প্রশ্ন-: ডঃ আসাদুল্লাহ আল গালিব সাহেব, যিনি আহলে হাদিস আন্দোলনের আমির। তিনি তার বই এ উল্লেখ করেছেন ‘এই যুগের কলমের জিহাদই মূল জিহাদ’, এ ব্যাপারে উনার দৃষ্টিভঙ্গি কি ইসলাম সম্মত?
উত্তরঃ
ইন্নাল হামদা লিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসুলিল্লাহ।
প্রথমতঃ ডঃ আসাদুল্লাহ গালিব সাহেবকে আল্লাহ জাযায়ে খায়ের দান করুন এ কারণে যে, তিনি অন্যান্য অনেকের মতো দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য কুফর মিশ্রিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গিয়ে সামিল হয়ে যাননি।
বিশেষতঃ অন্য অনেকের মতো ‘জিহাদ’ শব্দটা মুখে আনতে তিনি ভীত হননি। বরং তিনি দ্বীন কায়েমের জন্য জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে জিহাদের ব্যাপারে তার কিছু কথা অস্পষ্ট হওয়ায় আমরা সেই কথাগুলোর ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি ইনশাআল্লাহ।
‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ বই এ ‘জিহাদের হাতিয়ার’ অধ্যায়ে ডঃ আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব উল্লেখ করেছেনঃ
‘ইসলামের পরিভাষায় জিহাদের তাৎপর্য চিরকাল একই থাকবে। তবে জিহাদের পদ্ধতি পরিবর্তনশীল। অসিযুদ্ধ এখনই নয়। মসীযুদ্ধ অসির চাইতে মারাত্বক’।
একটু সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি বলেছেনঃ
‘এ যুগে জিহাদের সর্বাপেক্ষা বড় হাতিয়ার হলোঃ কথা, কলম, সংগঠন। আপনাকে অবশ্যই কথা বলা শিখতে হবে। …’
‘আন্দোলন অথবা ধ্বংশ’ অধ্যায়ে তিনি বলেছেনঃ
‘কথা, কলম, সংগঠন – জিহাদের এই ত্রিমূখী হাতিয়ার নিয়ে আমাদেরকে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’
‘ইক্বামতে দ্বীনঃ পথ ও পদ্ধতি’ বই এ ‘জিহাদের প্রস্তুতি’ অধ্যায়ে ২৮ পৃষ্টাতে তিনি বলেছেনঃ
‘তাওহীদ বিরোধী আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনই হলো সবচেয়ে বড় জিহাদ। নবীগণ সেই লক্ষ্যেই তাঁদের সমস্ত জীবনের সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত রেখেছিলেন।’
একই অধ্যায়ের ৩০ পৃষ্টায় তিনি বলেছেনঃ
‘অতএব শিরক ও বিদয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে রুখে দাঁড়ানোই হলো প্রকৃত জিহাদ। … তাই একই সাথে তাওহীদের ‘দাওয়াত’ ও তাওহীদ বিরোধী জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সর্বমূখী ‘জিহাদ’-ই হলো দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি।’
দ্বিতীয়তঃ ‘ইকামাতে দ্বীন’ কাকে বলে, এর অর্থ কি এসব বিষয়ের আলোচনায় তিনি সলফে সালেহীনদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন, বিভিন্ন তাফসীরকারকদের বক্তব্য তুলে এনেছেন। কিন্তু ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ এর ব্যাপারে কথা বলার সময় তিনি শুধুমাত্র নিজের বক্তব্য ও মতামত লিখেছেন। কিন্তু সলফে সালেহীনগণের, তাফসীর, হাদিস ও ফিকহের সম্মানিত ইমামগণের কোন বক্তব্য তিনি তুলে ধরেন নি। অথচ জিহাদ ফি সাবিলিল্লার ব্যাখ্যা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ হাদিসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ
قيل وما الجهاد قال أن تقاتل الكفار إذا لقيتهم قيل فأى الجهاد أفضل قال من عقر جواده وأهريق دمه – خرجه أحمد (4/114 ، رقم 17068) . وأخرجه أيضًا : عبد بن حميد (ص 124 رقم 301) قال المنذرى (2/106) : رواه أحمد بإسناد صحيح ، ورواته محتج بهم فى الصحيح ، والطبرانى وغيره ، ورواه البيهقى عن أبى قلابة عن رجل من أهل الشام عن أبيه . وقال الهيثمى (1/59) : رواه أحمد ، والطبرانى فى الكبير بنحوه ، ورجاله ثقات .
অর্থাৎ, বলা হলোঃ জিহাদ কি? তিনি বললেন, কাফিরদের সাথে লড়াই করা যখন তাদের সাথে সাক্ষাত হয়। বলা হলোঃ কোন জিহাদ সর্বোত্তম? তিনি বললেনঃ যার ঘোড়া নিহত হয় ও রক্ত প্রবাহিত হয়। (মুসনাদে আহমাদ, তাবরানী, বাইহাকী, সনদ সহীহ)
এছাড়া এ ব্যাপারে সলফে সালেহীনদের বক্তব্যও সুস্পষ্ট। তিনি যদি এ ব্যাপারেও সলফে-সালেহীনদের বক্তব্য তুলে ধরতেন, তাহলে হয়তো পাঠকরা তার এসব বই পড়ে জিহাদের ব্যাপারে ভুল ধারনায় পড়তেন না।
তৃতীয়তঃ ‘জিহাদ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘সর্বাত্বক চেষ্টা-সাধনা’ হলেও ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে জিহাদ অর্থ হলোঃ
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস বুখারী শরীফের আরবী ভাষ্যকার ইমাম কাসতালানী (রঃ) বলেন,
قتال الكفارلنصرة الإسلام ولإعلاء كلمة الله
“জিহাদ হলোঃ দ্বীন ইসলামকে সাহায্য করার জন্য ও আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করার জন্য কাফিরদের সাথে কিতাল করা।”
ইমাম ইবনে হুমাম (রঃ) বলেন,
الجهاد: دعوة الكفار إلى الدين الحق وقتالهم إن لم يقبلوا
“জিহাদ হচ্ছে কাফিরদেরকে সত্য দ্বীন ইসলামের প্রতি আহবান করা এবং যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তাদের সাথে লড়াই করা।” (ফাতহুল ক্বাদীর ৫/১৮৭)
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রঃ) বলেনঃ
وفى الشرع بذل الجهد فى قتال الكفار لإعلاء كلمة الله تعالى
“শরীয়াতের পরিভাষায় জিহাদ হলোঃ আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে সর্বশক্তি ব্যয় করা”। (উমদাতুল ক্বারী, ১৪/১১৫)
ইমাম কাসানী (রঃ) বলেন,
بذل الوسع والطاقة بالقتال في سبيل الله عزوجل بالنفس والمال واللسان وغير ذلك
“শরীয়াতের পরিভাষায় (জিহাদ হলো) নিজের জীবন, সম্পদ, মুখ ও অন্যান্য যা কিছু দিয়ে সম্ভব তার মাধ্যমে আল্লাহর পথে লড়াই করার জন্য শক্তি ও ক্ষমতা উৎসর্গ করা”। (আল বাদায়ীউস সানায়ী ৯/৪২৯৯)
মালেকী মাজহাবে জিহাদের সংজ্ঞা হলোঃ
قتال المسلم كافرا غير ذي عهد لإعلاء كلمة الله، أو حضوره له، أو دخوله أرضه له
“মুসলিমের জন্য আল্লাহর আইনকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে যেসব কাফির কোন চুক্তির অধীনে নয় তাদের বিরুদ্ধে অথবা যদি তারা আক্রমণ করার জন্য মুসলিমের সামনে উপস্থিত হয় অথবা যদি মুসলিমের ভূমিতে অনুপ্রবেশ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা।” (হাশিয়া আল – আদাউয়ি, আস-সায়িদী ২/২ এবং আশ-শারহুস সগীর আকরাব আল-মাসালিক লিদ-দারদীর; ২/২৬৭)
শাফেয়ী মাজহাবের ইমাম বাজাওয়ারী (রঃ) এর মতেঃ
الجهاد أي القتال في سبيل الله
“আল জিহাদ অর্থ আল্লাহর পথে লড়াই করা”। (হাশিয়াত বাজাওয়ারী আলা শারহুন ইবনুল কাসিম, ২/২৬১)
ইবনে হাজার (রঃ) এর মতেঃ
وشرعا بذل الجهد في قتال الكفار
“শরয়ী দৃষ্টিতে এর অর্থ হলো কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই এ ত্যাগ স্বীকারমূলক সংগ্রাম”। (ফাতহুল বারী ৬/৩)
হাম্বলী মাজহাবের সংজ্ঞা হচ্ছেঃ
قتال الكفار
“(জিহাদ হচ্ছে) কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা”। (মাতালিবু উলিন নাহি ২/৪৭৯)
الجهاد: القتال وبذل الوسع منه لإعلاء كلمة الله تعالى
“আল জিহাদ হচ্ছে আল ক্বিতাল এবং এই লড়াইয়ে উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর আইনকে সম্মুন্নত রাখা”।(উমদাতুল ফিকহ ১৬৬ পৃষ্টা ও মুনতাহাল ইরাদাত ১/৩০২)
ইমাম বুখারী (রঃ) ‘কিতাবুল জিহাদে’ শুধু কিতাল সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলোই উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিসগণও ‘জিহাদ অধ্যায়ে’ ঘোড়া, তরবারী, বর্ম, গণিমত, বন্দী, আক্রমণ ইত্যাদি কিতাল সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলোই উল্লেখ করেছেন। এমনিভাবে ফুকাহায়ে কিরামও ফিকহের কিতাব সমূহে জিহাদের আলোচনায় কিতাল সম্পর্কিত মাসায়েল উল্লেখ করেছেন।
এ আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ডঃ আসাদুল্লাহ আল গালিব সাহেব উল্লেখিত বইগুলোতে জিহাদ শব্দকে ইসলামী পরিভাষাগত (শরয়ী) অর্থে ব্যবহার করেন নি। বরং তিনি এ ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থে, কোথাও কোথাও নিজের আবিস্কৃত নতুন অর্থে ব্যবহার করেছেন!!
