আলমাসজিদুল আকসা ছিল মুসলমানদের একসময়ের কেবলা। ইসলামের নবী রাহমাতুল লিল আলামীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর প্রথমদিকের অনুসারীগণ দীর্ঘ একটি সময় এই মসজিদের দিকে ফিরেই নামায আদায় করেছেন। ইসলামের সবচেয়ে মর্যাদাবান জায়গাগুলোর মধ্যে এটি তৃতীয়। পবিত্র মাসজিদে হারাম ও মাসজিদে নববীর পরই এর স্থান। শত শত আম্বিয়ায়ে কেরামের স্মৃতি বিজড়িত এ মসজিদে আকসা। খাতামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজের রাতে এখানেই ইমামতি করেছেন আম্বিয়ায়ে কেরামের।এ মসজিদে নামাযের সওয়াব, মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববী বাদে অন্য যেকোনো মসজিদের তুলনায় বহু গুণ বেশি। এ মসজিদে আকসাকে ঘিরেই অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিন। যে ফিলিস্তিনের সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো নবী-রাসূলের সুখ-দুঃখের স্মৃতি। ইসলামের একেবারে শুরুর দিকে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা.-এর হাতে এবং তাঁর উপস্থিতিতে এ অঞ্চল মুসলমানদের অধীনে আসে। মাঝের কিছু সময় ছাড়া হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি মুসলমানদের হাতেই ছিল। কিন্তু খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগে ষড়যন্ত্র করে অঞ্চলটিতে পরিকল্পিতভাবে ইহুদী বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে কুফরি বিশ্ব। গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে মুসলমানদের ভূমি দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হয় অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। সে থেকেই মসজিদে আকসা এবং এর আশপাশের অঞ্চল জায়নবাদী ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণে। সে অঞ্চলের মুসলমানেরা একদিনের জন্যও এ অবৈধ দখলদারিত্ব মন থেকে মেনে নেয়নি। শত্রুর তুলনায় খুবই সামান্য উপায়-উপকরণ নিয়ে তারা প্রতিরোধ গড়তে সচেষ্ট থেকেছে।নিজেদের জান, মাল, ঘর-বাড়ি সব কিছু বিসর্জন দিয়েও মসজিদে আকসার সম্মান উদ্ধারে কোনো প্রকার ত্রুটি করেনি। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৭ অক্টোবর ঘটে গেছে ঐতিহাসিক কাণ্ড। যার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘তূফানুল আকসা’।
তূফানুল আকসা
আলআকসা পুনরুদ্ধারে টর্নেডো অভিযান। হাঁ, টর্নেডো অভিযানই বটে। এ অভিযানের মোটামুটি বিবরণ বিশ্ববাসী ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে। এটি ২০২৩ সালের সবচেয়ে আলোচিত এবং বিশ্বের কুফরী শক্তি ও তাদের দোসরদের জন্য সবচেয়ে বড় লোমহর্ষক ঘটনা। শুধু ২০২৩ সালেই নয়; বরং বিগত কয়েক দশকেও হয়তো এত বড় আঘাত তাদের অন্তরে আর লাগেনি। সেজন্য এ অভিযানের নাম তূফানুল আকসা যথাযথই হয়েছে। এ অভিযান কতটুকু সফল হল সে কথায় যাওয়ার আগে এর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনা দরকার। এ তুফান পরিচালিত হয়েছে এমন একটি দেশের বিরুদ্ধে, এমন একটি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে, যাদেরকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি বলে প্রচার করা হচ্ছে কয়েক যুগ থেকে। যাদেরকে অপ্রতিরোধ্য বলে ঠাওর করানো হচ্ছে। যে ইসরাইলের ভয় দেখিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোকে কাবু করে ফেলছে ইউরোপ-আমেরিকা, যে ইসরাইলকে পৃথিবীর তাবত কুফুরি শক্তি সামরিক ও বেসামরিক সংস্থা সহযোগিতা দিয়ে এসেছে, যে ইসরাইলের গোয়েন্দাসংস্থা মোসাদকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দাবিভাগ বলে প্রচার করা হয়েছে, যে ইসরাইলের কাছ থেকে বহু দেশের নেতারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নজরদারি যন্ত্র কিনছে- এ তুফান পরিচালিত হয়েছে সে ইসরাইলের বিরুদ্ধে। কারা পরিচালনা করছে এ তুফান? যেখানকার মানুষদেরকে যুগ যুগ ধরে উন্মুক্ত কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। যে অঞ্চলকে বলা হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগার। যে অঞ্চলের মানুষ প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্য-পানীয়র সুযোগ-সুবিধাও পায় না। যাদের সবকিছু শত্রুর নখদর্পণে। যারা শত্রুর তুলনায় অনেকটাই নিরস্ত্র। তারা তো ভয় করেনি। নিশ্চয় পশ্চিমের সেবাদাস আরব শাসকেরা আবার ভাবতে বাধ্য হবে, তাহলে কি ক্ষমতা পকাপোক্ত রাখতে ইসরাইলের সাথে হাত মেলানো নিরাপদ নয়? তাহলে কি খোদ ইসরাইলই অনিরাপদ?‘তূফানুল আকসা’ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বলতে হয়, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে, এ দেশসহ পৃথিবীর ওইসকল দেশের ক্ষমতাবানদের, যারা নিজেদের নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য, নিজেদের নিরাপত্তা ও স্থায়ী দখলদারিত্ব বহাল রাখার জন্য তলে তলে ইসরাইলের গোয়েন্দাদের সহযোগিতা নিয়ে থাকে, যারা ইসরাইল থেকে গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি কেনে, নাগরিকদের ফোনে ও ব্যক্তিগত জীবনে আড়ি পাতে, তাদেরও বোঝা উচিত, আসলে মোসাদ, মোসাদের গোয়েন্দাগিরি, গোয়েন্দা-সরঞ্জাম কোনোটাই চূড়ান্ত শক্তি নয়। কোনোটিই অপ্রতিরোধ্য নয়। একটি-দুটি টর্নেডোই সবকিছু ভাসিয়ে নিতে পারে। ভেস্তে যেতে পারে সকল পরিকল্পনা। তূফানুল আকসা এমনই আরো বহু কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে গেছে।
প্রতিক্রিয়া
