রশংসা করেছেন এভাবে:
والصبر ضياء
"সবর হলো জ্যোতি"।(সহীহ মুসলিম, কিতাবুত্-ত্বাহারাত, অধ্যায়:১, হাদীস নং ১/২৯৯৯)
ইমাম নববী রহ বলেনঃ" উদ্দেশ্যে হলো: যে, সবর অনেক প্রশংসার বস্তু, আর সবরকারী ব্যক্তি সর্বদা নূরের মধ্যে থাকে সঠিক পথে স্থায়ী এবং সুপথ প্রাপ্ত হয়।" (শরহুন-নববী ২/১০১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যশীলদের জীবনের সুফলতা এবং কল্যানের জন্য আশ্চর্যের বহিঃপ্রকাশ করেছেন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
*عَنْ*صُهَيْبٍ*، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : "عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ،*إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ ؛ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ".
"মুমিনের বিষয়টি খুবই আশ্চর্যকর, তার জীবনের সবটাই কল্যাণ, আর এটি মুমিন ছাড়া অন্য কারোর জন্য নয়, মুমিন যখন স্বচ্ছলতা লাভ করে তখন সে শুকরিয়া আদায় করে আর এটা তার জন্য কল্যাণ, আর যখন তাকে কোন দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করে তখন সে ধৈর্য ধারণ করে আর এটাও তার জন্য কল্যাণ।(সহীহ মুসলিম, যুহুদ ওর্-রাকায়েক, অধ্যায়: ১৩, হাদীস নং ২৪/২৯৯৯)
আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ
সূরা আন নাহল (النّحل), আয়াত: ১২৬
অর্থঃ আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।
ধৈর্যের গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ যেটা তা হলো ধৈর্য মুমিন এবং মুনাফিকের কাতারকে আলাদা করে দেয়, এবং ধৈর্যের মাধ্যমে প্রকৃত ব্যক্তিত্ব এবং রিজালুল্লাহর ভান্ডার উন্মোচিত হয় এবং ব্যক্তির রহস্য ভাণ্ডার স্পষ্ট হয়। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
সূরা মুহাম্মদ (محمّد), আয়াত: ৩১
অর্থঃ আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না ফুটিয়ে তুলি তোমাদের জেহাদকারীদেরকে এবং সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থান সমূহ যাচাই করি।
অনেকে মনে করে যে, ধৈর্য ধরা হলো ব্যক্তির জন্য অপমান এবং লাঞ্ছনা। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
ولا ظلم عبد مظلمة صبر عليها إلاّ زاد الله عز وجل -عزا.
"আর কোন বান্দা যখন কোন জুলুমের শিকার হয়েছে আর তার উপর সে ধৈর্য ধারণ করেছে তবে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তার ইজ্জত বাড়িয়ে দেন।" (সহীহ আল্ জামে' হাদীস নং ৩০২৪)
ধৈর্যে স্থির এবং কাজে অবিচল ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন যে সুসংবাদ তিনি ইবনে আব্বাস রাঃ কে দিয়েছেন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
وَاعْلَمْ أَنَّ*فِي الصَّبْرِ عَلَى مَاتَكْرَهُ خَيْرًا كَثِيرًا، وَأَنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ، وَأَنَّ الْفَرَجَ مَعَ الْكَرْبِ، وَأَنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ".