চতুর্থতঃ ‘এ যুগে জিহাদের সর্বাপেক্ষা বড় হাতিয়ার হলোঃ কথা, কলম, সংগঠন। আপনাকে অবশ্যই কথা বলা শিখতে হবে। …’ এই কথা উনি কোথায় পেলেন? এ রকম কথা কোরআন, সুন্নাহ, সলফে সালেহীনদের উপলব্ধি কোথাও পাওয়া যায় না। এটা উনার ব্যক্তিগত এমন একটি কথা যার পক্ষে কোন দলীল নেই। তাই এই কথা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বাতিল।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
بعثت بين يدي الساعة بالسيف
আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য তরবারি (অসি) দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।
একদিকে গালিব সাহেব দাবী করছেন, এখন আর অসির সময় নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরবারির নিচে এ যুগের তথাকথিত মুজতাহিদগণের মস্তিষ্ক প্রসূত অভিমত বধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরবারি দ্বারা দ্বীন বিরোধীদের মগজের খোপড়ী বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ
أمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله
“যতক্ষণ না মানুষ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহের সাক্ষ্য না দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে মানুষের সাথে কিতাল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
আর এটা তো জানা কথা যে, সবাই ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ গ্রহন করবে একেবারে কিয়ামতের পূর্বে, ঈসা (আঃ) এর আগমনের পর। অর্থাৎ সে সময় পর্যন্ত কিতাল চলবে। আর কিতাল যে অসি তথা অস্ত্র দিয়েই হয়, কলম দিয়ে হয় না, এটা এই দুনিয়ায় শিশুরাও বুঝবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ
الْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ الْأَجْرُ وَالْمَغْنَمُ – أحمد ، ومسلم ، والنسائى ، وابن حبان والبخارى ، والترمذى
অর্থাৎ, ঘোড়ার কপালে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ রয়েছে তা হলো সওয়াব ও গনিমত।
কিন্তু ঘোড়া দ্বারা এই দুনিয়ার কোন যুদ্ধের ময়দানে লিখা হয়? ঘোড়া দ্বারা করা যায় কিতাল। তাহলে অসিযুদ্ধ এখনি নয় – কথাটির মাহাত্ম কি?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ
لا تزال طائفة من أمتي يقاتلون على الحق ظاهرين على من ناوأهم
অর্থাৎ, আমার উম্মতের মাঝে সর্বদা হক্বের উপর যুদ্ধরত একটি দল অব্যাহত থাকবে, তাদের বিরোধিতাকারীদের উপর তারা বিজয়ী থাকবে।
বহু সংখ্যক হাদিসে এই তায়েফাতুল মনসুরাহ বা বিজয়ী দলের একটি বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে ক্বিতাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে যদি এখন অসির যুগ না থাকে, তা হলে এই সত্যপন্থী দলটি কিভাবে ক্বিতাল করবে? ক্বিতাল তো কলম তথা মসি, যুক্তি-তর্ক কিংবা বক্তৃতা ইত্যাদি দিয়ে করা যায় না।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেছেনঃ
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আহযাব, আয়াতঃ ২১)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত পর্যন্ত أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ কিন্তু যাদের ভাষ্যমতে বর্তমান যুগ মসির যুগ, তারা ভেবে দেখুন মসির যুগের যোদ্ধাদের জন্য এমন একজনকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন অনুসরণীয় নির্ধারণ করলেন যার জীবন কেটেছে অসির মাধ্যমে যুদ্ধের উপর। মসির যুদ্ধের মডেল হলেন অসির যোদ্ধা?
কি উদ্ভট গবেষণা!
কথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বেশী প্রভাব সৃষ্টিকারী কে হতে পারেন? তিনি ছিলেনজাওয়ামিউল কালিম এবং أفصح العرب এতদসত্ত্বেও রাসূলকে অসি ধরতে হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে বড় নেতা, উন্নত সংগঠক আর কে হতে পারবে? তারপরেও তাকে তরবারী হাতে নিতে হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় তেরো বছর অসিবিহীন চেষ্টা ও দাওয়াতী তৎপরতা চালিয়েছেন এত কিছু সত্ত্বেও ইকরামা ইবনে আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান, হিন্দা ও মক্কার অন্যান্য সাধারণ অধিবাসীরা, যারা পরবর্তীতে আমাদের সময়ের যে কোন সংগঠক কিংবা দায়ীর হাতে ইসলাম গ্রহণকারীর চেয়ে বহুগুনে শ্রেষ্ঠ মুসলমান হয়েছিলেন, তারাও তখন ইসলাম গ্রহন করেননি।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
إِذَا جَاء نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا.
যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়। এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। (সূরা নছর, আয়াতঃ ১-২)
অর্থাৎ, বিজয় আসলে ইসলাম বিস্তৃত হবে, দলে দলে মানুষ ইসলামে আসবে। আর বিজয় আসবে আল্লাহর সাহায্যে। আল্লাহর সাহায্য আসবে বান্দা যখন আল্লাহকে সাহায্য করবে। আল্লাহ বলেছেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَنصُرُوا اللَّهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ
হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন। (সূরা মুহাম্মদ, আয়াতঃ ৭)
আর আল্লাহ তায়ালাকে সাহায্য করা হয় লোহা দিয়ে। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ
আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে। (সূরা হাদীদ, আয়াতঃ ২৫)
জিহাদের পদ্ধতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমল করে দেখিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তদানুসারে পথ চলেছেন। উম্মত জিহাদের একটি রূপ উপলব্ধি করে আসছে। যেমন ‘ছালাত’ যখন বলা হয় তখন একটি রূপ মানসপটে ভেসে ওঠে, এর মধ্যে কারো কোন সংশয় থাকে না। অর্থাৎ কিয়াম, কিরাত, রুকু, সিজদাহ, তাহারাত এর মাধ্যমে যা আদায় করা হয় সেই ছালাতকেই সবাই বুঝেন। কেউ সালাত আদায় করেছে বলতে দুয়া করা বুঝায় না। অথচ দুয়া অর্থেও সালাত শব্দটির ব্যবহার হয়েছে।
‘হাইয়া আ’লাস ছালাহ’ শুনলে কেউ এটা বুঝেনা যে, মসজিদে গিয়ে দুরুদ শরীফ পড়ে আসলেই হবে। অথচ দুরুদ শরিফকেও কোরআনে ছালাত বলা হয়েছে (শাব্দিক অর্থে)। জিহাদের হলো তাই যা তীর, ধনুক, তরবারী, ঘোড়া, বর্ম এগুলোর মাধ্যমে সংগঠিত হয়। সময়ের ব্যবধানে এগুলোর ধরন পরিবর্তন হতে পারে – যেমন বন্দুক, গুলি, বোমা, ড্রোন, ইত্যাদি তবে যুদ্ধ সর্বদা যুদ্ধই থাকবে – যুদ্ধ কখনো লিখনি কিংবা ভাষন হয়ে যাবে না। সে যুগেও লিখনি ছিল কিন্তু এটাকে কেউ যুদ্ধ বলেননি।
হ্যাঁ কিতালের প্রতি উৎসাহ প্রদান, বিরোধীদের দলিল খণ্ডন, কৌশল প্রণয়ন এগুলো যা কিতাল তথা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট – এগুলোকেও ফুকাহায়ে কেরাম জিহাদ এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আর মূলতঃ মুখ, কলম ইত্যাদির দ্বারা যে জিহাদ আছে, তা এটাই।
কিতাল তথা যুদ্ধ হল সশস্ত্র লড়াই, জিহাদ তার চেয়ে একটু ব্যাপক। অর্থাৎ জিহাদ হলো যুদ্ধ সংক্রান্ত যে কোন কর্মকাণ্ড, প্রস্তুতি, উৎসাহ প্রদান, হত্যা-চিন্তা, যুদ্ধের পরিকল্পণা প্রণয়ন ইত্যাদি। দ্বীন বিজয়ের নিয়্যতে যে কোন চেষ্টা – এটা পরিভাষায় জিহাদ নয়, শাব্দিক জিহাদ হতে পারে। আর শাব্দিক জিহাদ কখনো জিহাদের আহকাম, ফযিলত, প্রভাব, তাসির কিংবা ফল বহন করে না। যেমনঃ স্ত্রী সহবাস কে শাব্দিক অর্থে জিহাদ বলা হয়।
إذا جلس بين شعبها الأربع ثم جهدها فقد وجب الغسل
অর্থাৎ, যখন তোমাদের কেউ (স্ত্রীর) চার শাখা (হাত-পা) এর মাঝে বসে তারপর ‘জিহাদ’ করে, তার জন্য গোসল ওয়াজিব।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا
(পিতা-মাতা) যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়ে শরীক স্থির করতে ‘জিহাদ’ করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। (সূরা লোকমান, আয়াতঃ ১৫)
এখানে বলা হচ্ছে কাফের মাতাপিতা যদি তোমাদের শিরক করার জন্য চূড়ান্ত চাপ প্রয়োগ করে তাদের কথা শোন না। এখানে কাফেরের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগকে জিহাদ শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এখন কি বলা হবে যে এ কাফের মাতা পিতা দ্বারা জিহাদ হয়েছে? তারা মুজাহিদ? জিহাদের ফযিলত তারা পাবে? এর দ্বারা দ্বীন বিজয়ী হবে?
