সর্ব হালতে রবের প্রশংসায় উচ্ছ্বাসিত হওয়া নবীদের সিফাত
প্রিয় যুবক ভাই!
ফিক ফিকিয়ে অন্তর দিয়ে হাসা মুমিন হওয়ার অন্যতম লক্ষ্মণ। মুখের মুচকি হাসি তো সবাই হাসতে পারে। অনেকে মিট মিট করে হেসে রঙিণ ছলনাও করতে পারে। কিন্তু কথা হলো-অন্তরের হাসিটা কজনের অবয়ব থেকে ফুটে উঠে? সেটাই হলো মোক্ষম বিষয়। সেটাই তো সুখী হওয়ার অজয়ন্ত বেনারশি। কাশফুল ফোটে এক সারিবেঁধে তবে যত্রতত্র মোটেও ফোটে না তেমনি অন্তরের হাসিও বিচ্ছুরিত ফুলকা ছড়ায় তবে সবার জাসাদ থেকে না।
কোন সে ব্যক্তি? যার তনু-মন শিওরে উঠে ইমানের পদধ্বনিতে। কোন সে ব্যক্তি? যার আচার-আচরণ অনন্য হয়ে উঠে দ্বীনের জলন্ত প্রদীপে। কোন সে ব্যক্তি? যার জান-মাল কুরবান হয়ে যায় রবের আহ্বানে?তাদের ব্যাপারেই আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাহ ঘোষণা দিচ্ছেন-
مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاہَدُوا اللّٰہَ عَلَیۡہِ ۚ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَہٗ وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ ۫ۖ وَ مَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا ﴿ۙ۲۳﴾
মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাঁদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে; তাঁদের কেহ কেহ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেহ কেহ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তাঁরা তাঁদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি।[১]
তাঁদের অন্তরই রবের ভালোবাসায় ফিক ফিকিয়ে হাসে। তাঁদের মুষ্টিতেই রবের রবকত পূর্ণতা পায়। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে রবকে ডাকতে গিয়ে শিরশির ব্যথাও অনুভব করে না। মায়া বিজড়িত কান্নারও কেনো প্রয়োজন পড়ে না। অথচ শরীর কাফেরদের পাথরের আঘাতে ঝরঝরিত। অন্তর কুরাইশ বংশীয় মানুষ দ্বারা ক্ষতবিক্ষত। প্রিয় মানুষটির উপর তায়েফবাসীর লৌহমর্ষক নির্যাতনের কথা বলছিলাম। ঐদিন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ থেকে এ বাণী উচ্চারিত হয়েছিলো- এরা বুঝে না; এরা তো আমারই উম্মত! [২]
প্রিয় যুবক ভাই!
লক্ষ্য করে দেখ্যোন-তাঁর অন্তরে কোনো শূন্যতা ছিলো না বরং অন্তর ছিলো ইমানী আলোতে ভরপুর। মনে মনে কিছু পাওয়ার আশায় ছিলেন উচ্ছ্বাসিত। আর সে পাওয়াটাই হলো রবের পক্ষ হতে রুহানী শিশির ছোঁয়া। যার দরুন-শুষ্ক দিল প্রফুল্ল হয়ে উঠে, শরীর সাঁজ সাঁজ যিকিরে মত্ত হয়ে উঠে, অজানা সুখ শক্তির আম্ফালন ঘটে। তখন পাঁয়ে ছেঁড়া জুতা থাকুক আর দিনের কোনো এক অংশে পোড়া এক টুকরো রুটি মুখে পোড়ুক।