তূফানুল আকসার যে প্রতিক্রিয়া চলছে তা অনেকটা অনুমেয় ছিল। হিংস্র পশু বা বিষাক্ত সাপকে কেউ আঘাত করলে যেরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়, বর্বর ইসরাইলী গোষ্ঠী তাই দেখিয়ে চলেছে। নিরপরাধ ও নিরস্ত্র গাজা ও ফিলিস্তিনবাসীর ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। হত্যা করছে হাজার হাজার নারী-শিশু ও বেসামরিক মানুষ। গুড়িয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের বাড়িঘর। বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে অনবরত। হামলা চালাচ্ছে চারদিক থেকে। এ ঘৃণ্য ও জঘন্য কাজে বরাবরের মতো সহযোগিতা করে যাচ্ছে তাদের পশ্চিমা প্রভুরা। ওই আঘাতের পর থেকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটেন, ফ্রান্সের ক্ষমতাবানরাসহ তাদের লালন-পালনকারী সেই চিহ্নিত ইসলামের দুশমন গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠেছে। তূফানুল আকসা পরিচালনাকারী হামাসের কাছে এ ধরনের পরিস্থিতি অননুমেয় ছিল না। ইসরাইল ও পশ্চিমাদের চিরচেনা চরিত্রের কারণে তারা জানত, এমনটি ঘটবে। যদিও যুক্তির কথা তো ছিল এই, সামরিক শক্তি দিয়ে তোমাদের সামরিক বাহিনীর ওপর, সামরিক স্থাপনায় হামলা করা হয়েছে, যাদের সাথে তোমরা যুগ যুগ থেকে একতরফা যুদ্ধে লিপ্ত, যাদেরকে তোমরা অহরহ মেরে যাচ্ছ। তারা তোমাদের তথাকথিত দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা চৌকি ভেঙেছে। তোমাদের বেসামরিক নাগরিকদেরকে ইচ্ছা করে টার্গেট করা হয়নি। কিছু বেসামরিক নাগরিক ধরে নিয়ে গেছে হামাসের মুজাহিদরা। কিন্তু সেটা তো যুদ্ধের কৌশল হিসেবে। তারা কি ইচ্ছা করে তোমাদের নারীদের ও শিশুদের হত্যা করেছে? তারা কি তোমাদের কোনো হাসপাতালে হামলা করেছে? তারা হামলা করেছে তোমাদের সামরিক স্থাপনায়; যা নিয়ে তোমাদের গর্ব। এটা যুদ্ধেরই অংশ। আর তোমরা তার বদলা নিচ্ছ নিরাপরাধ, নিরস্ত্র নারী-শিশু-বৃদ্ধ এবং সাধারণ অবরুদ্ধ মানুষকে মেরে। কাপুরুষতারও তো একটা সীমা থাকে। দুনিয়ার মানুষ জেনে গেছে, ইসরাইল কত বর্বর হতে পারে! কত বর্বর তাদেরকে সমর্থন ও সহায়তা দানকারীরা! তাই অল্প পরিমাণে হলেও বিশ্বের বিবেকবান মানুষ সাহস করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। খোদ আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে আইন করে পুলিশ দিয়ে তাদেরকে বাধা দেওয়া হয়েছে। তারপরও বিক্ষোভ থেমে নেই। তারা এই বর্বরতা, নিরপরাধ মানুষের ওপর এই জুলুম হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু থামছে না ইসরাইলের বর্বরতা। অথবা বলা যায়, এ বর্বরতা থামার এখনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। যদিও হামাসের পাল্টা প্রতিরোধে মাঝে মাঝে তারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে, কিন্তু বেসামরিক ফিলিস্তিনীদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
নৃশংস হামলা ও মিথ্যাচার
ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী আলআহলী আরব হাসপাতাল। যা ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দখলদার বর্বর ইসরাইলীরা গত ১৭ অক্টোবরে এই হাসপাতালে হামলা চালায়। শত শত ডাক্তার, নার্স ও আহত রোগীদের তারা শহীদ করে। অথচ এ বিষয়ে কোনো সাড়াশব্দ নেই। বিশ্বব্যাপী একটু আওয়াজ উঠেছে, নিন্দা এসেছে। ব্যস শেষ! এটাকে যুদ্ধাপরাধ বলা হচ্ছে না। তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলা হচ্ছে না। এমন নিরীহ মানুষের ওপর তারা বোমা মেরেছে, যাদেরকে তারাই আহত করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। শুধু হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি। হামলা করে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে যে, এটা হামাসের বন্ধু সংগঠন ইসলামী জিহাদের কাজ। কী শব্দে বলব? বৃদ্ধ নেতা বাইডেন সাহেব। যাই হোক মুখ নষ্ট করে লাভ নেই। তিনিও ইসরাইলীদের সাথে তাল মিলিয়েছেন ওখানে বসে। অথচ সকল তথ্য-প্রমাণ, বোমার ধরন সবকিছু দিয়েই বিশ্ববাসী জেনে গেছে, এটা ইসরাইলই করেছে। তাদের কর্মকর্তারাও টুইট করে এর কৃতিত্বও নিয়েছিল, যা পরে মুছে দেওয়া হয়। এটা মোটামুটি স্বীকৃত বিষয় হয়ে গিয়েছে যে, এটা ইসরাইলীদেরই হামলা ছিল। এরকম কাজ করে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া ইসরাইলের জন্য নতুন কিছু নয়। গত বছরও আলজাজিরার খ্রিস্টান মহিলা সাংবাদিক সিরীনকে টার্গেট কিলিং করেছিল ইসরাইল। তাকে মেরেছে; কিন্তু দোষ চাপিয়েছে ফিলিস্তিনীদের ওপর। পরবর্তীতে তার পরিবার সিসি টিভি ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করেছে- এটা ইসরাইলেরই কাজ।
‘আলকুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদা’
সকল কুফুরি শক্তি এক ও অভিন্ন। তূফানুল আকসার প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবশালী দেশগুলো যে আচরণ করছে, তাতে আবারো এ কথা প্রমাণিত হল, সকল কুফুরি শক্তি -যে ধর্মেরই হোক, ইহুদী-খ্রিস্টান-হিন্দু বা অন্য কিছু- ইসলাম-বিদ্বেষে এক ও অভিন্ন। বর্বর ইসরাইল কর্তৃক অবৈধ দখলের যারা সমর্থন করে গেছে, যারা এ দখলদারিত্বের আয়োজন করেছে তারা তো বরাবরই ইসরাইলের সাথে আছে। কিন্তু তারা ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার কট্টর কাফেররাও একই দলে যোগ দিয়েছে। তারাও ইসরাইলকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে, সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে মুসলিম নিধনে। ফিলিস্তিনী জাতি-গোষ্ঠীকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য তারাও তৎপর। আমাদের পাশর্^বর্তী রাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী সরকার ও তাদের দলের সাম্প্রতিক আচরণের দিকে তাকালেও একই কথা প্রমাণিত হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যারা আছে, যারা কিছুটা নীরব দেখা যায়, যেমন চায়না ও অন্যান্যরা। তাদেরও যুদ্ধ বন্ধে কোনো জোরালো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে অস্ত্র দিয়ে এই মজলুমদের পাশে কেউই দাঁড়াচ্ছে না। কুরআনের সেই আয়াতেরই বাস্তব নমুনা আবার দেখা গেল, যেখানে বলা হয়েছে-
وَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بَعْضُهُمْ اَوْلِيَآءُ بَعْضٍ.
যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা পরস্পরে একে অন্যের ওলি-ওয়ারিশ। -সূরা আনফাল (৮) : ৭৩
তাই দুনিয়ার মুসলমানদের বুঝতে হবে, অন্যের কাছে, কোনো কুফুরি শক্তির কাছে তেমন কিছু আশা করে লাভ নেই। দিন শেষে তারা সকলেই একে অপরের ভাই হিসেবেই দেখা দেবে।পশ্চিমা প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর ইসরাইলপ্রীতি নতুন কিছু নয় এবং অপ্রাসঙ্গিকও নয়। তূফানুল আকসা দ্বারা ইসরাইল আক্রান্ত হওয়ার পর অশীতিপর জো বাইডেনের দৌড়ে তেল আবিব আসা, ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত রণতরী মোতায়েন করা, সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাওয়া- এসবই সাধারণ বিষয় হিসেবে ধরে নিতে হবে। যদিও আমার অন্তত করুণা হয়েছে ওই বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে, যিনি কিনা বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও মঞ্চেও মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। বয়সের একটা ক্লান্তির ছাপ তো থাকেই। এই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি আগে থেকেই ইহুদীপ্রীতির জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। এমনিতেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনীদেরকে কোণঠাসা করা, ইসরাইলীদের সাথে আরব দেশগুলোর ঘনিষ্ঠতা তৈরি ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে গেছেন। এখন জো বাইডেন দেখাচ্ছেন, তিনি ট্রাম্প থেকে কম যান না; বরং তিনি আরো এগিয়ে রয়েছেন। সে যাই হোক, আমার কিন্তু করুণা হয়েছিল লোকটির জন্য। তাদের যে কত ঠেকা, কত সমস্যা! সমস্যা শুধু ফিলিস্তিনীদের, শুধু মুসলমানদের- তা নয়। তাদেরও বড় দায় ও ঠেকা রয়েছে।
ভাড়াটে রাষ্ট্র : পেছনের কথা
দুনিয়ায় বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ভাড়াটে লোকদের কথা শোনা যায়। যেমন, পেশাদার কিলার। যারা অন্যের হয়ে মানুষ খুন করে। বিভিন্ন সময় তদন্তে বেরিয়ে আসে, এত লাখ টাকার বিনিময়ে সে অমুককে হত্যা করেছে। খুনি ও নিহতের মাঝে কোনো সম্পর্কই নেই। সে অন্যের হয়ে খুন করে এসেছে। এরকম ভাড়াটে লোকদের কথা তো অহরহ শোনা যায়। এদেশেও এমন কিলারের উপস্থিতিতির কথা শোনা যায়। এমন ভাড়াটে সেনাবাহিনীও পৃথিবীতে রয়েছে। পাঠকদের মনে থাকবে, কয়েক মাস আগে রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের স্বপক্ষ ত্যাগের কথা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কথা। যার বাহিনী দীর্ঘদিন থেকে রাশিয়ার জন্য ভাড়ায় খাটছিল। সে ইউক্রেন যুদ্ধে একসময় রাশিয়াডর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং বিদ্রোহ করে। পরবর্তীতে অবশ্য রাশিয়া তাকে হত্যা করে। প্রথমে সে বেলারুশে যায়। পরবর্তীতে তার নিহত হবার খবর প্রচারিত হয়।যেমন ভাড়াটে কিলার, ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী, ভাড়াটে সেনাবাহিনীর রেওয়াজ দুনিয়াতে রয়েছে, তেমনি একটি ভাড়াটে রাষ্ট্রের মতো ইসরাইল বসে আছে মধ্যপ্রাচ্যে। একথার যৌক্তিকতা বোঝার জন্য দেখতে হবে, ইসরাইলকে যারা এখানে বসিয়েছে- সেই পশ্চিমারা যদি ইহুদী-দরদ থেকে এ কাজটা করত, ‘হিটলার ও নাৎসি বাহিনী লক্ষ লক্ষ ইহুদীদেরকে মেরেছে’, তাই সদয় হয়ে তাদেরকে একটি রাষ্ট্র দিতে চাইত, তাহলে সেটা মধ্যপ্রাচ্যে কেন? তারা এ অঞ্চলকে নিজেদের তীর্থস্থান দাবি করে বলেই এখানে বসিয়ে দেবে? তারা তো জানতই, এখানে অন্যের জমি দখল করতে আসলে, অন্যের দেশে এদেরকে বসিয়ে দিলে এরা অনন্তকাল যুদ্ধাবস্থায় থাকবে, তাদের কখনোই আরামের ঘুম হবে না। যেকোনো সময় তারা আক্রমণের শিকার হতে পারে। সবসময়ই তাদের কপালে দখলদারের চিহ্ন অঙ্কিত হয়ে থাকবে। একথা কি পশ্চিমারা জানত না? এ কথা কি ইসরাইলের নেতারা বুঝত না?তারা বুঝে-শুনেই এদেরকে এখানে বসিয়েছে। এ জায়গা এজন্যই নির্বাচন করেছে। সেই লীগ অব নেশনসে (যা পরবর্তীতে জাতিসংঘ বা ইউএন নামে আত্মপ্রকাশ করে) এ প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেয়, যত এলাকা ইংল্যান্ড দখল করে আছে, সেগুলো যাকে ইচ্ছা বণ্টন করে দিতে পারবে। এই যে প্রস্তাব পাশ করা, একবার অন্যের দেশ দখল করা, আবার সেটা মনমতো বণ্টন করা- এসবের হর্তাকর্তা তো তারাই! দখলকারীও তারা, প্রস্তাবকারীও তারা। লীগ অব নেশনসও তাদেরই বানানো। সেখান থেকে প্রস্তাব পাশ করিয়ে ওখানে ইসরাইল রাষ্ট্র তৈরি করে দেওয়া হয় একতরফাভাবে অন্যের ভূমি দখল করে। যেখানে এক লক্ষ ইহুদীও ততদিনে ফিলিস্তিনে ওঠেনি, সেখানে ১৯৪৯ সালে জাতিসঙ্ঘ ইসরাইলকে স্বীকৃতিও দেয়, সদস্যও করে নেয়। এখন জাতিসংঘ যা কিছু বলুক, এই অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রটিকে এখানে বসতে দেওয়া, স্বীকৃতি দেওয়ার পুরো দায়ই জাতিসংঘের ওপর বর্তায়। জাতিসঙ্ঘ অন্যের জমিতে ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দিলে, সদস্য না বানালে আন্তর্জাতিকভাবে অবৈধ হিসেবেই থাকত। আমরা ফিরে আসি। ভাড়াটে শব্দটা আসলে কেন ব্যবহার করা হল। এটা খুবই পরিষ্কার, ব্রিটেন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইহুদীদের জন্য এ জায়গাটা কেন নির্বাচন করেছে? খোলাসা কথা হচ্ছে, যেখানে মুসলমানদের এক সময়ের কেবলা মসজিদুল আকসা, মুসলমানদের আবাসভূমি, ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হারামাইন শরীফাইন যেখান থেকে খুবই কাছে, আরব রাষ্ট্রগুলো যেখানে অবস্থিত, ভৌগলিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর, মাঝে রয়েছে সুয়েজ খাল, যা দুই মহাদেশের সংযোগস্থল, ঠিক সেই জায়াগাতে তাদের একটা কলোনি বসানো গেলে তারা পাহারাদারির কাজ করবে, তাদের জন্য যুদ্ধ করবে, ভাড়াটে হিসেবে খাটবে, ভবিষ্যতে সামরিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে জায়গাটি ব্যবহার করা সহজ হবে। এ চিন্তা থেকেই সে সময়কার ব্রিটিশ শাসক ও কুশলিবরা এ জায়গাতে ইহুদী রাষ্ট্র বানানোর চিন্তা করেছে। না হয় পৃথিবীতে তো জায়গার অভাব ছিল না। এখনো অনেক রাষ্ট্র এমন আছে যেখানে বহু জায়গা খালি পড়ে আছে। সেখান থেকেও কিছু অংশ দিয়ে দিতে পারত। আমেরিকা কত বিশাল রাষ্ট্র। ওখানে জায়গার অভাব নেই। কানাডা পৃথিবীর অন্যতম বৃহদায়তনের দেশ। সেই তুলনায় জনসংখ্যা অনেক কম। ইহুদীদেরকে সেখানে পাঠাতে পারত। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বসাতে পারত। যুক্তির কথা তো এটাই ছিল যে, তাদেরকে ইউরোপে বসাবে। কারণ তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছে ইউরোপ থেকে। তাদেরকে অত্যাচার করা হয়েছে ইউরোপে। নাৎসিরা তাদের ওপর আক্রমণ করেছে, হত্যা করেছে ইউরোপে। যেখানে তাদের ওপর আক্রমণ হল, যেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করা হল, তাদেরকে সে অঞ্চলে জায়গা না দিয়ে কেন এখানে বসানো হল? আসলে এদেরকে ভাড়াটে গোষ্ঠী হিসেবেই পশ্চিমারা এখানে বসিয়েছে। উপরে উপরে আমরা অনেক কিছু দেখি। ইসরাইলও হাঁকডাক দেয়। ভাড়াটে গুণ্ডারাও এরকম বড় কথা বলে। মোচে তা দিয়ে মুখ বাঁকা করে ভাব দেখায়। আসলে সে তো দুটো টাকার জন্যই অন্যকে খুন করতে যায়। ইসরাইলও এরকম হাঁকডাক দিচ্ছে। ভাব দেখাচ্ছে। যা কিছুই দেখাক বুঝতে হবে, ইসরাইল যুদ্ধাবস্থায় বরাবরই আছে। যে কোনো সময় সে আক্রান্ত হতে পারে। সে শুধু অন্যকেই জুলুম করে যাচ্ছে, বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা-ই নয়; বরং দুর্বলের কাছ থেকেও সে যেকোনো সময় আক্রমণের শিকার হতে পারে। ইসরাইলের নাগরিকেরা যে এ ভয়ে থাকে- তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসরাইলী নাগরিকদের একাংশ এ যুদ্ধের বিরোধিতা করছে।যে রাষ্ট্রটিকে বলা হচ্ছে এত বড় শক্তিধর। যার সামরিক ও আর্থিক শক্তির অভাব নেই। অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ। সে দেশ কেন সবসময় যুদ্ধাবস্থায় থাকবে? তারা এত অল্পসংখ্যক লোক, এত টাকার মালিক হয়েও তারা কেন যুদ্ধাবস্থায় এখানে বাস করবে? এমন একটা জায়গায় যে জায়গায় মাত্রই তাদেরকে এনে বসানো হয়েছে। এমন না যে, তাদের চৌদ্দ পুরুষ এখানে ছিল। ভাড়াটে হওয়ার যৌক্তিকতাটা হল এখানে। পশ্চিমারা যে তাদেরকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যায়, বৃদ্ধ জো বাইডেন সাহেবরা যে দৌড়ে তাদের পক্ষে ওকালতি করতে আসে- এরও সার্থকতা এখানেই। কারণ এরা তাদের পোষ্য। এখানে তাদের পোষ্য পুত্রকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। এটাই কিন্তু ‘যিল্লাহ’ (লাঞ্ছনা)। কুরআন কারীমে যে যিল্লাহ শব্দ এসেছে-
ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ اَيْنَ مَا ثُقِفُوْۤا.
তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাক, তাদের ওপর লাঞ্ছনার ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১২
এখানে সকল ইহুদীর কথা বলা হচ্ছে না। যারা বর্বর, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বেয়াদবি করেছে, গণমানুষের সাথে অন্যায় আচরণ করেছে, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সে গোষ্ঠীর কথা বলা হয়েছে। আর সে গোষ্ঠীর উত্তরসূরীদের যিল্লাহ বা অপমানিত হওয়া এবং যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত হওয়ার এটাও একটা নজির যে, তারা ভাড়ায় খাটছে। যারা ভাড়ায় খাটাচ্ছে তারা ওপরে ওপরে সহযোগিতা দেখাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে হয়তো হাসছে যে, তোমাদেরকে টাকার বিনিময়ে খাটাচ্ছি। ইসরাইলের প্রভুরা যখন অন্য মুসলিম দেশগুলোতে আগ্রাসন চালিয়েছে সেখানে তাদের নিজেদের সৈন্যদের খাটতে হয়েছে। কিন্তু ইসরাইলে? ইসরাইলে তারা শুধু লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। অস্ত্র দিচ্ছে, টাকা-পয়সা দিচ্ছে, রণতরী নিয়োগ করছে, তাদের এসে এখানে খাটতে হয় না। যুদ্ধ করতে হয় না। কারণ, দুর্বলদের মাঝে তাদেরকে বসিয়ে রেখেছে। অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোকে কাবু করছে। ইসরাইলকে দিয়ে সব করিয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ ভাড়াটেরাই সব করুক। আমাদের খাটুনি নেই। আমরা শুধু মুখে মুখে সমর্থন দেব। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য জিনিস দেব। তো যিল্লাহ বা অপমান বোঝার জন্য এ কথাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
জাতিসঙ্ঘ
ফিলিস্তিন-ইসরাইল প্রসঙ্গ আসলেই অনেকে জাতিসঙ্ঘের দিকে তাকায়। শুধু এখানেই না। অন্যান্য জায়গায় যখনই মজলুমরা আক্রমণের শিকার হয়, দেশ থেকে বিতাড়িত হয় তখনো অনেকে জাতিসঙ্ঘের দিকে তাকায়। জাতিসঙ্ঘ কী করছে?আসলে জাতিসঙ্ঘের সাংগঠনিক কাঠামোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, জাতিসঙ্ঘ দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য নয়, মুসলমানদের জন্য নয়, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জন্যও নয়; জাতিসঙ্ঘ তাদের জন্যই, যারা দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ করার পর তার ক্ষতি অনুধাবন করে, নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি বন্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে শুধু মুসলমানদেরকে এবং দুর্বলদেরকে টার্গেট করে দুনিয়াতে ক্ষমতায় বসেছে। ইংরেজরা ছিল এক অঞ্চলে, এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দখল করে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। তাদের স্বার্থেই তারা জাতিসঙ্ঘ বানিয়েছে। তাই যদিও বলা হয়, এটা বিশ্ব সংস্থা। দুই শ’র মতো রাষ্ট্র এর সদস্য। খুব বাহাদুরির সাথে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নেতারাও দেশ ও জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে গাড়ি বহর, না বরং বিমান বহর নিয়ে জাতিসঙ্ঘে ভাষণ দিয়ে আসেন; মনে হয় তাদের অনেক মূল্য। তাদের কথার অনেক দাম। কিন্তু আসল ঘটনাটা কী? আসল ঘটনা ওয়াকিফহাল মহল জানেন। মোটকথা, জাতিসঙ্ঘকে তারা তাদের স্বার্থেই বানিয়েছে। সেভাবেই তারা কাজে লাগায়। এজন্য জাতিসঙ্ঘ বেশি কিছু করবে- এটা আশা করার কোনো অর্থ নেই। জাতিসঙ্ঘের বর্তমান মহাসচিব গুতেরেস গাজার সীমান্ত এলাকা রাফাহ ক্রসিং পরিদর্শনে যান। সেখানে ত্রাণ কার্যক্রম দেখেন। তিনি বারবারই বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, যুদ্ধ বন্ধ করা হোক, হত্যা বন্ধ করা হোক। এর আগেও জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন মহাসচিব এমন বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এগুলো শুধুই কথার কথা। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, তিনি এগুলো মন থেকে বলেছেন। কিন্তু তার তো ক্ষমতা নেই; তিনি তো পাওয়ারলেস। একজন সেক্রেটারি জেনারেল চাইলেই যুদ্ধ বন্ধ করাতে পারেন না। জাতিসঙ্ঘে যদি ভেটো পাওয়ার না থাকত, কারো ভেটো ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠের মত দিয়ে প্রস্তাব পাশ হত, আইন পাশ করা যেত, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা ছিল। ইসরাইলবিরোধী প্রস্তাব তো কম পাশ হয়নি। কিন্তু পৌনে এক শতাব্দী ধরে সেগুলোর প্রায় সবকটিতেই মোড়লরা ভেটো দিয়ে বানচাল করে দিয়েছে।
জুলুম ও ত্রাণ
যাইহোক, পৃথিবীতে এখন এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে, শক্তিশালীরা দুর্বলদেরকে আক্রমণ করবে, বের করে দেবে। এরপর তাদের জন্য কিছু ত্রাণ পাঠাবে। আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক। কয়েক বছর আগে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করা হল। এদেশে তাদেরকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হল। যেন স্থায়ী একটা বসবাসের আয়োজনই করে ফেলা হয়েছে। বছরের পর বছর যাচ্ছে প্রত্যাবাসনের কোনো নামগন্ধ নেই। তাদের জন্য ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণ আসছে। সে ত্রাণের জন্য বড় বড় সাহেবদের চাকরি হয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চলে গেলে দেখা যায়, বিশাল অঞ্চল নিয়ে বড় সাহেবরা আস্তানা গেড়ে আছেন। সেখানে কোটি কোটি টাকার গাড়ির বহর। ওই গাড়িগুলো যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। যেখানে ওরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। সেখানে সাহেবরা ত্রাণ তদারকি করেন। ত্রাণের ব্যবস্থাপনা করেন। এই ত্রাণ ও সহযোগিতা এক ধরনের প্রহসন। নির্যাতন করো, বের করে দাও, এরপর আবার ত্রাণও পাঠাও। একটু একটু দেখাও যে, আমরা ত্রাণ দিচ্ছি। ঔষধ দিচ্ছি। আমরা মানবিক! কিন্তু এ ত্রাণের জীবন যে কত কষ্টের, সেটা তো ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার নেই। একটি পঙক্তি মনে পড়ে গেল-
پہلے خود کانٹے بچھائے اہل دل کے راہ ميں
ہو گئے زخمي تو ان پر پھول برسائے گئے.
