একটি স্মরণীয় বাসরগল্প :
বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী যুগল প্রথম রাতে একত্রিত হয়, এটাকেই বাসর রাত বলে। মানবজীবনের এক কাক্সিক্ষত ও স্মরণীয় মধুময় রজনী এটি। রাত বাড়ার সাথে সাথে দু’জনের হৃদকম্পন ও ¯œায়ুচাপ বাড়তে থাকে দ্রুত গতিতে। সুনসান ও পিনপতন নিরবতা ভেঙে দু’জনে অনাগত ভবিষ্যতের গল্পে মেতে ওঠে। কিন্তু এ আনন্দঘন মুহূর্তে এবং সুখ-সাগরে সাঁতরানোর পূর্বক্ষণেও অনেকে জৈবিক ও মানবীয় লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ওঠে নিজের ঈমানি চেতনা এবং ধর্মীয়বোধ ও বিশ্বাসকে সমুন্নত করে তোলেন। এমনই একজন মহামানবের বাসর রাতের গল্প দিয়ে সংক্ষিপ্ত এ প্রবন্ধের ইতি টানব।
উপমহাদেশ স্বাধীকার আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা, ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্রভূমি দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাও. কাসেম নানুতবি রহ. দেওবন্দ শহরে বিয়ে করেন। মিরাঠের একটি কুতুবখানায় সম্পাদনার কাজ করতেন তিনি। কর্মক্ষেত্র মিরাঠে জীবনের বড় একটি অংশ কাটালেও শ্বশুরবাড়ি দেওবেন্দ আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত। এ সূত্রধরেই দেওবন্দের মাটির সাথে তাঁর পরিচয় এবং দেওবন্দ নামক ছোট্ট শহরেই প্রজ্জ্বলিত করেন ঈমানের মশাল। যা তাকে পরবর্তীতে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে এবং কিংবদন্তির মর্যাদা এনে দিয়েছে। সে যাক, এবার আমরা হযরতের মুহ্তারামা জীবনসঙ্গিনীর জবানিতে বাসর রাতের গল্প শুনব। তিনি বলেন :
“আমার পিতা শায়খ কারামত হাসান সাহেব দেওবন্দের সর্দার ও নেতা ছিলেন। আমাকে হযরতের সাথে বিয়ে দিয়ে বিদায় জানানোর প্রাক্কালে সেসময়ের তুলনায় অনেক মালামাল, জিনিসপত্র ও উপহারসামগ্রী দিলেন। দামি গহনা ও অলংকার, মূল্যবান কাপড়চোপড় ও তামানির্মিত হাড়ি-পাতিলসহ আরো অনেক আজনাপাতি ছিল। ফুলশয্যার রাতে হযরত বাসরঘরে প্রবেশ করে নফল নামায পড়লেন। নামায পড়াশেষে আমার কাছে এসে অত্যন্ত ভদ্রতা, ন¤্রতা, গাম্ভীর্যতা ও দৃঢ়তার সাথে বললেন, দেখ! আল্লাহ তাআলা যেহেতু আমাদেরকে একসাথে করে দিয়েছেন তাই পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমতাবিধান অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অত্যন্ত কঠিন। কারণ, তুমি ধনী ও বিত্তশালী; আর আমি গরিব ও সম্পদহীন। এখন পদ্ধতি দু’টিই, হয়তো আমিও তোমার ন্যায় ধনী হয়ে যাব কিংবা তুমি আমার মতো গরিব হয়ে যাবে। আর আমার ধনী হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ ও সুদূরপরাহত। এজন্য সহজ পদ্ধতি দ্বিতীয়টি-ই যে, তুমি আমার মতো গরিব হয়ে যাবে। এ ধরনের আরো কথাবার্তা বললেন। অবশেষে বললেন, তোমাকে যদি এমন কাজের নিদের্শ দিইÑ যাতে তোমারই উপকার রয়েছে, তা কি তুমি পালন করবে? এ ব্যাপারে কি আমার ওপর