"জেনে রেখো! তোমার কষ্টের এবং অপছন্দের বিষয়ের উপর ধৈর্য ধারণের মধ্যে রয়েছে অনেক কল্যাণ, আর সাহায্য সেতো সবরের সঙ্গী, আর দুঃখের পরেই মুক্তি এবং প্রত্যেক কষ্টের সাথেই আছে সহজ।(মুসনাদে আহমাদ ১/৩০৭–৩০৮)
মুসলিম সমাজ তো সেটাই যেখানে পরস্পরকে সবরের নসিহা এবং ওসিয়ত করা ব্যপকভাবে হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা এক মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যে একটি কবরের নিকটে বসে কাঁদছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন; ওহে! তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য ধরো।(সহীহ বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, অধ্যায় ৩১, হাদীস নং ১২৮৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাঁর একজন সাহেবজাদী রা: সংবাদ পাঠালেন যে, তাঁর (রা ছেলে এন্তেকাল করেছেন, উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলে পাঠালেন:
: " إِنَّ*لِلَّهِ مَا أَخَذَ،*وَلَهُ مَا أَعْطَى، وَكُلٌّ عِنْدَهُ بِأَجَلٍ مُسَمًّى، فَلْتَصْبِرْ وَلْتَحْتَسِبْ "
" নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা যা নিয়েছেন তা তাঁরই, আর যা দিয়েছেন সেটাও তাঁর, ধৈর্য ধরো এবং এহতিসাব করো।" (সহীহ বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, অধ্যায়:৩২, হাদীস নং ৫৬৫২)
কোন মানব সমাজ ক্ষতি এবং ধ্বংস থেকে রক্ষা পাবে না, এবং তারা সফল হবে না যতক্ষণ না তারা এই গুণের অধিকারী হয়;
১/
إِلَّا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
সূরা আছর (العصر), আয়াত: ৩
অর্থঃ কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।
অর্থাৎ:
ক) বিশুদ্ধ ঈমান,
খ) বিশুদ্ধ আ'মালে সালেহা,
গ) তাওয়াসী বিল হক
ঘ) তাওয়াসী বিস্ সবর।
২/
ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ
সূরা আল বালাদ (البلد), আয়াত: ১৭
অর্থঃ অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার।
অর্থাৎ:
ঙ) তাওয়াসী বিল মারহামাহ
সবর অনেক তিক্ত কিন্তু তার ফল অনেক মিষ্ট। তাই এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে, নিজের নফসের ব্যপারে সচেতন এবং যত্নবান হতে হবে, তবেই সবরে জামীলের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারবে।
সবরে জামীলের গুণ অর্জন করতে একজন মুসলিমের জন্য সহায়ক বিষয় আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর ধৈর্যশীল বান্দাদের জন্য যা যা পুরুস্কার দানের ওয়াদা করেছেন সর্বদা তা স্বরণে রাখা। আল্লাহ্ তায়ালা ধৈর্যশীলদের জন্য ওয়াদা করেছেন;
১/ তাঁদের গুনাসমূহ ক্ষমা করবেন,
২/ তাঁদের মর্যাদা উচূ করবেন,
৩/ তাঁদের নেকী ও সাওয়াবকে বহু গুণ বৃদ্ধি করবেন,
৪/ তাঁদেরকে সাহায্য করবেন,
৫/ আল্লাহ্ তায়ালা তাঁদের সঙ্গী হবেন,
৬/ মৃত্যুর পরে তাঁদেরকে জান্নাত দান করবেন।
এক মহিলা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যে কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করছিল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরোগ্যের জন্য দুয়া চাচ্ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন: তোমার ইচ্ছা, যদি তুমি সবর কর তাহলে তোমার জন্য জান্নাত, আর যদি চাও আল্লাহ তাআলার কাছে আমি তোমার সুস্থতার দুআ' করব, সেটাও তোমার ইচ্ছা, মহিলা বললো: আমি ধৈর্যই ধরবো। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল মারজা, অধ্যায়:৬, হাদীস নং ৫৬৫২)
আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রাঃ এর নিকট তিন ব্যক্তি খাদ্য, বাহন, এবং সামানা ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তার অভিযোগ নিয়ে আসল, তিনি তাদেরকে তিনটি এখতিয়ার দিলেন:
ক) তোমরা চাইলে আমাদের কাছে তোমাদের বিষয়টি পেশ করতে পার তাহলে আমরা তোমাদেরকে দেব যতটুকু আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের জন্য সহজ করে দেন।
খ) আর যদি তোমরা চাও তাহলে তোমাদের বিষয়টি সুলতানের নিকট পেশ করব।
গ) আর যদি চাও তোমরা নিজেদের অবস্থার উপর ধৈর্য ধারণ করে থাকবে, তাহলে জেনে রাখ! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
" গরীব মুহাজিরগণ ধণীদের থেকে চল্লিশ বছর পুর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে।"
তারা বলল: আমরা ধৈর্য ধরবো, কারো কাছে কিছু চাবো না। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুয্-যুহুদ, হাদীস নং ৩৭/২৯৭৯)
ধৈর্য ধারণ এবং দৃঢ়তা গ্রহণ করতে ব্যক্তিকে আরেকটি যে বিষয় অনুপ্রেরণা যোগায় এবং সাহায্য করে তা হলো সালেহীন বান্দাদের সীরাত থেকে শিক্ষা এবং তাদের আদর্শ গ্রহণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন কোন ব্যক্তি গনিমত বন্টনের ব্যপারে অপবাদ আরোপ করল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূসা আঃ এর কথা স্বরণ করে বললেন: " আল্লাহ্ তায়ালা মূসাকে রহম করুন, তাঁকে তো এর থেকেও বেশি কষ্ট দেয়া হয়েছে তার পরেও তিনি ধৈর্য ধারণ করেছে!। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল-আম্বিয়া, অধ্যায়:২৮, হাদীস নং ৩৪০৫)
আর কুরআনুল কারীম এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلَّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ ۔
সূরা আল আহ্*ক্বাফ (الأحقاف), আয়াত: ৩৫
অর্থঃ অতএব, আপনি সবর করুন, যেমন উচ্চ সাহসী পয়গম্বরগণ সবর করেছেন এবং ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবেন না। ওদেরকে যে বিষয়ে ওয়াদা দেয়া হত, তা যেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দিনের এক মুহুর্তের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি। এটা সুস্পষ্ট অবগতি। এখন তারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, যারা পাপাচারী সম্প্রদায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ...