মানুষের পথে নিজেই কাঁটা বিছিয়েছেপা ক্ষত-বিক্ষত হলে আবার পুষ্প বর্ষণ করতে আসে!জাতিসঙ্ঘের এখনকার কার্যক্রম, আঘাত করে সেই আঘাতের ওপর ফুল দিয়ে সমবেদনা জানানোর মতোই। সুতরাং জাতিসঙ্ঘকে নিয়ে আশাবাদি হওয়ার তেমন কিছু নেই, অন্তত যেই কাঠামোতে এখন জাতিসঙ্ঘ চলে, সেই কাঠামোতে রেখে।
মুসলিম বিশ্ব
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মজলুম মুসলমানদের পক্ষে কেউই নেই। পৃথিবীর কোনো কুফরি শক্তি, তারাও নেই, জাতিসঙ্ঘ, যা তাদেরই প্রতিষ্ঠিত এবং তাদেরই কাঠামোতে বানানো, তারও কিছু করার নেই বা তার যারা হর্তাকর্তা এবং নিয়ন্ত্রণকর্তা তারা করতে চায়ও না। তাহলে এ মজলুমদের দিকে তাকাবে কে? এদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে কে? এদের পক্ষে কথা বলবে কে? খুব স্বাভাবিকভাবেই সকলের নজর যায় মুসিলম বিশ্বের দিকে। কিন্তু বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অবস্থা! মুসলিম বিশ্বের কথা যখন আমাদের সামনে আসে তখন আমরা দেখতে পাই, মুসলিম বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। না, আমরা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিভক্তির কথা বলছি না। সেটা তো হয়েই আছে এবং করেই দেওয়া হয়েছে। যেখানে থাকার কথা ১টি সেখানে হয়ে গিয়েছে ৬০টির মতো। খোদ মুসলিম রাষ্ট্রই শুধু না, একই খেলাফতে উসমানিয়ার অধীনে থাকা আরব অঞ্চলকে খণ্ড-বিখণ্ড করে বহু রাষ্ট্র বানানো হয়েছে। তাতেই তারা খুশি হয়েছে। ইংরেজরা এভাবে দিয়ে গেছে। তারা নিজেদেরকে স্বাধীন ভাবা শুরু করেছে। তো আমরা সেই বিভক্তির কথা বলছি না। আমরা এখানে যেটা বলছি সেটা হল, মুসলিম বিশ্বে আজকে একটি গোষ্ঠী ক্ষমতাধর। হয়তো তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, নয়তো পরোক্ষভাবে তারাই ক্ষমতাধর। অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তির বলে তারা ক্ষমতার কল-কব্জা নাড়ে। আরেকটি গোষ্ঠী, সাধারণ মুসলমান। যদি আমরা পৃথিবীর সাধারণ মুসলমানদের কথা ধরি, তাহলে সাধারণ মুসলমানদের সকলেই তো মজলুমদের পক্ষে। তারা বিভিন্নভাবে সেটা জানানও দিচ্ছে। কোথাও বিক্ষোভ করে, কোথাও বক্তব্যের মাধ্যমে, বিবৃতির মাধ্যমে মনের কষ্ট ও ফিলিস্তিনীদের প্রতি আন্তরিকতার কথা জানান দিচ্ছে। ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবীর যেখানেই মুসলমানরা আক্রান্ত হচ্ছে, অন্য দেশের মুসলিমরা তাদের সহমর্মিতা সম্ভাব্য পন্থায় প্রকাশ করছে। এমনকি যারা নিয়মিত ইসলাম অনুশীলন করে না, তারাও প্রকাশ করছে। যে শুধু আল্লাহ্য় বিশ্বাস করে, ইসলামে বিশ্বাস করে, কিন্তু আমল করে না- সেও প্রকাশ করছে। কিন্তু অপর গোষ্ঠী, যারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা আকড়ে বসে আছে, সে গোষ্ঠীর একটি অংশ তো ধন-দৌলতে সমৃদ্ধ, যদিও সেগুলো তাদের নিজস্ব সম্পদ নয়; খনিজ সম্পদ, আল্লাহ তাআলার দেওয়া স¤পদ সেটা দিয়ে এখন তারা বড় সাহেব। তারা এখন বড় ক্ষমতাধর ভাবে নিজেদেরকে। তারাসহ পৃথিবীর অন্য গোষ্ঠীরা, অন্য ক্ষমতাধররা চলে সাধারণ মুসলমানের টাকায়। তাদের ওপর আরোপিত হরেক প্রকার ট্যাক্স দিয়ে, ট্যাক্সের টাকায় তারা বিলাসিতা ও প্রাচুর্যের জীবন যাপন করে। আবার তাদের ওপরই ছড়ি ঘুরায়। কিন্তু মুসলিম স্বার্থে, ইসলামের স্বার্থে তাদের অবদান শূন্যের কোঠায়। ইসলামের জন্য তো তারা কিছু করতে পারেই না, করেই না; শুধু লোক দেখানো কিছু জিনিস ছাড়া। কখনো কখনো হয়তো মনভোলানো লোক দেখানো দুয়েকটা কথার ফুলঝুরি ছাড়ে। অথবা দুয়েকটা নিয়ম দেখায়। যেগুলো দিয়ে তারা ভাব ধরে যে, হাঁ, আমরা ইসলামের সাথে আছি। কিন্তু যখন আসল সময় আসে, তখন তাদেরকে আর কাছেধারে পাওয়া যায় না। দুর্দশার সময়, কষ্টের সময় মজলুমের আহাজারির সময় তাদেরকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
ওআইসি
মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর একটি সংগঠনও রয়েছে ওআইসি নামে। কিন্তু তারা কি মুসলমানদের স্বার্থে, ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থে, আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থে, মজলুমদের স্বার্থে কোনো কিছু করতে পেরেছে? করেছে? তাদের কি কিছুই করার ছিল না? বর্তমানে কি তারা কিছু করছে? তারা কি ঐক্যবদ্ধ হতে পারত না? তারা কি একযোগে কথা বলতে পারত না? তাদের কি কোনো ক্ষমতাই দুনিয়াতে নেই? আজকে যদি ওআইসিভুক্ত দেশগুলো একত্রিত হয় এবং বিদ্রোহ করে, জাতিসঙ্ঘ থেকে একযোগে পদত্যাগের হুমকি দেয়, যদি এভাবে বারবার চলতে থাকে, সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে সকলে অবস্থান নেয় এবং সুদৃঢ় থাকে, যদি তারা নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য পরস্পর মিলে করার চেষ্টা করে, যদি তারা ইউরোর মতো নিজেদের মুদ্রা তৈরি করে; তাহলে নিশ্চয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডলারের প্রভাব থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু সেই ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থের চিন্তা কি ক্ষমতাধরদের আছে? থাকবে কীভাবে? এ ক্ষমতাধরদের মধ্যে তো কুরআনে যেই দুষ্ট ইহুদীদের দোষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাদেরও সেই রোগ পেয়ে বসেছে। সে রোগ হচ্ছে, ক্ষমতা ও সম্পদের লোভ। ক্ষমতা ও সম্পদের মোহ তাদেরকে অন্ধ করে ফেলেছে। তাদেরকে নিজ ধর্ম, স্বজাতির দরদ ও চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এই দূরে সরার কারণে ইসলামের মহান শিক্ষা জিহাদ থেকেও দূরে সরে গেছে।
