বোন তোমার নারীত্বের আঁচল এত সুন্দর কেন?
১৫ তম পর্ব
প্রিয় বোন আমার!
নিখিল সৃষ্টির অবিনশ্বর নিয়ন্তা তাঁর সৃষ্টি জীবের মাঝে বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। তাঁর লীলাপূর্ণ বৈচিত্র্যময় জগতে দ্বিমুখী প্রয়োজনীয়তা মেটাবার জন্য দৈহিক ও মনন শক্তি দান করেছেন। কেউ কেউ তার এ শক্তির আলোতে বিদঘুটে অন্ধকার দূর করতে সক্ষম হয়। তবে বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়।সব জীবই যে তাঁর রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয় তা কিন্তু সঠিক নয় আবার যারা করতে পারে তারাও যে একেবারে পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারে তাও নয়। ঊপরীওয়ালার মানশায় তো থাকতে হবে। তাঁর হিকমার মাকসাদও তো বুঝতে হবে। তবেই সম্ভব বড় কিছু পাওয়ার যা অনতিক্রম্য অন্ধকারকে ছিন্ন করতে পারবে। অভেদ্য অবোধগম্য বিষয়কে সহজেই নিজের কপাটে আনতে পারবে।
আজ এমনই একজন মহীয়সী নারীর সৎ সাহস ও কৌশলী জীবনযাত্রা নিয়ে বিক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করবো যা আমাদের মা-বোনদের মেধা-মননকে দ্বীনি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সহায়ক হবে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন-নারীরা পৃথিবীর অর্ধেক আর বাকি অর্ধেকের জন্মও তারাই দেয়। ফলতঃ তারাই যেন পুরো পৃথিবী। বুঝতে আরো সহজ হবে যখন আমরা তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের গল্প, উম্মাহর সাথে তাঁদের দৈনিক খুনসুটি সম্পর্কে কিছু জানতে পারবো তখন আমাদের পথচলা অধিক আসান হবে।
তাছাড়া মহীয়সী নারীদের সুরভিত জীবনের মুহূর্তগুলোকে যখন আমরা সরল ভঙ্গিমায় জানতে চেষ্টা করবো তখন এমনি এমনি নিজ পরিবারে পুণ্যের জোয়ার উঠতে শুরু করবে। কিরণ বর্ণের গাঁথুনিতে বিকীর্ণ মালা স্বাগত জানাবে আগত প্রজন্মকে। তখন জাতির প্রজন্ম নারীরা মনে করবে সালাফ নারীরাই আমাদের বিশ্বস্ত শিক্ষাঙ্গন। নারী সাহাবীরাই আমাদের পবিত্রতার পথপ্রদর্শক। নেককার সালেহ নারীরাই দ্বীনি সৌন্দর্য রক্ষার আবরণ। আম্মাজান সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা আর ফাতেমা বিনতে আইয়্যাশরাই ময়দানে আমাদের জন্য জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
প্রিয় বোন আমার!
