কিছুদিন আগে বিমানবন্দর গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, এক আত্মীয় বিদেশ থেকে আসবেন তাকে এগিয়ে আনা। বড় ভালো মানুষ, দ্বীনদার, সাদাসিধা মানুষ। বাড়িতে ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী-পরিজন থাকলেও সংসারের দায়ে সুদুর কুয়েতে পাড়ি দিতে হয়েছে। নিজের দুই ছেলেই ছোট হওয়ায় বাড়িতে আসার সময় আমাকেই বিমানবন্দরে থাকতে বলেছেন, যাতে তার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে পারি।
যথাসময়ে বিমান অবতরণ করল, সাক্ষাৎ হল, কথা হল, একে অপরের খোঁজ খবর নিলাম। এরই মধ্যে আমাকে হাদিয়াও দিলেন। একটি রুমাল ও একটি আতর, মূল্যবান হাদিয়া। অতপর বাড়ি যাওয়ার ফিকির। তিনি সায়েদাবাদ আসবেন তাই একটি ছোট গাড়ির প্রয়োজন। বেশ কয়েকজন চালকের সাথে কথা বললেন। তাদের যে চাওয়া, তাতে আমরা সম্মত হতে পারলাম না। আর তিনি যেহেতু হালাল উপার্জন করেন এবং রোজগারের পরিমাণও প্রচুর নয়, তাই অন্য দশজন বিদেশ প্রবাসীর মত চোখবুজে অর্থ ব্যয় বা নষ্টও করেন না। অবশেষে একজন চালক আমাদের কথামত রাজী হলেন। চালক বললেন, আসলে এই ভাড়ায় কাউকে নিই না, শুধু আপনারা যেহেতু ‘হুযুর মানুষ’ তাই রাজী হলাম। যাইহোক আমরা গাড়িতে চড়লাম, গাড়ি চলতে শুরু করল।
কুয়েতের খবরাখবর এবং নিজ দেশের খবরাখবর নিয়েই আমাদের কথাবার্তা চলছিল। একপর্যায়ে আমার হাতে রাখা তার দেয়া রুমালটির দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি রুমালটি মাথায় দিয়ে রাখতেন তাহলে সম্ভবত চালক আমাদের থেকে ভাড়া আরো কম নিত।
আরব দেশে আরবী রুমালের সম্মান আলাদা। যারা এ রুমাল পরিধান করেন তাদেরকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। বিশেষভাবে যদি শ্মশ্রæমণ্ডিত দ্বীনদার হন। অনেক ক্ষেত্রেই অন্যরা তাদেরকে সম্মান করে, অফিস আদালত বাজার-ঘাট গাড়ি ইত্যাদিতে তাদের থেকে অন্যের তুলনায় খয়খরচা কিছুটা কম নেয়ার চেষ্টা করে। সে প্রচলন হিসেবেই তিনি আমাকে এ কথাটি বললেন। তবে কোনো লৌকিকতা নিয়ে নয়, অত্যন্ত সাদাসিধা খোলামনে, নির্লিপ্তভাবে। উত্তরে আমি তাকে কিছু বললাম না। তবে মনে একটি উদ্বেগ তৈরী হল। এতে ইতিবাচক দিকটিতো স্পষ্ট। দ্বীনের সাধারণ চর্চা থাকায় ওখানকার সাধারণ মানুষের মাঝেও দ্বীনের গুরুত্ব ও দ্বীনদারদের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়টি হল, সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্য দ্বীনদারীর সূরত গ্রহণ করলে তো সব বরবাদ।
আমাদের সালাফ এ বিষয়ে কত সংবেদনশীল ছিলেন তা বিভিন্ন ঘটনা থেকে বোঝা যায়।
সম্ভবত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর কিতাবুয যুহদ-এ পড়েছি, এক ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে, ধ্যানমগ্ন হয়ে, যেন আল্লাহ তাকে দেখছেন এমন হালত নিয়ে তাওয়াফ করছে। এক লোক তা লক্ষ করল এবং ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করতে থাকল যখন ঐ ব্যক্তির তাওয়াফ শেষ হল তখন এক থলে দিরহাম তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এত সুন্দর তাওয়াফ আপনার। এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া। তাওয়াফের লোকটি থলেটি নিয়ে এমনভাবে ছুড়ে ফেললেন, থলে ছিঁড়ে দিরহামগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল এবং বললেন, আমি কি আমার তাওয়াফ বিক্রি করে দিব?