শত কষ্টের পরেও মুখের হাসি বলে দেয় সে খুব সুখী। অসংখ্য যাতনার বেষ্টনীতে থেকেও তার চাহনি বলে দেয় সে খুব দরদী। সুখের নদীতে এ সুখখানা খুবই মূল্যবান। ভাগ্যের জুড়িতে এমন ভাগ্যওয়ালা মানব গুটিকতক। তবে তা নিশ্চিত এ থেকে মুহাম্মাদের অস্ত্রধারী সৈনিকরা বঞ্চিত হবেন না। এটাও সঠিক এ থেকে মুহাম্মাদের ঝান্ডাবাহী ব্যক্তিরা আলাদা হবেন না। বরং সিজদায় উচ্চ প্রশংসায় লিপ্ত হবেন তবুও মাবুদ তোমার পরিবার ছাড়া করোনা![৩]
অন্তর যার প্রফুল্ল সে কোনো সালাত কায়েমে বিলম্ব কবরে? অন্তর যার ফকফকা সে কোনো জাকাত আদায়ে পিছপা হবে? অন্তর যার উর্বর সে কোনো জিহাদের ফরযিয়্যাত আদায়ে গড়িমসি করবে? না উল্টো এমন হওয়ার কথা ছিলো-বিজয় ছিনিয়ে এনে রাব্বে কারীমের শানে সিজদায় লুটিয়ে পড়বো। বিধান পালনার্থে শরয়ী খেলাফকারীদের গর্দানকে ছিন্ন করে দিবো। না পাবো কাউকে ভয় না হবো কারো সামনে নতজানু! প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য রব আর উচ্ছ্বাসিত হওয়া দরকার গোলামের।
অন্তর যার মৃদুময় হাসে তার জবানে এ কথা কোনোদিন আসবে না, আমি অতি নগন্য বিধান কায়েমের ক্ষেত্রে, আমি তুচ্ছ, দুবল অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পড়তে। আমার আকল বুঝে না তিক্ততার পর যে মিঠা আছে। আমার জাসাদ জানে না কষ্টের পর যে ইসতিরাহাত আছে। আমার কলব ধরতে পারেনা নেকের মাঝে যে ভারি লাজ্জাত আছে। বিপদ আসলে রবের প্রতি ঝোঁকার কথা! তাতো হচ্ছে না। যুবক ভাই এই তো তোমার সমস্যা?
তাহলে দেখ্যো- রবের প্রতি সালেহ আলাইহিস সালামের দৃষ্টিভঙ্গি অথচ কত বড় বিপদে না তিনি পড়ে গিয়েছিলেন, কণা পরিমাণ অভিযোগ তুলেন নি বরং তিনি বলছেন-إِنَّ رَبّي قَرِيْبُٗ مُجِيبُٗ নিশ্চয় আমার রব অতিদ্রুত সাড়াদানকারী। বিপদের মাঝেও তিনি রবের প্রশংসায় উচ্ছ্বাসিত হয়েছেন। কারণ ঐযে বললাম-তাঁদের হৃদয়কোণে কোনো শূন্যতা নেই। বিপদে স্থির থেকে রবকে স্বরণ করতে পারা আর আরামে আয়েশে তাঁর শুকরগুজার বান্দা হতে পারা তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। আর এসব লোকদেরই হৃদয়তন্ত্রী সদাসর্বদা হাসোজ্জল থাকে। নবী সালেহ আলাইহিস সালামের কথার এ আবেদন এটাই সুস্পষ্ট হয়ে যায়।[৪]
নবী শুআইব আলাইহিস সালামের ঘটনা জানেনা এমন কজন আছেন? তিনি কাতরোক্তি সময়ে এসে বলেই ফেললন-إِنَّ رَبِّيْ رَحِِيْم وَدُوْدُ নিশ্চয় আমার রব চিরদয়ালু ও বান্দার প্রতি সদয়বান। নিজ চিন্তাকে তিনি প্রাধান্য না দিয়ে রবের দিকে রুজু হয়ে গিয়েছেন। রবের প্রশংসায় উচ্ছ্বাসিত হয়ে প্রবৃত্তির খারাপি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। অধিক কল্যাণ কামনার্থে তিনি যা করেছেন তা বান্দা হিসেবে অতি প্রশংসার যোগ্য।[৫]