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাহ তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরসত্য আর হিদায়েতের দ্বীন দিয়ে উম্মাহর মাঝে পাঠিয়েছেন সতর্ককারী ও সুসংবাদাতা হিসেবে এবং নির্দেশ দিয়েছেন নিজ নিকট আত্মীয়দের মাধ্যমে এ দায়িত্বের সূচনা করতে তখন তিনি আব্দুল মুত্তালিবের সকল সন্তানকে একত্রিত করে বললেন-হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! ও আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা! যদি তোমাদের উপর আসমানী আযাব এসে পড়ে তা কিন্তু ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নেই। কোনো উপকারই আমি তোমাদের করতে পারবো না।[১]
তাদের সকলকে আহ্বান করলেন সত্য দ্বীনের পথে, বিশ্বাস স্থাপনের কথা বললেন এক আল্লাহর প্রতি, উৎসাহ দিলেন সত্য রিসালাতকে গ্রহণ করতে, তাদের মধ্য থেকে এগিয়ে এলেন কিছু মানুষ এ স্নিগ্ধ আলোর প্রতি। মাথা পেতে গ্রহণ করে নিলেন তাওহীদের এ অমূল্য বাণীকে আবার কেউ কেউ এ বার্তাকে প্রত্যাখ্যান করে রয়ে গেলো মিথ্যে অন্ধকারে। কিন্তু সাফিয়্যাহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব তাঁর তরুণ পুত্রকে নিয়ে শামিল হলেন স্নিগ্ধ আলোর মিছিলে। বিশ্বাসীদের সচল পথে। ফলে তাঁকেও ভোগ করতে হলো কুরাইশ নেতাদের চাপানো নির্যাতন, সীমাতিক্রম দুর্ভোগ আর বাড়াবাড়ির তিক্ত কষ্ট।
★আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথী-বর্গদের মদিনায় হিজরতের অনুমতি দান করেন। তখন এই মহীয়সী হাশেমী নারী মক্কায় তাঁর বহুমুখী গৌরব ও সুকীর্তির সকল স্মৃতি ফেলে রওয়ানা হন মদিনার অভিমুখে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে। অথচ তখন তাঁর জীবনের প্রায় অর্ধেকের চেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিলো। আর কিছু দিন পেরুলেই বুড়োদের সংখ্যা ছুই ছুই। কিন্তু তিনি নিজ অর্জন, পারিবারিক সম্মান, গোত্রীয় মর্যাদার পাত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শক্ত হাতে ধরলেন মুহাম্মাদের পবিত্র পাত্রকে। যাতে রাখা পবিত্রতার আবরণে ঢাকা রবের রেজামন্দি।
★বিশেষ করে এই মহীয়সী নারীর জিহাদের ময়দানে তাঁর এমন কিছু অবস্থান রয়েছে, ইতিহাস যার আলোচনা আজও অব্যাহত রেখেছে প্রশংসা ও মুগ্ধতায় পঞ্চমুখ হয়ে। এক হলো ওহুদের যুদ্ধে তাঁর অবস্থান, দ্বিতীয়ত খন্দকের যুদ্ধে তাঁর অবদান। তিনি মহিলাদের ছোট্ট একটি বাহিনী নিয়ে ওহুদ প্রান্তরে নিয়োজিত ছিলেন আহত ও তৃষ্ণার্ত মুজাহিদদের সেবাশুশ্রূষা করার জন্য। তাছাড়া অন্যান্য মহিলাদের দিয়ে তীর চেঁছে তীক্ষ্ণ করে দিতেন, ভাঙ্গা তলোয়ারগুলো মেরামতের প্রয়োজন হলে তাই করে দিতেন। ত্রুটিপূর্ণ ধনুকগুলো ব্যবহারযোগ্য করে তুলতেন। এভাবে ময়দানে একের পর এক সেবা করেই যাচ্ছিলেন।[২]
★উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা ছিলেন খুবই দৃঢ় চিত্তের একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী। জীবনে কখনও অধৈর্য হয়েছেন এমন কথা জানা যায় না। আল-কামূস দূর্গের পতন ঘটলে এবং গোটা খায়বারে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হলে হযরত বিলাল রাদিআল্লাহু আনহু সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা ও তাঁর চাচাতো বোনদের সঙ্গে করে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট যেতে থাকেন। ইহুদীদের লাশের পাশ দিয়েই তাঁরা চলছিলেন। সাধারণতঃ এরূপ পরিস্থিতি খুবই মর্মস্পর্শী হয়। অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষের অন্তরও কেঁপে ওঠে। এ কারণে তাঁর সাথের মহিলারাও এ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তাঁরা মাথার চুল ছিঁড়ে মাতম করতে থাকে। কিন্তু হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহার অবস্থা দেখুন, তিনি একটুও বিচলিত হননি। কোনো রকম ভাবান্তর নেই তাঁর। দৃঢ় পদক্ষেপে তিনি হেঁটেই চলেছেন।[৩]
★রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহার ভালোবাসা ছিলো অন্তহীন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার গৃহে অন্তিম রোগ শয্যায় তখন একদিন সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহাসহ অন্য বিবিগণ স্বামীকে দেখতে ও সেবা করতে একত্র হয়েছেন। হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা এক সময় অত্যন্ত ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলে ফেললেন-হে আল্লাহর রাসূল! আপনার এই সব কষ্ট যদি আমিই ভোগ করতাম, খুশী হতাম।তাঁর এমন কথা শুনে অন্যান্য বিবিগণ একে অপরের দিকে এমন ভাবে তাকাতে লাগলেন যেন, তাঁর কথায় তাঁরা সন্দেহ করছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে তাঁদেরকে বললেন- আল্লাহর কসম! আল্লাহর কসম! সে সত্য বলেছে।[৪]
★রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলে নারী ও শিশুদের সুরক্ষিত দুর্গে রেখে যাওয়া ছিলো তাঁর অভ্যাস। কেননা প্রহরীদের অবর্তমানে যেকোনো বিশ্বাসঘাতক তাঁদের উপর আক্রমণ করতে পারে। এদিকে যখন খন্দক যুদ্ধের সময় গনিয়ে এলো তখন তিনি নিজ স্ত্রীদের ও ফুফুদের রেখে গেলেন হাসসান বিনতে ছাবেত রাদিআল্লাহু আনহুর মিরাস সূত্রে প্রাপ্ত দুর্গে, আর এটিই ছিলো মদিনার সর্বাধিক সুরক্ষিত দুর্গ।[৫]
মুসলিম বাহিনী মদিনার কুরাইশ ও তার মিত্রদের মুখোমুখি অবস্থান করেছিলেন তাই নারী শিশুদের উপর আক্রমণ নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ ছিলো না। হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা ফজরের অন্ধকারে একটি ছায়ামূর্তির নড়াচড়া দেখতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার কাওমের কোনো গুপ্তচর দুর্গের রহস্য জানতে এসেছে। তাই তিনি সাথে সাথে লৌহদণ্ড নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন। সাথে থাকা ছুড়ি দিয়ে কল্লাটাকে আলাদা করে পাহাড়ের অপর পাশে অপেক্ষা করা তার বন্ধুদের নিকট নিক্ষেপ করলেন।
শত্রুরা এ অবস্থা দেখে তারা পরষ্পর(পরস্পর) বলাবলি করতে লাগলো-মুহাম্মাদ এমন ব্যক্তি নয় যে মহিলাদের প্রতিরক্ষা না দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। নিশ্চিতই আমরা জানতাম যে, তাঁর কৌশল খুবই সুক্ষ্ম(সূক্ষ্ম), না হয় এমন একজন নারী কি করে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ গোয়েন্দাকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়! আশ্চর্যবোধক এ চিহ্নের উত্তর নিজেদের মাঝে খোঁজতে খোঁজতে নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। এখানেও সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা বীরত্বগাঁথা এক ইতিহাস নারী জাতির জন্য আদর্শ হিসেবে রেখে গেলেন। নারী শুধু ঘরে নয় বরং ময়দানেও চৌকস। নারীর তেজস্বী শক্তির কাছে সময়ের পালাবদলে হার মেনে যায় কিছু অদ্ভুত ঘটনা, আর তার সাক্ষী হয়ে আছেন হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা।
প্রিয় বোন আমার!