সবর ও অবিচলতা
একজন মুজাহিদ যে নিজের জন্য কুরবানীর রাস্তাকে বেছে নিয়েছে সে কখনো এ পথে টিকে থাকতে পারবে না যতক্ষণ না সে নিজেকে ধৈর্যের দ্বারা সজ্জিত করে। এবং যে দল বিপদ ও মসিবতের কষ্টকীর্ণ বন্ধূর পথ অবলম্বন করবে তাদের পারস্পরিক বন্ধন স্থায়ী হবে না এবং তার ভিত্ মজবুত হবে না, যদি না তারা একেঅপরকে সত্যের এবং সবরের ওসীয়ত করে। আল্লাহ্ তায়ালা সকল মুমিনদের কে সম্বোধন করেছেন এই বলে:
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴾
সূরা আল ইমরান (آل عمران), আয়াত: ২০০
অর্থঃ হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার।
সবর দুই প্রকার: ১/ সবরে এখতিয়ারি, ২/ সবরে গায়রে এখতিয়ারি।
১/ এখতিয়ারি সবর, (অর্থাৎ: যা ধারন করতে বান্দার ইচ্ছা এবং প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন) উলামায়ে কেরাম তার সংজ্ঞা ও পরিচয় বিভিন্নভাবে দিয়েছেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো:
ক) ইমাম তবারী রহঃ বলেন:
الصبر منع النفس محابها، و كفها عن هواها.
অর্থাৎ: সবর হলো; নফসকে তার পছন্দের জিনিস থেকে বিরত রাখা এবং তার তাড়ণা থেকে তাকে বাধা প্রদান করা। (ফাতহুল বারী ৩/১৭২, কিতাবুল জানায়েয অধ্যায়: ৪২, হাদীস নং ১৩০২ এর ব্যাখ্যায়।)
খ) ইবনুল জাওযী রহ: সবরে এখতিয়ারির বর্ণনা এভাবে দিয়েছেনঃ
(حبس النفس عن فعل ما تحبه، و الزامها بفعل ما تكره في العاجل، مما لو فعله أو تركه لتأذى به في الآجل.)
অর্থাৎ: নফসকে এমন কাজ থেকে বারন করা যা সে করতে পছন্দ করে এবং তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যায় সে অপছন্দ করে, আর বিষয়গুলো হলো এমন যে যদি সেই কাজটি করা হয় অথবা ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে পরবর্তীকালে এর কারণে কষ্ট এবং শাস্তি পাবে। (ফাতহুল বারী ১১/৩০৪, কিতাবুর-রিকাক— অধ্যায়:২০,এর ব্যাখ্যা থেকে।)
গ) আল্লামা ইবরাহীম খাও্যয়াছ বলেন:
(الصبر: هو الثبات على الكتاب والسنة)
অর্থাৎ: সবর হলো আল্লাহ্ তায়ালার কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর উপর স্থীর এবং দৃঢ় থাকা। (শরহুন-নববী সহীহ মুসলিম ২/১০৪)
২/ সবরে গায়রে এখতিয়ারি, (অর্থাৎ এমন সব বিষয়ের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা যে সব বিষয়ে বান্দার কোন ইচ্ছা, এখতিয়ার কিংবা ক্ষমতা নেই যেমন তাকদীর নির্ধারিত বালা-মুসিবত এবং আপতিত বিপদ-আপদ) তার ব্যাখ্যায় ইবনে আত্বা' রহ: বলেন:
(الصبر: الوقوف مع البلاء مع حسن الادب)
অর্থাৎ: সবর হলো; সুন্দর ও উত্তম আদবের সঙ্গে বালা-মসিবতের সাথে স্থির থাকা ।
এবং আবু আলী আদ্-দাক্কাক রহঃ বলেন:
(حقيقة الصبر أن لايعترض على المقدور ...)