শামের বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহায়রীয, যেমন তিনি ইলমের ক্ষেত্রে ছিলেন বিদগ্ধ পÐিত তেমনি ছিলেন ইবাদত-বন্দেগীতে। তিনি একদিন এক দোকানে গেলেন কাপড় কিনতে। তখন এক ব্যক্তি দোকানীকে বলল, ভাই! ইনি ইবনে মুহায়রীয, তাঁর সাথে সুন্দরভাবে বেচা-কেনা কর। অর্থাৎ দাম কিছু কমিয়ে ধর। কথাটি শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহায়রীয রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং দ্রæত দোকান ত্যাগ করতে করতে বললেন,
إنما جئنا لنشتري بدراهمنا، ليس بديننا .
‘আমি তো আমার দিরহাম দিয়েই ক্রয় করতে এসেছি, দ্বীন দিয়ে নয়।’ Ñকিতাবুয যুহ্দ, আহমাদ ইবনে হাম্বল, পৃ. ৩০৯ (২২৪২)
কাকরাইল মসজিদের মাওলানা রবীউল হক দামাত বারাকাতুহুম প্রায় সময় হেদায়েতী বয়ানে উপমা দিয়ে বলেন, ভাই, আমীর সাহেবের দাম দুই টাকা। কীভাবে? আমীর সাহেব কোনো কিছু কিনতে দোকানে যান, জিনিসটার দাম দশ টাকা হলে দোকানদার বলে, আমীর সাহেব সবার কাছে দশ টাকায় বিক্রি করি আপনি দুইটাকা কম দেন। আপনি আট টাকা দিলে হবে।
চিন্তা করলে দেখা যায়, আমরা কতভাবে আমাদের নেক কাজ ও আখেরাতের আমলগুলো দুনিয়ার জন্য ব্যবহার করি।
ইবাদত-বন্দেগী ঠিকই করছি তবে মন চায় মানুষ তা দেখুক এবং তা প্রচার হোক। তাই লোকচক্ষুর আড়ালের ইবাদত আর জনসমক্ষের ইবাদত এক হয় না। বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ করি অথবা দ্বীনী কাজ করি, উদ্দেশ্য থাকে, আমি পরিচিত হই প্রসিদ্ধ হই, সবাই আমাকে চিনুক, জানুক। একজনের খামোখা প্রশংসা করছি যা বাস্তবে আমার দিলে নেই, যাতে সে আমাকে তার ভক্ত অনুরক্ত মনে করে আমার প্রতি খুশি থাকে। সময়মত আমার তার প্রয়োজন পড়তে পারে। যাকে বাংলায় চাটুকারিতা বলে।
মোটকথা, চিন্তা করলে এমন অনেক কাজ পাওয়া যাবে, যা দ্বীন ও আখেরাতের বিষয়, কিন্তু উদ্দেশ্য হল দুনিয়া; তথা অর্থ কড়ি, নাম, প্রসিদ্ধি, অন্যের সন্তুষ্টি অথবা অন্য কোনো ধরনের স্বার্থ। আর বলতে গেলে এসবের সর্বনিকৃষ্ট হলো আখেরাতে কাজ দিয়ে মূল্যহীন দুনিয়া কামাই করা।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী রাহ. বলেন,
إن أقبح الرعية، أن يطلب الدنيا بعمل الآخرة.
এমনিই তো কুরআন হাদীসে শিরক, রিয়া, নাম, প্রসিদ্ধি, লোক দেখানো, দ্বীন দিয়ে দুনিয়া কামাই ইত্যাদির খুবই নিন্দা এসেছে। সেগুলো ভালো কাজ নয়Ñ এই ইলম তো সবারই আছে। কিন্তু এ কাজগুলো এমন সূ²ভাবে আমাদের কাজে-কর্মে ও নিয়তে প্রবেশ করে যে, আমরা বুঝতেই পারি না, আমি অমুকটিতে লিপ্ত। আর বাহ্যতও তা দ্বীনী আমল হওয়াতে এর আড়ালে যে অন্য কিছু থাকতে পারে, আমার হিতাকাক্সক্ষী কেউ সহজে তা অনুমান করতে পারে না। ফলে কেউ আমাকে শুধরে দিতেও পারে না। তবে একথা তো সকলের কাছে পরিষ্কার যে, এমনটি হলে আখেরাতে এসব কাজের সামান্যতম প্রতিদান পাওয়া যাবে না। সাথে সাথে এসব কাজ করার অর্থ আল্লাহর কাজ দিয়ে অন্যের সন্তুষ্টি চাওয়া, যা শিরকের নামান্তর অথবা আল্লাহর কাজ দিয়ে দুনিয়া কামাই করা যা চরম হীন ও ঘৃণ্য।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ‘আবরার’গণের (নেককার মুমিনদের) বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
وَيُطْعِمُونَ الطَّعامَ عَلى حُبِّهِ مِسْكِيناً وَيَتِيماً وَأَسِيراً، إِنَّما نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزاءً وَلا شُكُوراً.
