সংশয় অপনোদন: জিহাদের উদ্দেশ্য কি কাফিরদের হত্যা করা?
মূলত...
১. ইক্বদামী (আক্রমণাত্মক) জিহাদ কিংবা ক্বিতালের উদ্দেশ্য কাফিরদের হত্যা করা নয়। বরং আক্রমণাত্মক জিহাদের উদ্দেশ্য ইসলামের দাওয়াত পৌছে দেয়া।
২. কুফর উপস্থিত থাকার কারণে কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা হবে এটা সত্য, তবে তাদের হত্যা করার জন্য নয়। বরং ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে তাদের কুফর যেন দূর করা যায় এই জন্য।
৩. কোন জাতির সাথে যুদ্ধের অনুমতি থাকা এবং সে জাতির প্রত্যেকে সদস্যকে হত্যার অনুমতি থাকা এক জিনিস নয়। এই কারণে ইক্বদামী জিহাদ সমস্ত কাফিরদের বিরূদ্ধে হবে। কিন্তু দিফায়ী জিহাদ কেবল আগ্রাসী কাফিরদের বিরূদ্ধে হবে।
“জিহাদের উদ্দেশ্য কাফিরদের হত্যা করা নয়” এর স্বপক্ষে দলীল -
দলীল ১. আল্লামা ইবনুস সলাহ (রহঃ) (৬৪৩ হি.) বলেন,
ان الاصل هو ابقاء الكفار وتقريرهم، لأن الله تعالى ما اراد افناء الخلق ولا خلقهم ليقتلوا، وانما أبيح قتلهم لعارض ضرر وجد منهم، لا ان ذلك جزاء لهم على كفرهم فان دار الدنيا ليست دار جزاء. واذا الامر بهذه المثابة لم يجز ان يقال: ان القتل اصلهم
"মূলনীতি হচ্ছে কাফিরদের অবশিষ্ট রাখা এবং তাদের বাঁচতে দেয়া। কারণ আল্লাহ তায়ালা তার মাখলুক্বের ধ্বংস চান না, এবং তাদের হত্যা করার জন্য তিনি তাদের সৃষ্টিও করেন নি। তাদের হত্যার বৈধতা তখনই দেয়া হবে, যখন তাদের মাঝে কোন ক্ষতিকর বিষয় পাওয়া যাবে। এই (হত্যার বৈধতা) তাদের কুফরের শাস্তিস্বরূপও দেয়া হয় নি। কারণ দুনিয়া প্রতিদানের জায়গা নয়। বিষয়টি যখন এমনই তখন এ কথা বলাও বৈধ নয় যে, হত্যা করাই তাদের (ব্যাপারে) মূলনীতি।"
["ফাতাওয়া ইবনুস সলাহ", ২২৪]
দলীল ২. হাফিয ইবনুল ক্বাইয়্যিম(রহঃ) (৭৫১ হি.) লিখেন,
قالوا ولأن القتل إنما وجب في مقابلة الحراب لا في مقابلة الكفر ولذلك لا يقتل النساء ولا الصبيان ولا الزمني والعميان ولا الرهبان الذين لا يقاتلون بل نقاتل من حاربنا . وهذه كانت سيرة رسول الله في أهل الأرض
“হত্যা করা কেবল যুদ্ধের মোকাবেলায় আবশ্যক হয়, কুফরের মোকাবেলায় নয়। একারণেই যুদ্ধ করে না এমন নারী, শিশু, পক্ষাঘাতগ্রস্থ, অন্ধ, সন্ন্যাসীদের হত্যা করা হয় না। বরং আমরা তাদের বিরূদ্ধেই যুদ্ধ করি যারা আমাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে। আর এটাই দুনিয়াবাসীর সঙ্গে আল্লাহর রাসুলের ব্যবহার ছিল।”
["আহকামু আহলিয যিম্মাহ", ১/১৭]
দলীল ৩. আল্লামা আল মারগিনানী (রহঃ) (৫৯৩ হি.) হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত “হিদায়াহ” গ্রন্থে লিখেন:
ولا يقتلوا امرأة ولا صبيا ولا شيخا فانيا ولا مقعدا ولا أعمى لأن المبيح للقتل عندنا هو الحراب ولا يتحقق منهم