অর্থাৎ: সবরের হাকীকত ও বাস্তবতা হলো তাকদীর এবং নিয়তির উপর কোন রকম অভিযোগ আপত্তি না তোলা। (উক্তি দুটি শরহুন-নববী সহীহ মুসলিম ২/১০৪ দ্রষ্টব্য।)
জীবন হলো হক ও বাতিলের মধ্যকার সংঘাতের নাম। এ সংঘাতে তাঁরাই বিজয়ী এবং সফল হবে যারা সুউচ্চ মনোবল এবং অধিক ধৈর্যশীল হবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
﴿وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً أَتَصْبِرُونَ وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيرًا .﴾
সূরা আল ফুরকান (الفرقان), আয়াত: ২০
অর্থঃ "আমি তোমাদের এককে অপরের জন্যে পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। দেখি, তোমরা সবর কর কিনা। আপনার পালনকর্তা সব কিছু দেখেন।"
যদি আহলে বাতিল তারা বাতিলের উপর ধৈর্যের এবং আঁকড়ে থাকার জন্য একেঅপরকে উপদেশ করতে পারে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা যেমন বলেছেনঃ ১/
وَانْطَلَقَ الْمَلَأُ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوا وَاصْبِرُوا عَلَى آَلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ
সূরা ছোয়াদ (ص), আয়াত: ৬
অর্থঃ তাদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি একথা বলে প্রস্থান করে যে, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের পূজায় দৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই এ বক্তব্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত।
২/
إِنْ كَادَ لَيُضِلُّنَا عَنْ آَلِهَتِنَا لَوْلَا أَنْ صَبَرْنَا عَلَيْهَا وَسَوْفَ يَعْلَمُونَ حِينَ يَرَوْنَ الْعَذَابَ مَنْ أَضَلُّ سَبِيلًا
সূরা আল ফুরকান (الفرقان), আয়াত: ৪২
অর্থঃ সে তো আমাদেরকে আমাদের উপাস্যগণের কাছ থেকে সরিয়েই দিত, যদি আমরা তাদেরকে আঁকড়ে ধরে না থাকতাম। তারা যখন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন জানতে পারবে কে অধিক পথভ্রষ্ট।
তবে আহলে হক আহলে বাতিলকে কেন একথা বলতে পারে না;
وَمَا لَنَا أَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَى اللَّهِ وَقَدْ هَدَانَا سُبُلَنَا وَلَنَصْبِرَنَّ عَلَى مَا آَذَيْتُمُونَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ
সূরা ইব্রাহীম (إبراهيم), আয়াত: ১২
অর্থঃ আমাদের আল্লাহর উপর ভরসা না করার কি কারণ থাকতে পারে, অথচ তিনি আমাদেরকে আমাদের পথ বলে দিয়েছেন। তোমরা আমাদেরকে যে পীড়ন করেছ, তজ্জন্যে আমরা সবর করব। ভরসাকারিগণের আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত।
যদি সত্যবাদীগণ মিথ্যাবাদীদেরকে দৃঢ়তার সাথে আয়াত আলোচিত কথা বলতে পারে তবে তাদের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার নুসরাত এবং তামকীনের ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। যেমনটি পুর্বের বনী ইসরাইলের জন্য ঘটেছিল। তাদের প্রসঙ্গে কালামে পাকে এরশাদ হয়েছে:
১/
وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ الْحُسْنَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ بِمَا صَبَرُوا وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُوا يَعْرِشُونَ
সূরা আল আরাফ (الأعراف), আয়াত: ১৩৭
অর্থঃ"এবং পরিপূর্ণ হয়ে গেছে তোমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত কল্যাণ বনী-ইসরাঈলদের জন্য তাদের ধৈর্য্যধারণের দরুন। আর ধ্বংস করে দিয়েছে সে সবকিছু যা তৈরী করেছিল ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় এবং ধ্বংস করেছি যা কিছু তারা সুউচ্চ নির্মাণ করেছিল।
২/
وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يُوقِنُونَ
সূরা আস সেজদাহ্ (السّجدة), আয়াত: ২৪।
অর্থঃ তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।
অনেকেই আপত্তি করে থাকে যে তারা নিজেদের স্বভাব প্রকৃতির কাছে পরাজিত, তাদের ধৈর্য-সহ্যের ক্ষমতা নেই!