অপরদিকে নুহ আলাইহিস সালাল কিশতী তৈরি কাজ শেষ করে যখন বিসমিল্লাহ বলে তাঁর অনুস্বারীদের কিশতীতে উঠার জন্য বললেন তখন তিনি তাঁর রবের প্রতি শুকরিয়া জানাতে ভুলে যাননি। সবার সামনে প্রাণ খুলে মন উজাড় করে বললেন-اِنَّ رَبِّیۡ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল ও অতি দয়াবান। সুতরাং তোমরা তাতে আরোহণ করতে কোনো ভয় নেই। কোনো শঙ্কা নেই। আরোহণ করো, নিরাপত্তার বিধান তিনিই আমাদের দেবেন।[৬]
নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা-মাতাকে নিজ সিংহাসনে বসালেন এবং তাঁর ভায়েরা সবাই তাঁর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়লো। তিনি বললেন- হে আমার পিতা! এটাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা; আমার রব ওটা সত্যে পরিণত করেছেন এবং তিনি আমাকে কারাগার হতে মুক্ত করেছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো,, ইউসুফ আলাইহিস সালাম পুরো কথাটা টেনে এনেছেনই মূলত সত্যটা জানিয়ে রবের প্রশংসায় সবাইকে উচ্ছ্বাসিত করতে। ؕ اِنَّ رَبِّیۡ لَطِیۡفٌ لِّمَا یَشَآءُ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ নিশ্চয় আমার রব যা ইচ্ছা করেন তা নিপুণতার সাথে করে থাকেন, তিনি তো সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।[৭]
নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে যখন রবের পক্ষ থেকে সুসংবাদ বাণী শুনতে পেলেন তখন আনন্দের আতিশয্যে বলেই ফেললেন-
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡ وَہَبَ لِیۡ عَلَی الۡکِبَرِ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِسۡحٰقَ اِنَّ رَبِّیۡ لَسَمِیۡعُ الدُّعَآءِ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের, যিনি বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব বান্দার প্রার্থনা শুনে থাকেন। আবার এই ব্যক্তিটিই যখন রবের পক্ষ হতে অগ্নি পরীক্ষায় নিপেতিত হলেন তখন কতটা নমনীয় ও রবের প্রশংসায় উচ্ছ্বাসিত হয়েছিলেন তা তুমি সীরাতগ্রন্থ থেকে একটু চোখ বুলিয়ে নিও।[৮]
আল্লাহ তা'আলা নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামকে কত কিছুই না দান করে ছিলেন। রাজত্ব, বাক-স্বাধীনতা, মোজেজা, এমন বিশেষ কিছু নেয়ামত। এরই মাঝে আবার আমার রব তাঁর রাজত্ব ফিরিয়ে নিয়ে তাঁকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন এবং তিনি স্বসম্মানে উত্তির্ণও হয়েছেন।
পরিশেষে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন فَإِنَّ رَبِّيْ غَنِيُٗ كَرِيْمُٗ নিশ্চয় আমার রবই প্রকৃত ধনী ও মহান সত্তা। নবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম রবের প্রশংসায় পূর্ণমাত্রায় উচ্ছ্বাসিত হয়েছেন।[৯]
প্রিয় যুবক ভাই!