(তরজমা) ‘এবং তাঁরা খাবারের চাহিদা সত্তে¡ও তা মিসকীন, ইয়াতীম, বন্দিদের খাওয়ায়। আর বলে, আমরা তো একমাত্র আল্লাহর জন্য খাওয়াই। তোমাদের থেকে না আমরা কোনো বিনিময় চাই, না কৃতজ্ঞতা। Ñসূরা দাহর (৭৬) : ৮,৯
মূলত মুমিনগণ একথা মুখে বলেননি, তাদের অন্তরের আবেগ, অনুধাবন এমনই ছিল। এবং সেভাবেই আল্লাহ তাআলা বিষয়টি তুলে ধরেছেন। প্রখ্যাত মুফাসসির মুজাহিদ এবং সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন, আসলে তারা তা মুখে বলেননি, তবে আল্লাহ তাআলা বিষয়টি তাদের অন্তর (ও কর্ম) থেকে বুঝেছেন, তাই এ বিষয়ে তাদের প্রশংসা করেছেন, যেন কোনো উৎসাহী উৎসাহ লাভ করে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৮/২৮৯)
এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে লক্ষ করা দরকার। আমরা কাউকে কোনো কিছু দিলে বা কোনো উপকার করলে মনে মনে তার প্রতি দাবি রাখি, সে আমার কল্যাণকামী হবে, আমাকে হাদিয়া দিবে, অন্তত পরবর্তীতে আমার উপকার করবে। আমার উপকারের কথা মানুষকে বলবে, কমপক্ষে আমার নিকট স্বীকার করবে ও ছোট হয়ে থাকবে এবং আমাকে সর্বদা ধন্যবাদ দিবে। তাই যদি কখনো সে আমাকে কষ্ট দেয় আমি তখন খোটা দিয়ে বসি। তোমার না আমি এই এই উপকার করেছি?! তেমনিভাবে কোনো লোক আমার উপকার গ্রহণ করে যদি ধন্যবাদ না দেয় তখন আমরা বলতে শুরু করি, এত কিছু করলাম একটু ধন্যবাদও দিল না! কিন্তু ভেবে দেখা দরকার এ আয়াত আমাদেরকে কী বলে?! কুরআন মাজীদে আম্বিয়া কেরামের দাওয়াতের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা যাদের কথাই বলেছেন
একটি কথা মোটামুটি সবার ব্যাপারেই উল্লেখ করেছেন। তা হল, তারা প্রত্যেকে স্বগোত্রকে বলেছেন,
يا قَوْمِ لا أَسْئَلُكُمْ عَلَيْهِ مَالا إِنْ أَجرِيَ إِلاَّ عَلَى اللَّهِ.
আমি )এ আহ্বানের জন্য( তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান আল্লাহ দিবেন। Ñসূরা হুদ (১১) : ২৯
মুফাসসিরীনে কেরাম লিখেন أجر শব্দটি নাকিরা (অনির্দিষ্ট)। অর্থাৎ যে কোনো ধরনের প্রতিদান, ছোট হোক বা বড়। অর্থ হোক বা যশ-খ্যাতি, প্রসিদ্ধি-সম্মান কিংবা যে কোনো ধরনের সেবা বা চাওয়া-পাওয়া। এই ছিল আম্বিয়ায়ে কেরামের ইখলাস ও অন্তরের হালত।
যদিও অনুগ্রহ গ্রহণকারীর কর্তব্য, ‘জাযাকাল্লাহু খাইরান’ বলা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
প্রখ্যাত সাহাবী আবু মাসউদ রা. এক ব্যক্তির কোনো এক প্রয়োজন নিয়ে শাসকের সাথে কথা বললেন, এবং শাসক তা পূর্ণ করে দিলেন। যখন তিনি ঘরে ফিরলেন, দেখলেন তার জন্য কেউ একটি হাঁস ও একটি মুরগী পাঠিয়েছে। ঘরের লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারা ঐ লোকটির নাম বলল, যার প্রয়োজন নিয়ে তিনি শাসকের কাছে গিয়েছিলেন। তখন তিনি বললেন, এগুলো বের করে দাও। আমি কি আমার সুপারিশের বিনিময় দুনিয়াতেই নিয়ে নিবো। Ñকিতাবুয যুহদ, আহমাদ ইবনে হাম্বল, পৃ.২৩৫
রবী ইবনে সবীহ্ বলেন, আমরা একদিন হাসান বসরীর নিকট ছিলাম, তিনি আমাদেরকে ওয়াজ করলেন। হঠাৎ এক লোক ওয়াযের প্রভাবে চিৎকার করে উঠল, তখন হাসান বসরী তাকে বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তোমাকে এ চিৎকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, এর দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য কী ছিল। Ñকিতাবুয যুহুদ, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, পৃ.২১৯
সাহাবী আবু উমামা রা. একদিন মসজিদে এসে দেখেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে এবং সেজদায়ে গিয়ে খুব কাঁদছে ও দুআ করছে। তখন আবু উমামা রা. লোকটিকে বললেন, ‘তুমি তুমিই (অর্থাৎ তোমার এসব সত্য) এমনটি যদি তুমি ঘরেও করে থাক।’ Ñপ্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫
ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাহ. বলেন,
لم يصدق الله عز و جل من أحب الشهرة.