কিন্তু বাস্তবতা হলো যদি কেউ নফসের সাথে মুজাহাদাহ করে,। ক্রোধ-গোশ্শা নিবারণ করে, হারাম থেকে বেচে থাকে, নিজের মনকে প্রসস্থ করে, এবং আল্লাহ্ তায়ালা তাকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকে এবং আল্লাহ তাআলার দেয়া বালা-মসিবতের উপর নিজেকে স্টীল করে তবে সে অবশ্যই ধৈর্য এবং সহনশীলতার গুণ অর্জন করতে পারবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
وَمَنْ*يَسْتَعْفِفْ يُعِفَّهُ اللَّهُ،*وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللَّهُ، وَمَنْ يَصْبِرْ يُصَبِّرْهُ اللَّهُ، وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ مِنْ عَطَاءٍ خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ*الصبر.
(صحيح مسلم، كتاب الزكاة، باب فضل التعفف)
"যে ইফ্ফত এবং পবিত্রতা গ্রহণ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ইফ্ফত দান করবেন, আর যে মাখলূক থেকে নিজেকে মুখাপেক্ষী হীন করবে আল্লাহ্ তাকে বে নিয়াজ করে দিবেন, এবং যে ধৈর্য গ্রহণ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ধৈর্যশীল করে দিবেন। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুয্-যাকাত, তায়াফ্ফুফ অধ্যায়)
ইবনে হাজার রহ হাদীস শরীফের শব্দ
"يَصْبِرْ يُصَبِّرْهُ اللَّهُ"
এর বিশ্লেষণ করে বলেন: "আল্লাহ্ তায়ালা তাকে ধৈর্যশীল করে দিবেন" অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাকে শক্তিশালী করবেন তার নফসকে তার নিয়ন্ত্রণ করে দিবেন যে কারণে নফস তার অনুগত হয়ে যাবে, এবং সে দুঃখ কষ্ট সহনের জন্য নিজের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠবে, আর তখনি আল্লাহ্ তায়ালা তার সঙ্গী হবেন এবং সে নিজ লক্ষ্যে উদ্দেশ্যে সফল হবে।(ফাতহুল বারী ১১/৩০৪, কিতাবুর-রিকাক, অধ্যায় ২০, হাদীস ৬৪৭০ এর ব্যাখ্যায়।)
উত্তম এবং প্রশংসনীয় সবর হলো যা কোন ধরনের হা হুতাশ, নৈরাশ্য, এবং অভিযোগ আপত্তি ব্যতিরেকে হয়। এ অর্থেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: " যখন কোন শহরে মহামারী আসে আর সেখানে কোন ব্যক্তি ধৈর্য এবং সাওয়াবের আশায় এই বিশ্বাস নিয়ে অবস্থান করে যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা ছাড়া তাকে কোন কিছুই স্পর্শ করবে না, তাহলে তার জন্য একজন শহীদের সাওয়াব লেখা হবে।"(সহীহ বুখারী, কিতাবুল আন্বা– অধ্যায়: ৫৪– হাদীস নং ৩৪৭৪)
ইবনে হাজার রহ বলেনঃ ধৈর্যের সাথে অবস্থান করার অর্থ হলো, অস্থিরতা, বিরক্তি এবং হা হুতাশ থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহ তাআলার আদেশ এবং সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্পিত হয়ে অবস্থান করা।" (ফাতহুল বারী ১০/১৯৩, কিতাবুত-ত্বিব্ব, অধ্যায়:৩১, হাদীস নং ৫৭৩৪ এর ব্যাখ্যায়)
দাওয়াহ ইলা-ল্লাহর প্রারম্ভিক কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবরে জামীল এখতিয়ার করতে আদেশ করা হয়। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
فَاصۡبِرۡ صَبۡرًا جَمِیۡلًا
সূরা আল-মাআরিজ (المعارج), আয়াত: ৫
অর্থঃ অতএব, আপনি উত্তম সবর করুন।
ইমাম কুরতুবী রহ: বলেনঃ সবরে জামীল হলো যার মধ্যে গায়রুল্লাহর কাছে কোন হাহুতাশ এবং অভিযোগ আপত্তির বহিঃপ্রকাশ থাকবে না।" (তাফসীরে কুরতুবী ১৮/১৮৪)