তোমার কাছে আচনক মনে হচ্ছে, রবের প্রতি তাঁদের উচ্ছ্বাসিত হওয়ার ধরনগুলো দেখে! তাঁদের বিপদগুলো কেমন ছিলো? পরীক্ষার মান কতটুকু ওজনওয়ালা ছিলো এ প্রশ্ন কি মনে একবারও জাগে না? হ্যা ভাই জাগে, তবে তা নিরীক্ষণের দৃষ্টিতে না। তাঁদের গল্পগুলো পড়ে ত্যাগের পন্থাগুলো দেখে সামান্য সরলরেখায় মজে গেলোও পরক্ষণে ভুলে যাই, আমি যে তাঁদেরই পথের পথিক।
একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন! তাঁদের কেউ কিন্তু একবারও বলেনি, ওগো রব! কেন তুমি আমাকে এত বড় বিপদে ফেলেছো! ওগো প্রভু! কেন তুমি আমাদের জন্য এ বিধান নাজিল করেছো!হে রাব্বে কারীম! কেন তুমি আমার উম্মাহকে ধ্বংস করে দিয়েছো! আমি নিছকই একা, আমার উম্মাহ নেহাত দুর্বল। বরং হয়েছে কি? সবকিছু আনুগত্যের সাথে মেনে নিয়ে রবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সন্তুষ্টির পরীক্ষায় বড় সফলতা অর্জন করেছেন। এর কারণ হলো-তাঁদের অন্তরগুলো ছিলো ইমানী সুভাসে সুশোভিত। স্রষ্টার আনুগত্যের বারিধারায় পরিপূর্ণ যার দরুন বিপদের আলিঙ্গন আর সুখের শমসায় তাঁদের আচরণ ছিলো একেবারে নমনীয় ও সাবলীলতার উচ্চাঙ্গে।
বিপদে ধৈর্য্য ধারণ করে রবের প্রতি উচ্ছ্বাসিত হতে পারাটা পরীক্ষার মানদন্ডে সফল হতে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ। সুতরাং ক্ষণিকের এ জীবনে সামান্য এ সবরটুকু মুফলীহুনদের পথে অগ্রগামী করতে এর ভূমিকা হতে পারে বিশাল। তাই ছোট বড় বিধানগুলোকে সুখ বানিয়ে নিজ অন্তরকে করে তুলো মানানসই। ইলমী মারকাযে, হাদীদের ময়দানে অন্তরকে বানিয়ে রাখো ভারসাম্যপূর্ণ। তখন দুনিয়ার সকল জঞ্জাল তোমার দ্বীনি কতৃত্বের কাছে ঝুঁকে বসবে। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবে নিশ্চয় আমার রব মহাপরাক্রমশালী ও অতিদয়ালু।
তথ্যসূত্র
______________________
১.সূরা আহযাব, আয়াত নং ২৩
২.সীরাত বিশ্বকোষ।
৩.সুখের দিনগুলো, রিসালা।
৪.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৫.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৬.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৭.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৮.ইতিহাস বিশ্বকোষ।
প্রিয় যুবক ভাই!
ফিক ফিকিয়ে অন্তর দিয়ে হাসা মুমিন হওয়ার অন্যতম লক্ষ্মণ। মুখের মুচকি হাসি তো সবাই হাসতে পারে। অনেকে মিট মিট করে হেসে রঙিণ ছলনাও করতে পারে। কিন্তু কথা হলো-অন্তরের হাসিটা কজনের অবয়ব থেকে ফুটে উঠে? সেটাই হলো মোক্ষম বিষয়। সেটাই তো সুখী হওয়ার অজয়ন্ত বেনারশি। কাশফুল ফোটে এক সারিবেঁধে তবে যত্রতত্র মোটেও ফোটে না তেমনি অন্তরের হাসিও বিচ্ছুরিত ফুলকা ছড়ায় তবে সবার জাসাদ থেকে না।
কোন সে ব্যক্তি? যার তনু-মন শিওরে উঠে ইমানের পদধ্বনিতে। কোন সে ব্যক্তি? যার আচার-আচরণ অনন্য হয়ে উঠে দ্বীনের জলন্ত প্রদীপে। কোন সে ব্যক্তি? যার জান-মাল কুরবান হয়ে যায় রবের আহ্বানে?তাদের ব্যাপারেই আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাহ ঘোষণা দিচ্ছেন-
مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ رِجَالٌ صَدَقُوۡا مَا عَاہَدُوا اللّٰہَ عَلَیۡہِ ۚ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ قَضٰی نَحۡبَہٗ وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّنۡتَظِرُ ۫ۖ وَ مَا بَدَّلُوۡا تَبۡدِیۡلًا ﴿ۙ۲۳﴾
মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাঁদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে; তাঁদের কেহ কেহ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেহ কেহ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তাঁরা তাঁদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি।[১]
তাঁদের অন্তরই রবের ভালোবাসায় ফিক ফিকিয়ে হাসে। তাঁদের মুষ্টিতেই রবের রবকত পূর্ণতা পায়। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে রবকে ডাকতে গিয়ে শিরশির ব্যথাও অনুভব করে না। মায়া বিজড়িত কান্নারও কেনো প্রয়োজন পড়ে না। অথচ শরীর কাফেরদের পাথরের আঘাতে ঝরঝরিত। অন্তর কুরাইশ বংশীয় মানুষ দ্বারা ক্ষতবিক্ষত। প্রিয় মানুষটির উপর তায়েফবাসীর লৌহমর্ষক নির্যাতনের কথা বলছিলাম। ঐদিন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ থেকে এ বাণী উচ্চারিত হয়েছিলো- এরা বুঝে না; এরা তো আমারই উম্মত! [২]
প্রিয় যুবক ভাই!