যে )নেক কাজ করে) প্রসিদ্ধি কামনা করে সে আল্লাহর সাথে সত্যবাদী নয়। Ñপ্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৯
হযরত লুকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘হে বৎস! তুমি মানুষদেরকে এমনটি দেখাবে না যে, তুমি (ইবাদাত বন্দেগী করে) আল্লাহকে ভয় করছো, যেন তারা তোমাকে সম্মান করে, অথচ তোমার অন্তর নাফরমান। Ñপ্রাগুক্ত
আব্দুস সামাদ ইবনে আলী মদীনার গভর্নর থাকাকালীন এক ব্যক্তি তার কাছে এসে একটি বিষয়ে কথা বলল। তা শুনে তিনি তাকে বললেন, মনে হচ্ছে তুমি রিয়াকারী (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এমনটি বলছ)। তখন লোকটি যমিন থেকে একটি কাঠি বা এ জাতীয় কিছু হাতে নিয়ে বললেন, আমি আমার আমল কাকে দেখাবো? আল্লাহর শপথ আমার নিকট সকল মানুষ এ কাঠি থেকেও তুচ্ছ (অর্থাৎ আল্লাহর তুলনায়)। Ñসিফাতুস সাফওয়াহ ২/৪৩৩
যাইহোক, রিয়া বিষয়টি যেমন বিস্তৃত তেমন সূ²ও। অনেক ক্ষেত্রে তো আমরা বুঝে শুনে ইচ্ছা করেই এমন করি বা অনেক কিছু আমাদের সমাজের নিয়মেও পরিণত হয়ে গিয়েছে। আবার অনেক সময় আমাদের আমলের মাঝে রিয়া এত সূ²ভাবে প্রবেশ করে, নিজেরাও ধরতে পারি না। এ থেকে বাঁচার জন্য করণীয় হল, বেশি বেশি ইখলাসের মুযাকারা করা, প্রত্যেক কাজে নিয়তের মুহাসাবা করা। আর বিষয়টি বাস্তবেও সুকঠিন।
আল্লাহর কাজ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য করা আল্লাহর নিকট শিরক এবং অসহনীয়। হাদীসে এসেছে, যে অন্যকে দেখানোর জন্য নামায পড়ল সে শিরক করল, যে অন্যকে দেখানোর জন্য রোযা রাখল সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য দান করল সে শিরক করল। Ñমুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী, হাদীস ১২১৬
একজন সুস্থ বিবেকবান মানুষের নিকটও তা নিতান্তই অপসন্দনীয় ও ঘৃণিত কাজ। এবং এটা অযৌক্তিকও বটে। আমি যাকে উদ্দেশ্য করে কাজটি করছি সে কে? আল্লাহর সামনে সে কতটুকু? মাটির নিচে তার সন্তুষ্টি আমার কী কাজে আসবে?