উত্তম সবর হলো যার মধ্যে আল্লাহ্ তায়ালার উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল এবং তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ য়াক্বীন এবং আস্থা রাখা হয়। আর এই য়াক্বীনই মুজাহিদকে রণাঙ্গনে সামনে অগ্রসর হতে তৎপর বানাবে এবং ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল: "হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি আল্লাহ্ তায়ালার রাস্তায় নিহত হয়ে যাই তাহলে কি আমার গুনাহগুলোকে মার্জনা করা হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যদি তুমি আল্লাহ তাআলার রাস্তায় নিহত এই অবস্থায় যে, তুমি ধৈর্যশীল এবং সাওয়াবের প্রত্যাশী ছিলে পশ্চাৎপশারণকারী ছিলে না। (আলবানী কর্তৃক সহীহ সুনানে তিরমিজী, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়:৩২–হাদীস সহীহ)
মসীবতের সময় ধৈর্য এবং য়াক্বীন তখনি যথার্থ বলে গণ্য হবে যখন ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবে না এবং মুখে প্রলাপ বকবে না।
হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
"হে ইবনে আদম! যদি তুমি (বিপদ ও মুসিবতের) প্রথম চোটেই ধৈর্য ধারণ এবং এহতিসাব(সাওয়াব লাভের এবং গুনাহ মাফের আশা) করতে তবে আমি তোমার পুরুস্কার হিসেবে তোমাকে জান্নাত দেয়া ছাড়া অন্য কিছুতে রাজি হতাম না।" (সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল জানায়েয, অধ্যায়:৫৫, হাদীস নং ১৫৯৭)
আল্লামা খাত্ত্বাবী রহ: বলেন:"অর্থাৎ: যে সবরের কারণে সবরকারী ব্যক্তির প্রশংসা করা হবে তা হলো যখন সে মুসিবত আসা মাত্রই সবর করবে কারণ পরে যে সবর করা হয় সেটা তো স্বাভাবিক ভাবে হয়েই থাকে।"(ফাতহুল বারী ৩/১৫০, কিতাবুল জানায়েয অধ্যায়:৩১, হাদীস নং ১২৮৩ এর ব্যাখ্যায়।)
নিশ্চয়ই যারা ধৈর্যের জিন্দেগী যাপন করে তারা জীবনের স্বাদ আস্বাদন করে এবং তার সুফল ভোগ করে, আর ধৈর্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক প্রভাব তাদের পরবর্তী জীবনে থেকেই যায়। হযরত ওমর ফারুক রা: বলেনঃ"ধৈর্যের মাধ্যমেই আমরা উত্তম জীবন পেয়েছি।"(সহীহ বুখারী, কিতাবুর-রিকাক, ২০ অধ্যায়ের মূল শিরোনামে।)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সবর থেকে অধিক উত্তম এবং সুপ্রসস্ত কল্যাণ কাউকে দেয়া হয়নি।"( সহীহ বুখারী, কিতাবুয্-যাকাত, অধ্যায়:৫০, হাদীস নং ১৪৬৯)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবেরর প্রশংসা করেছেন এভাবে:
والصبر ضياء
"সবর হলো জ্যোতি"।(সহীহ মুসলিম, কিতাবুত্-ত্বাহারাত, অধ্যায়:১, হাদীস নং ১/২৯৯৯)
ইমাম নববী রহ বলেনঃ" উদ্দেশ্যে হলো: যে, সবর অনেক প্রশংসার বস্তু, আর সবরকারী ব্যক্তি সর্বদা নূরের মধ্যে থাকে সঠিক পথে স্থায়ী এবং সুপথ প্রাপ্ত হয়।" (শরহুন-নববী ২/১০১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যশীলদের জীবনের সুফলতা এবং কল্যানের জন্য আশ্চর্যের বহিঃপ্রকাশ করেছেন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
*عَنْ*صُهَيْبٍ*، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : "عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ،*إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ ؛ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ".