তোমার আস্থা ও ভরসা রয়েছে? আমি বললাম, আপনার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা ও শতভাগ ভরসা রয়েছে। একথা শুনে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং আমাকে বললেন, আচ্ছা! তবে তোমার গহনা খুলে আামকে দিয়ে দাও; আর তোমার সমস্ত মালামালের ব্যাপারে আমাকে অধিকার দিয়ে দাওÑ আমি যা ইচ্ছে তাই করব। আমি কোনো চিন্তা-ভাবনা ও সন্দেহ-সংশয় ব্যতীত বললাম, এ ব্যাপারে আপনার পূর্ণ অধিকার আছে; আমি আপনাকে আমার সমুদয় মালমালের মালিক বানিয়ে দিলাম।
সকাল বেলা তিনি হাজার হাজার টাকার সমস্ত গহনা, কাপড়চোপড় ও মালামাল সুলতানি চান্দায় দান করে দিলেন (সেসময় তুরস্কের ইসলামি খেলাফতের জন্য হিন্দুস্তানে কালেকশন করা হচ্ছিল)।
এর কিছুদিন পর আমি প্রথম দেওবন্দ আসলাম। আমার হাত-পা ও কান খালি দেখে আমার পিতা জিজ্ঞেস করলেন, গহনা কোথায়? আমি পুরো ঘটনা আব্বাকে বলে দিলাম। শায়খ কারামত হাসান সাহেব মুখ দিয়ে কিছু বললেন না। তবে ভাবলেন, আমার মেয়ে আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর সামনে খালি হাত-পায়ে থাকবে, এটা কেমন দেখা যায়। তাই তিনি বাজারে গিয়ে আবার নতুনকরে অলংকার বানিয়ে আনলেন। এ নতুন অলংকার ও গহনাঘাটিসহ শ্বশুরবাড়ি ফিরলাম। রাতের বেলায় হযরত ঘরে তাশরিফ আনলেন। আমার সাথে দুনিয়াবিমুখতা ও আখেরাতের আলোচনা শুরু করলেন এবং একপর্যায়ে আমার অলংকার নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি বললাম, এ অধিকার তো আপনাকে আমি বাসর রাতেই দিয়েছিলাম, তা ফেরত নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না; যা দিয়েছি তা আর কোনোদিন ফেরত নিব না। সকালবেলা তিনি সব অলংকার পূর্বের মতো সুলতানি চাঁদায় দিয়ে দেন।
হযরতের স্ত্রী প্রায় বলতেন, এ ঘটনার পর আমার অন্তর থেকে অর্থকড়ি ও গহনাঘাটির ভালোবাসা এবং চাহিদা সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায়। এসবের প্রতি একধরনের ঘৃণা সৃষ্টি হয়। অতঃপর পুরো জীবন কাটিয়ে দিলাম কিন্তু আর কোনো অলংকার পরিনি, দামি কাপড় গায়ে জড়াইনি। এমনকি এগুলো নেওয়ার কোনো খাহেশ ও ইচ্ছাও পয়দা হয়নি।”
প্রিয় পাঠক! স্বামীর আদেশের সামনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার এমন নায্যারা এবং কুরবানির এমন নজ্রানা কোথায় পাওয়া যায়, বলুন? স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি মহিয়সী এ নারীর গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় মাও. আহমদ রহ., আর মাও. আহমদের ঔরসেই জন্ম নেয় দারুল উলুমের দ্বিতীয় রূপকার, দেওবন্দি মাসলাকের মুখপাত্র, কাসেমে সানি, হাকিমুল ইসলাম হযরত মাও. কারি মুহাম্মদ তৈয়্যব সাহেব রহ.। যিনি দীর্ঘ ষাট বছর দারুল উলুমের মুহতামিম ছিলেন এবং এ প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন; যার সামনে জামিআ আযহারের খ্যাতি ম্লান হয়ে যায়।
বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী যুগল প্রথম রাতে একত্রিত হয়, এটাকেই বাসর রাত বলে। মানবজীবনের এক কাক্সিক্ষত ও স্মরণীয় মধুময় রজনী এটি। রাত বাড়ার সাথে সাথে দু’জনের হৃদকম্পন ও ¯œায়ুচাপ বাড়তে থাকে দ্রুত গতিতে। সুনসান ও পিনপতন নিরবতা ভেঙে দু’জনে অনাগত ভবিষ্যতের গল্পে মেতে ওঠে। কিন্তু এ আনন্দঘন মুহূর্তে এবং সুখ-সাগরে সাঁতরানোর পূর্বক্ষণেও অনেকে জৈবিক ও মানবীয় লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ওঠে নিজের ঈমানি চেতনা এবং ধর্মীয়বোধ ও বিশ্বাসকে সমুন্নত করে তোলেন। এমনই একজন মহামানবের বাসর রাতের গল্প দিয়ে সংক্ষিপ্ত এ প্রবন্ধের ইতি টানব।
উপমহাদেশ স্বাধীকার আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা, ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্রভূমি দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাও. কাসেম নানুতবি রহ. দেওবন্দ শহরে বিয়ে করেন। মিরাঠের একটি কুতুবখানায় সম্পাদনার কাজ করতেন তিনি। কর্মক্ষেত্র মিরাঠে জীবনের বড় একটি অংশ কাটালেও শ্বশুরবাড়ি দেওবেন্দ আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত। এ সূত্রধরেই দেওবন্দের মাটির সাথে তাঁর পরিচয় এবং দেওবন্দ নামক ছোট্ট শহরেই প্রজ্জ্বলিত করেন ঈমানের মশাল। যা তাকে পরবর্তীতে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে এবং কিংবদন্তির মর্যাদা এনে দিয়েছে। সে যাক, এবার আমরা হযরতের মুহ্তারামা জীবনসঙ্গিনীর জবানিতে বাসর রাতের গল্প শুনব। তিনি বলেন :
“আমার পিতা শায়খ কারামত হাসান সাহেব দেওবন্দের সর্দার ও নেতা ছিলেন। আমাকে হযরতের সাথে বিয়ে দিয়ে বিদায় জানানোর প্রাক্কালে সেসময়ের তুলনায় অনেক মালামাল, জিনিসপত্র ও উপহারসামগ্রী দিলেন। দামি গহনা ও অলংকার, মূল্যবান কাপড়চোপড় ও তামানির্মিত হাড়ি-পাতিলসহ আরো অনেক আজনাপাতি ছিল। ফুলশয্যার রাতে হযরত বাসরঘরে প্রবেশ করে নফল নামায পড়লেন। নামায পড়াশেষে আমার কাছে এসে অত্যন্ত ভদ্রতা, ন¤্রতা, গাম্ভীর্যতা ও দৃঢ়তার সাথে বললেন, দেখ! আল্লাহ তাআলা যেহেতু আমাদেরকে একসাথে করে দিয়েছেন তাই পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমতাবিধান অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অত্যন্ত কঠিন। কারণ, তুমি ধনী ও বিত্তশালী; আর আমি গরিব ও সম্পদহীন। এখন পদ্ধতি দু’টিই, হয়তো আমিও তোমার ন্যায় ধনী হয়ে যাব কিংবা তুমি আমার মতো গরিব হয়ে যাবে। আর আমার ধনী হওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ ও সুদূরপরাহত। এজন্য সহজ পদ্ধতি দ্বিতীয়টি-ই যে, তুমি আমার মতো গরিব হয়ে যাবে। এ ধরনের আরো কথাবার্তা বললেন। অবশেষে বললেন, তোমাকে যদি এমন কাজের নিদের্শ দিইÑ যাতে তোমারই উপকার রয়েছে, তা কি তুমি পালন করবে? এ ব্যাপারে কি আমার ওপর তোমার আস্থা ও ভরসা