লক্ষ্য করে দেখ্যোন-তাঁর অন্তরে কোনো শূন্যতা ছিলো না বরং অন্তর ছিলো ইমানী আলোতে ভরপুর। মনে মনে কিছু পাওয়ার আশায় ছিলেন উচ্ছ্বাসিত। আর সে পাওয়াটাই হলো রবের পক্ষ হতে রুহানী শিশির ছোঁয়া। যার দরুন-শুষ্ক দিল প্রফুল্ল হয়ে উঠে, শরীর সাঁজ সাঁজ যিকিরে মত্ত হয়ে উঠে, অজানা সুখ শক্তির আম্ফালন ঘটে। তখন পাঁয়ে ছেঁড়া জুতা থাকুক আর দিনের কোনো এক অংশে পোড়া এক টুকরো রুটি মুখে পোড়ুক।
শত কষ্টের পরেও মুখের হাসি বলে দেয় সে খুব সুখী। অসংখ্য যাতনার বেষ্টনীতে থেকেও তার চাহনি বলে দেয় সে খুব দরদী। সুখের নদীতে এ সুখখানা খুবই মূল্যবান। ভাগ্যের জুড়িতে এমন ভাগ্যওয়ালা মানব গুটিকতক। তবে তা নিশ্চিত এ থেকে মুহাম্মাদের অস্ত্রধারী সৈনিকরা বঞ্চিত হবেন না। এটাও সঠিক এ থেকে মুহাম্মাদের ঝান্ডাবাহী ব্যক্তিরা আলাদা হবেন না। বরং সিজদায় উচ্চ প্রশংসায় লিপ্ত হবেন তবুও মাবুদ তোমার পরিবার ছাড়া করোনা![৩]
অন্তর যার প্রফুল্ল সে কোনো সালাত কায়েমে বিলম্ব কবরে? অন্তর যার ফকফকা সে কোনো জাকাত আদায়ে পিছপা হবে? অন্তর যার উর্বর সে কোনো জিহাদের ফরযিয়্যাত আদায়ে গড়িমসি করবে? না উল্টো এমন হওয়ার কথা ছিলো-বিজয় ছিনিয়ে এনে রাব্বে কারীমের শানে সিজদায় লুটিয়ে পড়বো। বিধান পালনার্থে শরয়ী খেলাফকারীদের গর্দানকে ছিন্ন করে দিবো। না পাবো কাউকে ভয় না হবো কারো সামনে নতজানু! প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য রব আর উচ্ছ্বাসিত হওয়া দরকার গোলামের।
অন্তর যার মৃদুময় হাসে তার জবানে এ কথা কোনোদিন আসবে না, আমি অতি নগন্য বিধান কায়েমের ক্ষেত্রে, আমি তুচ্ছ, দুবল অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পড়তে। আমার আকল বুঝে না তিক্ততার পর যে মিঠা আছে। আমার জাসাদ জানে না কষ্টের পর যে ইসতিরাহাত আছে। আমার কলব ধরতে পারেনা নেকের মাঝে যে ভারি লাজ্জাত আছে। বিপদ আসলে রবের প্রতি ঝোঁকার কথা! তাতো হচ্ছে না। যুবক ভাই এই তো তোমার সমস্যা?