"মুমিনের বিষয়টি খুবই আশ্চর্যকর, তার জীবনের সবটাই কল্যাণ, আর এটি মুমিন ছাড়া অন্য কারোর জন্য নয়, মুমিন যখন স্বচ্ছলতা লাভ করে তখন সে শুকরিয়া আদায় করে আর এটা তার জন্য কল্যাণ, আর যখন তাকে কোন দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করে তখন সে ধৈর্য ধারণ করে আর এটাও তার জন্য কল্যাণ।(সহীহ মুসলিম, যুহুদ ওর্-রাকায়েক, অধ্যায়: ১৩, হাদীস নং ২৪/২৯৯৯)
আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ
সূরা আন নাহল (النّحل), আয়াত: ১২৬
অর্থঃ আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।
ধৈর্যের গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ যেটা তা হলো ধৈর্য মুমিন এবং মুনাফিকের কাতারকে আলাদা করে দেয়, এবং ধৈর্যের মাধ্যমে প্রকৃত ব্যক্তিত্ব এবং রিজালুল্লাহর ভান্ডার উন্মোচিত হয় এবং ব্যক্তির রহস্য ভাণ্ডার স্পষ্ট হয়। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
সূরা মুহাম্মদ (محمّد), আয়াত: ৩১
অর্থঃ আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না ফুটিয়ে তুলি তোমাদের জেহাদকারীদেরকে এবং সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থান সমূহ যাচাই করি।
অনেকে মনে করে যে, ধৈর্য ধরা হলো ব্যক্তির জন্য অপমান এবং লাঞ্ছনা। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
ولا ظلم عبد مظلمة صبر عليها إلاّ زاد الله عز وجل -عزا.
"আর কোন বান্দা যখন কোন জুলুমের শিকার হয়েছে আর তার উপর সে ধৈর্য ধারণ করেছে তবে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তার ইজ্জত বাড়িয়ে দেন।" (সহীহ আল্ জামে' হাদীস নং ৩০২৪)
ধৈর্যে স্থির এবং কাজে অবিচল ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন যে সুসংবাদ তিনি ইবনে আব্বাস রাঃ কে দিয়েছেন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
وَاعْلَمْ أَنَّ*فِي الصَّبْرِ عَلَى مَاتَكْرَهُ خَيْرًا كَثِيرًا، وَأَنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ، وَأَنَّ الْفَرَجَ مَعَ الْكَرْبِ، وَأَنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ".
"জেনে রেখো! তোমার কষ্টের এবং অপছন্দের বিষয়ের উপর ধৈর্য ধারণের মধ্যে রয়েছে অনেক কল্যাণ, আর সাহায্য সেতো সবরের সঙ্গী, আর দুঃখের পরেই মুক্তি এবং প্রত্যেক কষ্টের সাথেই আছে সহজ।(মুসনাদে আহমাদ ১/৩০৭–৩০৮)
মুসলিম সমাজ তো সেটাই যেখানে পরস্পরকে সবরের নসিহা এবং ওসিয়ত করা ব্যপকভাবে হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা এক মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যে একটি কবরের নিকটে বসে কাঁদছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন; ওহে! তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য ধরো।(সহীহ বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, অধ্যায় ৩১, হাদীস নং ১২৮৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাঁর একজন সাহেবজাদী রা: সংবাদ পাঠালেন যে, তাঁর (রা ছেলে এন্তেকাল করেছেন, উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলে পাঠালেন:
: " إِنَّ*لِلَّهِ مَا أَخَذَ،*وَلَهُ مَا أَعْطَى، وَكُلٌّ عِنْدَهُ بِأَجَلٍ مُسَمًّى، فَلْتَصْبِرْ وَلْتَحْتَسِبْ "
" নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা যা নিয়েছেন তা তাঁরই, আর যা দিয়েছেন সেটাও তাঁর, ধৈর্য ধরো এবং এহতিসাব করো।" (সহীহ বুখারী, কিতাবুল জানায়েয, অধ্যায়:৩২, হাদীস নং ৫৬৫২)
কোন মানব সমাজ ক্ষতি এবং ধ্বংস থেকে রক্ষা পাবে না, এবং তারা সফল হবে না যতক্ষণ না তারা এই গুণের অধিকারী হয়;
১/
إِلَّا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
সূরা আছর (العصر), আয়াত: ৩
অর্থঃ কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।
অর্থাৎ:
ক) বিশুদ্ধ ঈমান,
খ) বিশুদ্ধ আ'মালে সালেহা,
গ) তাওয়াসী বিল হক
ঘ) তাওয়াসী বিস্ সবর।
২/
ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ
সূরা আল বালাদ (البلد), আয়াত: ১৭
অর্থঃ অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার।
অর্থাৎ:
ঙ) তাওয়াসী বিল মারহামাহ
সবর অনেক তিক্ত কিন্তু তার ফল অনেক মিষ্ট। তাই এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে, নিজের নফসের ব্যপারে সচেতন এবং যত্নবান হতে হবে, তবেই সবরে জামীলের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারবে।
সবরে জামীলের গুণ অর্জন করতে একজন মুসলিমের জন্য সহায়ক বিষয় আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর ধৈর্যশীল বান্দাদের জন্য যা যা পুরুস্কার দানের ওয়াদা করেছেন সর্বদা তা স্বরণে রাখা। আল্লাহ্ তায়ালা ধৈর্যশীলদের জন্য ওয়াদা করেছেন;
১/ তাঁদের গুনাসমূহ ক্ষমা করবেন,
২/ তাঁদের মর্যাদা উচূ করবেন,
৩/ তাঁদের নেকী ও সাওয়াবকে বহু গুণ বৃদ্ধি করবেন,
৪/ তাঁদেরকে সাহায্য করবেন,
৫/ আল্লাহ্ তায়ালা তাঁদের সঙ্গী হবেন,
৬/ মৃত্যুর পরে তাঁদেরকে জান্নাত দান করবেন।
এক মহিলা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যে কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করছিল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরোগ্যের জন্য দুয়া চাচ্ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন: তোমার ইচ্ছা, যদি তুমি সবর কর তাহলে তোমার জন্য জান্নাত, আর যদি চাও আল্লাহ তাআলার কাছে আমি তোমার সুস্থতার দুআ' করব, সেটাও তোমার ইচ্ছা, মহিলা বললো: আমি ধৈর্যই ধরবো। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল মারজা, অধ্যায়:৬, হাদীস নং ৫৬৫২)
আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রাঃ এর নিকট তিন ব্যক্তি খাদ্য, বাহন, এবং সামানা ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তার অভিযোগ নিয়ে আসল, তিনি তাদেরকে তিনটি এখতিয়ার দিলেন:
ক) তোমরা চাইলে আমাদের কাছে তোমাদের বিষয়টি পেশ করতে পার তাহলে আমরা তোমাদেরকে দেব যতটুকু আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের জন্য সহজ করে দেন।
খ) আর যদি তোমরা চাও তাহলে তোমাদের বিষয়টি সুলতানের নিকট পেশ করব।
গ) আর যদি চাও তোমরা নিজেদের অবস্থার উপর ধৈর্য ধারণ করে থাকবে, তাহলে জেনে রাখ! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
" গরীব মুহাজিরগণ ধণীদের থেকে চল্লিশ বছর পুর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে।"
তারা বলল: আমরা ধৈর্য ধরবো, কারো কাছে কিছু চাবো না। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুয্-যুহুদ, হাদীস নং ৩৭/২৯৭৯)
ধৈর্য ধারণ এবং দৃঢ়তা গ্রহণ করতে ব্যক্তিকে আরেকটি যে বিষয় অনুপ্রেরণা যোগায় এবং সাহায্য করে তা হলো সালেহীন বান্দাদের সীরাত থেকে শিক্ষা এবং তাদের আদর্শ গ্রহণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন কোন ব্যক্তি গনিমত বন্টনের ব্যপারে অপবাদ আরোপ করল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূসা আঃ এর কথা স্বরণ করে বললেন: " আল্লাহ্ তায়ালা মূসাকে রহম করুন, তাঁকে তো এর থেকেও বেশি কষ্ট দেয়া হয়েছে তার পরেও তিনি ধৈর্য ধারণ করেছে!। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল-আম্বিয়া, অধ্যায়:২৮, হাদীস নং ৩৪০৫)
আর কুরআনুল কারীম এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلَّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ ۔
সূরা আল আহ্*ক্বাফ (الأحقاف), আয়াত: ৩৫
অর্থঃ অতএব, আপনি সবর করুন, যেমন উচ্চ সাহসী পয়গম্বরগণ সবর করেছেন এবং ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবেন না। ওদেরকে যে বিষয়ে ওয়াদা দেয়া হত, তা যেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দিনের এক মুহুর্তের বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি। এটা সুস্পষ্ট অবগতি। এখন তারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, যারা পাপাচারী সম্প্রদায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ...
Comment