দ্বীনের ধারক-বাহকগণ বিষয়টি কত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।
হযরত ইয়াইয়া ইবনে আবী কাছীর বলেন, তোমরা নিয়ত শেখ। কেননা তা আমল থেকেও বেশি কার্যকরি। Ñজামিউল উলূম ওয়াল হিকাম পৃ. ২৬
হযরত সুফিয়ান সাওরী রাহ. বলেন, আমি নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে যত কঠিন সাধনা করেছি অন্য কোনো কিছুর ক্ষেত্রে এমন সাধনা করিনি। কেননা যতবারই আমি নিয়ত ঠিক করি, নিয়্যত আমার বিপরীতে চলে আসতে চায়। Ñপ্রাগুক্ত
হযরত ইউসুফ ইবনে আসবাত রাহ. বলেন, নিয়তকে রিয়ামুক্ত ও বিশুদ্ধ করা দীর্ঘ মুজাহাদা ও ইবাদাত-বন্দেগী করা থেকেও অনেক কঠিন। Ñপ্রাগুক্ত
আল্লাহ তাআলা সকলকে ইখলাস নসীব করুন। রিয়া থেকে হেফাজত করুন। প্রতিটি কাজ যেন একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য করতে পারি সে তাওফিক দান করুন।
সুত্রঃ আল-কাওসার
যথাসময়ে বিমান অবতরণ করল, সাক্ষাৎ হল, কথা হল, একে অপরের খোঁজ খবর নিলাম। এরই মধ্যে আমাকে হাদিয়াও দিলেন। একটি রুমাল ও একটি আতর, মূল্যবান হাদিয়া। অতপর বাড়ি যাওয়ার ফিকির। তিনি সায়েদাবাদ আসবেন তাই একটি ছোট গাড়ির প্রয়োজন। বেশ কয়েকজন চালকের সাথে কথা বললেন। তাদের যে চাওয়া, তাতে আমরা সম্মত হতে পারলাম না। আর তিনি যেহেতু হালাল উপার্জন করেন এবং রোজগারের পরিমাণও প্রচুর নয়, তাই অন্য দশজন বিদেশ প্রবাসীর মত চোখবুজে অর্থ ব্যয় বা নষ্টও করেন না। অবশেষে একজন চালক আমাদের কথামত রাজী হলেন। চালক বললেন, আসলে এই ভাড়ায় কাউকে নিই না, শুধু আপনারা যেহেতু ‘হুযুর মানুষ’ তাই রাজী হলাম। যাইহোক আমরা গাড়িতে চড়লাম, গাড়ি চলতে শুরু করল।
কুয়েতের খবরাখবর এবং নিজ দেশের খবরাখবর নিয়েই আমাদের কথাবার্তা চলছিল। একপর্যায়ে আমার হাতে রাখা তার দেয়া রুমালটির দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি রুমালটি মাথায় দিয়ে রাখতেন তাহলে সম্ভবত চালক আমাদের থেকে ভাড়া আরো কম নিত।
আরব দেশে আরবী রুমালের সম্মান আলাদা। যারা এ রুমাল পরিধান করেন তাদেরকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। বিশেষভাবে যদি শ্মশ্রæমণ্ডিত দ্বীনদার হন। অনেক ক্ষেত্রেই অন্যরা তাদেরকে সম্মান করে, অফিস আদালত বাজার-ঘাট গাড়ি ইত্যাদিতে তাদের থেকে অন্যের তুলনায় খয়খরচা কিছুটা কম নেয়ার চেষ্টা করে। সে প্রচলন হিসেবেই তিনি আমাকে এ কথাটি বললেন। তবে কোনো লৌকিকতা নিয়ে নয়, অত্যন্ত সাদাসিধা খোলামনে, নির্লিপ্তভাবে। উত্তরে আমি তাকে কিছু বললাম না। তবে মনে একটি উদ্বেগ তৈরী হল। এতে ইতিবাচক দিকটিতো স্পষ্ট। দ্বীনের সাধারণ চর্চা থাকায় ওখানকার সাধারণ মানুষের মাঝেও দ্বীনের গুরুত্ব ও দ্বীনদারদের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়টি হল, সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্য দ্বীনদারীর সূরত গ্রহণ করলে তো সব বরবাদ।
আমাদের সালাফ এ বিষয়ে কত সংবেদনশীল ছিলেন তা বিভিন্ন ঘটনা থেকে বোঝা যায়।
সম্ভবত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর কিতাবুয যুহদ-এ পড়েছি, এক ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে, ধ্যানমগ্ন হয়ে, যেন আল্লাহ তাকে দেখছেন এমন হালত নিয়ে তাওয়াফ করছে। এক লোক তা লক্ষ করল এবং ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করতে থাকল যখন ঐ ব্যক্তির তাওয়াফ শেষ হল তখন এক থলে দিরহাম তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এত সুন্দর তাওয়াফ আপনার। এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া। তাওয়াফের লোকটি থলেটি নিয়ে এমনভাবে ছুড়ে ফেললেন, থলে ছিঁড়ে দিরহামগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল এবং বললেন, আমি কি আমার তাওয়াফ বিক্রি করে দিব?
শামের বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহায়রীয, যেমন তিনি ইলমের ক্ষেত্রে ছিলেন বিদগ্ধ পÐিত তেমনি ছিলেন ইবাদত-বন্দেগীতে। তিনি একদিন এক দোকানে গেলেন কাপড় কিনতে। তখন এক ব্যক্তি দোকানীকে বলল, ভাই! ইনি ইবনে মুহায়রীয, তাঁর সাথে সুন্দরভাবে বেচা-কেনা কর। অর্থাৎ দাম কিছু কমিয়ে ধর। কথাটি শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহায়রীয রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং দ্রæত দোকান ত্যাগ করতে করতে বললেন,
إنما جئنا لنشتري بدراهمنا، ليس بديننا .