জিহাদ ও মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরেরা
ইসলামে দুষ্টদের দমনের জন্য এবং মজলুমদের রক্ষার জন্য আল্লাহ তাআলা বিধান তো দিয়ে দিয়েছেন। সেই জিহাদের গুরুত্বপূর্ণ বিধান থেকে আজকের মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতাধরেরা অনেক দূরে সরে আছে। কী জন্য রাষ্ট্রের বিশাল সৈন্যবাহিনী রাখা হয়? তাদের পেছনে রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের কোটি কোটি টাকা, কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করা হয়, সেটা জনগণও জানে না। দেখা যায়, এটা শুধুই ক্ষমতাধরদেরকে পাহারা দেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয়। যদি মুসলমান রাষ্ট্রের জনগণের টাকায় পরিচালিত প্রতিরক্ষা বিভাগ নিজ জাতির স্বার্থেই কাজে না আসে, তাহলে সে প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে লাভ কী? কিন্তু জিহাদের বিধানের ওপর মুসলিম শাসকেরা আমল করবে তো দূরের কথা, সেটার নামও তারা মুখে নিতে পছন্দ করে না। তো এই যে তাদের মধ্যে জিহাদ-ভীতি ঢুকেছে, অনীহা ঢুকেছে, এটার মূল কারণ হল ক্ষমতা ও সম্পদের মোহ তাদেরকে জিহাদের কথা ভুলিয়ে রেখেছে। পার্থিব জীবনের প্রতি ভালবাসা ও ধন-সম্পদের মোহের কারণেই তাদের মধ্যে ভীতি ঢুকে গেছে। হাদীসে তো তা-ই আছে। ভয় তাদেরকে পেয়ে বসেছে। এ ভয়ের কারণে আজকে আরব রাষ্ট্রগুলো, মুসলিম রাষ্ট্রগুলো মজলুম ফিলিস্তিনীদের বাদ দিয়ে ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্বে মেতে উঠেছে। ইহুদী-খ্রিস্টানদের সাথে বন্ধুত্বে মেতে উঠেছে। মুসলিমদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাই মুসলিমবিশ্বের যারা ক্ষমতাধর তাদের মধ্যে এই জাতের লোকেরা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন তাদের থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় বলে মনে হয় না। রঈস আমরোহী একজন নামকরা কবি ছিলেন। গত শতাব্দীর শেষের দিকে দৈনিক জঙ্গে নিয়মিত কবিতা লিখতেন। চারটি করে পঙক্তি প্রতিদিনই থাকত। কখনো বেশিও থাকত। কয়েকদিন আগে সাংবাদিক হামেদ মীর তার এক লেখায় রইস আমরোহির চারটি পঙক্তি উল্লেখ করেন। যা এ সময়ও খুব প্রাসঙ্গিক-
جو اہل فلسطين کو خطر ےسے بچائے
وہ عزم وتحريک وہ اقدام کہاں ہے
اب عالم اسلام کو اٹھنے کي ضرورت
بےشک ہے مگرعالم اسلام کہاں ہے
ফিলিস্তিনবাসীকে রক্ষা করার মতোসেই প্রতিজ্ঞা, প্রতিরোধ ও পদক্ষেপ কোথায়?এখন মুসলিম বিশ্বের জেগে ওঠা দরকারনিঃসন্দেহে; কিন্তু মুসলিম বিশ্ব কোথায়!
ক্ষমতার মোহ ও ভয়
মুসলিম বিশ্ব বা আরব মুসলিম বিশ্বের নেতাদের ক্ষমতার মোহ এবং ক্ষমতা চলে যাওয়ার ভয় ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। তারা ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন করছে। নিজ জাতি ও নিজ ভাষা-ভাষীদের কথা মাথায়ই নিচ্ছে না। শুধু যে পশ্চিমাদের ভয় আর স্বার্থসিদ্ধিই নয়; বরং দেখা যাচ্ছে, আরব নেতারা খোদ ফিলিস্তিনী মুজাহিদদেরও ভয় পায়। যেখানেই একটু জিহাদের গন্ধ, জিহাদের আওয়াজ, যেখানেই একটু সশস্ত্র আন্দোলন, সেখানেই তাদের ভয়। তারা হয়তো ভাবছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র যদি মজবুত হয়ে বসে যায়, এ মুজাহিদরা না আবার আমাদের দিকে ফিরে তাকায়! না তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করে বসে। আফগান তালেবানদেরও অনেকে এমন ভয় করেছিল। কিন্তু এখন যে তালেবানরা আফগানিস্তান চালাচ্ছে, তারা কি কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে? তারা কি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে গিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছে? অথচ এ ভয় আরব শাসকেরা এখন আর শুধু মনে পুষে রাখছে না, বিভিন্ন সময় প্রকাশও করে দিচ্ছে। এই তো সেদিন মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসি, কদিন আগে এক নতুন কথা ফরমাইলেন। বললেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দরকার। মুক্ত গাজা দরকার। তবে তা হতে হবে- ‘মানযুআতুস সিলাহ-নিরস্ত্র’। যেখানে কোনো অস্ত্র থাকবে না। কী মজার কথা! নিরস্ত্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্র! পৃথিবীর কোন্ রাষ্ট্র অস্ত্রবিহীন!? অস্ত্রকে কেন আপনাদের এত ভয়? আপনি নিজে চলতে তো হাজারো সৈন্য রাখেন। এলিট ফোর্স রাখেন। আজকালকার ক্ষমতাধরদের কত বাহিনী! এলিট ফোর্স, এই ফোর্স-সেই ফোর্স। কত নামে তারা বাহিনী রাখে। শুধু তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই দেশে দেশে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। তারা কিনা একটা নিরস্ত্র রাষ্ট্রের চিত্র সামনে নিয়ে এসেছে! এখান থেকেই কুমতলবটা সামনে চলে আসে। সেটা হল, মন থেকে তারা স্বাধীন ও স্বনির্ভর ফিলিস্তিন চায় না। এর একটা বড় কারণ এটাও যে, নিজ শক্তিতে বলিয়ান স্বাধীনতাকামী ও আন্দোলনকারীদের প্রতি ক্ষমতার মোহে থাকা জনগণের সাথে সম্পর্কহীন ক্ষমতাধরদের ভয় লেগেই থাকে। এ প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে সিসির ‘মানযুআতুস সিলাহ’ বক্তব্যটিকে।কিন্তু এসব করে কি শেষ রক্ষা হবে? ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় বসে যখন ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত চুক্তির ঘোষণা দেন তখন আলকাউসার (সেপ্টেম্বর ২০২০) সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, ‘ইসরাইল-আমিরাত চুক্তি : লাভ-ক্ষতি মিলিয়ে শেষ রক্ষা কি হবে?’ সেখানে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছিল, শেষ রক্ষা হবে না। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ‘এই চুক্তিতে ফিলিস্তিনীদের স্বার্থ রক্ষা হবে। পশ্চিম তীরে এবং গাজায় নতুন করে ইসরাইলী বসতি স্থাপন বন্ধ হবে।’ আমরা বলেছিলাম, দখলদারদের বসতি স্থাপনও বন্ধ হবে না, স্বার্থ রক্ষাও হবে না। ২০২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সেপ্টেম্বরও পার হয়ে গেছে। এই তিন বছরে কতটুকু স্বার্থ উদ্ধার হল ফিলিস্তিনীদের? ইসরাইল আরো কত বর্বর হল! এখান থেকেই বোঝা যায়, আরবরা যা ভেবেছিল তা নয়। আজকে কি কোনো আরবের কথা ইসরাইল শোনে? ইসরাইল তো তাদের বন্ধু! গত মাসেই জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, এখন একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য জন্ম নিচ্ছে। যার মালিক ইসরাইল ও তার বন্ধু আরব দেশগুলো। সেখানে তার দম্ভ ও উচ্চারণ খুবই সুস্পষ্ট ছিল। তিনি ফিলিস্তিনের নামটি পর্যন্ত মুখে আনার প্রয়োজন মনে করেননি। অথচ সেই ফিলিস্তিনের জমিতেই ইসরাইলের বসবাস। তার হয়তো দৃষ্টি ছিল আরবের বৃহৎ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রটির দিকে। সেখান থেকেও কয়েকদিনের মধ্যে সাড়া পেয়ে যাবেন। ইতিমধ্যে আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ কয়েকটা দেশকে তো কাবু করে ফেলেছেন। কিন্তু তার তো জানা ছিল না, পরবর্তী মাসেই তার জন্য প্রলয়ঙ্করি ‘তুফান’ অপেক্ষা করছে। যার প্রভাবে ঐ আরব রাষ্ট্রটি ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে তলে তলে যতটুকু এগিয়ে যাক, আপাতত তার চেয়েও বেশি পিছিয়ে গিয়েছে। তাই পৃথিবীতে কখন কী ঘটবে- অগ্রিম বলে দেওয়া যায় না।
উল্টো চিন্তার লোকেরা
মুসলমানদের মধ্যে আবার কিছু লোক এমনও রয়েছে, যারা ধর্ম-কর্ম করেন অথবা ইসলামী লেখাপড়াও হয়তো করেন বা করেছেন, কিন্তু তারা উল্টো চিন্তা করতে পছন্দ করেন। মৌলিক চিন্তা বাদ দিয়ে খুঁটিনাটির মধ্যে পড়ে থাকেন। বড় কিছুকে স্বীকৃতি দিতে তাদের কুণ্ঠাবোধ হয়। তাদের মতো করে কিছু না হলে সেটা যেন আর কোনো কাজের স্তরেই পড়ে না! এমন উল্টোচিন্তার লোকের অভাব নেই। দেশীয়, আন্তর্জাতিক, ধর্মীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিছু লোক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং বিভিন্ন ঠুনকো বিষয় সামনে নিয়ে আসে।
তেমনি কিছু লোককে দেখা যাচ্ছে, যারা ‘তূফানুল আকসা’ বা হামাস মুজাহিদীনদের এই প্রতিরোধকেও বাঁকা চোখে দেখছে। তাদের মধ্যে কিছু তো আছে যাদের বুঝ নেই, ঈমানী শক্তি দুর্বল। তাদের কথা ভিন্ন। তারা হয়তো বলছে, হামাস এটা করল কেন? এটা তাদের কর্মফল। এটা না করলেই তো পারত। এটা করে ইসরাইলকে খেপিয়ে তুলেছে। সেখানে ঢিল দেওয়াতে এখন ইসরাইল ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণকে মারছে!
ভাবতে অবাক লাগে, তারা কি অন্ধ? তারা কি এতদিন চোখে দেখেনি? ইসরাইল তো সেই ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে জুলুম করে যাচ্ছে। ইসরাইল কি শুধু হামাসের এই প্রতিরোধ আন্দোলন তূফানুল আকসার পরেই আক্রমণ করেছে? গাজা তো অবরুদ্ধই আছে বছরের পর বছর ধরে। সেখানে খাদ্য-বস্ত্র, পানীয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঢুকতে দেওয়া হয় না। শুধু মেপে মেপে গুণে গুণে যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়েও কম ঢুকতে দেওয়া হয়। ইসরাইলের পারমিশন ছাড়া সেখানে কিছুই ঢুকতে পারে না। ইসরাইলের যখন মন চায় তখন অত্যাচার করে, যখন মন চায় মেরে ফেলে, যখন মন চায় শিশুদের হত্যা করে, যখন মন চায় হাসপাতালে হামলা করে, যখন মন চায় মসজিদুল আকসাকে অপবিত্র করে। এটা কি একদিনের কথা?! তূফানুল আকসা তো মাত্র হল। এর আগে?
এর আগে যা হয়েছে সেগুলো কীভাবে হয়েছে? তাই যারা এটা বলছে যে, ইসরাইলকে খেপানোর কারণে তারা এটা করছে তারা ভীতদের নগরে, ভীতদের শহরে বাস করে এবং এটা তাদের অন্তরের ভীতি এবং ঈমানী শক্তি না থাকারই বহিঃপ্রকাশ বটে। আর যারা হয়তো দ্বীনদ্বার লোক, তাদেরও কিছু অংশ ঠুনকো অজুহাতে হামাসের জিহাদকে, তাদের আত্মদানকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। জানি, আমাদের মতো লোকের স্বীকৃতি ফিলিস্তিনীদের জন্য বড় কিছু হয়তো নিয়ে আসবে না। আমরা স্বীকৃতি দিয়ে তাদের আর কী করে ফেলতে পারব? কিন্তু যারা হীনতার পরিচয় দিতে চাচ্ছে তারা স্বীকৃতি দিতে চায় না।
সেদিন দরসে কোনো একজন ছাত্র প্রশ্ন করল, বাইরের কিছু লোক বলতে চায়, হামাসের মধ্যে গণতন্ত্র আছে, সেজন্য তাদের এটা জিহাদ না।
প্রশ্ন শুনে কী বলব? পরে শুনলাম, বাইরে এ ধরনের চিন্তারও কিছু লোক আছে। তারা গণতন্ত্রকে ঠেলে ওখান পর্যন্ত নিয়ে গেছে। তারা এখানে বসে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুই লাইন লেখেন, ফেইসবুক ও অন্যান্য স্যোশাল মিডিয়াতে এক কথা দুই কথা বলেনে। এ দিয়েই তাদের জিহাদ হয়ে যায়। আর হামাস রাতদিন এমন নারকীয় পরিবেশে থেকে নিজেদের জীবন দান কর, মুসলমানদের রক্ষার জন্য কাজ করছে, মুসলিম দেশ রক্ষার চেষ্টা করছে- এটা জিহাদ হয় না! তাদের কাছে এর মূল্যায়ন হয় না! তো উল্টো চিন্তার লোক এমন থাকে। প্রয়োজন হল, উল্টো চিন্তা না করে সোজা চিন্তা করা। ভালো কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া। ভালো কাজের স্বীকৃতি দিলে নিজেরই সম্মান হয়, নিজেরই দায়িত্ব আদায় হয়। উল্টো চিন্তা করতে গেলে পৃথিবীর সকল ভালো কাজের মধ্যেই খুঁত বের করে বাহাদুরি দেখিয়ে তৃপ্তি লাভ করা যায়। কিন্তু সেটা নেতিবাচক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।
ইহুদী ও আমেরিকানরা কি শান্তিতে আছে?
