সংক্ষিপ্ত আলোচনা:
সদকাতুল ফিতর সম্পর্কে এবং মূল বস্তুর পরিবর্তে মূল্য আদায় করা যাবে কি না?
হাদিসের বাহ্যিক বর্ণনা হিসাবে সদকাতুল ফিতরের মূল নিয়ম হচ্ছে মূল বস্তুটিই আদায় করা। কিন্তু কারণের প্রতি লক্ষ্য করে মূল্য আদায় করলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ হচ্ছে দরীদ্রদের প্রয়োজন ও চাহিদা পুরণ হওয়া। আর বর্তমান যামানায় মূল্য আদায় করাই ফকিরদের জন্য অধিক উপকারী। কারণ রাসূলুল্লাহ সা: এর যামানায় বেশিরভাগ ফকিরদের অবস্থা ছিল, তাদের কাছে রোজকার বা পরবর্তী দিনের খাবারও থাকত না। তাই তাদের জন্য খাদ্যদ্রব্যই অধিক উপকারী ছিল।
পক্ষান্তরে বর্তমানে অনেক ফকিরদের নিকটই রোজকার, বরং কয়েক দিনের খাবারও থাকে। তবে তাদের প্রয়োজন অর্থের। বর্তমানে ফকিরদের নিকটও বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য থাকে। যেমন: চাল ও গমের তৈরী খাদ্য। তেল, ঘি, চিনি, লবণ, টমেটোর মুরব্বা... রশুন, পেয়াজ... ডাল, মটরকলাই, আলু ইত্যাদি। তাই বর্তমানের ফকিরদের অর্থের প্রয়োজন বেশি। এতে তারা নিজ বাচ্চাদেরকে নতুন জোতা, পোষাক ইত্যাদি ক্রয় করে দিতে পারে এবং বাচ্চারা প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনের বাচ্চাদের সঙ্গে মিলিত হলে আনন্দিত হয়। তাই ঈদ হল মুসলমানদের অন্তরে আনন্দ ও স্বস্তি দেওয়া। বিশেষ করে শিশু ও ইয়াতীমদেরকে।
উলামায়ে কেরামের এই মাসআলার ব্যাপারে তিনটি মতামত রয়েছে:
১. মালেকী, শাফেয়ী ও অন্য একদল উলামায়ে কেরাম বলেন: হাদিসের বাহ্যিক বর্ণনার উপর আমল করত: মূল বস্তুই আদায় করবে। এক বর্ণনামতে এটা ইমাম আহমদ রা: এরও মাযহাব। তার থেকে আরেকটি বর্ণনা আছে, তা হল, মূল্য আদায়ও জায়েয আছে, কিন্ত একটি শর্ত সাপেক্ষে, যা সামনে উল্লেখ করা হবে।
২. আতা, হাসান বসরী, ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ, হানাফি আলেমগণ, সওরী, বুখারী, আশহাব, এক বর্ণনামতে ইবনুল কাসিম ও অন্য একদল উলামায়ে কেরাম বলেন: মূল্য আদায় করা জায়েয আছে।
ইমাম বুখারী রহ: মূল্য আদায় করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে দলিল পেশ করেন মুআয রা: এর কাজ দ্বারা, যিনি ছিলেন বড় বড় ফকীহ সাহাবীদের একজন। বুখারী রহ: তাউসের সূত্রে হযরত মু’আয রা: থেকে দৃঢ়তার সাথে সংযোজন হিসাবে উল্লেখ করেন (ফাতহুল বারী:৫/৫৭): মু’আয রা: ইয়ামানবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন: আপনারা চাদর বা কাপড় নিয়ে আসতে পারেন। সদকা হিসাবে তা গ্রহণ করবো। কারণ এটা আপনাদের জন্যও সহজ এবং মদীনার মুহাজিরদের জন্যও ভাল হবে। (ইমাম বায়হাকী রহ: হাদিসটি তাউস থেকেই মুত্তাসিল হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
ইবনে আবি শাইবা বলেন: ওয়াকী র্কুরার সূত্রে আমাদের নিকট বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদের নিকট ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের পত্র আসল: প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদা সা’ অথবা তার মূল্য, অর্ধেক দিরহাম সদকাতুল ফিতর আদায় করা হবে।
ইমাম বুখারী রহ: বর্ণনা করেন: আমাদের নিকট ওয়াকী নিজ সূত্রে হযরত হাসান রা: থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: সদকাতুল ফিতর হিসাবে দিরহাম আদায় করলে সমস্যা নেই।
তিনি আবু ইসহাক আসসাবিয়ী থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেন, আমি তাদের যামানা পেয়েছি, তারা রমজানের সদকাতুল ফিতর হিসাবে খাবারের মূল্য অনুযায়ী পরিশোধ করতেন। আবু ইসহাক ‘আমি তাদের যামানা পেয়েছি’ বলে সাহাবায়ে কেরাম ও বড় বড় তাবেয়ীদেরকে বুঝিয়েছেন। তিনি ৩০ এর অধিক সাহাবির সাক্ষাৎ লাভ করেছেন।
