‘কাফেরকে কাফের না বললে সে ও কাফের’ এই মূলনীতি নিয়ে কিছু কথা
কাফেরকে কাফের মনে না করা কুফর। কারণ কোরআন ও হাদিসে বহু জায়গায় কাফেরদেরকে সরাসরি 'কাফের' শব্দ দিয়েই ব্যক্ত করা হয়েছে, এমনকি 'কাফিরুন' নামে আলাদা একটি সুরাও নাজিল হয়েছে যাতে বলা হয়েছে 'নবী বলুন 'হে কাফেররা,'।
'কাফেরকে কাফের মনে না করা কুফর' এই কথাটি হুবহু কোরআন, সুন্নাহ বা ইজমায়ে উম্মাহ দ্বারা সাব্যস্ত নয়। এটি ইজতিহাদি বিষয়। তবে এটি দিয়ে যেই হুকুমটি প্রয়োগ হয় তা হয়তো কোরআন, নয়তো সুন্নাহ অথবা ইজমা দিয়েই প্রমাণিত হয়। তাই আগে এই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া জরুরী "কাফেরকে কাফের মনে না করাটা কুফর" এই মর্মে আহলে ইলমদের বক্তব্যগুলো কী?
১। কাজি আয়াজ রাহিমাহুল্লাহ তার 'শিফা' গ্রন্থে লেখেন-
قال القاضي عياض في كتابه الشفاء عند ذكره لما هو كفر بالإجماع: (ولهذا نكفر من دان بغير ملة المسلمين من الملل، أو توقف منهم أو شك أو صحح مذهبهم، وإن أظهر الإسلام واعتقده، واعتقد إبطال كل مذهب سواه فهو كافر بإظهار ما أظهر من خلاف ذلك) انتهى.
এইজন্যই আমরা ওই ব্যক্তিকে কাফের সাব্যস্ত করি যে কিনা ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্মকে ধর্ম হিসেবে গ্রহন করলো। অথবা ইসলামে বিশ্বাসী হওয়ার পাশাপাশি যদি কেউ তাদের (কুফরি) ধর্মে সন্দেহ করলো কিংবা তাদের ধর্মকে বিশুদ্ধ মনে করলো।.........(শিফা, কাজি আয়াজ)
جاء في كشاف القناع للبهوتي – وهو حنبلي المذهب-: من لم يكفر من دان أي تدين بغير الإسلام كالنصارى واليهود أو شك في كفرهم أو صحح مذهبهم فهو كافر لأنه مكذب لقوله تعالى : وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْأِسْلامِ دِيناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
ইমাম বুহুতী রাহিমাহুল্লাহ (১০ম শতাব্দীর হান্বালী মাজহাবের এক বড় ইমাম) বলেন-
যদি কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের অনুসারী যেমন ইহুদি, নাসারাদের কাফের সাব্যস্ত না করে অথবা তাদের কুফরে সন্দেহ করে কিংবা তাদের ধর্মকে বিশুদ্ধ মনে করে তাহলে এই ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে, কারণ সে ব্যক্তি আল্লাহর এই আয়াত অস্বীকার করেছে “আর যারা ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্মের কামনা করবে তার থেকে তা গ্রহন করা হবেনা এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবে”
(كشاف القناع للبهوتي)
৩। বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দীর্ঘ আলোচনা করে এক পর্যায়ে বলেন-
فالواجب على المكلفين -من المسلمين- اعتقاد كفرهم وضلالهم، ومن لم يكفرهم، أو شك في كفرهم؛ يكون مثلهم؛ لأنه مكذب لله ورسوله، شاك بما أخبر الله به ورسوله.
মুসলিম যারা মুকাল্লাফ, তাদের উপর আবশ্যক হল তারা কাফেরদের কুফরকে কুফর হিসেবে এবং তাদের ভ্রষ্টতাকে ভ্রষ্টতা হিসেবেই বিশ্বাস করবে। যদি কেউ তাদের কাফের সাব্যস্ত না করে কিংবা তাদের কুফরে সন্দেহ করে তাহলে এই ব্যক্তি কাফেরদের মতই হয়ে যাবে। কারণ কাফেরকে কাফের না বলা বা তাদের কুফরে সন্দেহ করাটা মূলত আল্লাহ ও তার রাসুল ﷺ কে-ই মিথ্যা সাব্যস্ত করার নামান্তর এবং নবী ﷺ এর হাদিসে সন্দেহ পোষনেরও নামান্তর।
শাইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন-
نعم صحيح ، ومن لم يقتنع بكفر الكافر المجمع على كفره في دين الله فما صدَّق ما أخبر الله تعالى به من كفرهم ، وما اعتقد أن دين الإسلام ناسخ لما قبله من الأديان ، وأن على كل أحد من الناس أن يتبع هذا الدين كائناً ما كان دينه قبل ذلك .