রয়েছে? আমি বললাম, আপনার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা ও শতভাগ ভরসা রয়েছে। একথা শুনে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং আমাকে বললেন, আচ্ছা! তবে তোমার গহনা খুলে আামকে দিয়ে দাও; আর তোমার সমস্ত মালামালের ব্যাপারে আমাকে অধিকার দিয়ে দাওÑ আমি যা ইচ্ছে তাই করব। আমি কোনো চিন্তা-ভাবনা ও সন্দেহ-সংশয় ব্যতীত বললাম, এ ব্যাপারে আপনার পূর্ণ অধিকার আছে; আমি আপনাকে আমার সমুদয় মালমালের মালিক বানিয়ে দিলাম।
সকাল বেলা তিনি হাজার হাজার টাকার সমস্ত গহনা, কাপড়চোপড় ও মালামাল সুলতানি চান্দায় দান করে দিলেন (সেসময় তুরস্কের ইসলামি খেলাফতের জন্য হিন্দুস্তানে কালেকশন করা হচ্ছিল)।
এর কিছুদিন পর আমি প্রথম দেওবন্দ আসলাম। আমার হাত-পা ও কান খালি দেখে আমার পিতা জিজ্ঞেস করলেন, গহনা কোথায়? আমি পুরো ঘটনা আব্বাকে বলে দিলাম। শায়খ কারামত হাসান সাহেব মুখ দিয়ে কিছু বললেন না। তবে ভাবলেন, আমার মেয়ে আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর সামনে খালি হাত-পায়ে থাকবে, এটা কেমন দেখা যায়। তাই তিনি বাজারে গিয়ে আবার নতুনকরে অলংকার বানিয়ে আনলেন। এ নতুন অলংকার ও গহনাঘাটিসহ শ্বশুরবাড়ি ফিরলাম। রাতের বেলায় হযরত ঘরে তাশরিফ আনলেন। আমার সাথে দুনিয়াবিমুখতা ও আখেরাতের আলোচনা শুরু করলেন এবং একপর্যায়ে আমার অলংকার নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি বললাম, এ অধিকার তো আপনাকে আমি বাসর রাতেই দিয়েছিলাম, তা ফেরত নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না; যা দিয়েছি তা আর কোনোদিন ফেরত নিব না। সকালবেলা তিনি সব অলংকার পূর্বের মতো সুলতানি চাঁদায় দিয়ে দেন।
হযরতের স্ত্রী প্রায় বলতেন, এ ঘটনার পর আমার অন্তর থেকে অর্থকড়ি ও গহনাঘাটির ভালোবাসা এবং চাহিদা সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায়। এসবের প্রতি একধরনের ঘৃণা সৃষ্টি হয়। অতঃপর পুরো জীবন কাটিয়ে দিলাম কিন্তু আর কোনো অলংকার পরিনি, দামি কাপড় গায়ে জড়াইনি। এমনকি এগুলো নেওয়ার কোনো খাহেশ ও ইচ্ছাও পয়দা হয়নি।”
প্রিয় পাঠক! স্বামীর আদেশের সামনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার এমন নায্যারা এবং কুরবানির এমন নজ্রানা কোথায় পাওয়া যায়, বলুন? স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি মহিয়সী এ নারীর গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় মাও. আহমদ রহ., আর মাও. আহমদের ঔরসেই জন্ম নেয় দারুল উলুমের দ্বিতীয় রূপকার, দেওবন্দি মাসলাকের মুখপাত্র, কাসেমে সানি, হাকিমুল ইসলাম হযরত মাও. কারি মুহাম্মদ তৈয়্যব সাহেব রহ.। যিনি দীর্ঘ ষাট বছর দারুল উলুমের মুহতামিম ছিলেন এবং এ প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন; যার সামনে জামিআ আযহারের খ্যাতি ম্লান হয়ে যায়।
Comment