ইহুদিদের স্বভাব পারিভাষিক অর্থ ও শাব্দিক অর্থের ব্যবধান না মানা । যেমনঃ ابناء শব্দটি পারিভাষিক ভাবে ‘প্রিয়’ এর অর্থ বহন করে, ইহুদি-খ্রিস্টানরা এটাকে শাব্দিক অর্থ গ্রহন করে, তারা বলে যে আমরা আল্লাহ্*র সন্তান। নাউজুবিল্লাহ! কি জঘন্য কাজ।
তারা পরিভাষাকে গুলিয়ে ফেলার কারনে تحريف করার কারণে শিরক পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। যারা বসে বসে কলমের খোঁচায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রক্ত ঝরা দান্দান শহীদ হওয়া জিহাদকে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছেন, তাদের রাসুলের বিরোধিতার কারণে কোন ফিতনায় পড়ে যাওয়া অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাবে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে ভয় করা উচিত। হামযা (রাঃ) টুকরো টুকরো হয়েছেন যে জিহাদে, সাহাবায়ে কেরামের শতকরা আশি ভাগ যে জিহাদে শহীদ হয়েছেন, কোরআনের সাড়ে চারশত এর অধিক আয়াতের মধ্যে যে জিহাদের আলোচনা করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতাশটির উপরে জিহাদি অভিযানে সৈন্য পরিচালনা করেছেন, অর্ধ শতকের উপরে জিহাদে সাহাবায়ে কেরামকে পাঠালেন – সে জিহাদ কারো কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে!! আবার কারো নিকট এটা জঙ্গিবাদ!! নাউজুবিল্লাহ!
সার কথাঃ জিহাদ অর্থ কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ, জিহাদকে অস্বীকারকারী কাফির, অপব্যখ্যাকারী গুমরাহ, পরিত্যাগকারী ফাসেক। (ছরখছী)।
কিতালের মাধ্যমেই দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবে, ফিতনাহ তথা শিরক, শিরকের প্রভাব প্রতিপত্তি খতম হবে।
হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ কলম-সৈনিক তৈরী হয়ে গেলেও দ্বীন বিজয়ী হবে না, যতক্ষণ না দ্বীন বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ যে পথ দেখিয়েছেন সে পথ গ্রহন করা হবে। সে পথ কি? আল্লাহ পাকের স্পষ্ট ঘোষণাঃ
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلّه فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করেন। (সূরা আনফালঃ ৩৯)
ফিতনাহ শেষ হওয়া আর পরিপূর্ণ দ্বীন প্রতিষ্ঠা হওয়া নির্ভর করে কিতালের উপর। কিতাল কঠিন, অপছন্দনীয়, কষ্টকর। বিজ্ঞ হাকিম কি আমাদেরকে এমন কষ্টের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন আরও সহজে অসুখ নিরাময় হবার পথ বাদ দিয়ে? অথচ তিনি আরহামুর রাহিমীন। তাহলে এবার চিন্তা করুনঃ ফিতনা দূরীভূত হবার, দ্বীন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আর কোন সহজ পদ্ধতি থাকতে পারে কি?
আমাদের ইয়াকিন হলো – না, আর নেই। থাকলে সেটা দয়াময় আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়ে দিতেন।
কাফেরদের সম্পর্কে আল্লাহ্* রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
وَلاَ يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّىَ يَرُدُّوكُمْ عَن دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُواْ
বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদিগকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়। (সূরা বাকারাঃ ২১৭)
কাফেররা দ্বীন থেকে ফিরানোর জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহন করবে? – কিতাল।
এখন দ্বীন রক্ষায় কি করণীয়? কিতাল এর মুকাবেলায় কি রুমাল কিংবা কলম নিয়ে মুখোমুখি হওয়া? নাকি শত্রু যেভাবে আসবে তেমন ধরনের হাতিয়ার নিয়ে যাওয়া? হ্যাঁ, শত্রু কলমের আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আক্রমণ, অর্থনৈতিক হামলা সব প্রয়োগ করছে কিন্তু এগুলো সবই সামরিক শক্তির অধীন। সামরিক বিজয় যার থাকবে এসব শক্তি তার পক্ষেই কাজ করবে। আজ কুফফারদের সামরিক বিজয় বিদ্যমান বিধায় এসব ক্ষেত্রে সমগ্র পৃথিবী তাদের অনুসারী।
মানুষ তার রাজন্যবর্গের মতাদর্শ গ্রহণ করে থাকে। সুরায়ে নাসর এর বক্তব্যও এর সমর্থন করে। নতুবা পশ্চিমাদের সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা কি ইসলামের চেয়ে উন্নত যে কারণে মুসলমানরা পর্যন্ত তাদের আদর্শগুলো গ্রহণ করছে? এটা তাদের সামরিক বিজয়ের প্রভাব। নতুবা লেখনীর / বক্তব্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিকট রয়েছে কিতাবুল্লাহ এর মতো মুজিযা। এর চেয়ে বড় লেখা / বক্তব্য পৃথিবীর সমুদয় লেখক-বক্তা কিয়ামত পর্যন্ত লিখে, বক্তৃতা দিয়ে এর ধারে কাছেও কি পৌঁছাতে পারবে? বাস্তবে লিখার ক্ষেত্রে আমাদের বিজয় বিদ্যমান।
এতদসত্বেও কোরআনের আদর্শ, বিধিবিধান, হুকুম-আহকাম কেন স্বয়ং মুসলিমরাই গ্রহণ করছে না? আপনি কোরআনের চেয়ে বেশি লিখে ফেলবেন? আরও উন্নত বক্তব্য দিয়ে ফেলবেন? পারবেন না। কিন্তু কোরআন মানা হচ্ছেনা কেন? সমাজে নামাজ নেই কেন, জাকাত নেই কেন, বরং সমাজে সুদ বিস্তৃত হচ্ছে কেন?
নামাজ ফরজ এটা মানুষ জানে না এ কারণে, নাকি এর দাওয়াত পৌঁছে নাই একারণে? নাকি রাফে ইয়াদাইনের ঝগড়ার নিস্পত্তি না হওয়ার কারনে? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেনঃ
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ
তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ দান করলে তারা নামায কায়েম করবে,যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। (সূরা হজ্জ্ব, আয়াতঃ ৪১)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইকামতে ছালাত হবে ক্ষমতা লাভ হলে। আল্লাহ বলছেন, মুমিনরা যদি ক্ষমতা পায় তখন ছালাতের প্রচলন করে আর আমাদের কেউ কেউ বলছে ‘এর জন্য ক্ষমতার প্রয়োজন নাই’। নাউজুবিল্লাহ!