তাহলে দেখ্যো- রবের প্রতি সালেহ আলাইহিস সালামের দৃষ্টিভঙ্গি অথচ কত বড় বিপদে না তিনি পড়ে গিয়েছিলেন, কণা পরিমাণ অভিযোগ তুলেন নি বরং তিনি বলছেন-إِنَّ رَبّي قَرِيْبُٗ مُجِيبُٗ নিশ্চয় আমার রব অতিদ্রুত সাড়াদানকারী। বিপদের মাঝেও তিনি রবের প্রশংসায় উচ্ছ্বাসিত হয়েছেন। কারণ ঐযে বললাম-তাঁদের হৃদয়কোণে কোনো শূন্যতা নেই। বিপদে স্থির থেকে রবকে স্বরণ করতে পারা আর আরামে আয়েশে তাঁর শুকরগুজার বান্দা হতে পারা তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। আর এসব লোকদেরই হৃদয়তন্ত্রী সদাসর্বদা হাসোজ্জল থাকে। নবী সালেহ আলাইহিস সালামের কথার এ আবেদন এটাই সুস্পষ্ট হয়ে যায়।[৪]
নবী শুআইব আলাইহিস সালামের ঘটনা জানেনা এমন কজন আছেন? তিনি কাতরোক্তি সময়ে এসে বলেই ফেললন-إِنَّ رَبِّيْ رَحِِيْم وَدُوْدُ নিশ্চয় আমার রব চিরদয়ালু ও বান্দার প্রতি সদয়বান। নিজ চিন্তাকে তিনি প্রাধান্য না দিয়ে রবের দিকে রুজু হয়ে গিয়েছেন। রবের প্রশংসায় উচ্ছ্বাসিত হয়ে প্রবৃত্তির খারাপি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। অধিক কল্যাণ কামনার্থে তিনি যা করেছেন তা বান্দা হিসেবে অতি প্রশংসার যোগ্য।[৫]
অপরদিকে নুহ আলাইহিস সালাল কিশতী তৈরি কাজ শেষ করে যখন বিসমিল্লাহ বলে তাঁর অনুস্বারীদের কিশতীতে উঠার জন্য বললেন তখন তিনি তাঁর রবের প্রতি শুকরিয়া জানাতে ভুলে যাননি। সবার সামনে প্রাণ খুলে মন উজাড় করে বললেন-اِنَّ رَبِّیۡ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল ও অতি দয়াবান। সুতরাং তোমরা তাতে আরোহণ করতে কোনো ভয় নেই। কোনো শঙ্কা নেই। আরোহণ করো, নিরাপত্তার বিধান তিনিই আমাদের দেবেন।[৬]
নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা-মাতাকে নিজ সিংহাসনে বসালেন এবং তাঁর ভায়েরা সবাই তাঁর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়লো। তিনি বললেন- হে আমার পিতা! এটাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা; আমার রব ওটা সত্যে পরিণত করেছেন এবং তিনি আমাকে কারাগার হতে মুক্ত করেছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি আরো,, ইউসুফ আলাইহিস সালাম পুরো কথাটা টেনে এনেছেনই মূলত সত্যটা জানিয়ে রবের প্রশংসায় সবাইকে উচ্ছ্বাসিত করতে। ؕ اِنَّ رَبِّیۡ لَطِیۡفٌ لِّمَا یَشَآءُ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَکِیۡمُ নিশ্চয় আমার রব যা ইচ্ছা করেন তা নিপুণতার সাথে করে থাকেন, তিনি তো সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।[৭]
নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে যখন রবের পক্ষ থেকে সুসংবাদ বাণী শুনতে পেলেন তখন আনন্দের আতিশয্যে বলেই ফেললেন-
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡ وَہَبَ لِیۡ عَلَی الۡکِبَرِ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِسۡحٰقَ اِنَّ رَبِّیۡ لَسَمِیۡعُ الدُّعَآءِ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের, যিনি বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব বান্দার প্রার্থনা শুনে থাকেন। আবার এই ব্যক্তিটিই যখন রবের পক্ষ হতে অগ্নি পরীক্ষায় নিপেতিত হলেন তখন কতটা নমনীয় ও রবের প্রশংসায় উচ্ছ্বাসিত হয়েছিলেন তা তুমি সীরাতগ্রন্থ থেকে একটু চোখ বুলিয়ে নিও।[৮]
আল্লাহ তা'আলা নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামকে কত কিছুই না দান করে ছিলেন। রাজত্ব, বাক-স্বাধীনতা, মোজেজা, এমন বিশেষ কিছু নেয়ামত। এরই মাঝে আবার আমার রব তাঁর রাজত্ব ফিরিয়ে নিয়ে তাঁকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন এবং তিনি স্বসম্মানে উত্তির্ণও হয়েছেন।
পরিশেষে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন فَإِنَّ رَبِّيْ غَنِيُٗ كَرِيْمُٗ নিশ্চয় আমার রবই প্রকৃত ধনী ও মহান সত্তা। নবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম রবের প্রশংসায় পূর্ণমাত্রায় উচ্ছ্বাসিত হয়েছেন।[৯]
প্রিয় যুবক ভাই!