قال الله عز وجل : ( وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ )آل عمران/ 85 ، وقال : ( قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا ) الأعراف/ 158
“হ্যাঁ, এটা সঠিক যে, কোন ব্যক্তি যদি কোন কাফেরের (যার কুফরি নিশ্চিত হয়েছে) কুফরের বিষয়ে সম্মতি না হয় (মেনে না নেয়) তাহলে এই ব্যক্তি মূলত আল্লাহর ওই কথাগুলোই সত্যায়ন করলোনা যা তিনি কাফেরদের কুফরের বিষয়ে বলেছেন এবং যেন সে এটাও বিশ্বাস করলোনা যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সকল ধর্মই রহিত করে দিয়েছে........”
সুতরাং কাফেরকে কাফের সাব্যস্ত না করা, তাদের কুফরে সন্দেহ পোষন করা কিংবা তাদের কুফরকে সঠিক মনে করা, এসবগুলোই মূলত কুফর, যা আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসুল ﷺ এর আনীত দ্বীনকেই মিথ্যা সাব্যস্ত করণে পরিণত করে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা!
যখন আমরা এটা বুঝলাম ও জানলাম যে কাফেরকে কাফের মানতেই হবে, তাদের কুফরকে সঠিক বলা/মনে করা যাবেনা এমনকি সন্দেহও করা যাবেনা, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে, আর তা হল “কোন কোন কাফেরকে কাফের তাকফির না করলে ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়?”
➤ কোন কোন কাফেরকে তাকফির না করলে ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়, অথবা 'কাফেরকে কাফের না বললে সেও কাফের' এই মূলনীতির ব্যখ্যা কী?
এর সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর হল 'যেই ব্যক্তির কুফর নিশ্চিত হয়েছে এমন ব্যক্তিকে কাফের সাব্যস্ত না করলে কাফের হয়ে যাবে'।
'নিশ্চিত' এর অর্থ কী? নিশ্চিত এর চারটি অর্থ-
☞ কোরআন দ্বারা প্রমাণিত (আবু লাহাব,ইহুদি, খৃষ্টান)
☞ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, (আবু জাহেল, মাজুসী ইত্যাদি)
☞ ইজমা দ্বারা প্রমাণিত (মুসাইলামা কাজ্জাব, কাদিয়ানী)
☞ হুজ্জাহ/প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হওয়া, যার সামনে প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হবে এটি তারজন্য৷ অন্যের জন্য নয়।
এর উপর ভিত্তি করে শাইখ সুলাইমান আল-উলওয়ান ৭টি প্রকার বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে কয়েকটি প্রকারে কাফেরকে কাফের না বললে ব্যক্তি কাফের হবে, আর কতেক এমন রয়েছে কাফেরকে কাফের না বললে ব্যক্তি কাফের হবেনা। শাইখ দীর্ঘ কথা বলেছেন আমি তার কথাগুলোই সংক্ষিপ্তাকারে বলছি-
১। ইসলাম ছাড়া যত ধর্ম রয়েছে সকল ধর্মের প্রতিটি সদস্যকে কাফের মনে করতে হবে। অন্যথায় ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে। কারণ নয়তো “আর যারা ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্মের কামনা করবে তার থেকে গ্রহন করা হবেনা এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবে” এই আয়াতকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে।