ক্ষমতা আসলে কিভাবে কিতাব প্রতিষ্ঠিত হবে? আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী। (সূরা হাদীদ, আয়াতঃ ২৫)
দ্বীনের সাহায্য করার উপায় হলোঃ লোহা-অসি-অস্ত্র দিয়ে। মসিহ আলাইহিস সালাম দাজ্জালকে দমন করবেন অসি হাতে নিয়েই।
আল্লাহ পাক নিজে কিতাল করেছেন। নবী অলিদের, ফিরিশতাদের দিয়ে কিতাল করিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ মিশনেই ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কে এ পথেই রেখে গেছেন।
সাহাবায়ে কিরাম এ পথেই অর্থাৎ অস্ত্র-সরঞ্জাম সহ পৃথিবীর দিকে দিকে এগিয়ে গেছেন। বিজয় এনেছেন। উম্মতের একটি জামাতের কিতালের মাধ্যমে এ বসুন্ধরা ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়েছে। কুফর অপসারিত হয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা সে পথ ছেড়ে আরামের পথ ধরে, এখন নানাবিধ ব্যারামে ভুগছি। যতক্ষণ সে পথ ফের না ধরবো, সেই ব্যারাম সারবে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
إذا تبايعتم بالعينة، ورضيتم بالزرع، وتبعتم أذناب البقر، سلط الله عليكم ذُلاً لا ينزعه عنكم حتى ترجعوا إلى دينكم
যখন তোমরা ঈনা (সন্দেহযুক্ত) কেনাকাটা শুরু করবে, গরুর লেজ ধরবে, ফসল ফলানো নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে, আর জিহাদ ছেড়ে দিবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর অপমান চাপিয়ে দেবেন তা সরাবেন না যতক্ষণ তোমরা দ্বীনের দিকে ফিরে না আসবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস সহীহ)
এখানে দ্বীনের দিকে ফেরত আসা বলতে হাদিসের ইমামগণ জিহাদ বুঝেছেন।
সুতরাং, অসিযুদ্ধ এখনই নয়, এখন মসি যুদ্ধের সময় – এসব কথা নফসের খায়েশাত ছাড়া আর কিছু নয়। এসব কথার পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ নেই।
অনুরুপভাবে, ‘তাওহীদ বিরোধী আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনই হলো সবচেয়ে বড় জিহাদ’ – আক্বীদা ও আমলের সংশোধনকে জিহাদ বলা হয়েছে, এমন কোন দলীল আমরা ইসলামে পাই না। হাদিস কিংবা ফিকহের কোন ইমামও এ রকম কোন কথা বলেন নি। যদি আক্বীদার সংশোধন জিহাদ হয়, তবে দাওয়াহ ইলাল্লাহ কি? তবে তালিম-তারবিয়া কি? আমরে বিল মারুফ-নাহি আনিল মুনকার কি?
তাই আমাদেরকে সর্বদা যথাযথ শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
অনুরুপভাবে, ‘তবে জিহাদের পদ্ধতি পরিবর্তনশীল। অসিযুদ্ধ এখনই নয়। মসীযুদ্ধ অসির চাইতে মারাত্বক’ – এই কথার পক্ষেও কোন দলীল-প্রমাণ নেই। এটা ইসলামের কোন কথা নয়। বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
ألا إن القوة الرمي، ألا إن القوة الرمي، ألا إن القوة الرمي
নিশ্চয়ই নিক্ষেপের মধ্যে আছে শক্তি, নিশ্চয়ই নিক্ষেপের মধ্যে আছে শক্তি, নিশ্চয়ই নিক্ষেপের মধ্যে আছে শক্তি। (সহীহ মুসলিম, সুনান আবু দাউদ, সুনান ইবনে মাজাহ, সুনান তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ)
দেখা যাচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিক্ষেপের তথা তীর, অসি, বন্দুক ইত্যাদির মধ্যে আছে শক্তি। কিন্তু এরকম সুস্পষ্ট হাদিস থাকার পরও কিভাবে আমরা ‘মসীযুদ্ধ অসির চাইতে মারাত্বক’ – এই ধরনের কথা বলতে পারি। বরং আল্লাহ আমাদেরকে জিহাদের প্রস্তুতির জন্য ঘোড়া ও শক্তি সঞ্চয় করতে বলেছেন।
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ
“আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সামর্থ অনুযায়ী সংগ্রহ করো শক্তি-সামর্থ্য ও পালিত ঘোড়া …”(সূরা আল আনফাল, আয়াতঃ ৬০)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জিহাদের জন্য মুসলমানদেরকে বড় বড় লেখক, সাংবাদিক হতে বলেন নি। কলমের ব্যবহারকে বেশী শক্তিশালী বলেন নি। বরং শক্তি ও ঘোড়া জোগাড় করতে বলেছেন। সুতরাং ডঃ আসাদুল্লাহ গালিব সাহেবের জিহাদ সম্পর্কে এই ধারনাগুলো আল-কোরআন ও হাদিসের পরিপন্থী।
আমরা কলমের গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না, মিডিয়ার গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না, মানুষের মন-মানষিকতা পরিবর্তনে লেখনীর গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু শরীয়াতে প্রত্যেক বিষয়ের একটা নির্দিষ্ট স্থান আছে। সেটাকে তার চাইতে বেশী আগে বাড়িয়ে দিলে, সমস্যা দেখা দেয়। বরং প্রত্যেকটা বিষয়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন, ততটুকু দেয়াই উচিত।
বরং আল্লাহ বলছেন, কাফিররা চায়, আমরা যেন আমাদের অস্ত্র সম্পর্কে বেখবর হয়ে যাই, আর শুধু মসী-কলম ইত্যাদি নিয়ে পড়ে থাকি, যাতে তারা আমাদের উপর সহজে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলিম উম্মাহ এখন এই অবস্থার সম্মুখীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেনঃ
وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً
কাফেররা চায় তোমরা তোমাদের অস্ত্র-শস্ত্র এবং সরঞ্জামাদি থেকে গাফিল হও যাতে তারা তোমাদেরকে একযোগে আক্রমন করতে পারে। (সূরা আন নিসা, আয়াতঃ ১০২)
পঞ্চমতঃ এই সাইটে এক মন্তব্যকারী মন্তব্য করেছেন, “এটি আসাদুল্লাহ আল গালিব এর একটি ইজতিহাদ”। এই ব্যাপারে আমাদের কথা হলোঃ ইজতিহাদ হয় আল-কোরআন ও হাদিসের আলোকে একটি নতুন সমস্যার সমাধান দেবার সময়। কিন্তু ‘আল-জিহাদের অর্থ কিংবা সংজ্ঞা’ তো আজ চৌদ্দশত বছর পর নতুনভাবে দেয়া হচ্ছে না, কিংবা এটা নতুন কোন বিষয়ও নয় যে এর উপর কেউ এখন ইজতিহাদ করবে। বরং যুগে যুগে আলিমরা এই ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে কথা বলে গেছেন। তাই জিহাদ কাকে বলে, এর অর্থ কি – এসব ব্যাপারে কোন ইজতিহাদের স্থান নেই। তাই মন্তব্যকারীর এই মন্তব্য গ্রহনযোগ্য নয়।
আর কলমের মাধ্যমে জিহাদের ব্যাপারটা ইমাম কাসানী (রঃ) এর সংজ্ঞায় এসে গেছে। তিনি বলেছেনঃ“শরীয়াতের পরিভাষায় (জিহাদ হলো) নিজের জীবন, সম্পদ, মুখ ও অন্যান্য যা কিছু দিয়ে সম্ভব তার মাধ্যমে আল্লাহর পথে লড়াই করার জন্য শক্তি ও ক্ষমতা উৎসর্গ করা”। তাই মুখ, কলম ইত্যাদি দিয়ে জিহাদে শরীক হওয়া যাবে তবে সেটা হতে হবে কিতাল ফি সাবিলিল্লাহর (সম্মুখ যুদ্ধের) সমর্থনে। কিন্তু ক্বিতালের সাথে সম্পর্কহীন কলমের মাধ্যমে দ্বীনের খেদমত দাওয়াহ, তারবীয়া-তাসফিয়া, আমরে বিল মারুফ-নাহি আনিল মুনকারের অংশ হতে পারে কিন্তু জিহাদের অংশ হবে না।
পরিশেষে আমরা বলতে চাইঃ ডঃ আসাদুলাহ গালিব সাহেবের উপরুক্ত কথাগুলো যথার্থ নয়, এসব কথার পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। বরং এই কথাগুলো সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদিসের বিরোধী। এগুলো তার একান্ত নিজস্ব কিছু মত যার পক্ষে আল-কোরআন, হাদিস কিংবা সলফে সালেহীনদের কোন বক্তব্য নেই।
উল্লেখ্য, এই বইসমূহে আরো কিছু বিষয় ছিলো যা আমাদের দৃষ্টিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অগ্রণযোগ্য মনে হয়েছে, কিন্তু আমরা শুধুমাত্র এই প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নিয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামী শরীয়াতের আলোকে জিহাদকে বুঝার ও জিহাদে সামিল হবার তৌফিক দান করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ
যে ব্যক্তি নিজে গাযওয়াতে (যুদ্ধের জন্য বের হওয়া) যায়নি কিংবা গাযওয়াতে যাবার ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে নিফাকের একটি শাখার উপর মৃত্যু বরণ করলো। (সহীহ মুসলিম)
আল্লাম সিন্দী (রঃ) সুনান নাসায়ীর হাশিয়াতে বলেন, ‘এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, সে জিহাদের যাবার নিয়্যত করে নি। আর জিহাদে যাবার নিয়্যত থাকার প্রমাণ হলোঃ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَوْ أَرَادُواْ الْخُرُوجَ لأَعَدُّواْ لَهُ عُدَّةً
আর যদি তারা বের হবার সংকল্প নিত, তবে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম প্রস্তুত করতো। (সূরা আত তাওবা, আয়াতঃ ৪৬)’
আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে নিফাকের শাখায় মৃত্যু হতে হিফাজত করেন।
উত্তরঃ
ইন্নাল হামদা লিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসুলিল্লাহ।
প্রথমতঃ ডঃ আসাদুল্লাহ গালিব সাহেবকে আল্লাহ জাযায়ে খায়ের দান করুন এ কারণে যে, তিনি অন্যান্য অনেকের মতো দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য কুফর মিশ্রিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গিয়ে সামিল হয়ে যাননি।
বিশেষতঃ অন্য অনেকের মতো ‘জিহাদ’ শব্দটা মুখে আনতে তিনি ভীত হননি। বরং তিনি দ্বীন কায়েমের জন্য জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে জিহাদের ব্যাপারে তার কিছু কথা অস্পষ্ট হওয়ায় আমরা সেই কথাগুলোর ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি ইনশাআল্লাহ।
‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ বই এ ‘জিহাদের হাতিয়ার’ অধ্যায়ে ডঃ আসাদুল্লাহ গালিব সাহেব উল্লেখ করেছেনঃ
‘ইসলামের পরিভাষায় জিহাদের তাৎপর্য চিরকাল একই থাকবে। তবে জিহাদের পদ্ধতি পরিবর্তনশীল। অসিযুদ্ধ এখনই নয়। মসীযুদ্ধ অসির চাইতে মারাত্বক’।
একটু সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি বলেছেনঃ
‘এ যুগে জিহাদের সর্বাপেক্ষা বড় হাতিয়ার হলোঃ কথা, কলম, সংগঠন। আপনাকে অবশ্যই কথা বলা শিখতে হবে। …’
‘আন্দোলন অথবা ধ্বংশ’ অধ্যায়ে তিনি বলেছেনঃ
‘কথা, কলম, সংগঠন – জিহাদের এই ত্রিমূখী হাতিয়ার নিয়ে আমাদেরকে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’
‘ইক্বামতে দ্বীনঃ পথ ও পদ্ধতি’ বই এ ‘জিহাদের প্রস্তুতি’ অধ্যায়ে ২৮ পৃষ্টাতে তিনি বলেছেনঃ
‘তাওহীদ বিরোধী আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনই হলো সবচেয়ে বড় জিহাদ। নবীগণ সেই লক্ষ্যেই তাঁদের সমস্ত জীবনের সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত রেখেছিলেন।’
একই অধ্যায়ের ৩০ পৃষ্টায় তিনি বলেছেনঃ
‘অতএব শিরক ও বিদয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে রুখে দাঁড়ানোই হলো প্রকৃত জিহাদ। … তাই একই সাথে তাওহীদের ‘দাওয়াত’ ও তাওহীদ বিরোধী জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সর্বমূখী ‘জিহাদ’-ই হলো দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি।’
দ্বিতীয়তঃ ‘ইকামাতে দ্বীন’ কাকে বলে, এর অর্থ কি এসব বিষয়ের আলোচনায় তিনি সলফে সালেহীনদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন, বিভিন্ন তাফসীরকারকদের বক্তব্য তুলে এনেছেন। কিন্তু ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ এর ব্যাপারে কথা বলার সময় তিনি শুধুমাত্র নিজের বক্তব্য ও মতামত লিখেছেন। কিন্তু সলফে সালেহীনগণের, তাফসীর, হাদিস ও ফিকহের সম্মানিত ইমামগণের কোন বক্তব্য তিনি তুলে ধরেন নি। অথচ জিহাদ ফি সাবিলিল্লার ব্যাখ্যা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ হাদিসের মাধ্যমে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ
قيل وما الجهاد قال أن تقاتل الكفار إذا لقيتهم قيل فأى الجهاد أفضل قال من عقر جواده وأهريق دمه – خرجه أحمد (4/114 ، رقم 17068) . وأخرجه أيضًا : عبد بن حميد (ص 124 رقم 301) قال المنذرى (2/106) : رواه أحمد بإسناد صحيح ، ورواته محتج بهم فى الصحيح ، والطبرانى وغيره ، ورواه البيهقى عن أبى قلابة عن رجل من أهل الشام عن أبيه . وقال الهيثمى (1/59) : رواه أحمد ، والطبرانى فى الكبير بنحوه ، ورجاله ثقات .
অর্থাৎ, বলা হলোঃ জিহাদ কি? তিনি বললেন, কাফিরদের সাথে লড়াই করা যখন তাদের সাথে সাক্ষাত হয়। বলা হলোঃ কোন জিহাদ সর্বোত্তম? তিনি বললেনঃ যার ঘোড়া নিহত হয় ও রক্ত প্রবাহিত হয়। (মুসনাদে আহমাদ, তাবরানী, বাইহাকী, সনদ সহীহ)
এছাড়া এ ব্যাপারে সলফে সালেহীনদের বক্তব্যও সুস্পষ্ট। তিনি যদি এ ব্যাপারেও সলফে-সালেহীনদের বক্তব্য তুলে ধরতেন, তাহলে হয়তো পাঠকরা তার এসব বই পড়ে জিহাদের ব্যাপারে ভুল ধারনায় পড়তেন না।
তৃতীয়তঃ ‘জিহাদ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘সর্বাত্বক চেষ্টা-সাধনা’ হলেও ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে জিহাদ অর্থ হলোঃ
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস বুখারী শরীফের আরবী ভাষ্যকার ইমাম কাসতালানী (রঃ) বলেন,
قتال الكفارلنصرة الإسلام ولإعلاء كلمة الله
“জিহাদ হলোঃ দ্বীন ইসলামকে সাহায্য করার জন্য ও আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করার জন্য কাফিরদের সাথে কিতাল করা।”
ইমাম ইবনে হুমাম (রঃ) বলেন,
الجهاد: دعوة الكفار إلى الدين الحق وقتالهم إن لم يقبلوا
“জিহাদ হচ্ছে কাফিরদেরকে সত্য দ্বীন ইসলামের প্রতি আহবান করা এবং যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তাদের সাথে লড়াই করা।” (ফাতহুল ক্বাদীর ৫/১৮৭)
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রঃ) বলেনঃ
وفى الشرع بذل الجهد فى قتال الكفار لإعلاء كلمة الله تعالى
“শরীয়াতের পরিভাষায় জিহাদ হলোঃ আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্য কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে সর্বশক্তি ব্যয় করা”। (উমদাতুল ক্বারী, ১৪/১১৫)
ইমাম কাসানী (রঃ) বলেন,
بذل الوسع والطاقة بالقتال في سبيل الله عزوجل بالنفس والمال واللسان وغير ذلك
“শরীয়াতের পরিভাষায় (জিহাদ হলো) নিজের জীবন, সম্পদ, মুখ ও অন্যান্য যা কিছু দিয়ে সম্ভব তার মাধ্যমে আল্লাহর পথে লড়াই করার জন্য শক্তি ও ক্ষমতা উৎসর্গ করা”। (আল বাদায়ীউস সানায়ী ৯/৪২৯৯)
মালেকী মাজহাবে জিহাদের সংজ্ঞা হলোঃ
قتال المسلم كافرا غير ذي عهد لإعلاء كلمة الله، أو حضوره له، أو دخوله أرضه له
“মুসলিমের জন্য আল্লাহর আইনকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে যেসব কাফির কোন চুক্তির অধীনে নয় তাদের বিরুদ্ধে অথবা যদি তারা আক্রমণ করার জন্য মুসলিমের সামনে উপস্থিত হয় অথবা যদি মুসলিমের ভূমিতে অনুপ্রবেশ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা।” (হাশিয়া আল – আদাউয়ি, আস-সায়িদী ২/২ এবং আশ-শারহুস সগীর আকরাব আল-মাসালিক লিদ-দারদীর; ২/২৬৭)
শাফেয়ী মাজহাবের ইমাম বাজাওয়ারী (রঃ) এর মতেঃ
الجهاد أي القتال في سبيل الله
“আল জিহাদ অর্থ আল্লাহর পথে লড়াই করা”। (হাশিয়াত বাজাওয়ারী আলা শারহুন ইবনুল কাসিম, ২/২৬১)
ইবনে হাজার (রঃ) এর মতেঃ
وشرعا بذل الجهد في قتال الكفار
“শরয়ী দৃষ্টিতে এর অর্থ হলো কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই এ ত্যাগ স্বীকারমূলক সংগ্রাম”। (ফাতহুল বারী ৬/৩)
হাম্বলী মাজহাবের সংজ্ঞা হচ্ছেঃ
قتال الكفار
“(জিহাদ হচ্ছে) কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা”। (মাতালিবু উলিন নাহি ২/৪৭৯)
الجهاد: القتال وبذل الوسع منه لإعلاء كلمة الله تعالى
“আল জিহাদ হচ্ছে আল ক্বিতাল এবং এই লড়াইয়ে উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর আইনকে সম্মুন্নত রাখা”।(উমদাতুল ফিকহ ১৬৬ পৃষ্টা ও মুনতাহাল ইরাদাত ১/৩০২)
ইমাম বুখারী (রঃ) ‘কিতাবুল জিহাদে’ শুধু কিতাল সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলোই উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিসগণও ‘জিহাদ অধ্যায়ে’ ঘোড়া, তরবারী, বর্ম, গণিমত, বন্দী, আক্রমণ ইত্যাদি কিতাল সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলোই উল্লেখ করেছেন। এমনিভাবে ফুকাহায়ে কিরামও ফিকহের কিতাব সমূহে জিহাদের আলোচনায় কিতাল সম্পর্কিত মাসায়েল উল্লেখ করেছেন।
এ আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ডঃ আসাদুল্লাহ আল গালিব সাহেব উল্লেখিত বইগুলোতে জিহাদ শব্দকে ইসলামী পরিভাষাগত (শরয়ী) অর্থে ব্যবহার করেন নি। বরং তিনি এ ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থে, কোথাও কোথাও নিজের আবিস্কৃত নতুন অর্থে ব্যবহার করেছেন!!