"নারী, শিশু, অতিবৃদ্ধ, পঙ্গু, অন্ধদের হত্যা করা যাবে না কারণ আমাদের কাছে হত্যার বৈধতা দাণকারী হচ্ছে যুদ্ধে অংশগ্রহণ, যা তাদের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।”
["আল হিদায়াহ", ২/৩৮০]
তিনি আরও লিখেন,
لأن المبيح للقتل عندنا هو الحراب ولا يتحقق منهم ولهذا لا يقتل يابس الشق والمقطوع اليمنى والمقطوع يده ورجله من خلاف والشافعي رحمه الله تعالى يخالفنا في الشيخ الفاني والمقعد والأعمى لأن المبيح عنده الكفر
“কারণ আমাদের নিকট হত্যার বৈধতা দাণকারী হচ্ছে যুদ্ধে অংশগ্রহণ, আর এজন্যই একপাশ অচল, ডানহাত কর্তিত, বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কর্তিত কাফিরদের হত্যা করা হয় না। এটা শাফিয়ী (রহঃ) এর বক্তব্যের বিপরীত। কারণ তার কাছে হত্যার বৈধতা দাণকারী হচ্ছে কুফর।”
["আল হিদায়াহ", ২/৩৮০]
এরপর তিনি লিখেছেন,
ولأن القتال مبيح حقيقة
“আর যুদ্ধে অংশগ্রহণই হচ্ছে প্রকৃত বৈধতা দাণকারী।”
["আল হিদায়াহ", ২/৩৮১]
দলীল ৪. হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফক্বীহ আল্লামা ইবনু হুমাম (রহঃ) (৮৬১ হি.) লিখেন:
في قوله تعالى: "وقاتلوا المشركين كافة كما يقاتلونكم كافة" فأفاد أن قتالنا المأمور به جزاء لقتالهم ومسبب عنه
আল্লাহর বাণী (সকল মুশরিকদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করো যেমন তারা তোমাদের বিরূদ্ধে সকলে যুদ্ধ করে) [তাওবা: ৩৬] সুতরাং বোঝা গেল, তাদের বিরূদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করার আদেশ তাদের যুদ্ধের বদলাস্বরূপ এবং এটাই (যুদ্ধের) কারণ।
["ফাতহুল ক্বাদীর", ৪/২৭৭-২৭৯]
দলীল ৫. আল্লামা শিরবিনী (রহঃ) (৯৭৭ হি.) লিখেন:
إذا المقصود بالقتال إنما هو الهداية وما سواها من الشهادة ، وأما قتل الكفار فليس بمقصود حتى لو أمكن الهداية بإقامة الدليل بغير جهاد كان أولى من الجهاد
"কিতালের উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবলই হেদায়েত, আর এছাড়াও (আল্লাহর দরবারে) সাক্ষ্যপ্রদাণ। আর কাফিরদের হত্যা কোন উদ্দেশ্য নয়। এমনকি যদি জিহাদ ছাড়াই দলীল প্রমাণের দ্বারা হেদায়েত লাভ সম্ভব হয়, তবে এটা জিহাদের চাইতেও উত্তম।”
["মুগনীল মুহতাজ", ৪/১২০]
দলীল ৬. আল্লামা তাক্বিউদ্দিন আস-সুবক্বি (রহঃ) (৭৫৬ হি.), লিখেছেন:
وإما قتل الكافر وهو ليس بمقصود أصلا لأن فيه إعدام نفس يرجى إسلامها وإسلام ذريتها، فانقطع هذا الرجاء بموتها على الكفر وليس ذلك بمقصود ولا وسيلة الى المقصود بخلاف الشهادة، وإنما هو ضرورة أدى اليه الحال
"আর কাফেরদের হত্যা করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, কারণ এতে এমন প্রাণ বিনষ্ট হয় যার ইসলাম গ্রহণের আশা ছিল এবং তার বংশধরদের ইসলাম গ্রহণেরও আশা ছিল। আর তাকে হত্যার দ্বারা এই আশা কর্তিত হয়ে যায়। আর এটা কোনভাবেই উদ্দেশ্য নয়, এমনকি উদ্দেশ্য পৌছার মাধ্যমও নয়। এটা সাক্ষ্যপ্রদাণের বিপরীত। বরং (যুদ্ধে কাফেরদের হত্যা করা) একটি প্রয়োজন ও অবস্থার দাবী ছিল।”