‘আমি তো আমার দিরহাম দিয়েই ক্রয় করতে এসেছি, দ্বীন দিয়ে নয়।’ Ñকিতাবুয যুহ্দ, আহমাদ ইবনে হাম্বল, পৃ. ৩০৯ (২২৪২)
কাকরাইল মসজিদের মাওলানা রবীউল হক দামাত বারাকাতুহুম প্রায় সময় হেদায়েতী বয়ানে উপমা দিয়ে বলেন, ভাই, আমীর সাহেবের দাম দুই টাকা। কীভাবে? আমীর সাহেব কোনো কিছু কিনতে দোকানে যান, জিনিসটার দাম দশ টাকা হলে দোকানদার বলে, আমীর সাহেব সবার কাছে দশ টাকায় বিক্রি করি আপনি দুইটাকা কম দেন। আপনি আট টাকা দিলে হবে।
চিন্তা করলে দেখা যায়, আমরা কতভাবে আমাদের নেক কাজ ও আখেরাতের আমলগুলো দুনিয়ার জন্য ব্যবহার করি।
ইবাদত-বন্দেগী ঠিকই করছি তবে মন চায় মানুষ তা দেখুক এবং তা প্রচার হোক। তাই লোকচক্ষুর আড়ালের ইবাদত আর জনসমক্ষের ইবাদত এক হয় না। বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ করি অথবা দ্বীনী কাজ করি, উদ্দেশ্য থাকে, আমি পরিচিত হই প্রসিদ্ধ হই, সবাই আমাকে চিনুক, জানুক। একজনের খামোখা প্রশংসা করছি যা বাস্তবে আমার দিলে নেই, যাতে সে আমাকে তার ভক্ত অনুরক্ত মনে করে আমার প্রতি খুশি থাকে। সময়মত আমার তার প্রয়োজন পড়তে পারে। যাকে বাংলায় চাটুকারিতা বলে।
মোটকথা, চিন্তা করলে এমন অনেক কাজ পাওয়া যাবে, যা দ্বীন ও আখেরাতের বিষয়, কিন্তু উদ্দেশ্য হল দুনিয়া; তথা অর্থ কড়ি, নাম, প্রসিদ্ধি, অন্যের সন্তুষ্টি অথবা অন্য কোনো ধরনের স্বার্থ। আর বলতে গেলে এসবের সর্বনিকৃষ্ট হলো আখেরাতে কাজ দিয়ে মূল্যহীন দুনিয়া কামাই করা।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী রাহ. বলেন,
إن أقبح الرعية، أن يطلب الدنيا بعمل الآخرة.
এমনিই তো কুরআন হাদীসে শিরক, রিয়া, নাম, প্রসিদ্ধি, লোক দেখানো, দ্বীন দিয়ে দুনিয়া কামাই ইত্যাদির খুবই নিন্দা এসেছে। সেগুলো ভালো কাজ নয়Ñ এই ইলম তো সবারই আছে। কিন্তু এ কাজগুলো এমন সূ²ভাবে আমাদের কাজে-কর্মে ও নিয়তে প্রবেশ করে যে, আমরা বুঝতেই পারি না, আমি অমুকটিতে লিপ্ত। আর বাহ্যতও তা দ্বীনী আমল হওয়াতে এর আড়ালে যে অন্য কিছু থাকতে পারে, আমার হিতাকাক্সক্ষী কেউ সহজে তা অনুমান করতে পারে না। ফলে কেউ আমাকে শুধরে দিতেও পারে না। তবে একথা তো সকলের কাছে পরিষ্কার যে, এমনটি হলে আখেরাতে এসব কাজের সামান্যতম প্রতিদান পাওয়া যাবে না। সাথে সাথে এসব কাজ করার অর্থ আল্লাহর কাজ দিয়ে অন্যের সন্তুষ্টি চাওয়া, যা শিরকের নামান্তর অথবা আল্লাহর কাজ দিয়ে দুনিয়া কামাই করা যা চরম হীন ও ঘৃণ্য।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ‘আবরার’গণের (নেককার মুমিনদের) বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
وَيُطْعِمُونَ الطَّعامَ عَلى حُبِّهِ مِسْكِيناً وَيَتِيماً وَأَسِيراً، إِنَّما نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزاءً وَلا شُكُوراً.