চতুর্থতঃ ‘এ যুগে জিহাদের সর্বাপেক্ষা বড় হাতিয়ার হলোঃ কথা, কলম, সংগঠন। আপনাকে অবশ্যই কথা বলা শিখতে হবে। …’ এই কথা উনি কোথায় পেলেন? এ রকম কথা কোরআন, সুন্নাহ, সলফে সালেহীনদের উপলব্ধি কোথাও পাওয়া যায় না। এটা উনার ব্যক্তিগত এমন একটি কথা যার পক্ষে কোন দলীল নেই। তাই এই কথা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বাতিল।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
بعثت بين يدي الساعة بالسيف
আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য তরবারি (অসি) দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।
একদিকে গালিব সাহেব দাবী করছেন, এখন আর অসির সময় নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরবারির নিচে এ যুগের তথাকথিত মুজতাহিদগণের মস্তিষ্ক প্রসূত অভিমত বধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরবারি দ্বারা দ্বীন বিরোধীদের মগজের খোপড়ী বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ
أمرت أن أقاتل الناس حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله
“যতক্ষণ না মানুষ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহের সাক্ষ্য না দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে মানুষের সাথে কিতাল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
আর এটা তো জানা কথা যে, সবাই ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ গ্রহন করবে একেবারে কিয়ামতের পূর্বে, ঈসা (আঃ) এর আগমনের পর। অর্থাৎ সে সময় পর্যন্ত কিতাল চলবে। আর কিতাল যে অসি তথা অস্ত্র দিয়েই হয়, কলম দিয়ে হয় না, এটা এই দুনিয়ায় শিশুরাও বুঝবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ
الْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ الْأَجْرُ وَالْمَغْنَمُ – أحمد ، ومسلم ، والنسائى ، وابن حبان والبخارى ، والترمذى
অর্থাৎ, ঘোড়ার কপালে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ রয়েছে তা হলো সওয়াব ও গনিমত।
কিন্তু ঘোড়া দ্বারা এই দুনিয়ার কোন যুদ্ধের ময়দানে লিখা হয়? ঘোড়া দ্বারা করা যায় কিতাল। তাহলে অসিযুদ্ধ এখনি নয় – কথাটির মাহাত্ম কি?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ
لا تزال طائفة من أمتي يقاتلون على الحق ظاهرين على من ناوأهم
অর্থাৎ, আমার উম্মতের মাঝে সর্বদা হক্বের উপর যুদ্ধরত একটি দল অব্যাহত থাকবে, তাদের বিরোধিতাকারীদের উপর তারা বিজয়ী থাকবে।
বহু সংখ্যক হাদিসে এই তায়েফাতুল মনসুরাহ বা বিজয়ী দলের একটি বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে ক্বিতাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে যদি এখন অসির যুগ না থাকে, তা হলে এই সত্যপন্থী দলটি কিভাবে ক্বিতাল করবে? ক্বিতাল তো কলম তথা মসি, যুক্তি-তর্ক কিংবা বক্তৃতা ইত্যাদি দিয়ে করা যায় না।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেছেনঃ
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আহযাব, আয়াতঃ ২১)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত পর্যন্ত أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ কিন্তু যাদের ভাষ্যমতে বর্তমান যুগ মসির যুগ, তারা ভেবে দেখুন মসির যুগের যোদ্ধাদের জন্য এমন একজনকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন অনুসরণীয় নির্ধারণ করলেন যার জীবন কেটেছে অসির মাধ্যমে যুদ্ধের উপর। মসির যুদ্ধের মডেল হলেন অসির যোদ্ধা?
কি উদ্ভট গবেষণা!
কথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বেশী প্রভাব সৃষ্টিকারী কে হতে পারেন? তিনি ছিলেনজাওয়ামিউল কালিম এবং أفصح العرب এতদসত্ত্বেও রাসূলকে অসি ধরতে হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে বড় নেতা, উন্নত সংগঠক আর কে হতে পারবে? তারপরেও তাকে তরবারী হাতে নিতে হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় তেরো বছর অসিবিহীন চেষ্টা ও দাওয়াতী তৎপরতা চালিয়েছেন এত কিছু সত্ত্বেও ইকরামা ইবনে আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান, হিন্দা ও মক্কার অন্যান্য সাধারণ অধিবাসীরা, যারা পরবর্তীতে আমাদের সময়ের যে কোন সংগঠক কিংবা দায়ীর হাতে ইসলাম গ্রহণকারীর চেয়ে বহুগুনে শ্রেষ্ঠ মুসলমান হয়েছিলেন, তারাও তখন ইসলাম গ্রহন করেননি।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
إِذَا جَاء نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا.
যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়। এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। (সূরা নছর, আয়াতঃ ১-২)
অর্থাৎ, বিজয় আসলে ইসলাম বিস্তৃত হবে, দলে দলে মানুষ ইসলামে আসবে। আর বিজয় আসবে আল্লাহর সাহায্যে। আল্লাহর সাহায্য আসবে বান্দা যখন আল্লাহকে সাহায্য করবে। আল্লাহ বলেছেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَنصُرُوا اللَّهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ
হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন। (সূরা মুহাম্মদ, আয়াতঃ ৭)
আর আল্লাহ তায়ালাকে সাহায্য করা হয় লোহা দিয়ে। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ
আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে। (সূরা হাদীদ, আয়াতঃ ২৫)
জিহাদের পদ্ধতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমল করে দেখিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তদানুসারে পথ চলেছেন। উম্মত জিহাদের একটি রূপ উপলব্ধি করে আসছে। যেমন ‘ছালাত’ যখন বলা হয় তখন একটি রূপ মানসপটে ভেসে ওঠে, এর মধ্যে কারো কোন সংশয় থাকে না। অর্থাৎ কিয়াম, কিরাত, রুকু, সিজদাহ, তাহারাত এর মাধ্যমে যা আদায় করা হয় সেই ছালাতকেই সবাই বুঝেন। কেউ সালাত আদায় করেছে বলতে দুয়া করা বুঝায় না। অথচ দুয়া অর্থেও সালাত শব্দটির ব্যবহার হয়েছে।
‘হাইয়া আ’লাস ছালাহ’ শুনলে কেউ এটা বুঝেনা যে, মসজিদে গিয়ে দুরুদ শরীফ পড়ে আসলেই হবে। অথচ দুরুদ শরিফকেও কোরআনে ছালাত বলা হয়েছে (শাব্দিক অর্থে)। জিহাদের হলো তাই যা তীর, ধনুক, তরবারী, ঘোড়া, বর্ম এগুলোর মাধ্যমে সংগঠিত হয়। সময়ের ব্যবধানে এগুলোর ধরন পরিবর্তন হতে পারে – যেমন বন্দুক, গুলি, বোমা, ড্রোন, ইত্যাদি তবে যুদ্ধ সর্বদা যুদ্ধই থাকবে – যুদ্ধ কখনো লিখনি কিংবা ভাষন হয়ে যাবে না। সে যুগেও লিখনি ছিল কিন্তু এটাকে কেউ যুদ্ধ বলেননি।
হ্যাঁ কিতালের প্রতি উৎসাহ প্রদান, বিরোধীদের দলিল খণ্ডন, কৌশল প্রণয়ন এগুলো যা কিতাল তথা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট – এগুলোকেও ফুকাহায়ে কেরাম জিহাদ এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আর মূলতঃ মুখ, কলম ইত্যাদির দ্বারা যে জিহাদ আছে, তা এটাই।
কিতাল তথা যুদ্ধ হল সশস্ত্র লড়াই, জিহাদ তার চেয়ে একটু ব্যাপক। অর্থাৎ জিহাদ হলো যুদ্ধ সংক্রান্ত যে কোন কর্মকাণ্ড, প্রস্তুতি, উৎসাহ প্রদান, হত্যা-চিন্তা, যুদ্ধের পরিকল্পণা প্রণয়ন ইত্যাদি। দ্বীন বিজয়ের নিয়্যতে যে কোন চেষ্টা – এটা পরিভাষায় জিহাদ নয়, শাব্দিক জিহাদ হতে পারে। আর শাব্দিক জিহাদ কখনো জিহাদের আহকাম, ফযিলত, প্রভাব, তাসির কিংবা ফল বহন করে না। যেমনঃ স্ত্রী সহবাস কে শাব্দিক অর্থে জিহাদ বলা হয়।
إذا جلس بين شعبها الأربع ثم جهدها فقد وجب الغسل
অর্থাৎ, যখন তোমাদের কেউ (স্ত্রীর) চার শাখা (হাত-পা) এর মাঝে বসে তারপর ‘জিহাদ’ করে, তার জন্য গোসল ওয়াজিব।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا
(পিতা-মাতা) যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়ে শরীক স্থির করতে ‘জিহাদ’ করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। (সূরা লোকমান, আয়াতঃ ১৫)
এখানে বলা হচ্ছে কাফের মাতাপিতা যদি তোমাদের শিরক করার জন্য চূড়ান্ত চাপ প্রয়োগ করে তাদের কথা শোন না। এখানে কাফেরের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগকে জিহাদ শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এখন কি বলা হবে যে এ কাফের মাতা পিতা দ্বারা জিহাদ হয়েছে? তারা মুজাহিদ? জিহাদের ফযিলত তারা পাবে? এর দ্বারা দ্বীন বিজয়ী হবে?
