আমীরুল মুমিনীন শাইখ হিবাতুল্লাহ আখুন্দযাদাহ হাফিযাহুল্লাহ’র পক্ষ থেকে
আমীর-উমারা ও জিম্মাদারগণের প্রতি কিছু উপদেশ
পর্ব-১
আমীর-উমারা ও জিম্মাদারগণের প্রতি কিছু উপদেশ
পর্ব-১
(১) সৎ ও নেককার ব্যক্তিদের সান্নিধ্য গ্রহণ করুন!
নেতৃবৃন্দ ও জিম্মাদারগণের উচিৎ- উনারা নেককার ব্যক্তি ও উলামায়ে কেরামের সান্নিধ্যে থাকবেন। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন এবং তাদের থেকে উপদেশ গ্রহণ করবেন। এটাই অতীতের নেক আমীর ও জিম্মাদারগণের আদর্শ ছিল।
যখন হযরত ওমর ইবনু আব্দিল আযীয (রহ.) খলীফাতুল মুসলিমীন নির্বাচিত হলেন, তখন এ বিষয়ে ওয়ালিউল্লাহ সালিম ইবনু আব্দিল্লাহ, মুহাম্মাদ বিন কা’ব এবং রজা বিন হায়াত (রহ.) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে ডেকে আনালেন এবং তাদেরকে বললেন, আমি তো এই মহাপরীক্ষায় নিপতিত হয়ে গেলাম। আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন আমি কী করবো?
সালিম ইবনু আব্দিল্লাহ বললেন, ‘আপনি যদি এ গুরু দায়িত্বের জবাবদিহিতা হতে মুক্তি পেতে চান, তবে দুনিয়াতে আপনি এমন রোজা রাখুন; যার ইফতার হবে আপনার মৃত্যু।’ (অর্থাৎ আপনি আপনার দায়িত্বের ব্যাপারে মৃত্যু পর্যন্ত একজন রোজাদারের ন্যায় সতর্ক ও সজাগ থাকুন।)
মুহাম্মাদ বিন কা’ব আরজ করলেন, ‘আপনি যদি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে চান, তবে মুসলমানদের আমীরকে নিজের পিতৃতুল্য ভাবুন। যুবক ছেলেদেরকে নিজের ভাই ভাবুন এবং ছোট বাচ্চাদেরকে নিজের সন্তান ভাবুন।’
অর্থাৎ পিতৃতুল্যদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন, ভাইদের সঙ্গে সদাচার করুন এবং ছোটদেরকে স্নেহ করুন।
রজা বিন হায়াত আরজ করলেন, ‘যদি আপনি জগতের সবচেয়ে কঠিন দিনটি থেকে মুক্তি চান, তবে মুসলমানদের জন্য আপনি ঐ সমস্ত কাজই করুন, যা আপনি নিজের জন্য পছন্দ করেন এবং তাদের জন্য ঐ সমস্ত জিনিস অপছন্দ করুন, যা আপনি নিজের জন্য অপছন্দ করে থাকেন।’
একজন আমীরের জন্য এটা সমীচীন নয় যে, তিনি তার আত্মীয় স্বজনদের মধ্য হতে অনোপযুক্ত কোন ব্যক্তিকে জিম্মাদার বানিয়ে দিবেন। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঐ ব্যক্তি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না, যে স্বজনপ্রীতি করে জিম্মাদার কোন পদ তার অযোগ্য কোন আত্মীয়কে দিয়ে দেয়, অথচ এই পদের জন্য তার চেয়েও যোগ্য ব্যক্তি রয়েছে।
অন্য আরেক জায়গায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি কোন আমীর মুসলিমদের উপর এমন কোন ব্যক্তিকে চাপিয়ে দেন যে, তিনি জানেন তার চেয়েও যোগ্য ও কুরআন-সুন্নাহর প্রতি অধিক অনুগত ব্যক্তি রয়েছে, তবে সে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং সমস্ত মুসলমানের সাথে খিয়ানত করলো।
অনুরূপভাবে হযরত ওমর (রা.) বলেন,
যদি কোন ফাসিক ব্যক্তিকে কেউ তাঁর পাপাচারিতার ব্যাপারে অবগত থাকা সত্ত্বেও কোন কাজের দায়িত্ব প্রদান করে, তবে সেই নিয়োগকারী ব্যক্তিও ফাসিক বলে বিবেচিত হবে।
(২) গোপনীয়তা রক্ষা করুন!