যৌবনের উন্মত্ততা সত্ত্বেও যারা বেপরোয়া নয়, যারা ফিতনার কঠিন সময়েও নিজের চরিত্রকে হেফাযতের জন্য নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে, সমাজের, পাড়া-প্রতিবেশীর, পরিবারের হাজারো কটুকথা, নিন্দাকে গায়ে না মেখে যারা নিজেদের আবৃত করে রাখছে পর্দায়, সকলের তিরস্কার উপেক্ষা করে যে বোনেরা দ্বীনকে আঁকড়ে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পেটে ধারণ করা সন্তানকে রণাঙ্গনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বিয়ের প্রথম রাতেই পাকাপোক্ত করেছে। এই যে অন্তরের এই সমস্ত 'ভালো'-কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা কি মূল্যায়ন করবেন না? অবশ্যই করবেন৷ এসবের পেছনে বোনদের যে ত্যাগ আর সংগ্রাম, একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা এসবের বিনিময়ে তাঁদের অতি-অবশ্যই উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন।
বোন! আমিও চাই তুমি এ স্নিগ্ধ আলোর মিছিলে শামিল হও। উত্তম এ প্রতিদান তুমিও রবের কাছ থেকে নিজ হাতে নাও। ধন্য করো নিজেকে আর আদর্শ উপহার দাও আগত জাতিকে। তখন কুঁড়ে ঘরে বাস করেও সুখের আর অন্ত থাকবে না। সাড়া দেহে বিরাজমান করবে রবের পক্ষ হতে রহমতের ফল্গুধারা। যা ধারণ করে জীবনযাত্রাকে অগ্রগতি করেছিলো সালাফ মহীয়সী নারীরা। তুমিও এ পথের পথিক হও, একটু পীড়ন দহন সহ্য করে নিজেকে আম্মাজান সাফিয়্যার মত গড়ে তুলো।
তথ্যসমূহ
________________________________
[১] সীরাতুন নাবিয়্যীন ১খন্ড
[২] মহীয়সী নারীদের গল্প ৩য় পার্ট
[৩] ইতিহাস পাতা থেকে, পৃষ্ঠা নং ৪৭
[৪] ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃষ্ঠা নং ৫৯
[৫] গাযওয়াতুর রাসূল সা. পৃষ্ঠা নং ১৮৮
১৫ তম পর্ব
প্রিয় বোন আমার!
নিখিল সৃষ্টির অবিনশ্বর নিয়ন্তা তাঁর সৃষ্টি জীবের মাঝে বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। তাঁর লীলাপূর্ণ বৈচিত্র্যময় জগতে দ্বিমুখী প্রয়োজনীয়তা মেটাবার জন্য দৈহিক ও মনন শক্তি দান করেছেন। কেউ কেউ তার এ শক্তির আলোতে বিদঘুটে অন্ধকার দূর করতে সক্ষম হয়। তবে বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়।সব জীবই যে তাঁর রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয় তা কিন্তু সঠিক নয় আবার যারা করতে পারে তারাও যে একেবারে পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারে তাও নয়। ঊপরীওয়ালার মানশায় তো থাকতে হবে। তাঁর হিকমার মাকসাদও তো বুঝতে হবে। তবেই সম্ভব বড় কিছু পাওয়ার যা অনতিক্রম্য অন্ধকারকে ছিন্ন করতে পারবে। অভেদ্য অবোধগম্য বিষয়কে সহজেই নিজের কপাটে আনতে পারবে।
আজ এমনই একজন মহীয়সী নারীর সৎ সাহস ও কৌশলী জীবনযাত্রা নিয়ে বিক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করবো যা আমাদের মা-বোনদের মেধা-মননকে দ্বীনি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সহায়ক হবে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন-নারীরা পৃথিবীর অর্ধেক আর বাকি অর্ধেকের জন্মও তারাই দেয়। ফলতঃ তারাই যেন পুরো পৃথিবী। বুঝতে আরো সহজ হবে যখন আমরা তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের গল্প, উম্মাহর সাথে তাঁদের দৈনিক খুনসুটি সম্পর্কে কিছু জানতে পারবো তখন আমাদের পথচলা অধিক আসান হবে।
তাছাড়া মহীয়সী নারীদের সুরভিত জীবনের মুহূর্তগুলোকে যখন আমরা সরল ভঙ্গিমায় জানতে চেষ্টা করবো তখন এমনি এমনি নিজ পরিবারে পুণ্যের জোয়ার উঠতে শুরু করবে। কিরণ বর্ণের গাঁথুনিতে বিকীর্ণ মালা স্বাগত জানাবে আগত প্রজন্মকে। তখন জাতির প্রজন্ম নারীরা মনে করবে সালাফ নারীরাই আমাদের বিশ্বস্ত শিক্ষাঙ্গন। নারী সাহাবীরাই আমাদের পবিত্রতার পথপ্রদর্শক। নেককার সালেহ নারীরাই দ্বীনি সৌন্দর্য রক্ষার আবরণ। আম্মাজান সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা আর ফাতেমা বিনতে আইয়্যাশরাই ময়দানে আমাদের জন্য জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
প্রিয় বোন আমার!