২। প্রাচীন ধর্মে ধর্মান্তরিতকে কাফের না বলা। (বর্তমানে অনেকেই খৃষ্টান হয়ে যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে।) এর কারণ প্রথম কারণ-ই।
৩। কেউ কুফর করলো, আর তার উপর উলামায়ে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিতও হল, এরপর যদি কেউ তাকে কাফের না বলে খাহেশাতের কারণে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। আর যদি সে কোন সন্দেহ বা প্রমান এর উপর কোন অস্পষ্টতার কারণে কাফের না বলে তাহলে সে কাফের হবেনা। কারণ কাফের হতে হলে কুফর অকাট্য লাগে, তাতে সন্দেহ থাকতে পারবেনা, আর এই সুরতে তার নিকট 'সন্দেহ' রয়েছে।
৪। কুফরে লিপ্ত ব্যক্তিকে এই কারণে কেউ কাফের সাব্যস্ত করছেননা যে, উক্ত কাজটি আসলেই ইমান ভঙ্গের কারণ কী না তা তার জানা নেই অথবা তিনি ভাবছেন কুফরে লিপ্ত ব্যক্তির সামনে হুজ্জাহ/প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি অথব হতে পারে তার সামনে কাফের হওয়ার শর্তগুলো পুরোপুরি উপস্থিত নেই, তাহলে এই ব্যক্তিকে কাফের বলা যাবেনা।
৫। ইরজায়ী উসুলের কারণে যদি কেউ কোন কাফেরকে কাফের না বলে তাহলে তাকে কাফের বলা যাবেনা, কারণ আহলুস সুন্নাহ এমনটির কারণে তাকফির করেননা।
৬। কিছু কুফর রয়েছে এমন যা শুরু জামানা থেকেই মতানৈক্য, যেমন “নামাজ তরক করা”। তাহলে এই কুফরে লিপ্ত ব্যক্তিকে কাফের না বলার কারণে ব্যক্তিকে কাফের বলা যাবেনা। কারণ তাহলে হাম্বালী মাজহাব ছাড়া বাকি তিন মাজহাবের ইমামদেরও তাকফির করতে হবে (নাউজুবিল্লাহ)।
৭। কোন দলের কুফরির উপর ইজমা হয়েছে কিন্তু সেই দলের প্রতিটি ব্যক্তির উপর ইজমা হয়নি, তাহলে এমন দলের সদস্যকে যদি কাফের না বলে এই অজুহাতে যে, তার কুফর রয়েছে কী না তাতে সন্দেহ আছে বা ইত্যাদি, সে দলকে তো কুফরি দল বলছেই কিন্তু ব্যক্তি বিশেষের বিষয়ে সে সতর্কতা অবলম্বন করছে, তাহলেও তাকে কাফের বলা যাবেনা। কারণ ইজমা হয়েছে দলের উপর প্রতিটি সদস্যের উপর নয়।
অতএব এটা যেমন সঠিক "কাফেরকে কাফের সাব্যস্ত না করা কিংবা তাদের কুফরে সন্দেহ করা কিংবা তাদের কুফরকে সঠিক মনে করা যেমন ইমান ভঙ্গের কারণ" তদ্রূপ এটাও ঠিক যে, "এই মূলনীতি ঢালাওভাবে প্রয়োগ করার মত মূলনীতি নয়। বরং তা সর্বোচ্চ যাচাই বাছাইয়ের পরই কেবল প্রয়োগ হওয়া সম্ভব"।
ইমান ভঙ্গের ১০ বা ততোধিক কারণগুলো আমাদের জন্য এইজন্য নয় যে, আমরা এটা পড়বো আর একেজনকে ধরে ধরে কাফের আখ্যা দিবো। এখন তো আরবি পারে না শরীয়াহর মেজাজ বুঝেনা এমন দ্বীনি ভাইদের থেকে আমাদের তাকফির দেখতে হচ্ছে।
হায় ইলমে শরীয়াহর অবনতি!!
হায় ইলমে শরীয়াহর অবনতি!!
আপনার আমার বা এজাতীয় ব্যক্তিদের জন্য ইমান ভঙ্গের কারণগুলো মূলত দুটি কাজের জন্য-
☞ নিজে এসমস্ত ইমান বিধ্বংসী কাজ থেকে পরিপূর্ণ বেঁচে থাকা।
☞ জাতিকে সতর্ক করা, দাওয়াহ দিতে গিয়ে বোঝানের সুবিধার্থে।
আপনাদের হাতে তাকফিরের দায়িত্ব দেয়ার জন্য ইমান ভঙ্গের কারন নয়। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতাই কাম্য।
--- এক মুয়াহিদ দাঈ
Comment