তোমার কাছে আচনক মনে হচ্ছে, রবের প্রতি তাঁদের উচ্ছ্বাসিত হওয়ার ধরনগুলো দেখে! তাঁদের বিপদগুলো কেমন ছিলো? পরীক্ষার মান কতটুকু ওজনওয়ালা ছিলো এ প্রশ্ন কি মনে একবারও জাগে না? হ্যা ভাই জাগে, তবে তা নিরীক্ষণের দৃষ্টিতে না। তাঁদের গল্পগুলো পড়ে ত্যাগের পন্থাগুলো দেখে সামান্য সরলরেখায় মজে গেলোও পরক্ষণে ভুলে যাই, আমি যে তাঁদেরই পথের পথিক।
একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন! তাঁদের কেউ কিন্তু একবারও বলেনি, ওগো রব! কেন তুমি আমাকে এত বড় বিপদে ফেলেছো! ওগো প্রভু! কেন তুমি আমাদের জন্য এ বিধান নাজিল করেছো!হে রাব্বে কারীম! কেন তুমি আমার উম্মাহকে ধ্বংস করে দিয়েছো! আমি নিছকই একা, আমার উম্মাহ নেহাত দুর্বল। বরং হয়েছে কি? সবকিছু আনুগত্যের সাথে মেনে নিয়ে রবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সন্তুষ্টির পরীক্ষায় বড় সফলতা অর্জন করেছেন। এর কারণ হলো-তাঁদের অন্তরগুলো ছিলো ইমানী সুভাসে সুশোভিত। স্রষ্টার আনুগত্যের বারিধারায় পরিপূর্ণ যার দরুন বিপদের আলিঙ্গন আর সুখের শমসায় তাঁদের আচরণ ছিলো একেবারে নমনীয় ও সাবলীলতার উচ্চাঙ্গে।
বিপদে ধৈর্য্য ধারণ করে রবের প্রতি উচ্ছ্বাসিত হতে পারাটা পরীক্ষার মানদন্ডে সফল হতে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ। সুতরাং ক্ষণিকের এ জীবনে সামান্য এ সবরটুকু মুফলীহুনদের পথে অগ্রগামী করতে এর ভূমিকা হতে পারে বিশাল। তাই ছোট বড় বিধানগুলোকে সুখ বানিয়ে নিজ অন্তরকে করে তুলো মানানসই। ইলমী মারকাযে, হাদীদের ময়দানে অন্তরকে বানিয়ে রাখো ভারসাম্যপূর্ণ। তখন দুনিয়ার সকল জঞ্জাল তোমার দ্বীনি কতৃত্বের কাছে ঝুঁকে বসবে। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবে নিশ্চয় আমার রব মহাপরাক্রমশালী ও অতিদয়ালু।
তথ্যসূত্র
______________________
১.সূরা আহযাব, আয়াত নং ২৩
২.সীরাত বিশ্বকোষ।
৩.সুখের দিনগুলো, রিসালা।
৪.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৫.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৬.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৭.বাচ্চু কা ইসলাম, ৮ম পর্ব
৮.ইতিহাস বিশ্বকোষ।