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাহ তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরসত্য আর হিদায়েতের দ্বীন দিয়ে উম্মাহর মাঝে পাঠিয়েছেন সতর্ককারী ও সুসংবাদাতা হিসেবে এবং নির্দেশ দিয়েছেন নিজ নিকট আত্মীয়দের মাধ্যমে এ দায়িত্বের সূচনা করতে তখন তিনি আব্দুল মুত্তালিবের সকল সন্তানকে একত্রিত করে বললেন-হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! ও আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানেরা! যদি তোমাদের উপর আসমানী আযাব এসে পড়ে তা কিন্তু ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নেই। কোনো উপকারই আমি তোমাদের করতে পারবো না।[১]
তাদের সকলকে আহ্বান করলেন সত্য দ্বীনের পথে, বিশ্বাস স্থাপনের কথা বললেন এক আল্লাহর প্রতি, উৎসাহ দিলেন সত্য রিসালাতকে গ্রহণ করতে, তাদের মধ্য থেকে এগিয়ে এলেন কিছু মানুষ এ স্নিগ্ধ আলোর প্রতি। মাথা পেতে গ্রহণ করে নিলেন তাওহীদের এ অমূল্য বাণীকে আবার কেউ কেউ এ বার্তাকে প্রত্যাখ্যান করে রয়ে গেলো মিথ্যে অন্ধকারে। কিন্তু সাফিয়্যাহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব তাঁর তরুণ পুত্রকে নিয়ে শামিল হলেন স্নিগ্ধ আলোর মিছিলে। বিশ্বাসীদের সচল পথে। ফলে তাঁকেও ভোগ করতে হলো কুরাইশ নেতাদের চাপানো নির্যাতন, সীমাতিক্রম দুর্ভোগ আর বাড়াবাড়ির তিক্ত কষ্ট।
★আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথী-বর্গদের মদিনায় হিজরতের অনুমতি দান করেন। তখন এই মহীয়সী হাশেমী নারী মক্কায় তাঁর বহুমুখী গৌরব ও সুকীর্তির সকল স্মৃতি ফেলে রওয়ানা হন মদিনার অভিমুখে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে। অথচ তখন তাঁর জীবনের প্রায় অর্ধেকের চেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিলো। আর কিছু দিন পেরুলেই বুড়োদের সংখ্যা ছুই ছুই। কিন্তু তিনি নিজ অর্জন, পারিবারিক সম্মান, গোত্রীয় মর্যাদার পাত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শক্ত হাতে ধরলেন মুহাম্মাদের পবিত্র পাত্রকে। যাতে রাখা পবিত্রতার আবরণে ঢাকা রবের রেজামন্দি।
★বিশেষ করে এই মহীয়সী নারীর জিহাদের ময়দানে তাঁর এমন কিছু অবস্থান রয়েছে, ইতিহাস যার আলোচনা আজও অব্যাহত রেখেছে প্রশংসা ও মুগ্ধতায় পঞ্চমুখ হয়ে। এক হলো ওহুদের যুদ্ধে তাঁর অবস্থান, দ্বিতীয়ত খন্দকের যুদ্ধে তাঁর অবদান। তিনি মহিলাদের ছোট্ট একটি বাহিনী নিয়ে ওহুদ প্রান্তরে নিয়োজিত ছিলেন আহত ও তৃষ্ণার্ত মুজাহিদদের সেবাশুশ্রূষা করার জন্য। তাছাড়া অন্যান্য মহিলাদের দিয়ে তীর চেঁছে তীক্ষ্ণ করে দিতেন, ভাঙ্গা তলোয়ারগুলো মেরামতের প্রয়োজন হলে তাই করে দিতেন। ত্রুটিপূর্ণ ধনুকগুলো ব্যবহারযোগ্য করে তুলতেন। এভাবে ময়দানে একের পর এক সেবা করেই যাচ্ছিলেন।[২]
★উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা ছিলেন খুবই দৃঢ় চিত্তের একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী। জীবনে কখনও অধৈর্য হয়েছেন এমন কথা জানা যায় না। আল-কামূস দূর্গের পতন ঘটলে এবং গোটা খায়বারে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হলে হযরত বিলাল রাদিআল্লাহু আনহু সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা ও তাঁর চাচাতো বোনদের সঙ্গে করে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট যেতে থাকেন। ইহুদীদের লাশের পাশ দিয়েই তাঁরা চলছিলেন। সাধারণতঃ এরূপ পরিস্থিতি খুবই মর্মস্পর্শী হয়। অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষের অন্তরও কেঁপে ওঠে। এ কারণে তাঁর সাথের মহিলারাও এ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তাঁরা মাথার চুল ছিঁড়ে মাতম করতে থাকে। কিন্তু হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহার অবস্থা দেখুন, তিনি একটুও বিচলিত হননি। কোনো রকম ভাবান্তর নেই তাঁর। দৃঢ় পদক্ষেপে তিনি হেঁটেই চলেছেন।[৩]
★রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহার ভালোবাসা ছিলো অন্তহীন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার গৃহে অন্তিম রোগ শয্যায় তখন একদিন সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহাসহ অন্য বিবিগণ স্বামীকে দেখতে ও সেবা করতে একত্র হয়েছেন। হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা এক সময় অত্যন্ত ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলে ফেললেন-হে আল্লাহর রাসূল! আপনার এই সব কষ্ট যদি আমিই ভোগ করতাম, খুশী হতাম।তাঁর এমন কথা শুনে অন্যান্য বিবিগণ একে অপরের দিকে এমন ভাবে তাকাতে লাগলেন যেন, তাঁর কথায় তাঁরা সন্দেহ করছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সাথে তাঁদেরকে বললেন- আল্লাহর কসম! আল্লাহর কসম! সে সত্য বলেছে।[৪]
★রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলে নারী ও শিশুদের সুরক্ষিত দুর্গে রেখে যাওয়া ছিলো তাঁর অভ্যাস। কেননা প্রহরীদের অবর্তমানে যেকোনো বিশ্বাসঘাতক তাঁদের উপর আক্রমণ করতে পারে। এদিকে যখন খন্দক যুদ্ধের সময় গনিয়ে এলো তখন তিনি নিজ স্ত্রীদের ও ফুফুদের রেখে গেলেন হাসসান বিনতে ছাবেত রাদিআল্লাহু আনহুর মিরাস সূত্রে প্রাপ্ত দুর্গে, আর এটিই ছিলো মদিনার সর্বাধিক সুরক্ষিত দুর্গ।[৫]
মুসলিম বাহিনী মদিনার কুরাইশ ও তার মিত্রদের মুখোমুখি অবস্থান করেছিলেন তাই নারী শিশুদের উপর আক্রমণ নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ ছিলো না। হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা ফজরের অন্ধকারে একটি ছায়ামূর্তির নড়াচড়া দেখতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার কাওমের কোনো গুপ্তচর দুর্গের রহস্য জানতে এসেছে। তাই তিনি সাথে সাথে লৌহদণ্ড নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন। সাথে থাকা ছুড়ি দিয়ে কল্লাটাকে আলাদা করে পাহাড়ের অপর পাশে অপেক্ষা করা তার বন্ধুদের নিকট নিক্ষেপ করলেন।