অনেকের কাছে মনে হতে পারে, জালিম জুলুম করে, শক্তি দেখিয়ে খুব শান্তিতে আছে। না, কোথাও নির্যাতনকারীরা শান্তিতে থাকতে পারে না। জুলুম তাকে ভেতরে ভেতরে পীড়া দিতে থাকে। অন্তরে দাগ কাটতে থাকে। বর্বর ইসরাইলী ইহুদিরা যে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, নিরপরাধ মজলুম মুসলমানদের ওপরে, তারা কি খুব আরামে আছে? আমরা আগেই বলেছি, তাদের সবসময়ই যুদ্ধাবস্থায় থাকতে হচ্ছে। শুধু তাই না! এত প্রাচুর্যে থেকেও কেন তাদের নাগরিকেরা ইসরাইল ছেড়ে চলে যাচ্ছে? তারা বেশি পরিমাণে দেশ ত্যাগ শুরু করলে হয়তো তাদের পশ্চিমা প্রভুরা তাদেরকে ঠেকাতে শুরু করবে। তাদের এই বের হয়ে যাওয়া কীসের আলামত? এই যে ইসরাইলে হামলা, ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলীদের নির্যাতন, পুরো বিশ্বে আমেরিকার নাগরিকদেরকে সতর্ক করে দেওয়া, বিনা প্রয়োজনে দেশের বাইরে যেতে নিষেধ করা- এসবের কারণ কী? এর মানে হল, তারা অন্যকে মারে, কিন্তু নিজের নিরাপত্তা নষ্ট করে। আতঙ্ক তাদের পিছু ধাওয়া করতে থাকে। তাদের মধ্যে অন্তত কিছুটা হলেও বিবেকবান যারা, তারা কিন্তু এসব যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। খোদ আমেরিকাতে, ব্রিটেনে ইহুদীদের বড় জমায়েত যুদ্ধের প্রতিবাদ করেছে। অবিলম্বে এ যুদ্ধ বন্ধের দাবি তুলেছে। আর খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের লোকদের অনেকে তো করেই থাকে। তারা ইসরাইলকে সহায়তা দিতে বারণ করেছে। কেন? কারণ তারা জানে, এ যুদ্ধ শুধু শত্রুতাই বাড়াবে, হিংসা বাড়াবে, বিদ্বেষ বাড়াবে, অশান্তি বাড়াবে। ক্ষমতাসীনেরা যেহেতু ক্ষমতার মোহে আছে, তাই জনগণকে নিয়ে ভাবনা নেই। তো অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে শান্তিতে থাকা সম্ভব নয়।
وہ رلا کر ہنس نہ پايا دير تک
جب ميں رو کر مسکرايا دير تک
گنگناتا جا رہا تھا اک فقير
دھوپ رہتي ہے نہ سايا دير تک
সে আমাকে কাঁদিয়ে বেশিক্ষণ হাসতে পারেনি। যেখানে আমি কেঁদে অনেকক্ষণ হাসতে পেরেছি।পথ চলতে চলতে এক দরবেশ গুনগুনিয়ে বলছিল, রোদ এবং ছায়া কোনোটিই স্থায়ী হয় না।
আমাদের করণীয়
আমাদের সাধারণ মুসলিমদের সম্ভাব্য করণীয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি তো সবাই করে যাচ্ছি। মজলুম ভাইদের জন্য দুআ অব্যাহত রাখা। আল্লাহ যেন তাদেরকে জালিমদের কবল থেকে মুক্তি দেন। ইসলামী হুকুমতসহ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের যেন ক্ষতির উত্তম বদলা দান করেন। যারা সন্তান হারাচ্ছেন, ভিটেমাটি হারাচ্ছেন, তাদের যেন আল্লাহ ধৈর্য ধারণের তাওফীক দান করেন এবং রক্ষা করেন। এই ধরনের দুআ করা এবং অব্যাহত রাখা। এটাই আমাদের সম্ভাব্য করণীয়র মধ্যে অন্যতম এবং বড় সম্বল। এছাড়াও সম্ভাব্য যে কোনো সহযোগিতা তাদের জন্য করা এবং এর জন্য রাস্তা খোঁজ করা। তাদের পর্যন্ত যে কোনো সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার যদি সঠিক ও নির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম পাওয়া যায়, সেই পথে অগ্রসর হওয়াও আমাদের দায়িত্ব। তাতে যেন কোনোভাবেই কুণ্ঠাবোধ না করি। মনে রাখতে হবে, তারা এমন জাতি, যাদের মাঝে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শায়েখ আহমাদ ইয়াসীন রাহ., যিনি হামাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। হুইল চেয়ারে বসেও যিনি এই জালিম দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর শেষ টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলে গিয়েছেন-
إنَّنَا طُلّابُ شَهَادَةٍ، لَسْنَا نَحْرِصُ عَلى هَذِهِ الْحَيَاةِ، هَذِهِ الْحَيَاةُ تَافِهَةٌ رَخِيْصَةٌ، نَحْنُ نَسْعى إلى الْحَيَاةِ الأبَدِيَّةِ.
আমরা শাহাদতের তামান্না করি, আমাদের এ জীবনের প্রতি কোনো লোভ নেই। সংক্ষিপ্ত এ জীবন তো ফুরিয়ে যাবে, আমরা চিরস্থায়ী জীবনের জন্য লড়াই করি।কী চমৎকার কথা! কী অসাধারণ উচ্চারণ! উক্তিটি আমার বারবার পড়তে মন চায়। আমাদের মতো দুর্বল ঈমানদার, যাদের ফিলিস্তিনী ভাইদের জন্য দুআ ছাড়া তেমন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না, সেই ফিলিস্তিনী ভাইয়েরা এমন নেতা পেয়েছিলেন, যার মুখ দিয়ে এমন কথা উচ্চারিত হয়েছে। যে জাতি এমন নেতা পায়, এমন নেতৃত্ব পায় এবং তিনি চলে যাওয়ার পরও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে, সেই জাতির শ্রম ও কষ্ট বৃথা যাওয়ার নয়। এই শায়েখ ইয়াসীনকে তো ইসরাইলীরা গুপ্ত হত্যা করে শহীদ করেছে। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া ‘হামাস’ এখন পর্যন্ত তাঁর পথেই হেঁটে চলেছে। যত দিন তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তাঁর দীক্ষা ও চিন্তা-চেতনা লালন করবে এবং সেই পথে চলবে, ততদিন কেউ তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। পৃথিবীর মহা থেকে মহাশক্তিও এই ধরনের মানসিকতার লোকদের নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। কারণ যে নিশ্চিহ্ন হয়, সে নিশ্চিহ্ন হয় ভয়ের কারণে। কিন্তু যার কাছে মৃত্যু তুচ্ছ, ঈমান ও ইসলাম, সর্বোপরি আখেরাতের জীবনই যার কাছে বড়, যে জাতির কাছে নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতাই বড়, সে জাতি কখনো শেষ হয় না। তার জয় অবধারিত। কোনো না কোনো সময় তা অর্জন করবেই, ইনশাআল্লাহ।আমাদের দ্বীন ইসলামে ‘হতাশা’ নেই। কুরআন কারীমে হাতাশ হতে নিষেধ করা হয়েছে। কাজেই আমরাও হতাশ হব না। মুসলমানদের কাজ, ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষাগুলো পালন করে সত্যিকারের মুসলিম হয়ে ওঠা। নিজেদের সাথে সাথে আশেপাশে, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন সকলকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসা। দেশবাসীকে দ্বীনের পথে চালানোর ফিকির করা। ইসলামের শিক্ষা অর্জন করে নিজের জীবনে অনুশীলন করা। এক্ষেত্রে আমরা যত অগ্রসর হব ততই আমাদের মাঝে কাজের মানুষ বাড়তে থাকবে। ততই মুসলমানদের হারানো বিষয়গুলো পুনরুদ্ধারের রাস্তা ত্বরান্বিত হবে। ততই দেশে দেশে জবরদস্তি মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরানো বাতিল শক্তিগুলো নিপাত যাবে! পালাতে বাধ্য হবে। আল্লাহর দ্বীনের বিজয় হবে। ফিরে আসবে সোনালী অতীত।
وَ يَكُوْنَ الدِّيْنُ كُلُّهٗ لِله.
...এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হয়ে যায়। -সূরা আনফাল (৮) : ৩৯
نَصْرٌ مِّنَ اللهِ وَ فَتْحٌ قَرِيْبٌ وَ بَشِّرِ الْمُؤْمِنِيْنَ.
আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও আসন্ন বিজয় এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। -সূরা সাফ (৬১) : ১৩
আল্লাহ তাআলা আমাদের মজলুম মুসলিম ভাইবোনদের রক্ষা করুন এবং কোনো না কোনোভাবে তাদের পাশে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন।
--সংগৃহীত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত
Comment