আমীরগণের প্রতি কাম্য হলো- তাঁরা যেকোন গোপনীয়তা কঠিনভাবে রক্ষা করবেন।
হযরত কা'ব বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কখনো এমন হতো যে, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন, তখন লোকদেরকে সেই যুদ্ধের ব্যাপারে আসল তথ্য জানাতেন না। বরং অন্য কোন দিকের কথা বলতেন।
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা এজন্য করতেন যে, যাতে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে মুসলিম বাহিনীর চলাফেরা গোপন থাকে। এমন যেন না হয় যে, মুসলিম সৈনিকদের চলাফেরা থেকে শত্রুরা আঁচ করে ফেলতে পারে যে, তাঁরা কোথায় যাচ্ছে। ফলে আগে থেকেই দুশমনরা মুসলিম বাহিনীর ক্ষতি করতে রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকবে।
অতএব, এমন প্রতিটি কাজের তথ্য গোপন রাখা আবশ্যক, যা ফাঁস হলে মুসলিমদের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
ইমাম মাওয়ারদী (রহ.) থেকে বর্ণিত যে, হযরত আলী (রা.) বলেন, তোমাদের গোপন বিষয়ের নিরাপত্তা তোমাদেরই মুঠোয়।
তোমাদের কারো সামনে গোপনীয় কোন কথা যদি হঠাৎ বেরিয়ে যায় বা ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে তুমি সেই কথাটার হিফাজতকারী হয়ে যাবে। অর্থাৎ সেই গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে পরবর্তীতে যে ক্ষতির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব তুমি নিজেই গ্রহণ করবে।
মাওয়ারদী (রহ.) বলেন, গোপন বিষয়াদির হিফাজত করা সফলতার সবচে' বড় কারণ, অথবা কোন কাজ সর্বোত্তম পন্থায় সম্পন্ন করার (একমাত্র) উপায়।
ইবনু হিব্বান (রহ.) বলেন, যে নিজের গোপন বিষয়াদি সংরক্ষিত রাখতে পারে, তার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত হয় এবং সফলতা (অনেকটাই) সুনিশ্চিত হয়।
ওমর ইবনু আব্দিল আযীয (রহ.) বলেন, অন্তর হল গোপন বিষয়সমূহের পাত্র। ঠোঁট হল তালা এবং জবান হল চাবি। প্রত্যেক বান্দার জন্যই এটা ওয়াজিব যে, সে গোপন বিষয়সমূহ খুলে দেওয়ার চাবিটা হিফাজত করে রাখবে। অর্থাৎ নিজের জবান দ্বারা কোন গোপন বিষয় ফাঁস হয়ে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকবে।
মুজাহিদীনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিহিত রয়েছে গোপনীয়তাসমূহ হিফাজত করার মাঝে। এজন্য আমীরের উচিৎ, যাচাই-বাছাই করে এমন সাথীদের সাথে পরামর্শ করা, যারা গোপনীয়তার রক্ষা করতে পারে।
(৩)মুজাহিদীন ও শহীদদের পরিবারের প্রতি খেয়াল রাখুন!
আমীর ও জিম্মাদারগণের কর্তব্য যে, উনারা মুজাহিদ ভাইদের পরিবারের প্রয়োজনাদি পূরন করে দিবেন। বিশেষতঃ ঐ সকল সাথী ভাইদের স্ত্রী এবং এতীম সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখবেন, যারা দ্বীনের জন্য শাহাদাত বরণ করেছেন।
হযরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুজাহিদদের পরিবারস্থ নারীগণের 'হুরমত' তথা সম্মান আপন নিবাসে বসে থাকা ব্যক্তিদের জন্য তাদের নিজ মায়েদের 'হুরমত' সমতুল্য। জিহাদে না গিয়ে বসে থাকা কোন ব্যক্তি যদি কোন মুজাহিদের পরিবারকে দেখাশোনা করতে থাকে এবং পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত হয়, তাহলে কিয়ামতের দিন ওই খিয়ানতকারীকে সেই মুজাহিদের জন্য দাঁড় করানো হবে এবং ওই খিয়ানতকারীর আমলনামা থেকে যত ইচ্ছা নেকি সেই মুজাহিদ নিয়ে নিবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এক্ষেত্রে তোমরা কী মনে করো?”
মুজাহিদের স্ত্রীকে খারাপ নজরে দেখা বা তাঁর সম্পর্কে কুৎসা রটানো ঠিক তেমনই হারাম, যেমন আপন মায়ের ক্ষেত্রে হারাম।
উপরোক্ত হুরমত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- তাকে সম্মান করা, তাঁর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা, পবিত্রভাবে লেনদেন করা এবং তাঁর প্রয়োজনসমূহ পুরা করে দেয়া। এটা (জিহাদ ছেড়ে) পিছনে বসে থাকা ব্যক্তিদের জন্য তেমনই ওয়াজিব, যেমন নিজ মায়ের সম্মান করা তার জন্য ওয়াজিব। "فما ظنكم؟" তোমরা কী মনে করো? অর্থাৎ কী পরিমাণ নেকি সে তার আমলনামা থেকে নিয়ে নিবে? উদ্দেশ্য হল, তার যত নেকি আছে একে একে সবগুলো নেকি সে নিয়ে নিবে।
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, উল্লেখিত হাদীসটি এই কথার দলীল যে, মুজাহিদদের পরিবারস্থ নারীগণের সাথে খিয়ানত করা, অন্য সকল খিয়ানত হতে খুবই মারাত্মক। কেননা, অন্য সকল ক্ষেত্রে খিয়ানতকারীর উপর এমন শাস্তির ধমকি নেই যে, যার সাথে সে খিয়ানত করেছে; সে ওই খিয়ানতকারীর আমলনামা থেকে যত ইচ্ছা নেকি নিয়ে নিবে। বরং সেসব ক্ষেত্রে যতটুকু পরিমাণ খিয়ানত তার সাথে করা হয়েছে কেবল ততোটুকু নেকিই সে ওই খিয়ানতকারীর আমলনামা থেকে নিতে পারবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর যত ইচ্ছা ততোই সে ওই খিয়ানতকারীর আমলনামা থেকে নিয়ে নিতে পারবে।
(আমাদের দায়িত্ব তো কেবল স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া!)
সূত্র: নাওয়ায়ে গাজওয়ায়ে হিন্দ ম্যাগাজিন থেকে অনূদিত
অনুবাদক:
আবু দুজানা11, মেম্বার, দাওয়াহ ইলাল্লাহু ফোরাম
আইডি লিঙ্ক:https://82.221.139.217/member.php?4102-
অনুবাদক:
আবু দুজানা11, মেম্বার, দাওয়াহ ইলাল্লাহু ফোরাম
আইডি লিঙ্ক:https://82.221.139.217/member.php?4102-
Comment