শত্রুরা এ অবস্থা দেখে তারা পরষ্পর(পরস্পর) বলাবলি করতে লাগলো-মুহাম্মাদ এমন ব্যক্তি নয় যে মহিলাদের প্রতিরক্ষা না দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। নিশ্চিতই আমরা জানতাম যে, তাঁর কৌশল খুবই সুক্ষ্ম(সূক্ষ্ম), না হয় এমন একজন নারী কি করে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ গোয়েন্দাকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়! আশ্চর্যবোধক এ চিহ্নের উত্তর নিজেদের মাঝে খোঁজতে খোঁজতে নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। এখানেও সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা বীরত্বগাঁথা এক ইতিহাস নারী জাতির জন্য আদর্শ হিসেবে রেখে গেলেন। নারী শুধু ঘরে নয় বরং ময়দানেও চৌকস। নারীর তেজস্বী শক্তির কাছে সময়ের পালাবদলে হার মেনে যায় কিছু অদ্ভুত ঘটনা, আর তার সাক্ষী হয়ে আছেন হযরত সাফিয়্যাহ রাদিআল্লাহু আনহা।
প্রিয় বোন আমার!
যৌবনের উন্মত্ততা সত্ত্বেও যারা বেপরোয়া নয়, যারা ফিতনার কঠিন সময়েও নিজের চরিত্রকে হেফাযতের জন্য নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে, সমাজের, পাড়া-প্রতিবেশীর, পরিবারের হাজারো কটুকথা, নিন্দাকে গায়ে না মেখে যারা নিজেদের আবৃত করে রাখছে পর্দায়, সকলের তিরস্কার উপেক্ষা করে যে বোনেরা দ্বীনকে আঁকড়ে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পেটে ধারণ করা সন্তানকে রণাঙ্গনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বিয়ের প্রথম রাতেই পাকাপোক্ত করেছে। এই যে অন্তরের এই সমস্ত 'ভালো'-কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা কি মূল্যায়ন করবেন না? অবশ্যই করবেন৷ এসবের পেছনে বোনদের যে ত্যাগ আর সংগ্রাম, একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা এসবের বিনিময়ে তাঁদের অতি-অবশ্যই উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন।
বোন! আমিও চাই তুমি এ স্নিগ্ধ আলোর মিছিলে শামিল হও। উত্তম এ প্রতিদান তুমিও রবের কাছ থেকে নিজ হাতে নাও। ধন্য করো নিজেকে আর আদর্শ উপহার দাও আগত জাতিকে। তখন কুঁড়ে ঘরে বাস করেও সুখের আর অন্ত থাকবে না। সাড়া দেহে বিরাজমান করবে রবের পক্ষ হতে রহমতের ফল্গুধারা। যা ধারণ করে জীবনযাত্রাকে অগ্রগতি করেছিলো সালাফ মহীয়সী নারীরা। তুমিও এ পথের পথিক হও, একটু পীড়ন দহন সহ্য করে নিজেকে আম্মাজান সাফিয়্যার মত গড়ে তুলো।
তথ্যসমূহ
________________________________
[১] সীরাতুন নাবিয়্যীন ১খন্ড
[২] মহীয়সী নারীদের গল্প ৩য় পার্ট
[৩] ইতিহাস পাতা থেকে, পৃষ্ঠা নং ৪৭
[৪] ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃষ্ঠা নং ৫৯
[৫] গাযওয়াতুর রাসূল সা. পৃষ্ঠা নং ১৮৮
Comment