ইহুদিদের স্বভাব পারিভাষিক অর্থ ও শাব্দিক অর্থের ব্যবধান না মানা । যেমনঃ ابناء শব্দটি পারিভাষিক ভাবে ‘প্রিয়’ এর অর্থ বহন করে, ইহুদি-খ্রিস্টানরা এটাকে শাব্দিক অর্থ গ্রহন করে, তারা বলে যে আমরা আল্লাহ্*র সন্তান। নাউজুবিল্লাহ! কি জঘন্য কাজ।
তারা পরিভাষাকে গুলিয়ে ফেলার কারনে تحريف করার কারণে শিরক পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। যারা বসে বসে কলমের খোঁচায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রক্ত ঝরা দান্দান শহীদ হওয়া জিহাদকে গুরুত্বহীন করে দিচ্ছেন, তাদের রাসুলের বিরোধিতার কারণে কোন ফিতনায় পড়ে যাওয়া অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাবে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে ভয় করা উচিত। হামযা (রাঃ) টুকরো টুকরো হয়েছেন যে জিহাদে, সাহাবায়ে কেরামের শতকরা আশি ভাগ যে জিহাদে শহীদ হয়েছেন, কোরআনের সাড়ে চারশত এর অধিক আয়াতের মধ্যে যে জিহাদের আলোচনা করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতাশটির উপরে জিহাদি অভিযানে সৈন্য পরিচালনা করেছেন, অর্ধ শতকের উপরে জিহাদে সাহাবায়ে কেরামকে পাঠালেন – সে জিহাদ কারো কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে!! আবার কারো নিকট এটা জঙ্গিবাদ!! নাউজুবিল্লাহ!
সার কথাঃ জিহাদ অর্থ কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ, জিহাদকে অস্বীকারকারী কাফির, অপব্যখ্যাকারী গুমরাহ, পরিত্যাগকারী ফাসেক। (ছরখছী)।
কিতালের মাধ্যমেই দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবে, ফিতনাহ তথা শিরক, শিরকের প্রভাব প্রতিপত্তি খতম হবে।
হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ কলম-সৈনিক তৈরী হয়ে গেলেও দ্বীন বিজয়ী হবে না, যতক্ষণ না দ্বীন বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ যে পথ দেখিয়েছেন সে পথ গ্রহন করা হবে। সে পথ কি? আল্লাহ পাকের স্পষ্ট ঘোষণাঃ
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلّه فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
আর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাক যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়; এবং আল্লাহর সমস্ত হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করেন। (সূরা আনফালঃ ৩৯)
ফিতনাহ শেষ হওয়া আর পরিপূর্ণ দ্বীন প্রতিষ্ঠা হওয়া নির্ভর করে কিতালের উপর। কিতাল কঠিন, অপছন্দনীয়, কষ্টকর। বিজ্ঞ হাকিম কি আমাদেরকে এমন কষ্টের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন আরও সহজে অসুখ নিরাময় হবার পথ বাদ দিয়ে? অথচ তিনি আরহামুর রাহিমীন। তাহলে এবার চিন্তা করুনঃ ফিতনা দূরীভূত হবার, দ্বীন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আর কোন সহজ পদ্ধতি থাকতে পারে কি?
আমাদের ইয়াকিন হলো – না, আর নেই। থাকলে সেটা দয়াময় আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়ে দিতেন।
কাফেরদের সম্পর্কে আল্লাহ্* রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
وَلاَ يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّىَ يَرُدُّوكُمْ عَن دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُواْ
বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদিগকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়। (সূরা বাকারাঃ ২১৭)
কাফেররা দ্বীন থেকে ফিরানোর জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহন করবে? – কিতাল।
এখন দ্বীন রক্ষায় কি করণীয়? কিতাল এর মুকাবেলায় কি রুমাল কিংবা কলম নিয়ে মুখোমুখি হওয়া? নাকি শত্রু যেভাবে আসবে তেমন ধরনের হাতিয়ার নিয়ে যাওয়া? হ্যাঁ, শত্রু কলমের আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আক্রমণ, অর্থনৈতিক হামলা সব প্রয়োগ করছে কিন্তু এগুলো সবই সামরিক শক্তির অধীন। সামরিক বিজয় যার থাকবে এসব শক্তি তার পক্ষেই কাজ করবে। আজ কুফফারদের সামরিক বিজয় বিদ্যমান বিধায় এসব ক্ষেত্রে সমগ্র পৃথিবী তাদের অনুসারী।
মানুষ তার রাজন্যবর্গের মতাদর্শ গ্রহণ করে থাকে। সুরায়ে নাসর এর বক্তব্যও এর সমর্থন করে। নতুবা পশ্চিমাদের সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা কি ইসলামের চেয়ে উন্নত যে কারণে মুসলমানরা পর্যন্ত তাদের আদর্শগুলো গ্রহণ করছে? এটা তাদের সামরিক বিজয়ের প্রভাব। নতুবা লেখনীর / বক্তব্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের নিকট রয়েছে কিতাবুল্লাহ এর মতো মুজিযা। এর চেয়ে বড় লেখা / বক্তব্য পৃথিবীর সমুদয় লেখক-বক্তা কিয়ামত পর্যন্ত লিখে, বক্তৃতা দিয়ে এর ধারে কাছেও কি পৌঁছাতে পারবে? বাস্তবে লিখার ক্ষেত্রে আমাদের বিজয় বিদ্যমান।
এতদসত্বেও কোরআনের আদর্শ, বিধিবিধান, হুকুম-আহকাম কেন স্বয়ং মুসলিমরাই গ্রহণ করছে না? আপনি কোরআনের চেয়ে বেশি লিখে ফেলবেন? আরও উন্নত বক্তব্য দিয়ে ফেলবেন? পারবেন না। কিন্তু কোরআন মানা হচ্ছেনা কেন? সমাজে নামাজ নেই কেন, জাকাত নেই কেন, বরং সমাজে সুদ বিস্তৃত হচ্ছে কেন?
নামাজ ফরজ এটা মানুষ জানে না এ কারণে, নাকি এর দাওয়াত পৌঁছে নাই একারণে? নাকি রাফে ইয়াদাইনের ঝগড়ার নিস্পত্তি না হওয়ার কারনে? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেনঃ
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ
তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ দান করলে তারা নামায কায়েম করবে,যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। (সূরা হজ্জ্ব, আয়াতঃ ৪১)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইকামতে ছালাত হবে ক্ষমতা লাভ হলে। আল্লাহ বলছেন, মুমিনরা যদি ক্ষমতা পায় তখন ছালাতের প্রচলন করে আর আমাদের কেউ কেউ বলছে ‘এর জন্য ক্ষমতার প্রয়োজন নাই’। নাউজুবিল্লাহ!