(তরজমা) ‘এবং তাঁরা খাবারের চাহিদা সত্তে¡ও তা মিসকীন, ইয়াতীম, বন্দিদের খাওয়ায়। আর বলে, আমরা তো একমাত্র আল্লাহর জন্য খাওয়াই। তোমাদের থেকে না আমরা কোনো বিনিময় চাই, না কৃতজ্ঞতা। Ñসূরা দাহর (৭৬) : ৮,৯
মূলত মুমিনগণ একথা মুখে বলেননি, তাদের অন্তরের আবেগ, অনুধাবন এমনই ছিল। এবং সেভাবেই আল্লাহ তাআলা বিষয়টি তুলে ধরেছেন। প্রখ্যাত মুফাসসির মুজাহিদ এবং সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন, আসলে তারা তা মুখে বলেননি, তবে আল্লাহ তাআলা বিষয়টি তাদের অন্তর (ও কর্ম) থেকে বুঝেছেন, তাই এ বিষয়ে তাদের প্রশংসা করেছেন, যেন কোনো উৎসাহী উৎসাহ লাভ করে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৮/২৮৯)
এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে লক্ষ করা দরকার। আমরা কাউকে কোনো কিছু দিলে বা কোনো উপকার করলে মনে মনে তার প্রতি দাবি রাখি, সে আমার কল্যাণকামী হবে, আমাকে হাদিয়া দিবে, অন্তত পরবর্তীতে আমার উপকার করবে। আমার উপকারের কথা মানুষকে বলবে, কমপক্ষে আমার নিকট স্বীকার করবে ও ছোট হয়ে থাকবে এবং আমাকে সর্বদা ধন্যবাদ দিবে। তাই যদি কখনো সে আমাকে কষ্ট দেয় আমি তখন খোটা দিয়ে বসি। তোমার না আমি এই এই উপকার করেছি?! তেমনিভাবে কোনো লোক আমার উপকার গ্রহণ করে যদি ধন্যবাদ না দেয় তখন আমরা বলতে শুরু করি, এত কিছু করলাম একটু ধন্যবাদও দিল না! কিন্তু ভেবে দেখা দরকার এ আয়াত আমাদেরকে কী বলে?! কুরআন মাজীদে আম্বিয়া কেরামের দাওয়াতের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা যাদের কথাই বলেছেন
একটি কথা মোটামুটি সবার ব্যাপারেই উল্লেখ করেছেন। তা হল, তারা প্রত্যেকে স্বগোত্রকে বলেছেন,
يا قَوْمِ لا أَسْئَلُكُمْ عَلَيْهِ مَالا إِنْ أَجرِيَ إِلاَّ عَلَى اللَّهِ.
আমি )এ আহ্বানের জন্য( তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান আল্লাহ দিবেন। Ñসূরা হুদ (১১) : ২৯
মুফাসসিরীনে কেরাম লিখেন أجر শব্দটি নাকিরা (অনির্দিষ্ট)। অর্থাৎ যে কোনো ধরনের প্রতিদান, ছোট হোক বা বড়। অর্থ হোক বা যশ-খ্যাতি, প্রসিদ্ধি-সম্মান কিংবা যে কোনো ধরনের সেবা বা চাওয়া-পাওয়া। এই ছিল আম্বিয়ায়ে কেরামের ইখলাস ও অন্তরের হালত।
যদিও অনুগ্রহ গ্রহণকারীর কর্তব্য, ‘জাযাকাল্লাহু খাইরান’ বলা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
প্রখ্যাত সাহাবী আবু মাসউদ রা. এক ব্যক্তির কোনো এক প্রয়োজন নিয়ে শাসকের সাথে কথা বললেন, এবং শাসক তা পূর্ণ করে দিলেন। যখন তিনি ঘরে ফিরলেন, দেখলেন তার জন্য কেউ একটি হাঁস ও একটি মুরগী পাঠিয়েছে। ঘরের লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারা ঐ লোকটির নাম বলল, যার প্রয়োজন নিয়ে তিনি শাসকের কাছে গিয়েছিলেন। তখন তিনি বললেন, এগুলো বের করে দাও। আমি কি আমার সুপারিশের বিনিময় দুনিয়াতেই নিয়ে নিবো। Ñকিতাবুয যুহদ, আহমাদ ইবনে হাম্বল, পৃ.২৩৫
রবী ইবনে সবীহ্ বলেন, আমরা একদিন হাসান বসরীর নিকট ছিলাম, তিনি আমাদেরকে ওয়াজ করলেন। হঠাৎ এক লোক ওয়াযের প্রভাবে চিৎকার করে উঠল, তখন হাসান বসরী তাকে বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তোমাকে এ চিৎকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, এর দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য কী ছিল। Ñকিতাবুয যুহুদ, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, পৃ.২১৯
সাহাবী আবু উমামা রা. একদিন মসজিদে এসে দেখেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে এবং সেজদায়ে গিয়ে খুব কাঁদছে ও দুআ করছে। তখন আবু উমামা রা. লোকটিকে বললেন, ‘তুমি তুমিই (অর্থাৎ তোমার এসব সত্য) এমনটি যদি তুমি ঘরেও করে থাক।’ Ñপ্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫
ইবরাহীম ইবনে আদহাম রাহ. বলেন,
لم يصدق الله عز و جل من أحب الشهرة.