এছাড়া আরেকটি দলিল হল, হাদিসের মধ্যে নির্দিষ্ট শ্রেণীর খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ থাকা অন্যগুলো হারাম হওয়া বুঝায় না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম হাদিসে উল্লেখিত যব, খেজুর ইত্যাদি বস্তুর পরিবর্তে গম আদায় করার অনুমতি দিয়েছেন। অথচ হাদিসের বর্ণনায় এটার উল্লেখ নেই।
ইবনুল মুনযির রহ: উল্লেখ করেন: সাহাবাগণ আধা সা’ গম আদায় করার অনুমতি দিয়েছেন। কারণ তারা এটাকে এক সা’ খেজুর বা যবের সমমূল্যের মনে করতেন। একারণে মু’আবিয়া রা: বলেন: আমি দেখি, শামের দুই মুদ সামরা এক সা’ খেজুরের সমান।
তাহলে দেখা গেল, সাহাবাগণ এটাকে মূল্য দ্বারা পরিমাপ করেছেন। (ফাতহুল বারি: ৫/১৪৪)
৩. তৃতীয় মত: এর মধ্যে বিশ্লেষণ রয়েছে। এটা ইমাম আহমাদ রহ: থেকে বর্ণিত এবং শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ:ও এটা গ্রহণ করেছেন। তা হচ্ছে, যদি ফকিরের প্রয়োজন ও সুবিধার জন্য মূল্য পরিশোধ করা হয় তাহলে কোন সমস্যা নেই। অন্যথায় জায়েয হবে না। এ মতটির সমর্থন পাওয়া যায় উলামায়ে কেরামের এ মূলনীতি থেকে যে: ‘সদকা বিষয়ক বর্ণনাগুলোকে ইবাদত হিসাবে হুবহু গ্রহণ করার চেয়ে তার মধ্যে কারণ বিবেচনা করাই অগ্রগণ্য”। এ মূলনীতিটি পাগল ও শিশু, যদিও ইয়াতীম হয়, তাদের মাল থেকেও সদকা ওয়াজিব হওয়ার মতকে সমর্থন করে। কারণ সদকাতুল ফিতরের হিকমত হল দরীদ্রদের প্রয়োজন পুরা করা।
নি:সন্দেহে অনেক ফকির খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে ওই দিন বা পরের দিনই তা অনেক কম মূল্যে বিক্রি করে দেয়। ফলে এতে সে খাদ্যদ্রব্যের দ্বারাও উপকৃত হল না এবং এই এক সা’ বস্তুর সমমূল্যও পেল না। একারণে এমন হলে মূল্য আদায় করাই ফকিরের জন্য অধিক উপকারী হবে ইংশাআল্লাহ।
সবশেষে: সুন্নাহর মধ্যে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, কোন প্রনিধানযোগ্য কারণের ভিত্তিতে বাহ্যিক শব্দ এড়িয়ে যাওয়া জায়েয আছে এবং বিষয়টি অবকাশসম্পন্ন। এর উত্তম দৃষ্টান্ত হল, রাসূল সা: সহাবাগণকে বনী কুরায়যায় ছাড়া নামায আদায় করতে নিষেধ করেছেন। এতদসত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহর কথার উদ্দেশ্য ও তার উপর আমল করা নিয়ে মতবিরোধ করেছেন।
উক্ত হাদিসটি ছিল: لا يصلين أحد منكم العصر إلا في بني قريظة..." “তোমাদের কেউ যেন বনু কুরাইযায় ছাড়া নামায আদায় না করে।” কিছু সাহাবা বাহ্যিক কথাটি গ্রহণ করেছেন, তাই পথে নামায আদায় করেননি। আর অন্যরা কারণের প্রতি লক্ষ্য করেছেন। তারা বললেন: আমাদের তারাতারি করাই রাসূল সা: এর উদ্দেশ্য। তাই তারা পথেই নামায পড়লেন। রাসূল সা: দুই দলের কোন দলকেই তিরস্কার করলেন না। যেমনটা ইবনে ওমর রা: বলেছেন।
হাদিসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ: উল্লেখ করেছেন। তাই এই উদাহরণটি প্রমাণ করে, কারণের প্রতি লক্ষ্য করা ধর্তব্য।
দৃষ্টি আকর্ষণ: তাই বিষয়টিতে ব্যপকতা আছে। আমাদের উচিত হবে না মানুষের উপর কঠিন করে ফেলা। বিশেষত: বৃদ্ধদের উপর।
আল্লাহ আপনাদের সবাইকে ভাল রাখুন!
আশা-শায়খ আলমুহাদ্দিস আব্দুর রায্যাক আল-মাহদি আদ-দিমাশকি
========###=========
আরবী মূল কপির লিঙ্কঃ-
----------
এই ব্যাপারের সালাফি আলেমদের ও একই রায় দেখুনঃ-
--------
বিস্তারিত দলীল সহ জানতে এই লিঙ্কে যানঃ- (আরবী)
আরবী মূল কপির লিঙ্কঃ-
----------
এই ব্যাপারের সালাফি আলেমদের ও একই রায় দেখুনঃ-
--------
বিস্তারিত দলীল সহ জানতে এই লিঙ্কে যানঃ- (আরবী)
Comment