["ত্ববাক্বাতুশ শাফি’ইয়্যাহ", ১০/২৯৩]
দলীল ৭. আল্লামা শায়বানী আল হানাফী (রহঃ) লিখেছেন:
إن الكفر وإن كان من أعظم الجنايات فهو بين العبد وربه جل وعلا ، وجزاء مثل هذه الجناية يؤخر إلى دار الجزاء
"নিশ্চয়ই কুফর- যদিও তা সবচেয়ে বড় অপরাধ- বান্দা ও তার রবের মাঝে (সীমাবদ্ধ)। আর এমন অপরাধের শাস্তি প্রতিদানের জায়গার (আখিরাহ) জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।"
["শারহু সিয়ারিল কাবীর", ৩/১৮২]
দলীল ৮. ইমাম আস সন’আনী (রহঃ) লিখেছেন:
فهذه عشر آيات دالة على أن الأمر بالقتال للمشركين ليس علته وسببه مجرد الكفر، وأما السنة فدلت على ذلك بالأقوال والأفعال
"আর এই দশ আয়াত হচ্ছে এই বিষয়ের দলীল যে, মুশরিকদের বিরূদ্ধে কিতালের কারণ ও মাধ্যম কেবলমাত্র কুফর নয়। আর সুন্নাহ (রাসুলের) কথা ও কাজ দ্বারা এটাই প্রমাণ করে।"
["আর-রিসালাহ", ১৬৩]
“কোন জাতির সাথে যুদ্ধের অনুমতি থাকা এবং সে জাতির প্রত্যেকে সদস্যকে হত্যার অনুমতি থাকা এক জিনিস নয়” বক্তব্যের স্বপক্ষে দলিল।
ইমাম ইবনু হাজার আল ‘আসক্বালানী (রহঃ) (৮২৫ হি.) লিখেছেন:
قال ابن دقيق : لا يلزم من إباحة المقاتلة إباحة القتل لأن المقاتلة مفاعلة تستلزم وقوع القتال من الجانبين , ولا كذلك القتل . وحكى البيهقي عن الشافعي أنه قال : ليس القتال من القتل بسبيل , قد يحل قتال الرجل ولا يحل قتله
"ইবনু দাক্বীক্ব(রহঃ)বলেন: যুদ্ধ করার বৈধতা থাকলে হত্যার বৈধতা থাকা আবশ্যক হয় না। কারণ যুদ্ধ হচ্ছে দুই পক্ষের সম্মিলিত কর্ম, কিন্তু হত্যা করা এমন নয়।” বায়হাক্বী (রহঃ) ইমাম আশ-শাফি’য়ী(রহঃ)থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেন – যুদ্ধ আর হত্যা একই জিনিস নয়। কখনো কোন ব্যাক্তির বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ হলেও তাকে হত্যা করা বৈধ হয় না।"
["ফাতহুল বারী", ১/৭৬]
আল্লাহ আমাকে, আমাদেরকে সহীহ বুঝ দাণ করুন।
ইমাম ইবনু হাজার আল ‘আসক্বালানী (রহঃ) (৮২৫ হি.) লিখেছেন:
قال ابن دقيق : لا يلزم من إباحة المقاتلة إباحة القتل لأن المقاتلة مفاعلة تستلزم وقوع القتال من الجانبين , ولا كذلك القتل . وحكى البيهقي عن الشافعي أنه قال : ليس القتال من القتل بسبيل , قد يحل قتال الرجل ولا يحل قتله
"ইবনু দাক্বীক্ব(রহঃ)বলেন: যুদ্ধ করার বৈধতা থাকলে হত্যার বৈধতা থাকা আবশ্যক হয় না। কারণ যুদ্ধ হচ্ছে দুই পক্ষের সম্মিলিত কর্ম, কিন্তু হত্যা করা এমন নয়।” বায়হাক্বী (রহঃ) ইমাম আশ-শাফি’য়ী(রহঃ)থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেন – যুদ্ধ আর হত্যা একই জিনিস নয়। কখনো কোন ব্যাক্তির বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ হলেও তাকে হত্যা করা বৈধ হয় না।"
["ফাতহুল বারী", ১/৭৬]
আল্লাহ আমাকে, আমাদেরকে সহীহ বুঝ দাণ করুন।
Comment