যে )নেক কাজ করে) প্রসিদ্ধি কামনা করে সে আল্লাহর সাথে সত্যবাদী নয়। Ñপ্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৯
হযরত লুকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘হে বৎস! তুমি মানুষদেরকে এমনটি দেখাবে না যে, তুমি (ইবাদাত বন্দেগী করে) আল্লাহকে ভয় করছো, যেন তারা তোমাকে সম্মান করে, অথচ তোমার অন্তর নাফরমান। Ñপ্রাগুক্ত
আব্দুস সামাদ ইবনে আলী মদীনার গভর্নর থাকাকালীন এক ব্যক্তি তার কাছে এসে একটি বিষয়ে কথা বলল। তা শুনে তিনি তাকে বললেন, মনে হচ্ছে তুমি রিয়াকারী (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এমনটি বলছ)। তখন লোকটি যমিন থেকে একটি কাঠি বা এ জাতীয় কিছু হাতে নিয়ে বললেন, আমি আমার আমল কাকে দেখাবো? আল্লাহর শপথ আমার নিকট সকল মানুষ এ কাঠি থেকেও তুচ্ছ (অর্থাৎ আল্লাহর তুলনায়)। Ñসিফাতুস সাফওয়াহ ২/৪৩৩
যাইহোক, রিয়া বিষয়টি যেমন বিস্তৃত তেমন সূ²ও। অনেক ক্ষেত্রে তো আমরা বুঝে শুনে ইচ্ছা করেই এমন করি বা অনেক কিছু আমাদের সমাজের নিয়মেও পরিণত হয়ে গিয়েছে। আবার অনেক সময় আমাদের আমলের মাঝে রিয়া এত সূ²ভাবে প্রবেশ করে, নিজেরাও ধরতে পারি না। এ থেকে বাঁচার জন্য করণীয় হল, বেশি বেশি ইখলাসের মুযাকারা করা, প্রত্যেক কাজে নিয়তের মুহাসাবা করা। আর বিষয়টি বাস্তবেও সুকঠিন।
আল্লাহর কাজ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য করা আল্লাহর নিকট শিরক এবং অসহনীয়। হাদীসে এসেছে, যে অন্যকে দেখানোর জন্য নামায পড়ল সে শিরক করল, যে অন্যকে দেখানোর জন্য রোযা রাখল সে শিরক করল। যে অন্যকে দেখানোর জন্য দান করল সে শিরক করল। Ñমুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী, হাদীস ১২১৬
একজন সুস্থ বিবেকবান মানুষের নিকটও তা নিতান্তই অপসন্দনীয় ও ঘৃণিত কাজ। এবং এটা অযৌক্তিকও বটে। আমি যাকে উদ্দেশ্য করে কাজটি করছি সে কে? আল্লাহর সামনে সে কতটুকু? মাটির নিচে তার সন্তুষ্টি আমার কী কাজে আসবে?
দ্বীনের ধারক-বাহকগণ বিষয়টি কত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।
হযরত ইয়াইয়া ইবনে আবী কাছীর বলেন, তোমরা নিয়ত শেখ। কেননা তা আমল থেকেও বেশি কার্যকরি। Ñজামিউল উলূম ওয়াল হিকাম পৃ. ২৬
হযরত সুফিয়ান সাওরী রাহ. বলেন, আমি নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে যত কঠিন সাধনা করেছি অন্য কোনো কিছুর ক্ষেত্রে এমন সাধনা করিনি। কেননা যতবারই আমি নিয়ত ঠিক করি, নিয়্যত আমার বিপরীতে চলে আসতে চায়। Ñপ্রাগুক্ত
হযরত ইউসুফ ইবনে আসবাত রাহ. বলেন, নিয়তকে রিয়ামুক্ত ও বিশুদ্ধ করা দীর্ঘ মুজাহাদা ও ইবাদাত-বন্দেগী করা থেকেও অনেক কঠিন। Ñপ্রাগুক্ত
আল্লাহ তাআলা সকলকে ইখলাস নসীব করুন। রিয়া থেকে হেফাজত করুন। প্রতিটি কাজ যেন একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য করতে পারি সে তাওফিক দান করুন।
সুত্রঃ আল-কাওসার
Comment