ক্ষমতা আসলে কিভাবে কিতাব প্রতিষ্ঠিত হবে? আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী। (সূরা হাদীদ, আয়াতঃ ২৫)
দ্বীনের সাহায্য করার উপায় হলোঃ লোহা-অসি-অস্ত্র দিয়ে। মসিহ আলাইহিস সালাম দাজ্জালকে দমন করবেন অসি হাতে নিয়েই।
আল্লাহ পাক নিজে কিতাল করেছেন। নবী অলিদের, ফিরিশতাদের দিয়ে কিতাল করিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ মিশনেই ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কে এ পথেই রেখে গেছেন।
সাহাবায়ে কিরাম এ পথেই অর্থাৎ অস্ত্র-সরঞ্জাম সহ পৃথিবীর দিকে দিকে এগিয়ে গেছেন। বিজয় এনেছেন। উম্মতের একটি জামাতের কিতালের মাধ্যমে এ বসুন্ধরা ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়েছে। কুফর অপসারিত হয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা সে পথ ছেড়ে আরামের পথ ধরে, এখন নানাবিধ ব্যারামে ভুগছি। যতক্ষণ সে পথ ফের না ধরবো, সেই ব্যারাম সারবে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
إذا تبايعتم بالعينة، ورضيتم بالزرع، وتبعتم أذناب البقر، سلط الله عليكم ذُلاً لا ينزعه عنكم حتى ترجعوا إلى دينكم
যখন তোমরা ঈনা (সন্দেহযুক্ত) কেনাকাটা শুরু করবে, গরুর লেজ ধরবে, ফসল ফলানো নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে, আর জিহাদ ছেড়ে দিবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর অপমান চাপিয়ে দেবেন তা সরাবেন না যতক্ষণ তোমরা দ্বীনের দিকে ফিরে না আসবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস সহীহ)
এখানে দ্বীনের দিকে ফেরত আসা বলতে হাদিসের ইমামগণ জিহাদ বুঝেছেন।
সুতরাং, অসিযুদ্ধ এখনই নয়, এখন মসি যুদ্ধের সময় – এসব কথা নফসের খায়েশাত ছাড়া আর কিছু নয়। এসব কথার পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ নেই।
অনুরুপভাবে, ‘তাওহীদ বিরোধী আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনই হলো সবচেয়ে বড় জিহাদ’ – আক্বীদা ও আমলের সংশোধনকে জিহাদ বলা হয়েছে, এমন কোন দলীল আমরা ইসলামে পাই না। হাদিস কিংবা ফিকহের কোন ইমামও এ রকম কোন কথা বলেন নি। যদি আক্বীদার সংশোধন জিহাদ হয়, তবে দাওয়াহ ইলাল্লাহ কি? তবে তালিম-তারবিয়া কি? আমরে বিল মারুফ-নাহি আনিল মুনকার কি?
তাই আমাদেরকে সর্বদা যথাযথ শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
অনুরুপভাবে, ‘তবে জিহাদের পদ্ধতি পরিবর্তনশীল। অসিযুদ্ধ এখনই নয়। মসীযুদ্ধ অসির চাইতে মারাত্বক’ – এই কথার পক্ষেও কোন দলীল-প্রমাণ নেই। এটা ইসলামের কোন কথা নয়। বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
ألا إن القوة الرمي، ألا إن القوة الرمي، ألا إن القوة الرمي
নিশ্চয়ই নিক্ষেপের মধ্যে আছে শক্তি, নিশ্চয়ই নিক্ষেপের মধ্যে আছে শক্তি, নিশ্চয়ই নিক্ষেপের মধ্যে আছে শক্তি। (সহীহ মুসলিম, সুনান আবু দাউদ, সুনান ইবনে মাজাহ, সুনান তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ)
দেখা যাচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিক্ষেপের তথা তীর, অসি, বন্দুক ইত্যাদির মধ্যে আছে শক্তি। কিন্তু এরকম সুস্পষ্ট হাদিস থাকার পরও কিভাবে আমরা ‘মসীযুদ্ধ অসির চাইতে মারাত্বক’ – এই ধরনের কথা বলতে পারি। বরং আল্লাহ আমাদেরকে জিহাদের প্রস্তুতির জন্য ঘোড়া ও শক্তি সঞ্চয় করতে বলেছেন।
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ
“আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সামর্থ অনুযায়ী সংগ্রহ করো শক্তি-সামর্থ্য ও পালিত ঘোড়া …”(সূরা আল আনফাল, আয়াতঃ ৬০)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জিহাদের জন্য মুসলমানদেরকে বড় বড় লেখক, সাংবাদিক হতে বলেন নি। কলমের ব্যবহারকে বেশী শক্তিশালী বলেন নি। বরং শক্তি ও ঘোড়া জোগাড় করতে বলেছেন। সুতরাং ডঃ আসাদুল্লাহ গালিব সাহেবের জিহাদ সম্পর্কে এই ধারনাগুলো আল-কোরআন ও হাদিসের পরিপন্থী।
আমরা কলমের গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না, মিডিয়ার গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না, মানুষের মন-মানষিকতা পরিবর্তনে লেখনীর গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু শরীয়াতে প্রত্যেক বিষয়ের একটা নির্দিষ্ট স্থান আছে। সেটাকে তার চাইতে বেশী আগে বাড়িয়ে দিলে, সমস্যা দেখা দেয়। বরং প্রত্যেকটা বিষয়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন, ততটুকু দেয়াই উচিত।
বরং আল্লাহ বলছেন, কাফিররা চায়, আমরা যেন আমাদের অস্ত্র সম্পর্কে বেখবর হয়ে যাই, আর শুধু মসী-কলম ইত্যাদি নিয়ে পড়ে থাকি, যাতে তারা আমাদের উপর সহজে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলিম উম্মাহ এখন এই অবস্থার সম্মুখীন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেনঃ
وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً
কাফেররা চায় তোমরা তোমাদের অস্ত্র-শস্ত্র এবং সরঞ্জামাদি থেকে গাফিল হও যাতে তারা তোমাদেরকে একযোগে আক্রমন করতে পারে। (সূরা আন নিসা, আয়াতঃ ১০২)
পঞ্চমতঃ এই সাইটে এক মন্তব্যকারী মন্তব্য করেছেন, “এটি আসাদুল্লাহ আল গালিব এর একটি ইজতিহাদ”। এই ব্যাপারে আমাদের কথা হলোঃ ইজতিহাদ হয় আল-কোরআন ও হাদিসের আলোকে একটি নতুন সমস্যার সমাধান দেবার সময়। কিন্তু ‘আল-জিহাদের অর্থ কিংবা সংজ্ঞা’ তো আজ চৌদ্দশত বছর পর নতুনভাবে দেয়া হচ্ছে না, কিংবা এটা নতুন কোন বিষয়ও নয় যে এর উপর কেউ এখন ইজতিহাদ করবে। বরং যুগে যুগে আলিমরা এই ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে কথা বলে গেছেন। তাই জিহাদ কাকে বলে, এর অর্থ কি – এসব ব্যাপারে কোন ইজতিহাদের স্থান নেই। তাই মন্তব্যকারীর এই মন্তব্য গ্রহনযোগ্য নয়।
আর কলমের মাধ্যমে জিহাদের ব্যাপারটা ইমাম কাসানী (রঃ) এর সংজ্ঞায় এসে গেছে। তিনি বলেছেনঃ“শরীয়াতের পরিভাষায় (জিহাদ হলো) নিজের জীবন, সম্পদ, মুখ ও অন্যান্য যা কিছু দিয়ে সম্ভব তার মাধ্যমে আল্লাহর পথে লড়াই করার জন্য শক্তি ও ক্ষমতা উৎসর্গ করা”। তাই মুখ, কলম ইত্যাদি দিয়ে জিহাদে শরীক হওয়া যাবে তবে সেটা হতে হবে কিতাল ফি সাবিলিল্লাহর (সম্মুখ যুদ্ধের) সমর্থনে। কিন্তু ক্বিতালের সাথে সম্পর্কহীন কলমের মাধ্যমে দ্বীনের খেদমত দাওয়াহ, তারবীয়া-তাসফিয়া, আমরে বিল মারুফ-নাহি আনিল মুনকারের অংশ হতে পারে কিন্তু জিহাদের অংশ হবে না।
পরিশেষে আমরা বলতে চাইঃ ডঃ আসাদুলাহ গালিব সাহেবের উপরুক্ত কথাগুলো যথার্থ নয়, এসব কথার পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। বরং এই কথাগুলো সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদিসের বিরোধী। এগুলো তার একান্ত নিজস্ব কিছু মত যার পক্ষে আল-কোরআন, হাদিস কিংবা সলফে সালেহীনদের কোন বক্তব্য নেই।
উল্লেখ্য, এই বইসমূহে আরো কিছু বিষয় ছিলো যা আমাদের দৃষ্টিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অগ্রণযোগ্য মনে হয়েছে, কিন্তু আমরা শুধুমাত্র এই প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নিয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামী শরীয়াতের আলোকে জিহাদকে বুঝার ও জিহাদে সামিল হবার তৌফিক দান করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ
যে ব্যক্তি নিজে গাযওয়াতে (যুদ্ধের জন্য বের হওয়া) যায়নি কিংবা গাযওয়াতে যাবার ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে নিফাকের একটি শাখার উপর মৃত্যু বরণ করলো। (সহীহ মুসলিম)
আল্লাম সিন্দী (রঃ) সুনান নাসায়ীর হাশিয়াতে বলেন, ‘এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, সে জিহাদের যাবার নিয়্যত করে নি। আর জিহাদে যাবার নিয়্যত থাকার প্রমাণ হলোঃ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَوْ أَرَادُواْ الْخُرُوجَ لأَعَدُّواْ لَهُ عُدَّةً
আর যদি তারা বের হবার সংকল্প নিত, তবে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম প্রস্তুত করতো। (সূরা আত তাওবা, আয়াতঃ ৪৬)’
আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে নিফাকের শাখায় মৃত্যু হতে হিফাজত করেন।
Comment